ভার্সিটি বন্ধ । কেন বন্ধ, সে নিয়ে আর কথা না বলাই ভাল । কবে খুলবে তারও কোন ঠিক ঠিকানা নেই । আবার ছোট ভাই দুটোরও বন্ধ । কাজিনের বিয়ে হবার জন্যে এর চাইতে উপযুক্ত সময় বোধ হয় আর হয় না । প্রায় তিন বছর পরে বাসার সবাই মিলে কোথাও যাচ্ছি । মজার ব্যাপার হল, শেষ বারও বিয়ের অনুষ্ঠানেই একসাথে সবাই বের হয়েছিলাম । সাত দিনের ভেতরে তিন তিনটা কাজিনের বিয়ে হয়েছিল সেবার ।
ভাইয়াকে দেখে একটু মায়া-ই হল । বেচারা ! বিয়ের আগে একজন মানুষ যে এত নার্ভাস হতে পারে , ভাইয়াকে দেখে জানলাম । তার উপরে চাচাতো ভাইদের মাঝে সেই বড় ; ‘বংশের বড় ছেলে’ বলে কথা ।
দাদু বাড়ি গ্রামের ভেতরে, রাজশাহীতে । তবে গ্রামটা একেবারে অজপাড়া গাঁ না, এমনকি ডিশও আছে অনেক বাড়িতে । যোগাযোগ ব্যবস্থা সবসময় ভাল । যদিও হাতে গুণে বলে দিতে পারব ঠিক কয়দিন দাদুবাড়িতে থেকেছি, তবুও যখনি এখানে পা রাখি , তখন বুঝতে পারি এই জায়গাটাকে কতটা ভালবাসি । আমার স্কুল ছিল ব্রাক্ষণবাডিয়াতে আর কলেজ, ভার্সিটি ঢাকাতে । যখন দূরে থাকি তখন কেন জানি এই আকর্ষনটা কখনোই অনুভব করি না ।
কিছু ভালবাসা বোধ হয় কাছে আসলে বোঝা যায় । আর কিছু ভালবাসা বোঝা যায় দূরে গেলে ।
বিয়ে হবে নাটোরে । শুরু থেকেই ঝামেলা সংগী হল । ‘বরবাহী’ মাইক্রোর সাথে ট্রাকের হালকা সংঘর্ষ ; এর পরে ট্রাকের ড্রাইভারের সাথে মাইক্রোগুলোর ড্রাইভারদের ‘সুমধুর’ আলাপন , বরের জন্যে বরাদ্দ শরবতে ঝালের পরিমান ‘দুঃখজনক’ভাবে ‘অস্বাভবিক’ বেশি [ তিনজন শ্যালিকার সবাই ভেবেছে , সে একাই মরিচের গুড়ো মিশিয়েছে ] , এর পরে আরো কিছু ‘ট্রেডিশনাল’ বিয়ে বাড়ি ঝামেলা মিটিয়ে বাড়ি ফেরা ।
আমার আরেক কাজিন কয়দিন হল বাইক কিনেছে । রেজিস্ট্রেশন কমপ্লিট হয়নি , ড্রাইভিং লাইসেন্সের তো প্রশ্নই আসে না । বিয়ের দিন অনেক ‘ভাব’ নিয়ে সে বাইক নিয়ে বের হয়েছে । ফেরার পথে সে আর তার এক ফ্রেন্ড একটু পরে রওনা হয় । এদিকে হাইওয়েতে মোবাইল কোর্ট – হঠাৎ সব বাইক আর মাইক্রো থামিয়ে কাগজ-পত্র চেক করা শুরু করেছে । ভাইয়াকে যে ফোন করে অন্যদিক দিয়ে আসতে বলব, সে উপায় ছিল না, বিয়ে বাড়িতেই ওর ফোনে চার্জ শেষ ।
অনেক দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি পৌছে দেখা গেল ও আমাদের আগেই এসে বসে আছে । হঠাৎ জটলা দেখে একটু সতর্ক হয়েছিল , এবং কিভাবে ‘হাইওয়ে পারস্যুয়েট’ খেলে সে বাড়ি পৌছিয়েছে সে কথা বড় গলাতে বলে বেড়াচ্ছে । [ তবে ওর কথা বিশ্বাস করবেন না , কারন প্রতি বারেই গল্পটা আগের চাইতে রোমাঞ্চকর হয়ে উঠছে । ]
আমার চাইতে ৫-৬ বছরের ছোট কাজিন গুলোও যখন আমাকে বাইকে ডাবলিং করতে বলে তখন আর সহ্য করতে পারলাম না । ওদের থেকে বড় বলে বড় দেখে একটা বাইক নিয়ে শুরু করলাম । ‘কাজতো খুব্বি সোজা’ ক্লাস নাইন পড়ুয়া আমার এক কাজিন, পাপ্পু, অতি উৎসাহে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে , ‘তুমি প্রথমে কিক করে স্টার্ট কর , এর পরে ক্লাচ চেপে গিয়ার দাও , এর পরে ধীরে ধীরে ক্লাচ ছাড় আর অ্যাক্সিলারেট কর । দেখবা ওটা একা একাই চলবে ।’ একটু থেমে টেনে টেনে বলল, ‘এক্কেবারে ই-জি ।’
সুপারি গাছে ধাক্কা খেয়ে ১টা মিরর ভেঙ্গে ক্ষান্ত দিলাম । তাও ভাল বাইকটা নিয়ে পুকুরে পড়িনি । পাপ্পু ভাগ্যিস হাসে নি । নইলে কয়টা দাত ফেলে দিতাম । ইজি ! হুঁহ !
বাড়িতে সবাই নতুন বউ নিয়ে খুব্বি ব্যস্ত । ততক্ষনে রাত বেশ গাঢ় হয়ে এসেছে । এক ফাঁকে চুপ করে বের হয়ে এলাম । পুকুরপাড়ে বাঁশঝাড়ের পাশে ছোট্ট মাঠে শুয়ে আছি । জায়গাটা আমার খুব্বি প্রিয় । রাত আরেকটু ঘন হয়ে আসতেই চারদিকে ঝিঝি পোকার ডাক , আর জোনাকীদের মেলা । মাথার উপরে তারার বন্যা । আকাশের তারা গুলো এভাবে কাছে টানে কেন ! তারাগুলো গণতে গণতে সেই পুরানো প্রশ্নগুলো ফিরে আসল । কোথায় চলেছি আমরা ! আসলে জীবন থেকে কি চাই আমি ?
দূরে কেউ নাম ধরে ডাকছে । আমার অনুপস্থিতি চোখে পড়েছে ওদের । হয়ত নতুন আত্মীয়দের সাথে ঘটা করে পরিচয় করে দেওয়া হবে । উঠে দাঁড়ালাম । কিন্তু প্রশ্নগুলো ঘুরতে থাকল মনে ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:৩৪