গতকাল থেকে মনটা ভালো নেই। খবরটি পড়বার পর থেকে। এতো বড় ব্যবধানে বাংলাদেশ হারালো সাউথ আফ্রিকাকে, সেই জয় মন ভালো করে দিতে পারলো না আমার। বারবার ঘুরে ফিরে আমার মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে একটা ছোট মুখ, একটা স্ট্যান্ডের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা একটা বাচ্চার মুখ।
রাজন মরে গেছে। বেঁচে থাকার অনেক আকুতি নিয়ে সে মরে গেছে। চারপাশে যারা ছিলো, তাদের মাঝে সে ব্যাকুল হয়ে খুঁজছিলো একটি মাত্র হাত। একজন, মাত্র একজন মানুষ এগিয়ে এলে হয়তো রাজন আবার ফিরে যেতে পারতো তার ঘরে, রাতে মায়ের কাছাকাছি শুয়ে ঘুমাতো। মাত্র একজন মানুষ এগিয়ে এলে রাজন আজকে আবার নিশ্বাস নিতে পারতো। যে নিশ্বাস নিয়ে এখন আমরা বেঁচে আছি সবাই। একটা বাচ্চার কাছ থেকে সেই নিশ্বাস কেড়ে নেওয়াটা আমাদের সবাইকে অপরাধী করে দেয়।
রাজন মরে গেছে। মরে যাওয়ার আগে সে কি ভাবছিলো তার মায়ের কথা? সে নিজেও ভাবে নি সে এবার আর ঈদ দেখবে না। তার বাবা ভাবে নি, বাচ্চাটার জন্য এবার আর কোনো কাপড় কিনতে হবে না। এবার ঈদের দিন তার বাড়িতে রাঁধা হবে না কোনো সেমাই। শুধু তার মা মাঝে মাঝে আঁচলে চোখ মুছবে নিঃশব্দে। তাতে অবশ্য কারোই কিছু যায় আসে না। সবার ঈদ আসবে, তারা আনন্দ করবে। শুধু এই বাড়িটার কথা সবাই ভুলে যাবে।
কে বেশি দোষী? যে মানুষগুলো, যারা পিটিয়ে পিটিয়ে তাকে মেরে ফেললো? নাকি যারা এগিয়ে না এসে ভিডিওতে ধারণ করলো পুরো দৃশ্য? নাকি রাষ্ট্র ব্যবস্থা, যাতে এরকম হত্যাকাণ্ড ঘটে? আমার মনে হয় না- যে বা যারা ভিডিওটি ধারণ করেছেন, তাদের কাউকেই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। তারাও রাজনের হত্যাকারী। বিশ্বজিতের হত্যা দৃশ্যও এভাবে ধারণ করা হয়েছিলো। কেউ এগিয়ে আসে নি। তাদের বিচারও হয় নি।
মানুষের মধ্যে এক অদেখা পশুর বসবাস, অতি গোপনে। সময়ে অসময়ে সে বের হয়ে আসে। আগে দেখেছি রাস্তায় ছেলেরা কুকুরের বাচ্চার লেজে দড়ি লাগিয়ে হিড়হিড় করে টানতে টানতে মেরে ফেলে, কিছু মানুষ পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে মেরে ফেলেছে বিড়াল। এগুলোকে হার মানানো হিংস্রতার এক ভিন্ন এক রুপ দেখি যখন মানুষ এভাবেই মেরে ফেলে আরেকটা মানুষ। এসব কিছুই মানব সুলভ আচরণ নয়; পশু প্রবৃত্তি। জন্তু জানোয়াররা একে অন্যকে হত্যা করতে পারে- তাদের বুদ্ধিমত্তা নিম্নপর্যায়ের। তাদের কোনো বোধ নেই, বিচার বুদ্ধি নেই। মানুষের তা ছিলো। অথচ তার প্রমাণ আশেপাশে দেখি না।
রাজন নামের বাচ্চাটিকে মেরে ফেলা হলো গতকাল। রাজন কি শুধু একজন? আর কেউ মরে নি এভাবে? একবার পিছে ফিরে তাকাই, দেখবো এরকম মরে যাওয়া অজস্র মুখের ভিড়। আমরা পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছি। আমরা বিনা দোষে হত্যা করেছি। আমরা ধর্মের দোহাই দিয়ে হত্যা করেছি। কলহ, বিবাদ, অপহরণ। সীমান্তে নির্বিচারে মরে যায় কতো। রাষ্ট্রযন্ত্র থাকে রাষ্ট্রযন্ত্রের মতো নির্বিকার। কারোই কিছু যায় আসে না। শুধু যার যায়- সে বোঝে।
কাল একটি বাচ্চা মারা গেলো, প্রবল মার সহ্য না করতে পেরে। আমাদের আশেপাশে প্রতিদিন এভাবে অসংখ্য শিশু নির্যাতনের শিকার হয়। ঘরে, বাইরে। বাসার কাজ করতে গিয়ে এখনো অজস্র কিশোর কিশোরী প্রতিদিন নির্যাতনের শিকার হয়। আমরা কি তাদের খোঁজ রাখতে পেরেছি? অকালে কতো রাজনই ঝরে যায়।
যে রাজন আজ মরে গেলো, আমরা হয়তো তার খুনিদের শনাক্ত করতে পারবো, আইনের আওতায় এনে বিচার করতে পারবো। কিন্তু বাচ্চাটাকে কি তার জীবনটা ফিরিয়ে দিতে পারবো? পারবো তার মৃত্যুর সময়টিতে অবর্ণনীয় কষ্টগুলো মুছে দিতে? আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মরে যাওয়া একটা বাচ্চাকে তার জীবনের সব সুখ আহ্লাদ ফিরিয়ে দিতে? তার হয়তো আরও অনেকগুলো বছর বেঁচে থাকার কথা ছিলো।
রাজনের খুনিদের গ্রেফতার করা হয়েছে, একজনকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। আমরা খুব দ্রুত রাজন হত্যার বিচার চাই। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে একটা বিচার দেখতে চাই, যা হবে খুব বেশি দৃষ্টান্তমূলক। ভবিষ্যতে কোনো অমানুষ যেনো কোনো মানুষের গায়ে হাত তুলতে না পারে, তার নিশ্চয়তা চাই। আমরা এই রাজনকে আর ফিরে পাবো না, কিন্তু আর কখনো এভাবে কোনো রাজনকে হারাতে চাই না।
তবে আমি মনে করি, একটি বোধশক্তি হীন সমাজে বিচার প্রতিষ্ঠাই সর্বস্ব নয়। আমাদের মূল্যবোধের মাত্রা সংস্কার করার প্রয়োজন আছে। মানুষের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিমা, মায়া- দয়া, এগুলো একদিনে শেখানো যায় না। শুধুমাত্র বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেও লাভ নেই যদি একজন মানুষকে যথোপযুক্ত মূল্য আমরা না দিতে শিখি। আমরা মানুষ, কিন্তু আমাদের আরও মানুষ হয়ে ওঠার প্রয়োজন আছে।
আসুন। আমরা সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠি। রাজন হত্যার বিচারের জন্য হাতে হাত রেখে উঠে আসি। কেউ এগিয়ে এলো না বলে রাজন মরে গেছে। কেউ এগিয়ে না আসলে রাজন হত্যার বিচারও হবে না। আমরা যদি আরও নির্বিকার থাকি, তাহলে ওই চিত্র ধারণকারী পরোক্ষ খুনিদের সাথে আমাদের কোনো পার্থক্য নেই। আমরা এমনিতেই অনেক অপরাধী হয়ে গেছি, আর অপরাধী হতে চাই না।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৩:২৮