বাবার পায়ের নিচে স্বর্গ আছে কি না প্রাতিষ্ঠানিক কোন ধর্মেই সে রকম কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই বাবার পায়ের নিচে কি আছে সে বিষয় নিয়ে সবার মাথা ব্যাথা একটু কম-ই। কারন মানুষ তার এক জীবনে বাবার পায়ের উপরে কি আশ্চর্য ক্ষমতা আছে তার-ই হিসেব মেলাতেই হিমশিম খায়।
আমার বাবার পা দুটোও আর সকলের বাবার মতো আশ্চর্য ক্ষমতাবাণ। কখনও কখনও তার চেয়ে বেশি। সেই হাটতে শেখার সময়টাতে বাবা তার পায়ের উপর আমার পা রেখে আমাকে শিখিয়েছেন হাটতে শেখার বিষয় আশয়। আমি এখন হাটতে পারি।
বাবা, আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।
২.
শৈশবে আমরা যেখানে থাকতাম সেখান থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ী যাওয়ারটা ছিল ব্যাপক যন্ত্রণাময় কাজ। একদম অজোপাড়া গায়ে বাড়ী হবার কারণে সেখানে যাবার পথে একটা বিশাল অংশ আমাদের হেটে যেতে হতো। সবাই হেটে যেত। আমি হাটতাম না। আমি থাকতাম বাবার কোলে। বাবা আমাকে নিয়ে বিরামহীন হেটে যেতেন মাইলের পর মাইল। ঐ সময়ে তেমন করে বুঝতে পারিনি বাবার কষ্ট হচ্ছে কি না? আমি হাটতাম না কারন হাটলে আমার পা ব্যাথা হয়ে যেত। আমি আমারটা বুঝলেও সেটা বুঝতাম না আমার বাবার পায়েও ব্যাথা হয়তো হয়।
আমরা প্রতিবছর ঈদ এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান মিলিয়ে বেশ ক'বার বাড়ি যেতাম এবং যাওয়া আসায় বরাবরই-ই দৃশ্য একটাই ছিল। বাবা আমাকে কোলে নিয়ে হাটছেন।
বাবা, তোমার কষ্টগুলো সে বয়সে আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি। তুমি আমাকে কষ্ট করতে দাওনি।
বাবা, আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।
৩.
আমার বাবা পেশাগত জীবনে আইনজীবী। বাবা প্রতিদিন কোর্ট থেকে ফিরে ক্লান্ত থাকে। প্রচন্ড পরিশ্রমে তার এই ক্লান্তি। এই পরিশ্রমের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে হাটাহাটি। প্রচুর হাটতে হয় তাকে। এ রুম থেকে ও রুম। এ বিল্ডিং থেকে ও বিল্ডিং। এখানেও মুক্তি নেই তার। কোনও উপায়ও নেই না হেটে। পেশার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়েছে এ হাটাহাটি। পেশার অন্য দিকের সাথে এ গতিময়তা আমাদের অন্ন যোগান দেয়। আমরা ভালো থাকি।
বাবা, আমাদের ভালো রাখতে তোমার এই পরিশ্রমে আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।
৪.
অনেকটাদিন পার হয়ে একটা পর্য়ায়ে চলে এসেছি। দুঃখজনক হলেও সত্য বাবার পায়ের উপর ভর দিয়ে চলার এখনো সমাপ্তি টানতে পারিনি। সে বয়সে নিজের পায়ে দাড়ানোর কথা সে বয়সেও আছি বাবার শক্ত পায়ের ভর-ই।
বাবা, এখনো এভাবে রেখে চলছ। একেবারের জন্যও দিচ্ছ না নিজের পায়ে দাড়ানোর তাগিদ।
বাবা, আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।
৫.
বাবার পায়ের আশ্চর্য ক্ষমতায় আমি এখনো ভালোভাবে বেঁচে আছি। বাবার পা দুটো আমাকে প্রতিনিয়ত ভাবায়। ইচ্ছে করে যখন তখন এই পা ছুঁয়ে যাই। ধরে থাকি। বয়সের কারনে সে কাজ খুব একটা হয়না। তারপরও আমি তা স্পর্শ করার চেষ্টা করি। ভালোবাসায়, কৃতজ্ঞতায়। কারন, এ পায়ের মতা আমার চেয়ে কে ভালো বোঝে? কে জানে?
৬.
আমার বাবার জীবনে এক অদ্ভুত ঐতিহ্য আছে। আমার বাবার স্যান্ডেল কখনো পুরোনো হয়না। আমরা কখনো বাবার পায়ে তেমন পুরোনো স্যান্ডেল দেখিনি। কখনো এমন দেখিনি যে আমার বাবা তার ছেড়া স্যান্ডেল ফেলে দিচ্ছেন। আমার বাবার স্যান্ডেল কখোনোই ছেঁড়ে না।
আমি জানিনা বিষয়টা কে কিভাবে নিবেন? কিন্তু কথা সত্য এবং ধ্রুব সত্য।
বিষয়টাকে যে কেই বিস্ময়কর হিসেবে ধরতে পারেন। কেউ ধরে নিতে পারেন অলৌকিক হিসেবেও। তবে না ধরাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কারন এটি ধারাবাহিক হলেও সাধারণ ঘটনা। ঘটনাটা হচ্ছে বাবার স্যান্ডেল একটা প্রায় নির্দিষ্ট সময় পরে চুরি হয়ে যায়। আর দুঃখজনক হলেও সত্য কথা, চুরিটা হয় অধিকাংশ সময়ই কাকাতালীয়ভাবে মসজিদ থেকে।
তবে খুব একটা সমস্যা হয়না বাবা সযত্নে আরো এক জোড়া এক-ই ডিজাইনের স্যান্ডেল কিনে আনেন। কিছুদিন পড়েন আর অপেক্ষায় থাকেন আবার নতুন এক জোড়া কিনে আনার।
৭.
বাবার পা দুটোর মহাত্ম বলার সাথে এই স্যান্ডেল চুরি যাওয়ার ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই। তারপরও বলতে ইচ্ছে হলো, কারন কিছুদিন আগে কোন এক জায়গায় পড়েছিলাম রবীন্দ্রনাথেরও এক সময় নাকি প্রচুর কলম চুরি হতো। কেন চুরি হতো, না জানা গেলেও ধারণা করা হয় রবীন্দ্রনাথেরও লেখার মহাত্ম নিজেদের মাঝে আনার চেষ্টা হয়তো।
আমি ভাবি কিন্তু অবাক হই না।
কারন রবীন্দ্রনাথ বিশ্বব্যাপী পরিচিত। এটা সম্ভব।
কিন্তু আমার বাবা একজন সাধারন, অপরিচিত মানুষ। তার স্যান্ডেল কেন চুরি হয়?
চোরগুলো তবে কি তার পায়ের মহাত্ম জানে?
আমি ভাবি এবং অবাক হই।
( আজ আমার বাবার জন্মদিন। এই দিনে তার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসায়। দীর্ঘজীবন কামনায়।)