মানুষটার অভিব্যক্তি খুবই অদ্ভুত। ওখানে একই সাথে ক্লান্তি এবং কিছুটা আগ্রহ মেশানো। সেটা মানুষটার চোখের দিকে তাকালে আরও ভালো করে বুঝা যায়। বাইরে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ। আর মানুষটা মনের সুখে কিবোর্ড চেপে টাইপ করে চলেছে নির্বিকার ভাবে। যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না সে। হঠাৎ করে দৃশ্যটা দেখলে মনে হতে পারে সে বধির, এবং অবশ্যই সে বধির নয় কারন এখনো তার ঘরে বেজে চলেছে বেহালার অদ্ভুত করুন সুর, যার আসল সৌন্দর্য, যেটা অনেক গাঢ়; ঢাকা পড়ে গেছে গোলাগুলি আর আর্তনাদ এর শব্দে। যদিও এই তিনটি শব্দ মিলে অদ্ভুত একটা কম্পোজিশন তৈরি হয়ে গেছে, যা হয়তো মানুষটার কাছে রীতিমত বিস্ময়কর এবং উপভোগ্য। না হলে তার আঙ্গুলগুলো হয়তো বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে ছুটে যেতো না কিবোর্ড এর বাটনগুলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লেখা হয়ে যেতো না কয়েকটা অর্থহীন অথবা (কারো কারো কাছে অর্থবহ) শব্দ।
সে আসলে একটি অফিসের একজন ছোটখাটো চাকুরে। যার কাজ শুধু একটাই, অফিসের সমস্ত দরকারি নথিপত্র, দলিল দস্তাবেজ এবং চিঠি-পত্র টাইপ করা। সোজা ভাষায় বললে যাকে বলা যায়- একজন টাইপিস্ট। এই কাজ করতে তার বড় বেশি একঘেয়ে লাগলেও পরবর্তীতে সে আবিস্কার করেছে, এইসব দলিল দস্তাবেজ, নথিপত্রও আসলে এক ধরনের গল্প। অর্থাৎ, তাকে একজন গল্পকারও বলা চলে। এবং এটা ভেবে সে গর্ব-বোধ করতেই পারে। যদিও তার একটা দুঃখ রয়েই যায় মনের মাঝে, সেটা হচ্ছে পুরোপুরি নিজের মতো করে একটা গল্প তৈরি করতে পারলো না সে, যেটা তার ছোটবেলার, অথবা বলা চলে, তার অনেক পুরনো একটা স্বপ্ন।
তবে আজকের যে দৃশ্য, তাতে তাকে অফিসে নয়, বরং দেখা যাচ্ছে বাসার টেবিলে। সে আপনমনে টাইপিং প্যাডে টাইপ করেই চলেছে একটা কিছু। ঘরের কোনায় ঝাড়বাতি, ওটা থেকে অল্প অল্প আলো এসে পড়ছে তার মুখে। হঠাৎ কিছু একটা হলো, যাতে তার পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠলো। সে একবার বিরক্ত হয়ে একবার পায়ের দিকে, তারপরে একবার ঘড়ির দিকে তাকালো। তার হাতে সময় খুব বেশি নেই, তাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। তাই এতো তাড়াহুড়ো করছে সে। অবশ্য তাড়াহুড়ো করতে গেলে মাঝে মাঝেই আঙ্গুল গুলোর সঞ্চালনগতি কমে আসে। যেমনটা কোন একটা নির্দিষ্ট ঘড়ি তাড়াতাড়ি চলতে গিয়ে বন্ধ হয়ে গেলে ওই ঘড়িটার সময় থেমে যায়, অনেকটা তেমন। তার জীবনে একটা সেকেন্ডের কাঁটা, মিনিট, কিংবা ঘণ্টার কাঁটা-একটা ঘড়ির কাছে যেমন একটা সেকেন্ড, মিনিট অথবা ঘণ্টার কাঁটা; ঠিক তেমনই অথবা তার চেয়েও বেশি কিছু।
অথচ গতি শ্লথ হলেও সে বুঝতে পারে, কার্নিশ থেকে তাদের পোষা কালো বিড়ালটা ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে নিচে নেমেছে। এতোক্ষন সে বসে বসে জানালা দিয়ে প্রতিদিন ফেলে দেওয়া মাছের এঁটো-কাঁটা এর জন্য অপেক্ষা করছিলো। আজ পায়নি। সে এখন এই দিকেই আসবে এবং এখন তার কাজ একটাই। ড্রয়িং রুমের সোফাটার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করা।
এবার সে কিছুটা শব্দগুলোর দিকে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করলো এবং টানা তিনবার ব্যর্থ হয়ে অবশেষে চতুর্থবারে সে সমর্থ হলো। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, হ্যা, দেখলোই বলা চলে, কারন শব্দরাও বাতাসে ভেসে বেড়ায়- সে দেখলো, একটা অনেক ভারী কিছু, যেমন একটা বড়সড় অথচ চাপা, দুম দুম শব্দ তার বাড়ির মুল দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। সে অবশ্য আগের মতোই নির্বিকার রইলো, কারন, সে জানে, এখনই তার স্ত্রী তার বিশালবপু শরীরটা নিয়ে হেলতে দুলতে গিয়ে দরজাটা খুলে দিবে। এটা নিয়ে সে মোটেও চিন্তিত নয়, সে বরাবরই জেনে এসেছে তার স্ত্রী কতো বড় নির্বোধ, উল্টো তার বদলে এক ধরনের আনন্দ যেন তার দীর্ঘদিনের ক্লান্তিমাখা শরীরে ভর করলো।
তবে সে পরপরই কিছুটা বিরক্ত হলো, কারন অযথাই দরজার দিকে তাকিয়ে সে সেকেন্ডের কাঁটাটাকে কয়েকবার সরে যেতে দিয়েছে। আবারও একবার কেঁপে উঠলো তার মেঝেটা, ঠিক এই মুহূর্তে তার সেটা খেয়াল করার সময় নেই। অনেকটা এগিয়ে থেকেও আবার কয়েক ধাপ পিছিয়ে পড়েছে সে। যদিও আলাদা একটা অনুভুতি সে ভালোই টের পাচ্ছে, সেটা হলো-তার পা বেয়ে বেয়ে একটা পোকার ক্রমাগত উপরে উঠে আসার অনুভুতি। সে শুনেছে, দীর্ঘদিন কোকেইন খেলেও নাকি অনেকটা এমনই অনুভুতি কেউ কেউ পেয়ে থাকে। তবে সে আসলে এখনো জানে না, ওখানে সত্যি সত্যি কোন পোকা হাঁটছে, নাকি-পুরোটাই আসলে নিছক একটা কল্পনা। সেটা এখন অবশ্য জানার চেষ্টা করেও লাভ নেই, কারন সময়ের সাথে সাথে সেটাও ক্রমশ স্পষ্ট হবে।
এই ভেবে লেখায় ডুবে গেলো সে।
সে যখন ডুবে যাচ্ছিলো, তখন আসলে আততায়ী, যাকে একটু আগে দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে- সে; সেই বিশালবপু মহিলাকে গুলি করে হত্যা করছিলো। হত্যার ঠিক আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মহিলার চোখ ঘুম ঘুম ছিলো, এবং সম্ভবত সে ঘুম পুরোপুরি কাটেও নি, কারন সে মাত্র একবার একটা আর্তনাদ করেই আবার থেমে গেছে। মহিলাটিকে হত্যা করার অবশ্য সুস্পষ্ট কারণ ছিলো। কারণ হচ্ছে সে মানুষটার স্ত্রী। তাদের বিয়ে হয়েছিলো ৭ বছর আগে। যদিও তাদের বিবাহিত জীবন অতোটা সুখকর কিছু হয়নি, এবং উভয়েই সেটা ভালো জানতো। হতে পারে, এটার এমন একটা পরিনতি এর দরকার ছিলো। হতে পারে, টাইপিস্ট নিজেই চেয়েছে এমনটা হোক। আরেকটা কারন হচ্ছে, এখন ধর্মযুদ্ধ। ধর্মযুদ্ধে শুধু ধর্ম, এবং একমাত্র ধর্মই সত্যি। বাকি সব মিথ্যা।
যেমন মহিলাটিকে হত্যার পরে সে সোফার কাছে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা বিড়ালটাকে হত্যা করলো। আততায়ীর হিসেব মতে এই কালো বিড়ালটিরও কোন ধর্ম ছিলো না। সুতরাং একজন মানুষ ও একটি বিড়ালের মধ্যে শাস্তির ব্যাপারে কোন পার্থক্য থাকা অবশ্যই উচিৎ নয়। সে অতিদ্রুত চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। সে দেখলো, এবং কিছুটা অবাকই হলো, সে দেখলো একজন মানুষ চেয়ারের মাঝে গা ডুবিয়ে বসে গভীর মনোযোগে কি যেন টাইপ করে চলেছে। কোথাও হালকা করে একটা বেহালার সুর বেজেই চলেছে কখন থেকে। এতো কিছুর পরেও তার চোখ আসলে আটকে গেলো এই বাড়িটার ডায়নিং টেবিলে, কারন ওখানে অজস্র খাবার পড়ে আছে। তবে খাবারের চিন্তাই এখন তার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া অনুচিত, কারন এখনো অনেক কাজ অসমাপ্ত পড়ে আছে। লাশগুলি টেনে নিয়ে গণকবরে নামানোর পর আজ তার ছুটি। তখন খাবারগুলোর ব্যাবস্থা করা যাবে।
এরই মধ্যে চেয়ারের মাঝে ডুবে থাকা মানুষটা, যে আসলে একজন টাইপিস্ট, অথবা- না, একজন লেখকও বলা চলে, জেগে উঠেছে। সে জেগে উঠেছে মুলত পোকাটার জন্য। ওটা ক্রমাগত উপরের দিকে উঠে আসছে। এখন তার ঘাড়ের কাছাকাছি। এখন সে পোকাটার পাখা নাড়ানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছে। তবে এখনো পোকাটা পাখা পুরোপুরি মেলেনি। পাখা পুরোপুরি মেললেই সে একটা প্রজাপতি হয়ে যাবে। তিনি প্রানপনে চাইছিলেন, পোকাটা প্রজাপতি হয়ে যাক।
কিন্তু, কি হলো, পোকাটা লাফ দিয়ে তার কানের ফুটো দিয়ে ঢুঁকে গেলো। এবং তার মনে হলো, পোকাটা এখন ঠিক যেন তার মাথার মধ্যে।
তারপর কিছু মুহূর্ত এভাবে কেটে গেলো
এবং,
মাথার মধ্যেই ঝপ করে পাখা মেললো পোকাটি, তারপর ওটা একটা প্রজাপতিতে পরিনত হলো।
“আমার মাথায় গুলি করে প্রজাপতিটাকে মুক্তি দেওয়া হোক।” লিখেছিলো সে।
যদিও আততায়ী এটা জানতো না, এবং তার কিছুক্ষন পর এক ঝলক রক্ত ছিটকে এসে কম্পিউটারের স্ক্রিনটির একাংশ ভিজিয়ে দিলো। যদিও তখনো থামেনি বেহালার সুর। ওটা বেজেই চলেছিলো বার বার। যেন আর শেষ নেই।
তারপর,
কবর দেওয়া হয়ে গেলে ফিরে আসলো আততায়ী। এসে গোগ্রাসে গিলতে লাগলো খাবার গুলো। না খেলে শুধু শুধু পচেই যাবে ওগুলো, খাওয়ার তো কেউ নেই। তারচেয়ে বরং সে ই শেষ করে যাক।
খাওয়া শেষ হয়ে গেলে, শেষবারের মতো চলে যাওয়ার আগে হঠাৎ তার মন খুঁতখুঁত করতে লাগলো। যেন কিছু একটা ফেলে যাচ্ছে সে। মনে করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই পারছে না।
অবশেষে তার মনে পড়লো, কেন তার মন খুঁতখুঁত করছিলো, এবং সে এসে রক্তমাখা স্ক্রিনটার সামনে দাঁড়ালো।
কি লেখা ছিল সেটা দেখতে গিয়ে তার কিছুটা রক্ত পরিস্কার করতে হলো। সেখানে দেখা গেলো, ঠিক এই লেখাটা, হ্যা ঠিক এটাই লেখা আছে টাইপিং প্যাডে, এমনকি এই লাইনটা পর্যন্ত। এখানে লেখা আছে, লাশগুলো গনকবর দেওয়া শেষে এখানে এসে সে গোগ্রাসে গিলবে খাবারগুলো, কারন ওগুলো আসলে ওর জন্যই রাখা হয়েছিলো। লেখা আছে, ওর চলে যাবার আগে এইখানে ঝুঁকে পড়ে এই লেখাটা দেখার কথা। তার হত্যাকারী যে তখন চোখে কিছুটা বিস্ময় এবং তার পর পরই এক ধরনের আতংক নিয়ে লেখাটা দেখেছে, সেটার কথাও এখানে লেখা আছে।
তারপর সে হন্যে হয়ে প্রজাপতিটাকে খুঁজতে লাগলো; এবং পেলে সে ওটাকেও মেরে ফেলতো, কিন্তু কোথাও আর প্রজাপতিটাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না।