স্পষ্টত বাংলাদেশ আজ ২ ভাগে বিভক্ত। জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টার পক্ষে ও বিপক্ষে। এখন সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্ন, যে প্রশ্নে আমি নিজেই হতভম্ব। তা হলো,"কী করে মানুষ অন্য মানুষের উপর হামলার পক্ষে যায়?"
একজন দুইজন নয়। হাজার হাজার মানুষ জাফর ইকবালের মৃত্যু কামনা করে তাও বেআইনী উপায়ে। একটা মানুষ যখন নিজেকে খুন জখম এর পক্ষপাতী বলে পরিচয় দেয়, অন্যায় এর পক্ষে গিয়ে রাজপথে আন্দোলন করে, আমি তার উপর ব্যক্তিগত ভাবে রাগ হতে পারিনা। আমি শুধু হা হয়ে থাকি। অবাক হয়ে ভাবি, অন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যেও আন্দোলন হতে পারে!!
আমার সবসময়ই ধারণা ছিল, মানুষ নিজের বিশেষ সুবিধা ছাড়া কখনো ভালো এবং সত্যের বিপক্ষে অবস্থান করেনা, অন্তত করা উচিত না। কিন্তু গত কয়েক বছরে আমার ধারণা পাল্টাতে বাধ্য করেছে ওরা।
আমার মনে আছে ছোট বেলায় ইরাক যুদ্ধ দেখেছি টিভিতে। আমি, আমার পরিবার সহ বাংলাদেশের প্রায় সবাই ইরাকিদের জন্য সহানুভূতিশীল ছিলাম। আমরা দরিদ্র দেশ অন্যদিকে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম) এর সদস্য। তাই দেশের প্রতিটা মানুষের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ইরাক আমাদের থেকে তেমন কোন সাহায্য পায়নি। একইভাবে ফিলিস্তিন, লিবিয়া, সিরিয়া তে যখন ছোট ছোট বাচ্চাদের পর্যন্ত রক্তাক্ত করা হয়, নরপিশাচেরা গর্ভবতী মায়েদের পর্যন্ত ছাড় দেয় না, এই বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-নাস্তিকেরা সবাই কষ্ট পায়। চলমান রোহিঙ্গা সঙ্কটে আমরা দেখতেই পেয়েছি, রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে যেমন সাহায্য করেছে মসজিদ গুলো, তেমনি মন্দির থেকেও ত্রাণ পাঠানো হয়েছে। প্রবারণা পূর্ণিমা পালন না করে দেশের বৌদ্ধরা সব টাকা পাঠিয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। শিখরা গুরুনানকের দরবার থেকে সাহায্য পাঠিয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চও বসে ছিল না। এই বিষয় স্পষ্ট যে বিশ্বের যেখানে যখন মুসলিম গণহত্যা হয়েছে, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের মানুষ একজোট হয়ে গণহত্যার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
কিন্তু যখনই প্রশ্ন এসেছে বিশ্ব মানবতার, এই দেশের কিছু সুবিধাবাদী কাঠমোল্লারা আমাদেরকে ইসলামের দোহাই দিয়ে প্রতারিত করেছে। গতবছরের আগস্টে টেক্সাসে হারিকেনে ১২০০ এর বেশি মৃত্যু হয়েছিল। আমার বাবা নিউজ দেখে বলছিলেন, আহারে আহারে। কিন্তু কয়েক ঘন্টা পরই তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার পর তার মতামত পালটে যায়। খ্রিস্টান যখন মরেছে, ভালোই হয়েছে।
২০১৬ সালে ইসরাইলে যখন দাবানল হল, আমি দেখলাম বাংলাদেশে যেন উৎসব শুরু হল। সবাই দাবানলে খুশি। সেখানে শুধু ইহুদি নারী পুরুষই কি পুড়েছিল? ২ মাসের নিষ্পাপ শিশুরা দগ্ধ হয়নি? সে তো ইহুদি ছিল না। তার মৃত্যতে আমাদের নাচতে হবে?
নেপালের ভূমিকম্পেও নিউজ পোর্টালের কমেন্টগুলো চেক করে অবাক হতে হয়। মন্দিরের দেশে গজব পড়েছে, মালাউনরা মরেছে তাই সবার খুব খুশি লাগছে মনে।
আমরা ছোটবেলা থেকেই পাঠ্যবইয়ে মানবতার গল্প-কবিতা পড়ে বড় হই। কিন্তু আমাদের হুজুর সমাজ আমাদের শেখায় এই মানবতা শুধু মুসলিম দের বেলায়। সাধারণ মানুষ যদি কোন কারণে বিধর্মীর মৃত্যতে শোক প্রকাশ করে, তাদেরকে লাল সালুর মত ব্রেইন ওয়াশ করে বোঝানো হয় বিধর্মীরা অমানুষ। মরেছে ভালো হয়েছে।
এটাই কি ইসলাম? বিশ্ব মানবতার শান্তির প্রতীক ইসলাম এর কি এই রূপ দিয়েছিলেন আল্লাহ? আমার বিশ্বাস হয়না আল্লাহ এই ধর্ম আমাদের দিয়েছেন। আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন কুরআন ও একজন মহাপুরুষের আদর্শ। সেসব ছেড়ে যদি আমরা ফাজায়েলে আমল নিয়ে বসে থাকি, অবস্থাতো এমন হবেই। এটাই পার্থক্য ইসলাম ও বাংলাদেশি ইসলামের। আল্লাহ আমাদের মদিনা ও সত্যিকারের ইসলামের পথে পরিচালিত করুন।
আর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তার উপর হামলার পক্ষপাতী হওয়া আর ইসরাইলে দাবানলে খুশি হওয়া কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যে চেতনা আমাদের দেশের মুসলমানের একতরফা মানবতার ইন্ধন জুগিয়েছে, সেই চেতনাবলেই আজ তারা জাফর ইকবালের মৃত্যু চায়। অধিকাংশ লোকই এমন যে তারা জানেই না জাফর ইকবাল লোকটা কে! জীবনে কী ত্যাগ স্বীকার করেছেন জাফর ইকবাল। তারা শুধু হুজুরদের মুখে নাস্তিক শব্দটা শুনেছে, আর কিছু শোনার প্রয়োজন নেই। এবার জাফর ইকবালের কল্লা চাই।
কিন্তু জাফর ইকবাল কি কোনদিন বলেছিলেন, আমি নাস্তিক? নাকি তার লেখা কোনভাবে বাস্তুবাদের সাথে সম্পর্কিত?
লোকে প্রশ্ন করে জাফর কেন মুক্তিযুদ্ধ করেনাই? এতো যখন দেশপ্রেম, যুদ্ধ করলো না কেন?
১৯৭১ এ তার বাবা শহীদ ফয়জুর রহমান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেন। তার দাম তাকে দিতে হয়েছে দেলোয়ার হোসেন সাইদীর সাহায্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়ে। জাফর ইকবালের মা বিশ্বাস করেন নি, কেউ তার স্বামীর মত ভালো মানুষকে হত্যা করতে পারে। তখন জাফর ইকবাল ও হুমায়ূন আহমেদ কে নিজের বাবার কবর খুড়ে, নিজের বাবার সেই বিভৎস লাশের চেহারা দেখতে হয়েছিলো।
তখনও সাইদীর লোকজন ফয়জুর রহমানের পরিবারকে হত্যা করার জন্য খুজছে। ৬ সন্তানের জননী আয়শা ফয়েজ তখন কী করবেন, কোথায় যাবেন তা আমি ভাবতে পারিনা। শুধু মনে হয়, সেই জায়গায় আমার মা থাকলে কী করতেন? এতগুলো বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কোথায় পালাতেন?
৩ ভাই, ৩ বোন আর মা এই ৭ জনের দল নৌ পথে এদিক সেদিক পালিয়ে বেড়াতে থাকে, সাথে শুধু শুকনো চিড়া। যারা আজ প্রশ্ন করে জাফর ইকবাল কেন মুক্তিযুদ্ধ করেন নি, তারা কি একটা বার ভেবে দেখেছে মা আর ছোট ভাইবোনদের নিয়তির হাতে ফেলে যুদ্ধে যাওয়ার পরিণাম কী হতো! মা যখন কেদে কেদে অন্ধ হতে বসেছেন, ৩ টি বোন আর ১ টি ছোট ভাইয়ের যখন খাবার জুটছে না, তখন মা ও পরিবারকে ত্যাগ করা কি তার উচিত ছিল?
যুদ্ধের পরের বছর জাফর ইকবাল ঢাবির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ৭৬' সালে মাত্র ২ নম্বরের ব্যবধানে তিনি মেধা তালিকায় ২য় স্থান পান। দরিদ্র জাফর ইকবাল মেধাবলে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। ক্যালটেকে পড়াশুনা শেষে বেল কমিউনিকেশন রিসার্চে চাকরি করেন। চাইলেই বাকি জীবনটা মোটা বেতনে চাকরি করে কাটেতে পারতেন। কিন্তু দেশের সেবার উদ্দেশ্যে সব লোভ ছেড়ে এখানে বাংলাদেশে কোপ খেতে আসেন। সেই ৯৫ সালেই মৌলবাদীরা তাকে 'মুরতাদ' নাম দেয়। কেন সে মুরতাদ এই প্রশ্ন মৌলবাদীদের করা হলে তার উত্তর তারা দিতে পারবেনা। কিন্তু তাদের মনের কথা এই, "জাফর ইকবাল বেচে থাকলে যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাবেই, সুতরাং তাকে আগেই শেষ করে দেওয়া হোক"। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের ভয়ের ধারাবাহিকতাই আজ জাফর ইকবালের উপর ছুরিকাঘাত।
যে ঘাতক জাফর ইকবাল কে মেরে ফেলতে চাইলো, সেই ঘাতককে বাচাতে মুমূর্ষু অবস্থাতেও জাফর ইকবাল সবাইকে বলে গেলেন, তাকে যেন না মারা হয়। এটাই পার্থক্য মানুষ ও অমানুষে।
ঘাতকের মতে নাস্তিক হবার কারণে ছুরিকাঘাত, অথচ জাফর ইকবাল নাস্তিক নন। যদি নাস্তিক হওয়া অপরাধই হয়, আর নাস্তিকতার শাস্তি মৃত্যুদন্ড হয় তবে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে কেন কোপানো হচ্ছেনা? রাশেদ খান মেনন এমপি বা সাবেক মন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়াকে কেন কোপানো হয় না? দেওয়ানবাগী পীর বা হাসানুল হক ইনুকে কেন ছুরিকাঘাত করা হয়না? এরা সবাই তো নাস্তিক। এদের কেউ মৃত্যু চায়না কেন?
উত্তর খুব সহজ। নাস্তিকতা বা আস্তিকতার জন্য কখনোই কাওকে কোপানো হয়না। যখন যেখানে যে কেউ বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য কাজ করবে, যখন কেউ ভন্ড পীর ও কাঠমোল্লাদের ব্যবসা বন্ধ করবে, যখন কেউ বাংলায় কুরানের অর্থ পড়ার উপর জোর দিবে ও বই পড়াতে মানুষকে উৎসাহ দিবে তাকেই শেষ করে দিতে হবে। আর এ কথা সবাই জানে জাফর ইকবাল সাহেব, বাংলাদেশে তরুণ ও কিশোর পাঠক তৈরী করতে কতটা ভূমিকা রেখেছেন। সবাই জানে কার হাত ধরে বাংলাদেশের শিশু কিশোর বিজ্ঞান মনস্ক হয়েছে। কার হাত ধরে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে পুরস্কার ছিনিয়ে এনেছে। দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করার পরিণাম বঙ্গবন্ধু ও শহীদ জিয়া আগেই প্রমাণ করেছেন, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপর হামলা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির স্মারক মাত্র।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৩:৫৫