সে ছিলো অদ্ভুত।
হ্যাঁ, এই একটি বিশেষণই তার জন্য বেশ মানানসই- অন্তত প্রথম দেখাতে একবার হলেও মনে হবে ব্যাপারটা, যে কিছু একটা অস্বাভাবিকতা আছে তার মধ্যে; এবং সেটা ঠিক কী, আপনি ধরতে পারবেন না। মানুষ হিসেবে সে যথেষ্টই শুকনো এবং ঢ্যাঙা, অনেকটা তালগাছের মতো, মুখ ভর্তি কয়েকদিনের শেভ না করা দাড়ি, পরণে একটা কালো কোট; অন্তত তাকে দেখলে একজন বিষণ্ণ মানুষ বলে মনে হয়- কিন্তু তার চোখ দুটো ছিল অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল। আমার অবাক লাগে, যুদ্ধের এমন সময়েও একজন মানুষের চোখে এতোটা উজ্জ্বলতা থাকে কীভাবে?
গোটা শহর সারাদিন এক ধরণের ক্লান্তি নিয়ে অপেক্ষা করে। যেন আর কিছু নয়- পুরো শহরটাই একজন বিধ্বস্ত মানুষ। কে জানে- হয়তো আরেকটু পরেই নিস্তব্ধতার বুক চিড়ে আবারও বের হয়ে আসবে আর্তনাদ। আমাদের নিঃশ্বাস আটকে যেতে চায় বারবার; নিঃশ্বাস নিতে ভয় হয়। কবে থেকে- তাও ভুলে গেছি। মনে নেই- একদিন হঠাৎ শুনলাম, পোলিশ সৈন্যরা এ দিকে এগোচ্ছে উত্তর দিক থেকে। একদিন, ভারী মর্টারের আওয়াজ। যুদ্ধের সাইরেন। তারপর শুরু হয়ে গেলো একটি অনন্তকাল।
প্রতিদিনই মনে হয়, মরে যাবো-কোন ভারী গোলার আঘাতে, অথবা এক ঝাঁক গুলি পাখির মতো উড়তে উড়তে এসে ঝাঁঝরা করে দিয়ে যাবে আমার বুক, যদিও আমার বুক এমনিতেই বিদীর্ণ হতে থাকে প্রতিদিন- যখন একটা দিনের যুদ্ধ শুরু হয়; আর পৃথিবীটা কাঁদে। আমরা অপেক্ষা করি- জানি না কিসের অপেক্ষা। সম্ভবত আরও একটি ভোরের। একসময় ভোরের আলো ফুটে উঠলে- চেতনায় যোগ হয়ে যায় আরও একটি দিন। মৃত্যুর খুব কাছাকাকাছি থেকে একেই বুঝি সত্যিকারভাবে বেঁচে থাকা বলে।
মাঝে মাঝে শুনি যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে। এইতো, দাঁতে দাঁত চেপে আর কয়টা দিন, তারপর নাকি সব ঠিক হয়ে যাবে। সব কী ঠিক হবে? যা কিছু ছাই হয়ে গেছে, পুড়ে গেছে, পচে গেছে, তা ঠিক হবে? তবুও মানুষ যখন ফিসফাস করে এ সব গল্প গুজব করে, কানে ভেসে এসে অস্পষ্টের মতো- তখনও ভালো লাগে। যুদ্ধের বীভৎসতা, আর হারিয়ে যাওয়ার আতঙ্ক ভুলে থাকতে মাঝে মাঝে আমি এই ছোটো পাবটাতে আসি, কিছু প্রিয় মানুষের সাথে। হালকা জ্যাজ সঙ্গীতে আনন্দ খুঁজতে। ছোট্ট পেয়ালায় চিকচিক করে ওঠা সোনালি রঙে কিছুটা আরামদায়ক উষ্ণতা। কিছু সময়ের জন্যেও সত্যিকারভাবে বেঁচে উঠি আমি। মনে হয়, এটাই সত্যি! বাকি সব মিথ্যা।
ঠিক এই সময়ে তার সাথে আমার দেখা।
যদিও সেই সাক্ষাত-স্মৃতির ভেতরে কোনো উপভোগ্য উপকরণ নেই, বরং প্রথম দেখার কথা মনে হতেই আমার মধ্যে কিঞ্চিত বিরক্তি এখনো চলে আসে। সে দাঁড়িয়ে ছিলো আমার বন্ধু ফীনচের সাথে। পরিচয়ের ক্ষেত্রে হয় সে বাড়াবাড়ি রকমের আনাড়ি, না হয় অহংকারী। ঠিক এমনই আমার মনে হয়েছিলো- যে সে ভদ্রতা একেবারেই জানে না। সম্ভাষণের ব্যাপারে সে আশ্চর্য রকম চুপচাপ- এমনকি নিজে থেকেও নিজের নামটা একবারও যখন বললো না, আমার মনে আছে, ফীনচও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলো। তার এই গুণধর বন্ধুটিকে আমি এই শহরে আগেও কখনো দেখি নি।
যাই হোক- এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। অন্তত একটা মেয়ের কাছে তো নয়ই। ওখানে লানা ছিলো, জো ছিলো, প্যাট ছিলো। আমি ওদের মাঝে খোশগল্পে মশগুল হয়ে গিয়েছিলাম। পোয়েট্রি নিয়ে তখন তুমুল তর্ক চলছে লানা আর জো এর মাঝে। বলতে ভুলে গেছি, এর মাঝে আবার লানা আবার ঔপন্যাসিক। জো সাহিত্যের ছাত্র, সে মাঝে মাঝে নির্মম সমালোচনা করে লানাকে রাগানোর চেষ্টা করে। এই যেমন সেদিনও তর্কাতর্কির এই পর্যায়ে লানার মুখটা রাগে লাল হয়ে গেলো। পরিচিত ঝড়ের পূর্বাভাস।
আমি বেশিক্ষণ দাঁড়ালাম না। বাড়ি ফিরে যাবার তাড়া ছিলো, সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসেছিলাম সেই রাতে। এবং সেই মানুষটির কথা প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম।
কয়েকদিন পর এক সকালে জো এর বাসায় বই আনতে গিয়ে তার সাথে আবার দেখা। বারান্দায় বসে ছিলো জো এর সাথে। মুখে চুরুট। আমি যখন বারান্দা দিয়ে ঢুকছি, ততক্ষণে সে উঠে পড়েছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই মৃদু করে হেসে দিলো।
শুভ সকাল, অ্যানাবেলা।
শুভ সকাল।
কেমন আছেন?
প্রথম সাক্ষাতে চরম উদাসীনতা; দ্বিতীয় সাক্ষাতে ভদ্রতার আমূল পরিবর্তন- কি খাপছাড়া নয়? অথবা, বাহুল্য! যাই হোক, মুখ যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে শুষ্ক গলায় বললাম- ভালো।
সে দিন রাতে খুব একটা কথা হলো না। যদিও জো, ফীনচের মুখে আপনার অনেক কথা শুনেছি। আপনি তো বোধহয় ওদের বন্ধু। আগামী পরশু রাতে আমার একটা শো আছে। টাউনহলে। আমি খুব খুশী হবো আপনি যদি আসেন। জো এর কাছে কয়েকটা টিকেট পাঠিয়ে দেবো।
ব্যাপার হচ্ছে আমি জানিও না সে কী করে, কিংবা কিসের শো তার। কৌতূহলঃবশত জিজ্ঞাসা করাই যায়, তবু কী মনে করে আগ বাড়িয়ে আর জিজ্ঞাসা করলাম না। শুধু বললাম- আচ্ছা, ধন্যবাদ। চেষ্টা করবো।
আজ তবে আসি, ভালো থাকা হোক।- কালো টুপিটা মাথায় দিয়ে বের হয়ে গেলো সে।
আমি জো কে জিজ্ঞাসা করলাম- এই মহান ব্যক্তিটি কে?
আমার প্রশ্ন শুনে জো একটু অবাক হলো।
তুমি সত্যিই চেনো না?
না। কী আশ্চর্য! সে কে, যে তাকে চিনতেই হবে?
না, চেনা অথবা না চেনা- তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। তবে চেনাটা স্বাভাবিক ছিলো। অবশ্য আমিও ওকে আগে চিনতাম না। হঠাৎ আত্মপ্রকাশের পর এই অল্প ক’দিনেই মোটামুটি জনপ্রিয় হয়ে গেছে শহরে। ওর শেষ তিনটি শো’ই হিট করেছে দারুণভাবে। ভয়েজার পত্রিকা তাকে নিয়ে একটা কভার করেছে। তার কী নাম দিয়েছে জানো? দি স্ট্রেঞ্জার!
সে মূলত কী? মানে, তার কীসের শো?
সে একজন ম্যাজিশিয়ান।
আমি এটা শুনে অবাক হয়েছিলাম, যে একটি যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত শহরকে সে তার ম্যাজিক শো এর জন্য বেছে নিয়েছিলো।
তার হঠাৎ আত্মপ্রকাশও এক ধরণের রহস্যের ঘোরটোপে বাঁধা। হতে পারে- সে এই শহরের, আবার এই শহরের নয়। সে হারিয়ে যাওয়ার পর আমি ফীনচকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, জো কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কেউই তার পূর্ব ইতিহাস জানতো না, সে কোথা থেকে এসেছিলো, এতোদিন কোথায় ছিলো। ওদের সাথে তার পরিচয়ও তেমন গভীর নয়, ভাসা ভাসা! কী আশ্চর্য! আমি বুঝি না আমার বন্ধুরা এতো নির্বোধ কেন? সম্ভবত ইচ্ছাকৃতই সে সূক্ষ্মভাবে এমন একটা বলয় তৈরি করে রাখতো তার চারপাশে, যাতে কেউ তার সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু জানতে না পারে। এই যেমন তার অন্তর্ধান সম্পর্কেও কেউ কিছুই জানে না। আমাকে এড়িয়ে যাওয়াটাও নিশ্চয়ই তার উদাসীনতা ছিলো না, বরং ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা একটি দেয়াল। ঠিক সেভাবে যে এসেছিলো, সেভাবে সে চলে গেলো।
ম্যাজিশিয়ান হারিয়ে গেছে। এটা ঠিক, আমি তাকে পছন্দ করতাম না। এমনও না আকর্ষণ করার মতো অনেক কিছু তার ভেতর ছিলো। তবু তার দিকে আমি ধাবিত হচ্ছিলাম ঠিক যেমন লোহাকে নিজের দিকে প্রবলভাবে টেনে নেয় চুম্বক। শেষদিন আমি তার দিকে ঝুঁকে পড়েছিলাম অবচেতনভাবে।
তার প্রতি আমি আকর্ষণ অনুভব করছি- এটা অনুধাবন করার পর নিজের ওপর আমার রাগ উঠতে থাকে। আমি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু পারলাম না। এক অজানা কৌতূহল আমার মনে বার বার উঁকি দিয়ে গেলো তার প্রতি। আমি ভেবেই রেখেছিলাম সেই রাতের শো’তে যাবো না। এমনকি জো, লানা সহ আমার বন্ধুরা পীড়াপীড়ি করার পরেও। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে, আমি শেষ পর্যন্ত তার শো তে গিয়েছিলাম। দাঁড়িয়ে ছিলাম একদম পেছনের দিকে।
এমনও কেউ না সে, যাকে মনে রাখতে হবে। তবু তাকে ভুলে যাওয়া আমার জন্য কষ্টকর হয়ে যায় যখন আমি দেখলাম, সে জাদু দেখানোর বদলে একটি পিয়ানো নিয়ে বসে ছিলো, এবং সে সবাইকে পিয়ানোটি সত্যিকারভাবে শেষ হওয়া পর্যন্ত নিশ্চুপ থাকার অনুরোধ করলো- যদি পিয়ানোর ছন্দপতনও ঘটে এমনকি, এবং সত্যি সত্যি সেই পিয়ানোর ছন্দপতনও হলো- কিন্তু উপস্থিত সমস্ত দর্শক পিনপতন নিরবতা আবার বজায়ও রাখলো ঠিক ঠিক, এবং খুব ধীরে ধীরে- প্রায় শোনা যায় না এমন করে আবছা পিয়ানোর মাঝে সবাইকে হতবাক করে ফুটে উঠলো পাখিদের কান্না!
আমি এর আগে কখনো পাখিদের কান্না শুনি নি।
কেউ কিছু বলে দিলো না- তবু যে যার মতো বুঝে নিলো কিছু কষ্ট। কিছু মৃত পাখিদের- একটু পরেই যাদের আত্মারা দৃশ্যমান হয়ে উড়ে চলে গেল হলরুমের ছাদের দিকে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৩:৫২