১
রাত্রি উঁকি দিয়ে একবার দরোজার গলিতে তাকালো । কেউ নেই । দরোজা আধখোলা । সেখান থেকে ডাইনিং-এর গোল কাঁচের খাবার টেবিলটার একাংশ দেখা যাচ্ছে । একবার ভাবলো উঠে গিয়ে কাউকে ডাকবে কি না । ইচ্ছেটা কেমন মরে গেল । অচেনা একটা বাসা, অচেনা ঘর । কাউকে সেভাবে চেনে না সে । সম্বোধনেরও তো একটা মাপ থাকা চাই । কাকে কি বলে ডাকবে ? আবার অচেনা একটা পুরুষ মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত ঘরে, তার নিজস্ব বিছানায় পুতুল পুতুল ভঙ্গিতে বসে থাকাটাও অনভিপ্রেত । নিঃসঙ্গ পুরুষ মানুষের ঘরের আলাদা এক ধরণের গন্ধ থাকে, আলাদা বৈদগ্ধ সহজেই টের পাওয়া যায় । রাত্রি পাচ্ছে । স্পষ্টতই টের পাচ্ছে । তবু সে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে । নতুন উপন্যাসের প্রথম কয়েক পাতা যেমন করে পড়া হয়, সেভাবে একটা নতুন পৃথিবীতে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা ।
রাত্রির উচিত ভয়-ভয় করা । শংকায় সারা শরীর ঘেমে নেয়ে যাওয়া, মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠা, ঘন ঘন পানির তৃষ্ণা পাওয়া । অথচ এর কোনটাই তার হচ্ছে না । হয়ত তার মস্তিষ্ক ব্যাপারটাকে আর দশটা-পাঁচটা স্বাভাবিক দুশ্চিন্তার কাতারে ফেলে দিয়েছে । তার ক্লান্ত মস্তিষ্ক আর ভাবনার যন্ত্রণা নিতে চাইছে না হয়তো । রাত্রির শীত লাগছে । সে এসির বাতাস বেশীক্ষণ সহ্য করতে পারে না । ঘরে এসি চলছে । তীব্র মাত্রায়ই চলছে । এই ঠান্ডা ঘরটাতে সে দুঘন্টার মত একা একা বসে আছে । এখন নিজের কাছে সমস্ত শরীরটাকে মনে হচ্ছে মৃত মানুষের মত ঠান্ডা । সে ঘরটাতে চোখ বোলালো । আশেপাশে লেপ নেই । পাতলা চাদরও নেই । থাকার কথা না যদিও । এখন ভাদ্র মাস । উষ্ণ সব রাত্রির নিরন্তর নিয়মিত আসা যাওয়ার কাল । রাত্রির চৈত্র মাসের গরমেও ফ্যান ছেড়ে দিয়ে গায়ে কাথা জড়িয়ে রেখে ঘুমুতে হয় । ঘুমোনোর সময় সবসময় এক ধরণের ইনসিকিওর অনুভূতি কাজ করে । এই বুঝি কেউ ঘরে ঢুকলো, ওড়নাটা বোধহয় সরে গেছে কিংবা কামিজটা কোথাও উঠে গেছে কি না । আচ্ছা, ছেলেদের কি এ ধরণের বিশ্রী কোন অনুভূতি আছে ? মনে হয় না । একটা ছেলে কখনোই মেয়ে হয়ে জন্মানোর যন্ত্রণাগুলো উপলব্ধি করতে পারে না । সেই টেনশনগুলি ধরতে পারার সুযোগও তার নেই ।
মহসিনের কথাই ধরা যাক । মহসিনের সাথে বিয়ের ছ’মাসও তখন পার হয় নি । শোবার ঘরে রাত্রি এলোমেলো ভঙ্গিতে পাশ ফিরে শুয়ে ছিল । দুপুর দুপুর সময়ে কলিংবেল বাজল । মহসিন উঠে গেল দরোজা খুলতে । তার দুজন বন্ধু এসেছিল । মহসিন চাইলেই ওদের নিয়ে ড্রইং রুমে বসতে পারতো । রাত্রি অবাক হয়ে খেয়াল করলো, সেটা না করে সে তার বন্ধু দুজনকে নিয়ে হুট করে শোবার ঘরে চলে এল । ব্যাপারটা এতোটাই আকস্মিক ছিল যে রাত্রি বোজা চোখ খুলে দেখবারও সুযোগ পেল না, নিঃশ্বাস বন্ধ করে শক্ত হয়ে পড়ে রইলো । এত রাগ, এত জিদ হচ্ছিল ! মহসিনের বন্ধুরাও ঘরে ঢুকে বিব্রত হয়ে পড়ল । তাদের মধ্যে একজন ইতস্ততঃ ভঙ্গিতে চাপা গলায় বলল, ‘ভাবী এখানে ঘুমুচ্ছে । আমরা বরং সামনে গিয়ে বসি ।’ মহসিন নির্বিকার ভঙ্গীতে বলল, ‘আরে ! ওর কথা বাদ দে । এখানে বোমা ফাটলেও ওর ঘুম ভাঙবে না । হাহাহা । ফিল ফ্রি ।’
মহসিনের সাথে প্রেমের সময়টাতে তাকে একদমই এরকম মনে হয় নি । খুবই রেসপন্সিবল এবং গোছানো স্বভাবের মানুষ বলে মনে হত । খেয়ালী আর উদাসীন ছিল না । খুব গুছিয়ে কাজ করতো । গুছিয়ে কথা বলতো । প্রথমবার মহসিনের সাথে তার দেখা হয়েছিল নোভাদের বাড়িতে । মহসিন ড্রইং রুমের সোফায় বসে টিভি দেখতে দেখতে চা খাচ্ছিল । ডান হাতে চায়ের কাপ, বা হাতে টিভির রিমোট আর জ্বলন্ত সিগারেট একসাথে ধরে রাখা । রাত্রি ঘরে ঢুকতেই মহসিনের সাথে চোখাচোখি হল । সিগারেটসমেত রিমোটটা দুম করে তার হাত থেকে মখমলের কার্পেটে পড়ে গেল । সেটা তুলতে গিয়ে বা হাতের কাপ থেকে চা ছলকে পড়ল । সেই চায়ে তার গায়ের ধবধবে সিল্কের পাঞ্জাবীটা মাখামাখি হয়ে গেল । রাত্রির খুব সিরিয়াস সময়ে হেসে ফেলার বদ অভ্যাস আছে । অনেক চেষ্টা করেও সে হাসি আটকাতে পারল না । মহসিন তাতে আরও বিব্রত হল । তারপর সামলে নিয়ে বলল, ‘তুমি কি নোভার বন্ধু ?’
‘জ্বী ।’
জ্বী বলে রাত্রি আবার শব্দ করে হেসে ফেলল । তখন মহসিন হঠাৎ করে খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, ‘রাত্রি ! তোমার সাথে আমার খুব জরুরী কিছু কথা আছে । তুমি কি আমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিতে পারো ?’
রাত্রি ‘না’ বলবে করেও হুট করে হ্যাঁ-বোধক ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে ফেলল । মহসিন হড়বড় করে বলল, ‘বোসো । আমি যা বলছি প্লিজ মন দিয়ে শোনো । কথা শেষ করার আগে ইন্টারাপ্ট করবে না । মহাভারতে আছে, ব্রহ্মা অর্থ্যাৎ ঈশ্বর একবার বিশ্বকর্মাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন পৃথিবীর প্রত্যেকটি সুন্দর উপাদান থেকে তিল পরিমাণ অংশ নিয়ে একজন অপূর্ব রূপবতী নারীকে সৃষ্টি করার জন্যে । অপরিমেয় সৌন্দর্যের আধার থেকে তিল তিল উত্তম অংশ নিয়ে তার শরীর নির্মিত হওয়ায় রূপসীর নাম দেয়া হয় তিলোত্তমা । তিলোত্তমা প্রাণ পাওয়ার পর ব্রহ্মার চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেবলোক দেখতে লাগল । ঘুরতে ঘুরতে তিলোত্তমা যেদিকে যায়, ব্রহ্মা সেদিকেই তাকান । চোখ ফেরাতে পারেন না । হিন্দুমতে, ব্রহ্মার তিন দিকে তিনটি মুখ । তিলোত্তমা চতুর্থ দিকে যেতেই ব্রহ্মার চতুর্থতম মুখের সৃষ্টি হয় । শুধু তাই নয়, তাকে একবার দেখেই দেবরাজ ইন্দ্র তার প্রেমে পড়ে যান । তিলোত্তমাকে নিখুঁতভাবে দেখার লোভে ইন্দ্রের সহস্র নয়নের উদ্ভব হয় ।...’
রাত্রি রূঢ় ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনার কি মনে হচ্ছে আমি তিলোত্তমা আর আপনি দেবরাজ ইন্দ্র ?’
‘উহুঁ । আমি এমনিতেই সুদর্শন নই । নিজেকে ইন্দ্র ভাববার প্রশ্নই আসে না । আচ্ছা, তুমি কি এমন কোন প্রানীর নাম জানো যার সহস্র চোখ আছে ?’
‘রূপকথার কোন প্রাণীর কথা বলছেন ?’
‘না । এই পৃথিবীরই । খুবই পরিচিত প্রাণী । বাংলাদেশের শতকরা অলমোস্ট আশিভাগ স্থলে এই প্রাণী বিরাজমান ।’
‘এরকম কোন প্রাণী আছে সেটাই জানতাম না ।’
‘জানো । কারন প্রাণীটি হচ্ছে তেলাপোকা । এই পোকাটির প্রায় দুসহস্র চোখ আছে । এগুলি যদিও আমাদের চোখের মত না । কম্পাউন্ড চোখের এক একটা ইউনিট । বায়োলোজিস্টরা বলেন ওমাটিডিয়া । ওমাটিডিয়াগুলির সাহায্যে এরা রাতের বেলায় অন্ধকারেও চমৎকার দেখতে পায় । কিন্তু এরা যেহেতু দেবতা না, এদের এই অলৌকিক শক্তির কিছু সাইডএফেক্ট আছে । হঠাৎ কোন ধরণের উজ্জ্বল আলো পড়লে এদের চোখ ধাঁধিয়ে যায় । সহস্র চোখে এরা একটি বস্তুকেই সহস্র জায়গায় দেখতে পায় । তখন ভয় পেয়ে একই জায়গাকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে ।’
‘আমার মনে হচ্ছে স্কুলজীবনে ফিরে গেছি । বায়োলোজির জ্ঞানগর্ভ লেকচার শুনছি কিন্তু সারাংশ ধরতে পারছি না ।’
‘তুমি কিন্তু ইন্টারাপ্ট করছো । আমার কথা আগে শেষ করতে দাও । নিজেকে আমার মাঝেমধ্যে ফ্রানৎজ কাফকার পোকার মত মনে হয় । ‘দ্য গ্রেট গ্রেগর সামসা’ । এখন তিলোত্তমার মত রূপবতী নারীর পাশে নিজেকে তারচেও ক্ষুদ্র লাগছে । লাগছে তেলাপোকার মত যার ওপর দুসহস্র চোখ এসে ভর করেছে । তোমার উজ্জ্বল আলো থেকে চোখ সরাতে পারছি না । তোমাকে ঐ সময় হুট করে দেখে আমার সহস্র চোখে আগুন ধরে গিয়েছিল । তাই আনএভয়েডেবল একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে ।’
‘এখন কি আগুন নিভেছে ? নাকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা অনির্বাণ ? অজর-অমর-অক্ষয় !’
‘বোধহয় ওরকমই কিছু একটা হবে । দ্যাখো, জ্বলন্ত সিগারেটে নোভাদের ত্রিশ হাজার টাকা দামের দামী কার্পেট পুড়ে যাচ্ছে । আমি ওঠাতে ভুলে গেছি । হড়বড় করে কথা বলে চলেছি ।’, মহসিন হঠাৎ থমকে গিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, আমি কি উল্টোপালটা কথা বলছি ? আসলে আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, বোঝাতেও পারি না । আমার জায়গায় রবীন্দ্রনাথ থাকলে এক বাক্যে বুঝিয়ে ফেলতেন ।’
‘আপনার এত কথা এক বাক্যে বোঝানো বোধহয় তাঁর পক্ষেও সম্ভব হত না ।’
‘হত । তার পক্ষে সম্ভব হত । তিনি ‘বধূ, কোন্ আলো লাগলো চোখে ?’-এই জাতীয় কিছু একটা বলতেন ।’
প্রথম পরিচয়ে এ ধরণের কথোপকথনে যে কোন মেয়ে অভিভূত এবং মুগ্ধ হয়ে যাবে । রাত্রিও হয়েছিল । পরিচয়ের ঠিক তিনদিন পরে ছিল রাত্রির জন্মদিন । মহসিন সেদিন কোত্থেকে হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে দেয়াল সমান একটা পেইন্টিং রাত্রিকে উপহার দিয়ে দ্রুত চলে গেল, যেন মহাব্যস্ত । ব্রাউন পেপারে মোড়া পেইন্টিংটা খুলে রাত্রি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । নিজেকে আয়নায় এতক্ষণ মুগ্ধ চোখে কখনও দেখেছে কিনা তা সে জানে না । এক দেখায় রাত্রিকে এত চমৎকার করে কেউ আঁকতে পারবে, তাও সে ভাবতে পারে নি ।
এরপর যতবারই মহসিনের সাথে দেখা হয়েছে, কিছু না কিছুতে রাত্রিকে অবাক হতে হয়েছে । তার শৈল্পিক জীবন, তার শিল্প, তার অদ্ভুত জীবনাচরণ –সবটাই রাত্রিকে মুগ্ধ করেছে । কিন্তু মুগ্ধতা বেশীদিন স্থায়ী হয় নি । বিয়ের পরে যত দিন গড়িয়েছে, রাত্রির কাছে মহসিন তত অচেনা হয়ে উঠেছে । মাত্র আট মাস স্থায়ী হয়েছিল তাদের সংসার । শেষদিকে একসময় মহসিনের হাতের স্পর্শগুলিও রাত্রির কাছে অপরিচিত লাগতে শুরু করেছিল । রাতে, গভীর অন্ধকারে তার হাত রাত্রির গায়ের ওপর নেমে এলে মনে হত অন্য কেউ তার শরীরে হাত দিচ্ছে । গা ঘিনঘিনে একটা ব্যাপার ।
রাত্রি বিছানা থেকে নামল । ভারী শাড়ি আর গা-ভর্তি গয়নায় নিজেকে বর্মধারী যোদ্ধার মত মনে হচ্ছে । যেন এখনই কলোসিয়ামে তুমুল করতালি পড়বে, তাকে বের হতে হবে হাইপোজিয়াম থেকে । যুদ্ধের মতই তো ব্যাপারটা । এমন এক যুদ্ধ যেখানে শুরুতেই নিঃশর্ত পরাজয় মেনে নেয়া হয়েছে । দ্বিতীয়বার কখনও ‘নতুন বৌ’ চরিত্রে এমন যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হতে হবে, একথা স্বপ্নেও ভাবা হয় নি । একটা স্বাভাবিক বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের মত করেই সে তার সাংসারিক জীবন নিয়ে ভেবেছে । স্বপ্ন দেখেছে । অথচ আজ দ্বিতীয় কোন পুরুষের সামনে তাকে ‘স্ত্রী’ হয়ে উঠতে হবে । হয়তো সেই মানুষটি এমন বাসরে কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাইবে না । লোভী লোভী দৃষ্টিতে তার শরীরের দিকে তাকিয়ে কুৎসিত ইঙ্গিত করতে থাকবে । রাত্রির কিছুই করার থাকবে না । বারবণিতার মত শাড়ি খুলে নিজেকে সঁপে দিতে হবে । লোকটি যেমন করে চাইবে ঠিক তেমনি করে । ‘বারবণিতার মত’ উপমাটা ঠিক যথার্থ হল না । বিছানায় ওদেরও ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য থাকে । তার সেটাও থাকবে না । কি উপমা দেয়া যায় ? ‘একটা পোকার মত’ উপমাটা কি মন্দ হবে ? ফ্রানৎজ কাফকার পোকা নয় নিশ্চয়ই । তারচেও দুর্ভাগা কেউ ।
রাত্রি ঘরের কোথাও এসির রিমোট খুঁজে পেল না । সে বিছানার চাদরের ওপর ছড়ানো ফুলের পাপড়িগুলি বেডসাইড টেবিলটার ওপর জড়ো করে রাখলো । তারপর বিছানার চাদরের নিচে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল । গোলাপের পাপড়িগুলি দিয়ে একটা হার্টের শেপ করে রাখা ছিল বিছানার ওপর । এটা কে করেছে ? ঐ মানুষটির কোন আত্মীয়া কি ? বাসর সাজানোটা নির্দিষ্ট লিঙ্গের কোন মানুষের কাজ না । কিন্তু রাত্রির মনে হল কোন অল্পবয়স্কা মেয়ে সম্ভবতঃ কাজটা করেছে । রাত্রি যতটুকু জানে, মানুষটি নিতান্তই একা- বাবা-মা নেই, স্ত্রীও মৃত । বিপত্নীক হয়েছেন দশ বছরের মত । দশ বছর যে মানুষটি বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে স্থির থেকেছে, হঠাৎ সেখান থেকে সরে আসার কি এমন কারন থাকতে পারে ? রাত্রির ছোটমামী, যিনি এই বিয়ের বন্দোবস্ত করেছেন, তার কথা অনুযায়ী রাত্রিকে দেখে এই ভদ্রলোকের ভাল লেগেছে । যদিও রাত্রির সাথে তার কখনও কোন ধরণের কথাবার্তা হয় নি । আয়োজন করে ‘কনে দেখা’ ধরণের কোন সাক্ষাতও হয় নি । লোকটা তাকে কোন একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখে পছন্দ করেছেন । পেশায় সে ডাক্তার, সুদর্শন, দ্বিতীয় বিয়ের পাত্র হিসেবে বড় ধরণের কোন দুর্বলতা নেই । রাত্রি কোন ধরণের না বলার সুযোগ পায় নি । পাওয়ার কথা না । বিয়ে ভাঙার পরে বড় মামার বাড়িতে দুবছর আশ্রিতা থাকা সহজ ব্যাপার না । এই দুবছর তার কিভাবে কেটেছে ? পরাজিত একটা মানুষের মত । অনেক চেষ্টা করেও সে একটা চাকরী জোগাড় করতে পারে নি । অন্যের ঘাড় থেকে নেমে যাওয়ার আর কি কোনও পথ তার সামনে ছিল ?
রাত্রির ইচ্ছে করছে লেপ মুড়ি দিয়ে দীর্ঘ ঘুম দিতে । অথচ এখন ভাদ্রের উষ্ণ রাত্রি । নিশ্চিতভাবেই শহরের মানুষগুলির অধিকাংশের আকাংখা একটু ঠান্ডা হাওয়া । আর সে কি না আরও উষ্ণতা চাইছে ! অদ্ভুত ব্যাপার, মহসিনের সাথেও তার বিয়ে হয়েছিল এমন ভাদ্র মাসে । পালিয়ে বিয়ে করা টাইপ বিয়ে, তাড়াহুড়ো করে রেজিস্ট্রি অফিসের খাতায় নাম সাক্ষর করা । ভাদ্র মাসে নাকি বিয়ে হয় না । রাত্রির স্কুলজীবনে মঞ্জুষা নাম করে এক কুৎসিতদর্শন টিচার ছিলেন যার কথা বলার ধরণও ছিল বেশ নোংরা । অশ্লীল অশ্রাব্য কথাগুলিও তিনি এমন অবলীলায় বলতেন যে লজ্জায় চোখ নিচে নামিয়ে রাখতে হত । সবাই এমন ভাব ধরে ক্লাসে বসে থাকতো যেন কিছু শোনা যাচ্ছে না । যেন কিছুই হয় নি । সেই মঞ্জুষা আপা একবার ষড়ঋতু রচনার এক ফাঁকে তার চিরাচরিত অশ্লীল ভঙ্গিতে ভাদ্রমাস নিয়ে বিভিন্ন অদ্ভুত গল্প করা শুরু করলেন । বইয়ের দু-চার লাইনের ভাদ্র মাসকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মঞ্জুষা আপা রাস্তার কুকুরের উত্তেজনা থেকে শুরু করে রাতে বিছানায় তার নিজের স্বামীর অসভ্যতা কোন কিছুই বলতে বাধ রাখলেন না । ঘন্টা পড়ার আগ পর্যন্ত বেশ রসিয়ে মেয়েলী গল্প-টল্প করে শেষে বললেন, ‘বুঝেছো মেয়েরা, ভাদ্র মাসে প্রেম হয় না, বিয়েও হয় না । এই হল ভাদ্র মাস ।’
রাত্রি কখনোই কোন ধরণের কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেয়ার মেয়ে ছিল না । কিন্তু এখন মাঝেমধ্যেই মনে হয় সেই ভাদ্র মাসে দুমদাম বিয়ের সিদ্ধান্তটা না নেয়াই বোধহয় ভাল ছিল । হয়ত পরে আর বিয়েটা হতই না । দুমাসের প্রেমে মহসিন নিজেকে যেভাবে আড়াল করে রাখতে পেরেছিল, হয়ত আর কিছুদিন হলে সে মুখোশটা ভেঙে পড়ত । অন্য কোথাও বিয়ে হলেও কি তার বিয়ে ভেঙে যেত ? অনার্সে পড়াকালীন সময়ে নোভার দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল, তিনি এস্ট্রোলজি জানতেন । ভদ্রলোক বৃদ্ধ, রুগ্ন এবং যথেষ্ট কর্কশ । প্রথম পরিচয়েই রাত্রির হাত দেখে অকপটে বলেছিলেন, ‘আপনার স্বামীভাগ্য একেবারেই নেই । সংসার টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে ।’ নোভা খুব বিব্রত হয়েছিল । আমতা আমতা করে বলেছিল, ‘রাত্রি যে পরিমাণ সুন্দর, ওর রূপেই তো ওর স্বামী আটকে যাবে, ভাগ্য একটু খারাপ হলেও ওর কিছু আসে যায় না ।’
রূপের চেয়ে ভাগ্য বড় । কতটা বড় সেটা রাত্রি নিজের জীবন থেকে শিখেছে । রূপ নিয়ে একটা সময় তার খুব একটা অহংকার কাজ করত । এখন করে না । বয়সের সাথে সাথে রূপ ভাঙতে শুরু করেছে । একসময় মুখের ঔজ্জ্বল্য আরও কমে যাবে, গালে ভাঁজ পড়তে শুরু করবে । ভাঁজ গোলাপের পাপড়িতেই সুন্দর, নারীর মুখে নয় । আচ্ছা, মহসিনের কাছে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কি ? স্থির কিছু নয় নিশ্চয়ই- এলজেব্রার চলকের মত পরিবর্তনীয় । রাত্রিকে সে অপূর্ব বলেছে । রাত্রিকে সে কুৎসিত বলে ডেকেছে । তার পেইন্টিং এর মূল চরিত্র ছিল রাত্রি । তার পেইন্টিং এর বড় বাধা ছিল রাত্রি । রাত্রিকে দেখে দেখে সে রাত্রির পর রাত্রি পার করে দিতে পারত । রাত্রির দিকে ফিরে তাকাবার যথেষ্ট সময় তার ছিল না । শিল্পীদের চোখ এমন অদ্ভুত কেন হয় ? বড় সহজেই মনোটোনাস হয়ে পড়ে । মহসিন কি আবার বিয়ে করেছে ? সুখে আছে অনেক ? কি করছে এখন ? রাত্রি চাদর থেকে মুখ বের করে ঘড়ির দিকে তাকালো । রাত দশটা বাজতে চলেছে । রাত্রি তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে । চোখে বড্ড আলো লাগছে । বাসায় থাকলে খাটে শুয়েই হাত বাড়িয়ে বাতি নিভিয়ে দেয়া যেত । এখানে সেটা সম্ভব না । সুইচবোর্ডের কাছে যেতে হলে বিছানা ছেড়ে নামতে হবে । রাত্রির পক্ষে সেটা সম্ভব না । বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না । লোকটা তাকে ‘কিছুক্ষণ’-এর কথা বলে কোথায় চলে গেল ?
দু-তিন বার টানা ডোরবেল বাজল । কেউ দরোজা খুলল না । রাত্রি কখন অঘোর ঘুমে ডুবে গেছে সে জানে না । রাত্রি যার জন্যে অপেক্ষা করে ছিল, সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পকেট থেকে চাবি বের করে দরোজা খুলল । ঘুমের ভেতর রাত্রি তখন খুব অদ্ভুত ধরণের একটা স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছে । স্বপ্নটাকে তার স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে না । মনে হচ্ছে খুব যেন বাস্তব । রাত্রির দুহাতে দুটি হালকা নীল রঙের পোকা বসে আছে । দুটি পোকাই দৈত্যাকার, গায়ে কালো কালো অসংখ্য ছোপ । একজনের হাতে ছোট্ট একটা ইউকেলেলে, সে মাঝে মাঝে তার বাদ্যযন্ত্রে টুং-টাং শব্দ করছে । অন্য জন রাত্রির ডান হাতের আঙুলগুলিকে কোন এক উপায়ে পিয়ানো বানিয়ে ফেলেছে । পিয়ানোবাদক পোকা চমৎকার গলায় গাইছেঃ
It’s Spring in my mind, But the Autumn leaves- they fall,
As I am walking by, I collect them all,
I’m walking blind upon this road in search of higher ground.
I’m walking blind upon this road in search of higher ground.
Don’t look back, Don’t look back, Don’t look back,
And don’t look down !
২
মহসিনের যখন ঘুম ভাঙল তখন রাত প্রায় দশটা । তার সমস্ত শরীর ঘেমে নেয়ে গেছে । সে আবার সেই দুঃস্বপ্নটা দেখেছে । একই দুঃস্বপ্ন বারবার দেখে ভয় পাওয়ার কোন মানে হয় না । সে পাচ্ছে । মহসিন উঠে বসল । বালিশের পাশ থেকে সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিল । ধরাবে কি ধরাবে না এই নিয়ে টস করতে হবে । মানিব্যাগে কয়েন নেই । সে পাঁচশ টাকার একটা চকচকে নোট বের করল । বঙ্গবন্ধুর ছবি আসলে তার সম্মানে সিগারেট ধরানো হবে না । সে নোটটা ছুঁড়ে ফেলল । নোটটা দুবার পাক খেয়ে টাইলসের ফ্লোরে নিজের পাতলা পুরুত্বের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে পড়ল । খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার ! মহসিন সিগারেট ধরালো । কথা ছিল, বঙ্গবন্ধুর ছবি আসলে সিগারেট ধরানো হবে না । ছবি আসে নি । কাজেই নিশ্চিন্তে ধরানো যায় ।
মহসিন ভেজা শার্ট খুলতে যাবে তখন সেলফোন বাজতে শুরু করল । সেলফোনে চিং-পিং জাতীয় শব্দে গান বাজছে । এটা রোদসীর কাজ । সে আজকাল কোরিয়ান সিনেমা-টিনেমা দেখে, কোরিয়ান অদ্ভুত সব গান রিংটোন দিয়ে রাখে । ফোন তুলে মহসিন দেখল রোদসীই ফোন করেছে । সে সবুজ বাটন স্পর্শ করল ।
‘হ্যালো, রোদ ?’
‘কই তুমি ?’
‘বাসায় । কোথায় আর থাকব ?’
‘আজ না তোমার যাওয়ার কথা ?’
‘ও আচ্ছা । রোদ, আজ আমি কোথাও যাব না ।’
‘থাপড়ায়ে দাঁত ফালায়ে দিতে হয় তোমার । কাগজ পোড়ার শব্দ পাচ্ছি, ঘটনাটা কি ? তুমি কি সিগারেট খাচ্ছো নাকি ?’
‘মানুষ কাগজ পোড়ার গন্ধ পায়, শব্দ পাওয়ার কথা না ।’
‘আমি পাই । আমি আসতেছি । আজকে এক প্যাকেট সিগারেট ট্যাং এর সাথে গুলে তোমাকে খাইয়ে দেবো । দেখবো, কত খেতে পারো তুমি । বদ কোথাকার ।’
‘ট্যাং-এর সাথেই কেন ? রুহ-আফজার সাথে কেন না ?’
রোদসী হিউমার ধরতে পারল কি না তা জানা গেল না । তার আগেই লাইন কেটে গেল । মহসিন শার্ট খুলল । ওয়ার্ডরোব খুলে টাওয়েল বের করল । তারপর বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিল । অনেকক্ষণ ধরে ভিজলো । দাড়ি ফেলতে হবে । খোঁচা খোঁচা দাড়িতে তাকে ভাল দেখায় না । ‘ভাল দেখায় না’ বলাটাও বাড়িয়ে বলা হয় । যথাযথ শব্দটা হবেঃ বিশ্রী । আলস্যের কারনে শেভ করতে ইচ্ছে করছে না । ফোম মেখেও মহসিন পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেললো । সে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এসে দেখে রোদসী বিছানা ঝাড়ছে । সে হাসল । রোদসী সে হাসিকে পাত্তা দিল না । কঠিন গলায় বলল, ‘সিগারেটের প্যাকেট বারান্দা দিয়ে ফেলে দিয়েছি । কোন সাহসে আবার সিগারেট খাও তুমি ?’ মহসিন লক্ষ্য করল রোদসীর ঠান্ডা লেগেছে । গলা বসে গেছে । মহসিন এ নিয়ে কোন প্রশ্ন করল না । অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, ‘রোদ ! আজ আবার সেই দুঃস্বপ্নটা দেখলাম ।’
‘পোকা হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন ?’
‘হুঁ ।’
‘তোমাকে মানসিক ডাক্তার দেখানো উচিত আগে । আজ গেলে না কেন ডাক্তারের কাছে ?’
‘এমনি । ভাল্লাগছে না শরীরটা । কাল যাবো ।’
দুজনে রাতের ডিনারের পর ড্রইংরুমে টিভির সামনে গিয়ে বসলো । টিভিতে দুজন কবি ‘কবিতা’ বিষয়ক কঠিন আলাপ করছেন । এখন তর্ক হচ্ছে ‘প্রস্বরবৃত্ত’ নিয়ে । একজন কবি বেশ রেগে রেগে বারবার বলছেন, ‘আপনি কেন বুঝতে পারছেন না প্রাস্বরিক কোন আলাদা ছন্দ না ?’ ভদ্রলোকের রাগ দেখতে মন্দ লাগছে না । মহসিন শব্দ করে হেসে ফেলল । এই রোগ সংক্রামক । রাত্রির সাথে অনেকদিন একসাথে থাকায় তার মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে । রোদসী তার ভাঙা-ভাঙা কন্ঠে বলল, ‘ভাইয়া, অনেক আগে, যখন অঞ্জন স্যারের কবিতার ক্লাশে যেতাম, তখন স্যার একটা অদ্ভুত খেলা খেলতেন আমাদের নিয়ে । মনে আছে তোমার ?’
‘হুঁ ।’
‘তুমি যে একবার রাগ হয়ে স্যারের গায়ে কালি ছুঁড়ে মেরেছিল, সেটা মনে আছে ?’
‘হুঁ-হুঁ করছো কেন ? মনে নেই –তাই বলো !’
‘মনে আছে । আমি একটা কবিতার লাইন বলব । ওটা শুনে আমার পরের জনের মাথায় ঐ কবির যে কবিতার লাইন আসবে সেটা বলতে হবে । দেরী করলে আসর থেকে বাদ পড়ে যেতে হবে । এভাবে একজন টিকে থাকবে । আমি একদম শেষে গিয়ে বাদ পড়ে যাওয়ায় রেগে গিয়েছিলাম ।’
‘আমার মাঝে মধ্যে আবার ঐ বয়েসটাতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে । চিন্তা নেই, ভাবনা নেই । আছে অজস্র আশা-স্বপ্ন । কেন আবার পেছনে ফিরে যাওয়া যায় না, বলো তো ?’
‘কারন আমাদের জীবন পাখিদের মতো নয়
যদি হ’ত
হয়তো হাজার হাজার বছর পরে
মাঘের নীল আকাশে
সমুদ্রের দিকে যখন উড়ে যাব
আমাদের মনে হবে
হাজার হাজার বছর আগে আমরা এমন উড়ে যেতে চেয়েছিলাম ।’
রোদসী একটু থেমে বললো,
‘যে জীবন ফরিঙের, দোয়েলের- মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা
এই জেনে ?’
মহসিন ক্ষীণ হেসে আবৃত্তি করলো,
‘আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর ? জানি নাকি আহা,
কী বুঝিতে চাই আর ? রৌদ্র নিভে গেলে পাখপাখালির ডাক
শুনি নি কি ? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখি নি কি উড়ে গেছে কাক ?’
রোদসী ভাঙা গলায় বলল,
‘যাবে চলে তবে কোন্ পথে ?
সেই পথে আরো শান্তি-আরো বুঝি সাধ ?
আরো বুঝি জীবনের গভীর আস্বাদ ?
মহসিন বলল,
‘কোথাও চলিয়া যাব একদিন-তারপর রাত্রির আকাশ
অসংখ্য নক্ষত্র নিয়ে ঘুরে যাবে কত কাল জানিব না আমি...’
রোদসী থমকে গেল । মহসিনও বিব্রত হয়েছে । মনসুরের সমস্ত সত্তা জুড়ে এখনও রাত্রি বাস করছে, এটা যে কেউ বুঝতে পারবে । রোদসীর মন প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল । তার ভাইটা এত ভাল, ভাল মানুষগুলিকে কেন এত আগে আগে চলে যেতে হবে ? যে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রাত্রিকে কেন সবটা খুলে বলছো না ? এই সময়গুলিতে তোমার পাশে থাকার অধিকার তো ওর আছে ।’
‘ওর আজকে বিয়ে রোদ ! এখন ও বাসর ঘরে । আমি যদি ওকে জানাতাম, যদি ওর সাথে রূঢ় আচরণ না করতাম...’, মহসিন সহজ গলায় বলল, ‘ও কি আমাকে এত ঘৃণা করতে পারত কখনও ? এত সহজে ওর আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র ফলে উঠতে পারত না । এই ঘৃণার মধ্যেও এক ধরণের ভালবাসা আছে । সবাই ধরতে পারে না । আমি পারি । এজন্যেই আমার পেইন্টিংগুলি সুন্দর হয় ।’
রোদসী কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তুমি এত ভাল কেন, আমাকে বলবা প্লিজ ?’
‘এত ভালও না আমি...’, মহসিন হেসে উঠল হো-হো করে, ‘ক্যান্সারটা সেরে গেলে ওকে জোর করে তুলে নিয়ে আসবো একদিন ।’
রোদসী হেসে ফেলল । তারপর চোখ মুছে বলল, ‘আমাকে এখন যেতে হবে । চশমা বানাতে দিয়েছিলাম । ওটা এনে বাসায় ফিরতে হবে । যাচ্ছি ।’ মহসিন তাকে দরোজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল । রোদসী হঠাৎ পিছন ফিরে বলল, ‘মনে করো, এটা রাত্রি তোমাকে বলেছেঃ
‘একাকী তারার মত, সব তারা আকাশের কাছে
যখন মুছিয়া গেছে-পৃথিবীতে আলো আসিয়াছে-’
মহসিন সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল,
‘মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে নিয়ে
আমরা কেবল আকাশ ভেঙে চলি
হয়না শোনা নিঃশব্দের ভাষা-
হয়না দেখা চোখের শব্দাবলী-
তুমি কি আজ সেই মানবীই আছো ?
দূরের হয়েও রইতে পারো কাছে ?
পড়ে নিও-; শব্দবিহীন চিঠি
রেখে দিলাম দুই আকাশের মাঝে ।
‘এটা তো জীবনানন্দের না !’, রোদসী চমকে বলল, ‘এটা কার কবিতা ?’
‘আমার কবিতা বললে বিশ্বাস করবে ?’
রোদসী কিছু বলল না । মহসিন দরোজা বন্ধ করে দিল ।
৩
বাইরে প্রবল বাতাস । শোঁ-শোঁ শব্দ । বাতাসে জানলার কাচ ভেঙে গেল । বাতাসের বেগ ক্রমেই বাড়ছে । তীব্র বাতাসে রাত্রির একটা আঙুল হঠাৎ ঝড়ে পড়া দেবদারু গাছের সুবলিত শাখার মত ভেঙে উড়ে চলে গেল । আঙুল খামচে ধরে রাখা পিয়ানোবাদক নীল পোকাটাও এই প্রথম ধাক্কাতেই উড়ে হারিয়ে গেছে । রাত্রি ব্যথায় চিৎকার করে উঠল । বৃষ্টি শুরু হয়েছে । শ্রাবণ মাসের মত মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে । এখন তো ভাদ্র মাস ! অসময়ে এমন করে বৃষ্টি হচ্ছে কেন ? রাত্রি তার আঙুলঝরা ভেজা ডান হাতের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । দ্বিতীয় পোকাটার বাতাস নিয়ে তেমন কোন সমস্যা আছে বলে মনে হচ্ছে না । হঠাৎ বৃষ্টিতে সে মহাখুশী । পোকাটি এবার তার ইউকেলেলে বাজিয়ে বরষার গান শুরু করলঃ
Here comes the rain again !
Falling on my head like a memory
Falling on my head like a new emotion
I want to walk in the open wind
I want to talk like lovers do
I want to dive into your ocean
Is it raining with you ?
রাত্রির মনে হল তার গায়ে কেউ হাতে রেখেছে । মহসিন না, অন্য কেউ । মহসিনের গায়ের গন্ধ রাত্রি ভুলে গিয়েছিল । এখন সে মনে করতে পারছে । তার খুব ইচ্ছে করছে সেই গন্ধে অনেকক্ষণ মুখ ডুবিয়ে রাখতে । অচেনা হাতটা তাকে জড়িয়ে ধরতে চাইল । রাত্রি ঘুমের ঘোরে সেই হাত সরিয়ে দিল ।
________________________
গল্পটি ব্লগার সংকলন ঋদ্ধ-১ এ প্রকাশিত হয়েছিল ।