††
আশ্বিন মাস ।
উদার বিস্তৃত মাটির পথের ওপর সকালবেলার রোদ ছিটে-ছিটে পড়ছে । মাঝে মধ্যে হুট করে বাতাস ঝাপ্টা দিয়ে ঠান্ডা একটা আরাম বুলিয়ে গেলে শরীর জুড়িয়ে আসে । বিনয় মুন্সী ছাতি গুটিয়ে ফেললেন । এই বাতাসী রোদ গায়ে মাখতে মন্দ নয় । ঘন্টা দুয়েক হল তিনি নদীর তীর ধরে দাঁড়য়ে আছেন । লঞ্চের কোনরকম উপায় হচ্ছে না । তার অত্যন্ত দূর্বল লাগছে । পা ভেঙে আসছে । একটা সময় ছিল, তিনি মাইলের পর মাইল ক্লান্তিহীনভাবে হেঁটেছেন । ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেও ছিটেফোটা ক্লান্তি টের পান নি । সময় পাল্টেছে । বয়স জানান দিচ্ছে । কানের পাশ থেকে উঁকিঝুকি দেয়া কয়েকটা শাদা চুল নিভৃতে বৃদ্ধত্বের গুন টানছে । তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন ।
‘তুমি মুন্সী বাড়ির ছোডো পোলা না ?’
বৃদ্ধের দিকে এক নজর তাকিয়েই বিনয় মুন্সী বুঝে গেলেন ইনি মাঝি বাড়ির মঈনুদ্দীন । শৈশবে এই লোকের নৌকায় চড়ে কি রকম হৈ-হুল্লোড়টাই না করতো সে । খুব শখ ছিল বড় হয়ে একদিন মঈনুদ্দীনের মত কাঁচা কাঠের ছোট্ট একটা নৌকা বানাবে । তারপর তার খোলে আলকাতরা শুকিয়ে একা একা নৌকোয় চড়ে নদী পাড়ি দেবে । খরস্রোতা ইলিশা নদী !
‘কতা কও না ক্যা ? তুমি চিনির জামাই না ?’, গ্রাম্য ভাষায় মঈনুদ্দীন আবার বলল ।
‘জ্বি চাচা ।’
‘তোমারে শ্যাষ দেকছি তোমার বিয়ার কালে । অ্যারপর গেরাম ছাড়া হইলাম । পরে যহন আইছি তোমার ভাইজানের লগে দেহা অইছিল্ । হ্যায় কইলো তুমি চিটাগাং থাহো । আর দেহা নাই । আছো বালো ?’
‘জ্বি ।’
‘ম্যালা১ করছিলা কহন ?’
‘তাতো গত রাতে । আপনি ভাল আছেন চাচা ?’
মঈনুদ্দীন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বিনয় মুন্সীর হাত ধরে বলল, ‘বাড়ি যাবা ?’
‘জ্বি । লঞ্চ তো নয়টায় আসবার কথা শুনলাম । এখনই বাজছে এগারোটা, লঞ্চের দেখা নাই ।’
‘আইজগে আর পাবা না । বিষ্যুদবার আর শুক্কুরবার এইদিকে ঘাট দেয় না । মুন্সী ! নৌকায় যাবা নাহি ?’
‘কার নৌকা ?’
‘আমারই, কার আবার ? আও দেহি । হাডা২ লাগবে এট্টু । আও আমার লগে ।’
তারা দুজন হাঁটা শুরু করল । কতদূর কে জানে ? বিনয় মুন্সীর প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে । সারা রাত টানা ভ্রমনের পর সাতসকালে বাস থেকে বরিশালে নেমে তেমন কিছুই খেতে পারে নি । বাসস্ট্যান্ড থেকে কোনরকম সময়ক্ষেপন না করে ছোট্ট টমটম গাড়িতে উঠে পড়তে হয়েছে । পরের গাড়িটি আবার তিন ঘন্টা পরে ছাড়বে । তিন ঘন্টা অপেক্ষা হয়তো করা যেত । এর মধ্যেই ধীরে-সুস্থ্যে চা-নাশতা সেরে ফেলা । কিন্তু বাঙালির তিন ঘন্টা মানে হচ্ছে তিন গুণন দুই- ছয় ঘন্টা ! রিস্ক নেয়াটা উচিত হতো না । যত দ্রুত বাড়ি পৌঁছুনো যায় ততই ভালো । কাল সন্ধ্যে-সন্ধ্যে একটা টেলিগ্রাম পেয়ে সে দ্রুত বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে এলেন । ছোট-মা নাকি প্রচন্ড অসুস্থ্য, মৃত্যুশয্যায় । মৃত্যুর আগে বিনয়ের সাথে একবার দেখা করতে চান ।
প্রায় বিশ বৎসর পর নিজের গ্রামে ফেরা । এর আগে বহু ডাক এসেছে-তার এসেছে । তার ফিরবার ইচ্ছে হয় নি । ঐ গ্রামে যেই স্মৃতি সে রেখে এসেছে তার সঙ্গে আবার দেখা করবার সাহস তার হয় নি । আজ নিতান্ত বাধ্য হয়েই যেতে হচ্ছে । ছোট-মা’র শেষ ইচ্ছাকে তুচ্ছ করবার ক্ষমতা তার নেই । ভালবাসার দাবী অগ্রাহ্য করা যায় না !
তিনি চট্টগ্রাম বিআইটি’তে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক । শহর থেকে পনেরো-ষোল মাইল দূরের প্রকৌশল কলেজ । খুব নিরিবিলি । যেদিকে তাকাও সবুজ আর সবুজ । তার সবসময়ের ইচ্ছে ছিল ভীড়-ভাট্টা, মানুষজনের মধ্যে থাকবার । মানুষ অনেকসময় যা প্রবলভাবে চায়, ঘটে ঠিক তার উল্টোটা । শাদা তার পছন্দের রং হলে, তাকে বেঁচে থাকতে হয় চারপাশে কালো সঙ্গে নিয়ে । কেন কে বলবে ?
বিনয়ের বড়ভাবীকে তিনি ছোট-মা ডাকতেন । অসাধারন একজন মহিলা ছিলেন বিনয়ের ছোট-মা । কথায় কথায় বড় আহ্লাদ করতেন বলেই বোধহয় বাবা-মা তার নাম রেখেছিল আহ্লাদী । খুব সহজ-সরল ছিল, আর বড় ছেলেমানুষী । পা পর্যন্ত লম্বা চুলের শান্তসুন্দর একটা মুখ । রংটা একটু ময়লা ছিল বলে বিনয়ের মা তাকে পছন্দ করতেন না । আনাজ-তরকারী কাটবার সময় প্রায়ই আড়ালে আবডালে নীচু স্বরে তাকে বলতে শোনা যেত, ‘আমার রফিক যহন জন্মাইলো তহন দুধের বাডির পাশে ধরলে দুধের চাইয়া রফিকরে বেশী পরিষ্কার লাগদো । আহারে ! বৌডা পাইলাম পাতিল্যা কালা ।’ আহ্লাদীর এই নিয়ে খুব গোপন একটা কষ্ট ছিল ।
রফিক মুন্সীর যখন বিয়ে হয় বিনয়ের বয়স তখন খুবই কম । আহ্লাদী তাকে নিজের সন্তানের মত জানতেন । নিজের দুই মেয়ে হওয়ার পরও বিনয়ের প্রতি আহ্লাদীর মমতা কিছুমাত্র কমে নি । গঞ্জ থেকে রফিক ভাল কিছু খাবার নিয়ে এলে তিনি তা যত্ন করে পালিয়ে রাখতেন । একান্নবর্তী পরিবার- পাছে বাড়ির অন্য ছেলেপুলে নিয়ে খেয়ে ফেলে ! সন্ধ্যা নামলে হয়তোবা চুপি-চুপি গভীর চক্রান্ত করবার ভঙ্গিতে বিনয়কে এক ঘরে ডেকে নিয়ে বেতের লাঠি বালিশে পিটিয়ে ধুপধাপ শব্দ করে বলতেন, ‘কিরে ? তাল পড়লো নাকিরে ?’ । ছেলেপুলেরা ভাবতো সত্যিই বুঝি পিছনের বাগানে পাকা তাল ঝরেছে । অমনি ভোঁ-দৌড় সবাই মিলে ! ঐ সুযোগে তিনি প্রগাঢ় স্বস্তি নিয়ে লুকোনো সাত রাজার ধন বিনয়ের হাতে তুলে দিতেন ।
বিনয়ের এখনো মনে আছে ছোটকাকার বিয়ের দিন সে শ্যাওলায় পিছলে তাদের বাড়ির পেছনের বড় দীঘিটায় পড়ে গেছে । অতটুকু বয়সে নিজের ছোট-ছোট হাত-পা ঝাপটে সর্বশক্তি দিয়ে উঠবার চেষ্টা করছে, পারছে না । বার-বার ডুবে যাচ্ছে । উপর্যুপরি পানি খেয়ে চিন্তার শক্তিটুকুও লোপ পেয়েছে । চিৎকার করবে সেই বোধটুকু নেই । ঘাটের কাছাকাছিই কোথাও হয়তো বৌ-ঝিরা সেজেগুজে ঘোমটা পরে ঘুরঘুর করছে । বিয়েবাড়ির হুল্লোড়ে তারা একাকার হয়ে গেছে । পানির ঝাপাঝাপি টের পাওয়ার কথা নয় তাদের । যখন সে পুরোপুরি ডুবে যাচ্ছে, তখন হঠাৎ করে ভাঁজভাঙা নতুন শাড়ি পরেই ছোট-মা জলে ঝাঁপ দিয়ে তাকে টেনে তুললেন । অনেক অনেক আগের কথা । তাও কোন কিছুই আবছা হয়ে যায় নি এখনো ।
বিনয় মুন্সী যে বছর পড়াশোনা পুরোপুরি শেষ করে ঢাকা থেকে ফিরে এল, সেবার ঢাকা ফেরত যাবার আগে এক কান্ড হল । ছোট-মা তার হাত ধরে কেঁদে-টেদে একেবারে একাকার হয়ে বলল, ‘তুই ঢাকা’ত্ চাকরি করবি ?’
বিনয় বলল, ‘তো হয়েছেটা কি ? কাঁদছেন কেন ?’
‘তুই ঢাকা’ত্ গ্যালে আর কি ফিরবি ?’
‘এইটা কি বলেন ছোট-মা ? ফিরবো না ক্যান ?’
‘আমি জানি তুই ফিরবি না ।’
‘আচ্ছা যান, ফিরবো না ।’
ছোট-মা সারারাত কাঁদলেন । পরদিন সকালে মুখ কালো করে কাচারি-ঘরে বসে ছিলেন । বিনয় মুন্সী চলে যাবার সময় দেখা পর্যন্ত করলেন না । রফিক মুন্সী দরজা ধাক্কাধাক্কি করলেন বহু । লাভ হল না । আহ্লাদী দরজা বন্ধ করে ভেতরে বসে রইলেন । হয়তো ভেবেছিলেন- এমন করলে বিনয় শেষপর্যন্ত থেকে যাবে । রফিক মুন্সী বিনয়কে বললেন, ‘পারলে থাইক্যা যা- আর দুই-এউক্কা৩ দিন । তর ছোট-মার ভাল্লাগবে ।’ কেবল রফিকের মা মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, ‘বৌ-এর রং দ্যাহো৪ !’
বিনয়ের চাকরীর ইন্টারভিউটা না থাকলে হয়তো সে আরো দু-একটা দিন থেকেই যেত । যেতে যেতে বারবার মনে হয়েছিল, ছোট-মা বুঝি খুব রেগে গেছেন । এ রাগ কি করে ভাঙানো যায় মাথাতেই এলো না । এক সপ্তাহ পর যখন সে ফিরে এলো- তখন ছোট-মাকে দেখে অবাক হওয়া ছাড়া উপায় রইলো না । কিসের রাগ – কি অভিমান ! সব ধুয়ে মুছে জল । বিনয়ের কাছে এসে মুখ টিপে হেসে বললেন, ‘এইবার আর যাইতে দেওয়া হইবে না মিয়াসাইবরে । তর অষুধ জোগাড় হইছে ।’
আহ্লাদীর চোখ-মুখ জুড়ে ভীষণ একটা আনন্দের আভাস ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল । বিনয় আরও অবাক হল যখন দুপুরে খেতে বসার পরপরই বিশাল লম্বা একটা ঘোমটা টেনে ষোল-সতেরো বছরের একটা কিশোরী মেয়ে ফুল-পাতা নক্সা করা হাতপাখা নিয়ে পাশে এসে বসল তাকে বাতাস করবে বলে । এ নাকি আহ্লাদীর খালাতো বোন । খাসকান্দি থেকে এ বাড়িতে তার বুজানের কাছে বেড়াতে এসেছে দুদিন হল । চমকের ওখানেই শেষ না, তখনো বাকী ছিল অনেকখানি ।
বিনয় চেয়ার-টেবিল ছাড়া একেবারেই পড়তে পারতো না । খাওয়া-দাওয়ার শেষে সে জন ডিকসন কারের ‘দ্য ডেভিল ইন ভেলভেট’ হাতে নিয়ে টেবিলে বসেছে । মারাত্মক উপন্যাস । নায়ক নিকোলাস ফেন্টন শয়তানের সাথে প্যাক্ট করে টাইম ট্রাভেলের মত একটা ব্যাপার ঘটায় । সে অতীতে ঘটে যাওয়া একটা হত্যাকান্ডের ঠিক আগের সময়টিতে এসে পৌঁছায় এবং লিডিয়া নামের এক বিবাহিত তরুনীর প্রেমে পড়ে যায় । মজার ব্যাপার হচ্ছে সে জানে এই লিডিয়াকেই কিছুদিন পর খুন করা হবে । এমন কঠিন পরিস্থিতিতে বিনয় যখন খুব চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝুঁকিয়ে নিজেই উপন্যাসের ভেতর ঢুকে পড়েছিল, ঠিক তখন কোথা থেকে যেন চোখে তীব্র আলোর ছটা পড়লো । হঠাৎ আলো পড়ায় সে দারুন চমকে মাথা তুলল । এমন চার দেয়ালের ভেতর আলো পড়ল কোত্থেকে ? বিনয় এদিক ওদিক তাকালো । আলোটা মিলিয়ে গেছে । সে আবার বই পড়তে শুরু করেছে, আবার আলো পড়লো চোখে । কি যন্ত্রণা ! রেগেমেগে উঠে জান্লা ভিজিয়ে দেবে এমন সময় খেয়াল করলো অনুদেহী অসম্ভব রূপবতী কিশোরী একটি মেয়ে পাশের ঘরের দাওয়ায় বসে নখ খুঁটছে । চোখে চোখ পড়ায় তার শঙ্খরঙা মুখ চন্দন ফুলের মত রাঙা হয়ে উঠল । তার হাতে ছোট গোল একটি কাচের আয়না । সে কি ইচ্ছে করে চোখের ওপর আলো ফেলছে নাকি ? কি আশ্চর্য !
ঐদিন রাত্রিবেলায় ছোট-মা তার ঘরে ঢুকে এক খন্ড হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘গান হুনবি ল’ !’
‘গ্রামোফোন কই পেলেন ?’
‘আরে ওড না আগে !’, আহ্লাদী তাকে টেনে নিয়ে গেলেন উঠোনে । উঠোনের কাছাকাছি কাগজী লেবুর বন থেকে মিষ্টি ঘ্রান উড়ে আসছিল । ঘুটঘুটে অন্ধকারে দাওয়ার পাশের করমচার ঝোপটিকে ঘিরে থোপা থোপা জোনাকি পোকা ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা খেলছে । আর দাওয়ার ওপর এক কোণে একটা কুপীর আলোয় মুখ পেতে আহ্লাদীর বোনটি বসে আছে । আহ্লাদী গান গাইতে বলতেই বেণী দুলিয়ে পা নাচিয়ে নাচিয়ে বেশ গান গাইতে শুরু করলো । গানের গলা তার তেমন নমনীয় নয় । সুর দ্রুত ভাঙছে-গড়ছে । কন্ঠটাও খুব ভাঙা-ভাঙা- তবে বড্ড বেশী মায়াময় । গানের এক পর্যায়ে সে ঘাড় ঘুরিয়ে ডাগর চোখ করে বিনয়ের দিকে চাইল । ঐ চোখে একটা কিছু ছিল । যা শিক্ষিত আধুনিক ধাঁচের একটি ছেলেকে অতি সহজে পাড়াগেঁয়ে একটি মেয়ের প্রেমে পড়তে বাধ্য করিয়ে নেয় ।
বারোই ভাদ্র বিনয় গ্রামে ফিরেছিল । চৌদ্দই ভাদ্র হুটহাট করে মেয়েটির সাথে তার বিয়ে হয়ে গেল । ভাদ্র মাসে নাকি বিয়ে হয় না, এই বলে রফিকের মা ক্ষীণ আপত্তি তুললেও শেষ পর্যন্ত নিমরাজি হলেন । কারন একটাই । মেয়ের গায়ের রং কাঁচা সোনার মতন ! তার বড় সাধ ছিল পরীর মত রূপবতী একটি মেয়েকে পুত্রবধু করবেন । সেই সাধ তিনি পূর্ণ করলেন ।
বরযাত্রী করে যেদিন মেয়ে উঠিয়ে আনা হল, চাঁদোয়া খাটিয়ে বেশ একটা হৈ-রৈ হল সেদিন । সবার সঙ্গে কোমড় দুলিয়ে দুলিয়ে আহ্লাদীর শ্বাশুড়ী পর্যন্ত নাচলেন । সবাই আঁচলের খুঁট ধরে মুখ চেপে হাসল । নাচের শেষে দৌড়ে গেলেন উত্তরের ঘরে । আলমিরা খুলে কি একটা বের করে নিয়ে এলেন । তারপর নতুন বৌয়ের কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘পরো তো বৌ ! দেহি তো, ক্যামন লাগে সোনা বৌরে !’
বাড়ির সবাই তাজ্জব হয়ে গেল । বিনয়ের মায়ের হাতে চমৎকার এক নক্ষমালা হার ! হারের ওপরে স্বর্ণের অপূর্ব সূক্ষ্ণ ঝালরের কাজ আর তাতে আটকানো সাতাশটা আশ্চর্য রঙিন মুক্তো । আলো যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে এক একটার গা থেকে । হারটা ছোটবেলায় একবার দেখেছিল বিনয় । তার বাবা মজার এক গল্প শুনিয়েছিলেন তখন তার মাকে । এই হার নাকি বহুকাল আগে মুর্শিদাবাদে গড়ানো হয়েছিল । ঐ অঞ্চলের ধনকুবের রাজা ধনপৎ সিং দুগার তার অত্যন্ত সুন্দরী স্ত্রীর জন্য এটি গড়িয়েছিলেন তার শখের সাতাশটি মূল্যবান মুক্তার সমন্বয়ে । হিন্দু নক্ষত্রবিচারে চন্দ্রের সাতাশটি স্ত্রী আকাশে যেমনভাবে সেজে থাকে ঠিক ঐ আদলে বিশজন নামী কারিগর মিলে একমাস ধরে গড়েছিলেন এই এক ধরা নক্ষমালা হার । পরে কোন এক কালীপূজারী ঠ্যাঙারে-ডাকাতের দলের হাতে এই হারের জন্যেই বলির কারন হন দুগারের স্ত্রী । বহুহাত ঘুরে এই হার আসে বিনয়ের বাবার পরদাদার হাতে । শেষপর্যন্ত বংশানুক্রমে তার বাবার হাতে এসে পৌঁছায় । মা এতোদিন ধরে এই হার লুকিয়ে রেখেছিলেন- এমনকি ছোট-মাকেও পড়তে দেন নি কেন, এই ভেবেই বিনয় বড় বিস্মিত হল ।
বিনয়ের মা হার খুলে বৌয়ের গলায় পড়িয়ে দিতে দিতে অদ্ভুত একরকমের মুখভঙ্গি করে বললেন, ‘বড় বৌটার জন্যই রাখছিলাম এইডা । হ্যার যে রঙের ছিরি- এইডা মানাইবে না বড়ো । এই যে- দেহি ! কি সুন্দর পরীর লাহান লাগদে আছে ...’ বিনয়ের মার চোখ উচ্ছ্বাসে ঝলমল করে উঠল । বিনয় পাশেই বসা ছিল । সে বড় বিব্রত হল । এমন একটা কথা কি মার ছোট-মা’র সামনে না বললেই হত না ! আহ্লাদীর চোখের দিকে চেয়ে সে স্পষ্টই বুঝতে পারল তার ছোট-মা অনেক কষ্টে নিজের চোখের জল ভেতরে আটকে রেখেছে । অন্য কেউ হলে হয়তো অপমানের আঁচে ছুটে এখান থেকে বের হয়ে যেত । কিন্তু, তার ছোট-মা বড় অন্যরকম- বড় ভালো । অনেকের হাসি-আনন্দের ভীড়ে নিজের গভীরতম ব্যথা উড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা নিয়ে খুব কম মানুষ জন্মায় । পৃথিবী এদেরকে যত কষ্ট দেয়, এরা ততই পরম মমতা নিয়ে সেই দুখের গাঁথায় ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র সুখের ফুল ফোটানোর চেষ্টা করে । ছোট-মা তেমন একজন মানুষ !
বাসর ঘরে ঢুকতেই বিনয়ের বৌ ঘোমটা ফেলে দিয়ে মুখ ভেংচে বলল, ‘মুন্সী, এউক্কা শোলোক৫ ভাঙ্গেন দেহিঃ
ঘর করলে করতে হয়,
হুইয়া পড়লে দিতে হয় ।।’
বিনয় এতোটাই চমকালো যে তার হাতে লেগে খাটের পাশের ছোট্ট নীচু চৌকিতে রাখা পেয়ালায় ঢাকা দেয়া দুধের গ্লাস উলটে পড়লো । ঘরের মেটে মেঝে দ্রুত সেই দুধ শুষে নিল । বিনয় ঢোঁক গিলতেই মেয়ে খিলখিল করে হেসে বলল, ‘মাগ্গো-মা ! আম্নে৬ এতো দ্যাঁড়া৭ ক্যান ? এইডা হইলো গিয়া হুড়কা । ঘরবাড়ি বানাইলে দরজার হুড়কা বানাইতে হয় । আর রাইতের বেলা হুইতে৮ গেলেও হুড়কা দিয়া আইতে হয় । এইবার বোজ্জেন৯ ক্যান আম্মেরে১০ শোলোক’ডা জিগাইছি ?’
বিনয় বোকার মতন মাথা নাড়লো ।
‘আল্লাগো-আল্লা ! মুন্সী তো দেহি বিরাট দ্যাঁড়া পাগল ! ঘরে ঢুকছেন হুড়কা দ্যান নাই । যান, হুড়কা দিয়া আন । খাঁড়ান- খাঁড়ান- দুধের গেলাসটা লইয়া যান- হালাইয়া দিলেন যে ।’
গ্রামীন ভাষাটা এই মেয়েটার মুখে কি চমৎকারভাবেই না মানিয়ে যাচ্ছে ! কেমন একটা অন্যরকম টানে সে আঞ্চলিক ভাষাটাকেই শুদ্ধ করে নিয়েছে । বেশ মিষ্টি লাগছে শুনতে ! বিনয় একটু একটু স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে বলল, ‘তুমি তো বেশ চালাক মেয়ে । তোমাকে দেখে কিন্তু এতোটা বোঝা যায় না ।’
‘কি বুঝা যায় না ?’
‘তুমি যে শুধু রূপবতীই না- বেশ স্মার্ট !’
‘আম্মের মন বুইঝগা১১ কতা কইছি তো, এইল্লইগ্যা এমন লাগছে ।
গোণ বুইঝগা নাও বায়
হ্যারে কয় নাইয়াডি
আসর বুইঝগা গান গায়
হ্যারে কয় গাইয়াডি
আর মন বুইঝগা কতা কয়
হ্যারে কয় মাইয়াডি’, বলেই মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠলো ।
বিনয় বলল, ‘তুমি তাহলে মাইয়াডি ?’
মেয়েটি মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে হাসছে । বিয়ের সাজে কি অদ্ভুতরকম সুন্দরটাই না লাগছে তাকে ! ঝিঁঝিঁর ডাক যেন প্রতিদিনের চেয়ে আজ আরো বেশী । মৃদু হারিকেনের আলোয় ঝিল্লীমুখর অদ্ভুত এই রাত্রিটিকে তার কাছে অলৌকিক বলে মনে হচ্ছে ! যেন কোন মায়ার বুননে সাজানো- এক্ষুনি ঘুম ভেঙে সমস্তটাই এক নিমেষে মাটি হয়ে যাবে ...
কই ? নাতো ! এইতো মেয়েটি হাসি থামিয়ে বৃষ্টি বটেরার মত তার কন্ঠী ঘাড় বাঁকিয়ে ভাঙা-ভাঙা গলায় আবার বলল, ‘মুন্সী ! আম্মেরে আরেউক্কা শোলোক জিগাই ?’
বিনয় একবার ভাবল না করে দেয় । আবার কি কঠিন ধাঁধাঁ জিজ্ঞেস করবে, সে পারবে না এবং যথারীতি তার উপাধি হবে ‘দ্যাঁড়া’ ! তারপরও সে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল । মেয়েটির মজার মজার কথা শুনতে ভালই লাগছে ।
‘কয়েন্ তো দেহি, আমার নামডা কি ?’
বিনয় অপ্রস্তুত হয়ে গেল । সে-যে এমন প্রশ্ন করবে এটা সে ভাবতেই পারে নি । কি অদ্ভুত ব্যাপার ! বিয়ের হুড়োহুড়ির ভেতর মেয়েটির নামই শোনা হয় নি । এ তো ভীষণ লজ্জা ! বিনয় কথা ঘুরানোর জন্য বলল, ‘তোমার কি মনে হয় আমি তোমার নাম না জেনে বিয়ে করেছি ?’
কি আশ্চর্য ! মেয়েটি দিব্যি মাথা ঝাঁকালো । সে নিশ্চিত বিনয় তার নাম জানে না । বিনয় বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, ‘তোমার নাম জানতাম, এখন ভুলে গেছি । একটু ধরিয়ে দাও । মনে পড়বে ।’
মেয়েটি মাথা দোলাতে দোলাতে সুর করে বলল,
‘বাইরায় লাডি-- ফাইট-গা
খাইতে মজা-- চাইট-গা ।।’
বিনয় যখন ভেবে-ভেবে অস্থির ঠিক তখন ছোট-মা ‘চিনি-চিনি-’ ডাকতে ডাকতে ঘরে এলেন । মেয়েটার নাম তাহলে ‘চিনি’ । কি অদ্ভুত নাম ! ছোট-মা যেতেই বিনয় নিজের কর্কশ কন্ঠে সুর ঢালতে ঢালতে গম্ভীর গলায় গাইতে শুরু করলোঃ
‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে
ওগো বিদেশিনী ...’
চিনি তার বিয়ের কস্তা লাল শাড়ির সোনালী ছাপ মারা আঁচল মুখে চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো । ছিঃ ! কি আমার গানের ছিরি ! আমি চিনি গো চিনি ... হিহিহি ...
আহ্লাদী ঠিকঠাক চিনিকে বিনয়ের জন্যে বেছে বের করেছিল । গ্রাম্য এই মেয়েটির মধ্যে চুম্বকের মত অস্বাভাবিক একটা আকর্ষনী ক্ষমতা ছিল বৈকী ! শুধুমাত্র চিনির কারনে বিনয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার মত অমন বিশাল সুযোগ হেলায় হারাল । বৈশাখ মাস তখন । কাঠফাটা রোদ পড়ছে । আম-কাঁঠালের গন্ধে মৌ-মৌ করছে চারদিক । চিনি কিছুতেই শহরে যাবে না । বিনয় খুব একটা বোঝাবার চেষ্টা না করেই হাল ছেড়ে দিল । সে জানে এখন বেশী জোরাজুরি করলে চিনি তাকে কঠিন একটি ‘শোলোক’ ধরবে । শোলোকের উত্তর বের করতে পারলে সে যাবে, নইলে না । যে শোলোক ভাঙানোর ক্ষমতা চিনি ভিন্ন ইহজগতে আর কারো নেই ! বিনয় পাকাপোক্তভাবে গ্রামেই থেকে গেল ।
একবার কথায় কথায় বিনয় বলছিল, ‘আচ্ছা ! এমন একদিন তো আসবে যেদিন তোমার জানা সমস্ত ধাঁধাঁর উত্তর আমার জানা হয়ে যাবে- আমায় ধরবার মত নতুন আর কোন ধাঁধাঁ থাকবে না । তখন কি করবে ?’
‘যহন এমন হইবে তহন মুন্সীর দাঁতও লড়বে- আমার দাঁতও লড়বে ... হিহিহি ...’
যা ভেবে রাখা হয়, তা কখনোই হয় না । আষাঢ় মাসে চিনি বড় রকমের অসুখে পড়লো, আর শ্রাবন মাসের এক তারিখ ভোর রাতে অনেক অনেক ধাঁধাঁর গোপন উত্তর মাথায় নিয়ে সে অন্য ভুবনে যাত্রা করল । বিনয় এতোটুকুও কাঁদলো না । যা হয়েছে- ভালই হয়েছে । চিনির অসুখটা মানসিক ছিল । শেষদিকে এমন হল, সে কাউকে চিনতে পারতো না- বিনয়কেও না । এক টুকরা পরিমান কাপড়ও শরীরে রাখতে পারতো না, কেবলই বলতো, ‘গরম, গরম লাগে...’ । বিনয়ের মা সুর করে কাঁদতো আর বলতো, ‘কার নজর লাগলো আমার বৌডার উপর ? কার নজর লাগলো ?’ চিনিকে কবরে শুইয়ে সেই যে গ্রাম ছাড়লেন বিনয় মুন্সী- আর ফেরেননি । দ্বিতীয় বিয়ের কথাও তার চিন্তাতে আসেনি কখনো ।
‘এ বিজ্জু, তরে মাইরগালাম !’
বিনয় মুন্সী ঘোর কাটিয়ে তাকালেন । সাত-আট বছরের বাচ্চা এক ছেলে আঙুল উঁচিয়ে কাকে যেন শাসাচ্ছে । মঈনুদ্দিন মাঝি বলল, ‘আমার মাইয়ার ঘরের নাতি, রইস । নছিমনরে তো তুমি দ্যাহো নাই । অয় হের পোলা ।’ সে রইসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঐ ছ্যাড়া ! কি অইছে ? চিল্লাস ক্যা ?’
‘দ্যাহো না নানা ! নৌকা দিয়া দুইডা আম লইয়া দৌড় দিছে । চোরার চোরা ।’
‘হইছে, হইছে । অ্যাচ্চা১২ ! তর মামারে কয়ডা আম আইনগা১৩ দে । যা ।’
রইস দুহাত ভরে ছইয়ের নিচে রাখা আম নিয়ে এলো । মঈনুদ্দীন বলল, ‘খাও বাজান । ব্যান১৪ হইতে কি খাইছো না খাইছো । খাও ।’ বিনয় মুন্সী সিঁদুররঙা একটা আম হাতে তুলে নিল । বাহ্ ! কি চমৎকার রঙ ! যেন তুলি দিয়ে আঁকা ক্লদে মনেতের কোন শিল্পকর্ম । ভেঙে সৌন্দর্যটা নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে না এমন অবস্থা । নিজের চিন্তার ধরন ভেবে বিনয় মুন্সীর নিজেরই হাসি পেয়ে গেল । মঈনুদ্দীন বলল, ‘কি ভাইস্তা ? মুখ টিপ্কা হাসো ক্যা ? খাও ।’
বিনয় মুন্সী আম ছিঁড়তে শুরু করলেন । আমে কামড় দিতেই মুখের মধ্যে কিছু বাঁধল । কিছু একটা কৃমির মত কিলবিল করছে মুখের ভেতর । তিনি থুথু করে পুরোটা ফেলে দিলেন । ফেলে দেয়া আমের দলার ভেতর থেকে শাদাটে কিড়া বের হয়ে আসছে । কী ভয়াবহ !
পোকায় কাটা আম রইসকে মনে হয় খুব প্রফুল্ল করল । সে তার ফোকলা ময়লা দাঁতের উপরের পাটির পুরোটুকু বের করে হি-হি-হি-হি করে হাসতে হাসতে বলল, ‘মাছিপোকে কাডা আম ।’
মঈনুদ্দীন হতাশ গলায় বলল, ‘গত বৎসরও এই কাম হইছিলো । ব্যাকগুন১৫ আম পোকে খাইছে ।’
শাদা শাদা কিড়াগুলো কেঁচোর মতই কিলবিল করছে । দেখতেই অস্বস্তিতে গা গুলিয়ে আসে । অমন সুন্দর রাঙা ডাঁসা ফলটার ভেতরটা কি কুৎসিত ! আলোর নীচে কি অন্ধকারই থাকতে হবে সবসময় ?
মঈনুদ্দীন বলল, ‘খাড়াও । কাইটগা পোক ছাড়াইয়া দেই ।’
বিনয় মুন্সী ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘চাচা, আর খেতে ইচ্ছা করছে না । বাদ দেন । নৌকা ছাড়েন । ছোট-মা মৃত্যুশয্যায় । যত তাড়াতাড়ি পৌঁছুনো যায়, ততই ভাল ।’
‘আহ্লাদী বৌ’র কথা কও ?’
‘হুঁ । কেন ? আপনি কিছু জানেন না ?’
‘জানি । জানি । এতো ভাল একটা মাইয়া । আহারে ! কি অসুখ যে বাজাইলো । চামড়ায় কিড়া ধইরগা গ্যাছে । অষুধ-পত্র তো খাওয়ান কিছু বাদ রাহে নাই । কিছুতেই কিছু হইলো না ।’
বিনয় মুন্সী এক হাতে ব্যাগ, আরেক হাতে ছাতা নিয়ে নৌকায় চড়ে বসলো । মঈনুদ্দীনের আগের সেই শক্তি সামর্থ্য আর নেই । সে ঢিমেতালে নৌকা বাইতে লাগল । রইস বেশ খুশীমনেই নৌকার পানি সেচতে শুরু করেছে । তার ফোকলা দাঁত এখনও বেড়িয়ে আছে । কিছু জেলে তাদের নৌকা নিয়ে বিষণ্ণ মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে । মাছ আহরণের সরঞ্জামে তাদের নৌকা ভর্তি । বিনয় মুন্সী ছইয়ের নীচে ঢুকে গা এলিয়ে দিলেন এবং দেখতে দেখতে ঘুমিয়েও পড়লেন । ঘুম যখন ভাঙলো তখন দুপুর গড়িয়েছে । নৌকা বাড়ির কাছের ঘাটে এসে ভীড়েছে । মুন্সী উঠে বসলেন । মঈনুদ্দীন তাকে উঠে বসতে দেখে হাঁক ছাড়লো, ‘ব্যামালা১৬ ঘুম দেছো দেইখ্যা আর জাগাই নাই ভাইস্তা । ওডো-ওডো১৭, আইয়া পড়ছো ।’
বিনয় মুন্সী পারে নেমে বুকভরে একটা নিঃশ্বাস নিল । আহারে ! কতদিন পরে এইখানে ফিরে আসা । মঈনুদ্দীনকে টাকা মিটিয়ে দিতে যাবে, সে বলল, ‘ভাইস্তা যাবা কবে ?’
‘এখনও জানি না ঠিক ।’
‘আইচ্চা-আইচ্চা- যাও । আইছো যহন, থাহো কিছুদিন । সাইঝের কালে যামু হানে তোমাগো বাড়ি ।’
‘কয়টাকা দেবো চাচা ?’
‘আরে সবুর ! সাইঝের কালে দিও ’খন ।’
তাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মঈনুদ্দীন ব্যস্ত ভঙ্গিতে নৌকার দিকে হাঁটা ধরলো । রোদ আবার চড়েছে । বিনয় মুন্সী ঘড়ি দেখলেন । তিনটা বাজে । তিনি ছাতাটা খুলে ব্যাগ হাতে ধীরপায়ে মুন্সীবাড়ির দিকে চললেন ।
††
উঠোনটা বদলায় নি এতোটুকুও । ঠিক আগের মতনই আছে, যেমনটা দেখে গিয়েছিলেন মুন্সী । এই তো উঠোনে পা রাখতেই লেবু বনের নরম সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছে । পূবকোনের কাকডুমুর গাছটি এখনো মাথা জাগিয়ে তার শিরিষ কাগজের মতন খসখসে পাতায় পাতায় সূর্যালোকের গাঢ় রঙ ধরবার চেষ্টা করছে । তার পাশেই ঘন জঙ্গলের এখানে ওখানে শাদা-শুভ্র সফেদা ফুল উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে ।
ঐতো চিনির কবর ! বিনয় মুন্সী এগিয়ে গেলেন । কবরের আশেপাশে কিছু গাছ এলোমেলো ভাবে দাঁড়িয়ে আছে । সামনের দিকটায় হলুদরঙা দু-তিনটে লটকন ফুল ঝুলে আছে । থেকে থেকে গন্ধ ছড়াচ্ছে সেগুলি । চিনির টক-ফল খাওয়ার শখ ছিল দেখার মত । যখনই দেখা যেতো, শাড়ির আঁচলে নইল, লটকন কিংবা ছোট্ট একটা দুটো আমলকী বাঁধা । একবার করমচা ছিঁড়তে গিয়ে হাতে কাঁটা ফুটিয়ে সে কী চিৎকার ।
‘আরে ! বিনয় ? তুই আইলি কহন ?’, রফিক মুন্সী এগিয়ে এলেন । তার আগের সেই চেহারা এখন আর নেই । সাস্থ্যও ভেঙে গেছে । মুখের ফর্সা রঙ জ্বলে গেছে । চোখের নিচে পড়েছে কালি । তার গায়ে একটা পাতলা শাদা গেঞ্জী, পরনে নীল রঙের লুঙ্গী ।
‘এইতো ভাইজান । ভালো আছেন ?’
‘আর থাকন । তার তো পাইছোস ?’
‘ছোট-মা’র অবস্থা এখন কেমন ?’
‘অবস্থা বালো না । ডাক্তার আইসিল্ । আনাইসিলাম ঢাকাত্তন । হ্যাতে তো কইলো আর কিস্যু করোনের নাই । কহন কি হইয়া যায় আল্লাই জানে । তত্তরী যা । তোরে দেহার লইগ্যা কাইল হইতে খুব কইতাছে ।’
‘অসুখটা কি ?’
‘কত ডাক্তার দেহাইলাম । কেউ ধরতে পারল না ...’ রফিক মুন্সী বুকের ভেতর চেপে রাখা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন ।
মাঝের ঘরের সেগুন কাঠের বড় খাটে আহ্লাদীকে ঘিরে অনেকে বসে ছিল । বেশিরভাগই মহিলা । বিনয় মুন্সীকে ঘরে ঢুকতে দেখে তারা তড়িঘড়ি করে আঁচল টেনেটুনে বসলো, কেউ কেউ মাথায় কাপড় দিল । ঘরের ভেতরটা আগড়বাতির ভৌতিক গন্ধে ভরে গেছে । ছোট-মাকে দেখে বিনয়মুন্সী চমকে উঠল । যাকে খাটের ওপর শোয়া দেখছে এর সাথে আগের সেই ছোট-মার কোথাও কোন মিল নেই । মাথায় চুল নেই বললেই চলে, চোখের ভ্রূ ঝরে গেছে । গালে-গলায় ফোস্কার দাগ জমাট হয়ে বসেছে । গলার নীচটা লাল দগদগে পোড়া ঘায়ে ঘেরা । কোন কোন জায়গা ফেটে পুঁজ বের হচ্ছে- বীভৎস লাগছে দেখতে । তালপাখা হাতে বয়স্কমত যিনি অনবড়ত বাতাস করছিলেন তিনি উঠে গিয়ে বিনয়মুন্সীকে বসবার জায়গা করে দিলেন । বললেন, ‘আর সময় বেশী নাই । দুফুরে খাওয়াইন্যার পরে পরে রক্তবমি হইছে । প্রস্রাবও বন্ধ হইয়া গ্যাছে ।’
মুন্সী পাশে বসে ছোট-মা’র মাথায় হাত রাখলেন । গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে । প্রবল জ্বরে আচ্ছন্ন চোখের পাতাদুটি থিরথির করে কাঁপছে । কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম । ছোট-মা চোখ মেললেন, ‘বিনয় ! আইছোস্ ?’
আহ্লাদীর চোখ গাঢ় লাল । জ্বরের কাঠিন্যে তা যক্ষা রোগীর মতই জ্বলজ্বল করছে । মুন্সীর চোখ ভিজে এলো, ‘জ্বি ।’
‘তোরে একটা কথা কমু বিনয় । না কইয়া মরলে সারা জনম দোজখে পুড়মু ।’
‘কি যে বলেন ছোট-মা !’
‘না বিনয় ! তুই জানোছ না ।’
আহ্লাদী হাতের ইশারায় সবাইকে বেড়িয়ে যেতে বললেন । ধীরে ধীরে ঘর খালি হয়ে এলো । আহ্লাদী গলা জাগিয়ে বলতে চেষ্টা করছেন, পারছেন না । শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বোধহয় । বিনয় মুন্সী তার হাত ধরলেন ।
‘তর চিনিরে আমিই নষ্ট করছিলাম ।’, আহ্লাদীর দুই চোখ বেয়ে পানির ধারা নেমে এলো, ‘আমারে তুই ক্ষমা দিছ্ বিনয় !’
বিনয় মুন্সী হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলেন । ছোট-মা কি জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে ? সে স্থির হয়ে বসে রইলো । মুখে কোন কথা ফুটলো না ।
আহ্লাদী খুব কষ্ট করে বলতে লাগলো, ‘লোভ বাজান লোভ ! নক্ষমালার লোভে পড়ছিলাম । আর দ্যাখ আল্লার খেলা, নক্ষমালা যেই গলায় পিন্দনের লইগ্যা এতোকিছু করলাম হেই গলায় আইজ পচন ধরছে । পচন তো না- পাপ ! পাপে ধরছে আমারে ।’
মুন্সী আহ্লাদীর হাতটা আস্তে করে ছেড়ে দিলেন । আহ্লাদীর চোখের জল শ্রাবণের ঢলের মতই উপচে পড়ছে । অনুশোচনার গভীর রং দুই চোখের কনিনীকায় তীব্রভাবে ধরা পড়ছে । আহ্লাদী ভেজা কন্ঠে থেমে থেমে বললেন, ‘মাফ দিওনের না চাছ, দিছ না । আমার একটা কথা রাখ্ বিনয় । নক্ষমালা’ডা তুই লইয়া যা । এইডুক দয়া কর !’
আহ্লাদী বহুকষ্টে ঘাড় তুলে বালিশের আধেকটা সরালো । ঘরের অন্ধকারময় আলোয় সেখানটায় অতি-পরিচিত নক্ষমালাটি নিজের দেহ ছড়িয়ে সূর্যের মতই জ্বলজ্বল করে জ্বলছে !
††
সন্ধ্যা হয়ে এলো । চারপাশ একটুখানিও নিষ্প্রভ হয়নি । বরং আলো বাড়ছে । সব পূর্ণিমায় এতো আলো হয়না । আজ প্রবারণা পূর্ণিমা বুঝি ! সত্যিই তো ! দূর আকাশে কিছু ফানুসের প্রদীপ ভাসছে । দোল খেতে খেতে তারা নিরুদ্দেশ যাত্রা করছে । বিনয় মুন্সী চমকে তাকালেন । চোখের উপর চিনির উচ্ছ্বল মুখটা স্পষ্ট ভেসে উঠলো । সে খুব হাসছে । তার মেঘের মত চুলগুলো দীর্ঘ হয়ে নেমে এসেছে হাঁটু অব্দি । ভ্রূ নাচিয়ে ঘোমটা টানতে টানতে সে বলল, ‘কন্ তো মুন্সী ! ঘর নাইতো দুয়ার বান্দে, মাউগ নাইতো পোলা কান্দে- জিনিসটা কি ? ...’ । বলেই খুব হাসছে । সপ্রেম-সলজ্জ হাসি ।
নৌকা নদীতে পড়েছে । ডাঙর ঢেউয়ে নৌকা প্রবলভাবে দোল খাচ্ছে । বড় মায়াবী লাগছে নদীটাকে । নদীর মধ্যখানে ভরাট সরলরেখা হয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে চাঁদের রূপালী আলো । ছলাৎ-ছল, ছলাৎ-ছল । সেখানটা চকোলেটের রাংতার মতই চকচক করছে । বিনয় মুন্সীর চোখে পানি ভরে এল । কাঁপা-কাঁপা হাতে অতি দ্রুত তিনি তার শাদা পাঞ্জাবির পকেট থেকে হাতরে-হাতরে হারটা খুঁজে বের করলেন । চাঁদের সাতাশটি বৌ যেখানে সাতাশটি মুক্তা হয়ে আটকে আছে যাবজ্জীবন । নক্ষমালা ।
ঝুপ্ করে একটা শব্দ হল কোথাও । মঈনুদ্দীন মাঝি চেঁচিয়ে উঠলো, ‘ও মুন্সী ? হালাইলা কি ? কিছু খুয়াইছো নাহি ?’ । বিনয় মুন্সী ধীরে-সুস্থে গলুইয়ে মাথা ঠেকিয়ে নৌকার পাটায় গা মেলে দিলেন । আকাশের থৈ-থৈ আলোর দিকে তাকিয়ে ক্ষীণক্ষুদ্র স্বরে বললেন, ‘সব’ । কেউ তার সেই কথা শুনতে না পেলেও তার কাছে মনে হল, সবাই যেন সব শুনে নিয়েছে ! গভীরভাবেই মনে হল । অপাঙক্তেয় হারটিকে ফেলে দিয়ে তার বড় শান্তি লাগছে ।
________________________________
টীকাঃ
১. ম্যালা করা = যাত্রা করা
২. হাডা = হাঁটা
৩. এউক্কা = একটা
৪. দ্যাহো = দ্যাখো
৫. শোলোক = শ্লোক / ধাঁধাঁ
৬. আম্নে = আপনি
৭. দ্যাঁড়া = বোধশূণ্য
৮. হুইতে = শুতে
৯. বোজ্জেন = বুঝেছেন
১০. আম্মেরে = আপনাকে
১১. বুইঝগা = বুঝে
১২. অ্যাচ্চা = এদিকে তাকা
১৩. আইনগা = এনে
১৪. ব্যান = ভোর
১৫. ব্যাকগুন = সবগুলি
১৬. ব্যামালা = বিশাল
১৭ . ওডো = ওঠো
১৮ হ্যাতে = সে
১৯ তত্তরী = তাড়াতাড়ি
উৎসর্গঃ
‘নক্ষমালা’ গল্পটি লেখার পেছনে একটি গল্প আছে । সেই গল্পটি না বললেই নয় । কিছুদিন আগে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি, যাবার আগের দিন রাতে একজন প্রিয়ভাষিণী আত্মীয়া ব্লগারের সাথে চ্যাটবক্সে কথা হল । তিনি বেশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি ঐ অঞ্চলের ভাষা কেমন জানেন ?’
আমি বললাম, ‘তেমন পারি না । তবে দু-একদিন শুনলেই বলতে পারবো । কেন ?’
তিনি বললেন, ‘যাচ্ছেন যখন- ঐ অঞ্চলের সবকিছু মিলিয়ে একটা গল্প লিখে ফেলুন ।’ আমি ভেবে দেখলাম- চমৎকার আইডিয়া । প্রিয় জায়গাটিকে লেখায় তুলে আনবার যে প্রগাঢ় আনন্দ পাওয়া যাবে তার কথা ভেবেই মন কেমন হয়ে গেল । গ্রামে যতক্ষণ ঘুরেছি- আমার মাথায় ঘুরঘুর করেছে গল্প । গ্রামীণ জীবনযাত্রা, সৌন্দর্য, সংলাপ, অনন্যতা সবকিছু দেখতে চেষ্টা করেছি একজন লেখকের চোখ দিয়ে । সত্যিই পেরেছি কিনা কে জানে !
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আহ্লাদী, চিনি, বিনয়, রফিক চরিত্রগুলি সত্যি-সত্যি এক্সিস্ট করেছিল । মেহেন্দীগঞ্জের লেঙ্গুটিয়া নামের একটি নদীতীরবর্তী অঞ্চলে ছিল তাদের বাস । গহনার লোভে পরে করা উক্ত ঘটনাটির ব্যাপারে আমি শুনেছি আমার নানীজানের মুখে । তিনি আমাকে যে গল্পটি বলেছিলেন, ‘নক্ষমালা’ তারই প্রেক্ষাপটে সেজে উঠেছে । যদিও আমি চেষ্টা করেছি মূল চরিত্রগুলিকে আমার নিজের মত করে সাজাতে । কিছু কিছু ঘটনা আমার নিজের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি বলে ঐভাবে ফোকাস করিনি- টান দিয়ে লিখে দ্রুত অন্য প্লটে সরে গেছি ।
গল্পে অনেক আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছি । কিছু শব্দে পাঠক বিভ্রান্ত হবেন ভেবে নিচে টিকা যুক্ত করে দিলাম । অনেকে অনুযোগ করে বলতে পারেন, গল্পের আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার ঠিকমত হয়নি- ‘আমি’-‘আমরা’ ইত্যাদি বারবার ব্যবহার করা হয়েছে । বরিশালের বিখ্যাত ‘মুই’-‘মোরা’ গল্পে পুরোপুরি অনুপস্থিত । তাদের জন্য অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলছি, আমি খোঁজখবর করে যতদূর জেনেছি- আমার নানা-নানীর বাবার আমলেও লেঙ্গুটিয়ার মানুষজন ‘মুই’-‘মোরা’ ব্যবহার করেনি । যদিও আমার দাদাবাড়ির লোকেরা এখনো মুই-মোরা ইত্যাদি সর্বনাম অহরহই ব্যবহার করছে ।
সবশেষে, গ্রামীন জীবনের গল্পগাঁথা লিখবার ভুত যিনি মাথায় চাপিয়েছেন ‘নক্ষমালা’ তাঁর জন্যেই দিলামঃ
উৎসর্গঃ জোবায়েদা হুসাইন , প্রিয়ভাষিণী !