মুল পোস্ট
তিন বছর পরের কথা-
অন্তু মাত্র কলেজ থেকে ফিরলো। মা রেহানা বেগম তাকে ভাত দিয়েছেন। ভাত খাওয়ানোর পর তাকে পাঠাতে হবে স্যারের বাসায়। দিনে তার ৩ টা প্রাইভেট থাকে। কলেজ না করলেও স্যারের বাসায় ঠিকই যেতে হয়। বিশেষ করে বায়োলজি। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। এইটাতে ৯৫ % মার্কস তো লাগবেই এবার। না হলে মেডিকেলে চান্স পেতে অসুবিধা হয়ে যাবে। অন্য সাবজেক্টগুলি তেও ভালো মার্কস রাখতে হবে। এজন্য স্যারদের তেল মারা জরুরী। অন্তুর কলেজের পরীক্ষার সিট সবসময় বিজ্ঞান কলেজে পড়ে। এইকারনে বিজ্ঞান কলেজের টিচারদের সাথেও কথা বলে রাখতে হবে। প্র্যাক্টিকাল মার্কস এর একটা ব্যাপার আছে তো। তার জন্য যদি প্রাইভেট পড়াতেও হয়, অসুবিধা নেই। অন্তুর বাবা বলে দিয়েছে, যত টাকা লাগে ঢালো, যত তেল মারা লাগে, মারো। তবু গোল্ডেন উইথ হাই মার্কস চাই। মেডিকেলে চান্স তো পেতেই হবে ছেলেকে।
স্যাররাও অবস্থা বুঝে নিজেদের ডিমান্ড বাড়িয়ে দিয়েছেন। আগে মানুষ টাকা ঢালত কোচিং এ, এখন ঢালছে স্যারদের কাছে। তাও ভালো, ভর্তি পরীক্ষা তো দেওয়া লাগে না। কাউকে না বললেও রেহানা জানেন- অন্তু একটু গবেট কিসিমের। স্যারদের মুখ না চিনানো গেলে তার এসএসসিতেও খবর ছিলো। যাই হোক, সমস্যা নাই। মেডিকেলে ভর্তির সুবর্ণ সুযোগ এখন হাতের মুঠোয়। পরীক্ষা দিয়ে নিজের যোগ্যতা আবার আলাদা করে প্রমান করতে হবে না। স্যারদের সাথে একটু ভালো সম্পর্ক রাখলেই নাম্বার ভালো পাবে অন্তু। মাঝখান থেকে পরীক্ষার পর বোর্ডে একটু খোঁজ লাগাতে হবে খাতাটা কোনদিকে গেলো। বোর্ডে লোক আছে তার, এই খবর বের করা ব্যাপারনা। রেহানা মনে মনে বেশ তৃপ্ত বোধ করেন।
মৌরি নামের মেয়েটাও অন্তুর সাথে পড়ে। মৌরির পরিবারের সাথে তাদের চেনাজানা আছে ভালোই। মৌরীর বাবা মন্ত্রনালয়ের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা। তাদের ভাব সাবই আলাদা। মাঝে মাঝে রেহানা এরকম একটা পরিবারের সাথে জানাশোনা রাখতে পেরে অনেক গর্বিত বোধ করেন নিজেকে। মৌরি এর মা এর সাথে তার অসম্ভব ভালো সম্পর্ক। পড়াশোনায় মৌরিও অতোটা ভালো না। এটা নিয়ে মৌরির মা এর দুশ্চিন্তা এর শেষ নেই। যদিও তার মেয়েকে কলেজের প্রিন্সিপাল থেকে শুরু করে সবাই চেনে। মৌরীর মা মাঝে মাঝেই ফোন করে অন্তুর মা এর কাছ থেকে পরামর্শ নেন কিভাবে মেয়েকে পড়ানো উচিত। অন্তুর মায়ের মতো তারও ইচ্ছা মেয়েকে মেডিকেলে পড়াবেন। অন্তুর মা অবশ্য তাকে আশ্বাস দিয়েছেন, মৌরির ভয়ের কিছু নেই। সব ঠিক থাকলে স্যাররাই একটা ব্যবস্থা করে দেবে তার। মেডিকেলে ভর্তি প্রক্রিয়া পরিবর্তন হওয়ার পর স্কুল কলেজের স্যারদের এখন অনেক ক্ষমতা।
কিন্তু অন্তুর মা এর হিসাবে একটু গরমিল হয়ে গেলো। এইচএসসি পরীক্ষায় ফট করে মৌরীর বায়োলজিটা একটু খারাপ হয়ে গেলো। মৌরীর মা তো কেঁদে কেটে একেবারে অস্থির। গেলো বুঝি, চান্স গেলো। সব গেলো, সব গেলো। মেয়ে তার ভেসে গেলো। অন্তুর মা কে ফোন করে অনেকক্ষণ হা পিত্যেশ করলেন তিনি।
অন্তুর মা তাকে পরামর্শ দিলো একটু বোর্ডে খবর নিতে। আজকাল বোর্ডে দুর্নীতি করা কোন ঘটনা না। কিছু কর্মচারী আছে, অল্প কিছু টাকা পেলেই খাতা কার কাছে গেলো না গেলো, সব হাঁড়ির খবর বের করে দেয়। বাঙালি তো, টাকা দিলেই তাদের কেনা যায়। একবার যদি বের করা যায়, কার কাছে খাতা গিয়েছে, তাহলে সেই স্যারকে ম্যানেজ করাও ব্যাপার হবেনা। আর স্যার ম্যানেজ না হলেও সমস্যা নাই। মার্ক টেবুলেশন এর সময় বোর্ডে কিছু টাকা খাওয়ালেও হবে। ৬৩ কে ৯৩ বানানো আজকাল ডাল ভাত ব্যাপার স্যাপার। সবার জন্য অবশ্যই না, ক্ষমতাবান এবং পয়সাওয়ালাদের জন্য। মৌরীর বাবা দুটোই আছে। তবে আর চিন্তা কি? হয়ে তো গেলো মেডিকেলে চান্স।
অবশ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়কেও তো বিশ্বাস নেই। দুর্নীতি তো এখানেও হচ্ছে। আগে ভর্তি পরীক্ষায় তো কে কতো মার্ক পেতো, দেখা যেতো। সেই অনুসারে ডিএমসি, সলিমুল্লাহ। এবার যে তলে তলে কোন মেকানিজম খাটিয়ে তারা পিছনের জিপিএ ৫ কে সামনে আনবেন আর সামনের জিপিএ ৫ কে পিছে ফালাবেন, তার কোন রেকর্ড নেই। কেউ জানতেও পারবে না। মৌরীর বাবা অবশ্য চিন্তা করে রেখেছেন ব্যাপারটা। আগে থেকে বলে রাখবেন তিনি যাতে তার মেয়েকে ডিএমসি তে রাখা হয়। জিপিএ ৫ তো কতো ভুরি ভুরি থাকবে। সবাইকে তো আর ডিএমসি দেওয়া যাবে না। সিস্টেম করতে হবে। তার মেয়েকে ডিএমসি দিলে কারো কিছু বলার নাই। কেউ তো আর জানবে না তার মেয়ের আসল র্যাঙ্ক কতো ছিলো। মজাই মজা।
জীবনের রঙ্গমঞ্চে অবশ্য আরও একজনকে নিয়ে না আসলে হবেনা। যদিও তার অন্তু, মৌরীদের মতো গাড়ি বাড়ি, প্রভাব প্রতিপত্তি নেই, তবুও তাকে আনা দরকার। তার নাম রুবাই।
রুবাই এর বাবার নাম রুস্তম। সে রিকশা চালায়। দিনে চার পাঁচশ টাকা আয় তার। তবে দিনের আয় দিনেই শেষ হয়ে যায় তার। মাস শেষে হিসাব মিলাতে তাই হিমসিম খায় সে। স্ত্রী দীর্ঘকাল যাবত অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য টাকা জমানোর চেষ্টা করেও জমাতে পারছে না সে। তার ছেলেটা পড়ালেখায় ভালো। রুস্তম নিজে পড়াশোনা করতে পারে নি। সে তাই বোঝে, পড়াশোনাটা করা কতো জরুরী। ছেলে বড় হয়েছে। তাকে কাজে লাগিয়ে দিলে সংসারে অনেক বেশি সাচ্ছ্যলতা আসবে সে জানে। তবুও রুবাইকে সে পড়াশোনা করাতে চায়। শত কষ্ট হলেও করাবে। ছেলেটা তার সাত রাজার ধন। তাকে নিয়ে তার অনেক আশা ভরশা।
রুস্তম মাঝে মাঝেই স্বপ্ন দেখে, রুবাই অনেক বড় ডাক্তার হয়েছে। রুবাই এর মা স্বপ্ন দেখে, তার ছেলে তার অসুখ ভালো করে দিয়েছে। মাঝে মাঝেই তার ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতে ইচ্ছা হয়।
রুবাই জানে তার বাবা মা এর আশা ভরসার কথা। তার অনেক ভয় হয়। এই অঞ্চলে খাতায় তেমন নাম্বার আসেনা। জিপিএর ভিত্তিতে ভর্তি করা হলে, তাকে হয়তো ঝামেলায় পড়তে হবে। হয়তো, সম্ভব হবে না তার পক্ষে তার বাবা মা এর স্বপ্ন গুলো বাস্তব করে তোলা। স্বপ্ন ভেঙে গেলে তার মা এর কেমন লাগবে? ভাবতেই ওর মন যেন কেমন কেমন করে।
রিটেন পরীক্ষা শেষে প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষায় পরীক্ষক রুবাইকে আড়চোখে দেখলেন। এই ছেলে প্রাইভেট পড়েনা। ফকির জানি কোনখানকার। সব ছেলেমেয়েরা টাকা দিয়ে প্রাইভেট পড়ে ২৫ করে মার্কস নিচ্ছে, আর এই ছেলেকে শুধু শুধু নাম্বার দিয়ে দিবে সে? যারা প্রাইভেট পড়েছে তাদের তো কম দেওয়া সম্ভব না। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো কম পেতেই হবে। না হলে পরীক্ষা হয়?
অবশেষে এইচএসসি প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষায় পরীক্ষক রুবাইকে চোখমুখ শক্ত করে একটা নাম্বার দিলেন।
রুস্তমের মন একদিন খারাপ হবে। শূন্য উঠানে বসে থাকবে হয়তো সে। ফ্যালফ্যাল করে একদিন তাকিয়ে থাকবেন আকাশের দিকে রুবাই এর মা।
রুবাই কি করবে?
আমরা জানি না। কেউ জানে না। সেই দিনটাকে দেখার জন্য অদৃষ্টও অধির আগ্রহে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
শেষকথাঃ
আমরা নিজেদের হাতে আমাদের ভাগ্য তৈরি করি। আমরা পরিবর্তন এভাবেই ঘটাই। তিন বছর পরে নয়, বরং গল্পের অন্তু, মৌরি কিংবা রুবাইরা এখনও আমাদের আশে পাশেই আছে। আমরা তাদের দেখার চেষ্টা করিনা। অথবা দেখেও না দেখার ভান করি। করি দেখেই আমরা খুব দ্রুত "খুব সঠিক" কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারি।
হয়তো আর কখনো কোন গরীবের ছেলে এদেশে ডাক্তার হবেনা। হয়তো অজ পাড়াগাঁ এর কোন মেয়ে পড়বে না কোনোদিন এপ্রন। ডাক্তারি তারাই পড়বে, যারা নামি দামি স্কুল কলেজে পড়ে। যেখানে না চাইতেই হাত ভরে নাম্বার দেওয়া হয়। ডাক্তারি তারা পড়বে, যাদের মামা-খালু দের অনেক প্রভাব প্রতিপত্তি আছে। যাদের টাকা আছে। দুর্নীতি করার সামর্থ্য আছে।
কোচিং গুলোর এর হাত থেকে টাকার খেলা সরে গেছে, এবার টাকা ঘুরবে শিক্ষা বোর্ডগুলোতে। টাকা ঘুরবে স্কুল কলেজ শিক্ষকদের হাতে। টাকা ঘুরবে মন্ত্রনালয়ে। যারা সিদ্ধান্ত প্রনয়ন করেন, তারা চাইলেই অনেক সুন্দর কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। তাতে মেধার বিচার হতো, সব ধরনের টাকার খেলাও বন্ধ হতো। তারা তা করেন নি। কেন করেন নি, সেটা একটা রহস্য। এ দেশে মেধা নিয়ে খেলা সবসময়ই চলবে। অন্য কোন ভাবে, অন্য কোন রূপে।
জয় হোক বাংলাদেশের। লাল সালাম রইলো এদেশের নীতি নির্ধারকদের তরে।
----------------------------------------------
পূর্ববর্তী আপডেট( ১৩/০৮/১২)
মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা ২০১২ এর সার্কুলার এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেছেন ড. ইউনুস আলী আকন্দ নামের একজন আইনজীবী।
দুটি নির্দেশনা চেয়ে তিনি আবেদন করেছেন বলে জানা গেছে।
এক- ২০১২ সালের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না
দুই- সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য কেন নির্দেশ দেওয়া হবেনা
আজ বিকেলে ভর্তিচ্ছু সাধারন ছাত্র ছাত্রীর পক্ষ থেকে তিনি এই আবেদনটি করেন।
এদিকে বিক্ষুদ্ধ ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ শেষে সচিবালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচী গ্রহন করেছেন। দাবি আদায় না হয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালাবেন বলে জানা গেছে।
আগামীকাল সকাল ৯ টায় ছাত্র ছাত্রীরা শহীদ মিনারে জড়ো হয়ে পরবর্তী কর্মসূচী নির্ধারণ করবেন। খুব সম্ভবত সেখান থেকে মিছিল করে তারা আবার সচিবালয় ঘেরাও করবেন।
--------------------------
আপডেট( ১৪/০৮/১২ সময়- ০৫: ৩০)
মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা ২০১২ এর ঘোষিত সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ হবেনা, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট।
তবে এখন পর্যন্ত কাগজ কলমে কোন ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত না হওয়ায় আবেদনটি এখনো একটি পরিপূর্ণ আবেদন হতে পারেনি বলে জানিয়েছে হাইকোর্ট।
ঠিক এ কারনেই রিট করা দ্বিতীয় আবেদনটি সম্পর্কে আদালত কোন রুল জারি করেনি। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র জিপিএ এর মাধ্যমে মেডিকেলে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে সরকারের আইনত কোন বাধা নেই।
এদিকে ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সড়কে অবস্থান করছেন শত শত শিক্ষার্থী। দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন তারা। দুপুর থেকে শত শত শিক্ষার্থীর রাস্তায় অবস্থানকালে রাস্তায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
আপডেট আপাতত এতোটুকুই।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১২ বিকাল ৫:৪৯