ll--দ্বিতীয় জীবন--ll (শেষ পর্ব)
প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে জানানো হলো, চন্দ্রার কোন পছন্দ অপছন্দ নেই। পুরোপুরি বাবা মা এর মতেই সে বিয়ে করবে। বাবা মা কানা খোঁড়া ছেলে এনে দিলেও করবে।
দুই পরিবারের মহা সম্মতিতে আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলো।
হ্যাঁ, চন্দ্রা আমার স্ত্রীর নাম। যাকে আমি আমার স্ত্রীর প্রাপ্য মর্যাদাটুকু কখনো দিতে পারিনি। উল্টো তাকে আমি অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছি। প্রথম দিন থেকেই তার প্রতি যথেষ্ট উদাসীন ছিলাম আমি। কোন মেয়ের পক্ষে এই ধরনের উদাসীনতা সহ্য করা কষ্টকর। খুব বেশি কষ্টকর।
বিয়ের প্রথম রাত্রেই আমি চন্দ্রাকে বলেছিলাম-
"আমাকে বিয়ে করে খামোখা নিজের জীবনটাকে নষ্ট করতে কেন গেলে?"
চন্দ্রা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো। হতভম্ব হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিয়ে নিয়ে একটা মেয়ের অনেক রকম স্বপ্ন থাকে। বাসর রাত নিয়ে সে অনেক কিছুই কল্পনা করে। কিন্তু কখনো কল্পনা করে না যে বাসর রাতে তার এমন কথা শুনতে হবে।
আমি চন্দ্রার হতভম্ব ভাব কাটানোর জন্য বললাম-
"মানুষ হয়ে একটা না-মানুষ এর সাথে থাকতে এসেছো। ঝামেলা হয়ে গেলো। সারাজীবন দুঃখ পাবে। তোমার অন্তত একবার বিয়ের আগে ভাবা উচিৎ ছিলো। তবে দুঃখ কম পাওয়ার একটা উপায় আছে। তোমাকে বলে দেই। আমার কাছ থেকে কখনো কিছু প্রত্যাশা কোরো না। যেই আমার কাছে প্রত্যাশা করে, সেই হতাশ হয়। আমার বাপ মা এর আমাকে নিয়ে অনেক প্রত্যাশা ছিলো। আমি তার কিছুই পুরন করতে পারিনি। যূথীর ও আমাকে নিয়ে অনেক আশা ভরসা ছিলো। লাভ হয়নি। আমি তাকেও হতাশ করেছি।"
চন্দ্রার হতভম্ব ভাব কেটে গেছে। সে এখন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি জানি, সে কি শুনতে চাইছে। আমি হাই তুলে বললাম-
"আমি জানি তোমার মাঝে এখন কি প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে। হ্যাঁ, আমি যূথী নেমের একটা মেয়েকে ভালবাসতাম। কোন এক কালে। এখনও অবশ্য একজনকে বাসি। তবে সেটা যূথী নয়। আমি আমার নিজেকে ভালোবাসি। শুধুই আমাকে।
"যূথীকে বিয়ে করলে না কেন?"
চন্দ্রা প্রশ্ন করা শুরু করেছে। তার প্রাথমিক ধাক্কা সে কাটিয়ে নিচ্ছে। আমি চমৎকৃত হলাম।
আমি বললাম-" যূথী খুবই প্র্যাকটিকাল ধরনের মেয়ে। সে আমাকে ভালোবাসতো কারন আমার পাগলামি তার ভালো লেগেছিলো। কিন্তু পাগলকে দিয়ে তো সারাজীবন চলেনা। সে পরে চিন্তা করে দেখেছে, আমার সাথে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না। তাছাড়াও যূথীর পরিবার আমাকে পছন্দ করতো না। তাই সে ছেড়ে গেছে।"
"যূথীকে এখন আর ভালোবাসো না?"
"নাহ।"
"কেন?"
"নিজেকে ভালবেসে কুল পাচ্ছিনা। মানুষকে ভালবাসবো কি? আরও বড় একটা ব্যাপার আছে।"
"কি?"
"মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা পরিবর্তন হয়। ভালোবাসা জন্ম নেয়, বৃদ্ধ হয়, মারা যায়। শুধু নিজের প্রতি ভালোবাসা পরিবর্তন হয়না। একই রকম থাকে।"
চন্দ্রা বললো-"যূথীর উপর তোমার অনেক রাগ আছে?"
"নাহ। তা থাকবে কেন?"
"তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে, তাই।"
আমি হাই তুলে বললাম- "যূথীর উপর আমার কোন রাগ নেই। যূথী যেটা করেছে, সেটা স্বাভাবিক। যূথীর জায়গায় বীথি, সিঁথি, গীতি থাকলেও একই কাজ করতো। যূথী আমাকে বলে গিয়েছিলো, আমার সাথে কারো সংসার করা কোনোদিন সম্ভব না। কালক্রমে নিজেকে দেখে আমারও তাই মনে হচ্ছে। এনিওয়ে, আমার ঘুম পেয়েছে খুব। আমি শুয়ে পড়লাম।"
চন্দ্রা বসে রয়েছে। বসে থেকে নিঃশব্দে কাঁদছে। তার চাপা কান্নার দমকা কাঁপুনিতে বিছানা মাঝে মাঝেই কেঁপে উঠছে।
মেয়েটা কাঁদুক। সে এখানে কষ্ট পাওয়ার জন্য এসেছে। যে কষ্ট পাওয়ার জন্য পৃথিবীতে আসে, তাকে কষ্ট দেওয়াই উচিৎ। যূথী কষ্ট পাওয়ার জন্য আসেনি। আচ্ছা, যূথী আজ এখানে থাকলে কি করতো? চিৎকার করতো?
ভাবতে ইচ্ছা করছে না কিছু। ঘুম পাচ্ছে খুব। আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
পরদিন সকালে উঠে দেখি সবকিছু স্বাভাবিক। চন্দ্রা বসে বসে বিরাট আয়নার সামনে তার ভেজা চুল আঁচড়াচ্ছে। গোসল ও করেছে মনে হয়। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, এ বাড়িতে এসে সে অত্যন্ত আনন্দিত। আমি মনে মনে অসম্ভব বিরক্ত হলাম। মনে হয় সে আমার কথা বিশ্বাস করেনি। তাকে হয়তো শক্ত শক্ত আরও কিছু কথা বলা উচিৎ ছিলো।
আমাকে উঠতে দেখে চন্দ্রা বিরক্ত গলায় বললো-" তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। এতো বেলা করে কেউ ঘুম থেকে ওঠে? টেবিলে সেই কখন নাস্তা দেওয়া হয়েছে। বাবা মা আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।"
আমি বললাম- "আমাদের জন্য মানে?"
"আমাদের জন্য মানে হচ্ছে- For us. me and you. me and you মিলে হয় us. এটার বাংলা অর্থ- আমরা।"
"তুমি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করা চেষ্টা করছো?"
"মোটেই না! আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করবো কেন? আমি তোমার কি লাগি যে ঠাট্টা করবো?"
"তো কি করার চেষ্টা করছো?"
"আমি তোমাকে প্রেমে ফেলার চেষ্টা করছি।"
চন্দ্রা আমার সাথে কি আসলেই ঠাট্টা করছে? বোধহয়। নাকি সত্যি বলছে? আমি বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম।
চন্দ্রা চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে হালকা গলায় বললো-" ভয় পেয়েছো? মজা করলাম একটু। তোমাকে প্রেমে ফেলার চেষ্টা করে লাভ কি? আমি জানি, তুমি এমনিতেই আমার প্রেমে পড়বে।"
আমি মনে মনে একটু হাসলাম। মেয়েটা এখনো বুঝেনি আমি কেমন।
"তা তুমি কি করে নিশ্চিত হলে যে আমি তোমার প্রেমে পড়বো?"
"আমি আগে থেকেই অনেক কিছু জানি।"
"আমি যদি বলি, এই জীবনে তুমি আমার ভালোবাসা পাবে না, তাহলে?"
"তাহলে কি তা তো জানিনা। আচ্ছা ঠিক আছে, লাগবে না। এখন নাস্তা করতে চলো। দেরী হয়ে গেছে।"
"আমি যাবো না।"
"ছেলেমানুষি কোরো না। আমি তোমাকে নাস্তা খেতে বলেছি, ভালবাসতে তো বলিনি। আচ্ছা ঠিক আছে, একসাথে যেতে চাওনা, একসাথে যেওনা। তুমি আগে যাও, অথবা আমি আগে যাই। কে যাবে?"
আমি কোন জবাব দিলাম না।
বিয়ের পর ঢাকার বাড়িতে দুদিন থেকেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসা শুরু করলো। বাসায় এতো মানুষের ভিড়ে থাকতে আমার ভালো লাগেনা। মাথার মধ্যে অনেক লেখা জমে গেছে। সেগুলোকে মুক্তি দিতে হবে। এই পরিবেশে সম্ভব না। আমার দরকার নির্জন এবং প্রশস্ত পরিবেশ। আমার দরকার ত্রিশাল। আর আমি এমনিতেও ঠিক করেছিলাম ত্রিশালেই থাকবো।
চন্দ্রাকে বলতেই সে রাজি হয়ে গেলো। আমি ভেবেছিলাম সে রাজি হবেনা। মেয়েটার কি কোন কিছুতেই না-বাচকতা নেই নাকি? আমি না-মানুষ হলে চন্দ্রা হ্যা-মানুষ।
ত্রিশাল এর বাড়িটা বড় বেশি নির্জন। এতো নির্জনতা কোন মানুষের ভালো লাগার কথা না। চন্দ্রা দেখলাম এই পরিবেশটার সাথেও নিজেকে মানিয়ে নিলো। সারাদিন সে এঘর থেকে ওঘরে ঘুরে বেড়ায়, ছাদে যেয়ে আকাশ দেখে, পুকুর পারে বসে বসে পা দোলায়। একজন আবেগহীন, অনুভূতিশূন্য এবং বাউন্ডুলে লেখকের স্ত্রী হয়েও তার কোন মাথা ব্যাথা নেই। আমি যে কোন কাজ করিনা, তাতেও তার কিছু যায় আসেনা। মেয়েটার চরিত্রের মধ্যে পানি স্বভাব প্রবল। পানির ধর্ম হচ্ছে, যে কোন ধরনের রঙের পাত্রে সে সেই রঙের সাথে নিজেকে আড়াল করে ফেলতে পারে। মেয়েটার মধ্যে আঠা ভাব ও প্রবল। এই বাড়িতে এসেও দিনরাত সে আমার পিছে ঘুরঘুর করতে লাগলো।
অবশ্য তাতে আমার প্রাত্যাহিক জীবনযাত্রার কোন পরিবর্তন হলো না। আমি আমার মতোই আমার ঘরে বসে থাকি সারাদিন, রাত জাগি, দিনের বেলা ঘুমাই। প্রতি সন্ধ্যায় বাগানের দোলনায় বসে সিগারেট খাই।
আঠা মানবী সেখানেও আঠার মতো সেঁটে রইলো। সন্ধ্যায় দোলনায় বসে বসে রাতের পুকুর দেখছি, এমন সময় আঠা মানবী এসে উপস্থিত হলো।
"একটু বসি তোমার সাথে?"
"বসো।"
চন্দ্রা বসলো। বসে বসে সেও আমার মতো পুকুর দেখতে লাগলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, রাতের পুকুরের মাঝে গভীর শিক্ষণীয় কিছু আছে।
নিয়ম অনুযায়ী আমার বিরক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু আমি বিরক্ত হলাম না। চন্দ্রা চাইছে আমি বিরক্ত হই। সে খুজে খুজে আমি যেসব জিনিস অপছন্দ করি, সেগুলো করছে। ইচ্ছা করেই করছে। এটা একটা খেলা। কেন সে আমার সাথে এ ধরনের খেলা খেলতে চাইছে আমি বুঝছিনা। আমি বিরক্ত হওয়া মানেই খেলায় হেরে যাওয়া।
চন্দ্রা বললো-" তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?"
"করো।"
"তুমি সিগারেট খাও কেন?"
"ভালো লাগে, তাই।"
"আমি যদি তোমাকে বলি, তুমি আর সিগারেট খাবে না, তুমি কতোটুকু রাগ হবে?"
আমি বললাম-" রাগ সবসময় খুব আপনজনের সাথেই করা যায়। আপনজন ছাড়া রাগ করা ঠিক না। আর তুমি ভালো করেই জানো, তোমার বলার কারনে আমি সিগারেট ছেড়ে দেবো না। আমার যেটা ভালো লাগে আমি সেটাই করি।"
"আমাকে একটা সিগারেট দেবে?"
"কেন?"
"খাবো।"
আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে তার হাতে একটা সিগারেট তুলে দিলাম।
চন্দ্রা যে আমাকে শুধু বিরক্ত করার চেষ্টাই করছে তা নয়। ভড়কে দেওয়ারও চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে সে আমার লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে। তার সাবলীলতা দেখে মনে হচ্ছে, সে বহুদিন ধরেই সিগারেট খায়। পৃথিবীতে কিছু মানুষ জন্মগতভাবে এডাপটেশন এর প্রতিভা নিয়ে আসে। চন্দ্রাও হয়তো তাদের মধ্যে একজন। সিগারেট ধরিয়েছে মানে সে নিশ্চয়ই আমাকে আরও কিছুক্ষণ জ্বালাবে। মেয়েটা প্রচুর কথা বলে। এখনও নিশ্চয়ই বলবে। কথা শুনতে ইচ্ছা করছে না।
সিগারেটে দুটো লম্বা টান মেরে চন্দ্রা বললো-
"চলো, একটা ছোট নৌকা কিনি।"
"নৌকা কিনে কি হবে?"
"পুকুরে থাকবে। রাতে ঘুরবো। তোমার পানিতে ঘুরতে কেমন লাগে?"
"ভালো।"
"আমারও খুব ভালো লাগে। ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির পিছে যে পুকুর ছিলো ওখানে আমি খুব সাতার কাটতাম। লম্বা গাছ ছিলো, গাছ থেকে লাফ দিয়ে পুকুরে পড়তাম। ইউনিতে ওঠার পরে আর পুকুরে নামা হয়নি, লাফঝাপও দেওয়া হয়নি। তুমি গাছে চড়তে পারো?"
"না।"
"ব্যাটাছেলে হয়ে গাছে চড়তে পারো না, তো পারোটা কি?"
আমি শীতল দৃষ্টি দিয়ে চন্দ্রার দিকে তাকালাম।
চন্দ্রা বললো-"চা খাবে? এনে দেই?"
চন্দ্রা এর যন্ত্রণা দিন দিন বাড়তেই থাকলো। তার মুল লক্ষ হচ্ছে আমাকে বিরক্ত করা। যদিও সে শুধু বিরক্তই করে, অন্য কিছু নিয়ে বেশি জোর টোর করে না। এই যেমন আমি দিনে ঘুমাই, রাতে জাগি- এটা নিয়ে তার মাথা ব্যাথা নেই। সেও একা ঘুমায়। এটা নিয়ে তার কোন অভিযোগ নেই। সে আমাকে বিরক্ত করে অন্যভাবে। আমি যখন লিখতে বসি, ঠিক তখনই সে এসে আমাকে হাজারটা প্রশ্ন করে। আমার কনসেনট্রেশন নষ্ট হয়।
সন্ধ্যার পর লিখতে বসেছি, এমন সময় চন্দ্রা আসলো।
"কি করো?"
"কিছু না।"
"ও আচ্ছা। লিখছো? কি লিখছো? কবিতা?"
"আমি কবিতা লিখিনা।"
"তাহলে কি লিখছো? আমাকে পড়ে শুনাও।"
আমি বললাম- "এটা আমার লেখার সময়। গল্প পাঠ করার সময় নয়।"
"চন্দ্রা, আমি কি তোমাকে একটা অনুরোধ করতে পারি?"
"কি অনুরোধ?"
"দয়া করে আমার লেখালিখির সময় এই রুমে আসবে না। আমার লেখায় সমস্যা হয়।"
"আচ্ছা, আসবো না। শুধু খাওয়ার সময় ডাকতে আসবো।"
"তোমার ডাকতে আসতে হবে না। ইদরিস মিয়া আসবে। ঠিক আছে?"
"আচ্ছা।"
চন্দ্রা গুনগুন করতে করতে চলে গেলো।
পরের দু দিনও খুব শান্তিতে গেলো। চন্দ্রার কোন সাড়া শব্দ নেই, ইদ্রিস মিয়া এসে রাতে খাবার দিয়ে যায় রুমে। কিন্তু তিন দিনের দিন ইদ্রিস মিয়া এলো না, তার বদলে এলো চন্দ্রা।
"চলো, ভাত দিয়েছি টেবিলে।"
আমি মেঘস্বরে বললাম- "ইদ্রিস মিয়া কই?"
"ইদ্রিস মিয়াকে বিদায় করে দিয়েছি।"
"কেন?"
"সারদিন বাসার মধ্যে একজন কর্মচারীর ঘুরাঘুরি আমার ভালো লাগে না। তাছাড়া অন্য একটা ব্যাপার আছে।"
"কি?"
চন্দ্রা হাসতে হাসতে বললো-" আমি জানি, ইদ্রিস মিয়াকে বিদায় করলে তুমি রাগ করবে। তুমি রাগ করেছো এটাও আমি জানি। এখন প্লিজ বলোনা, তুমি রাগ করোনি। আমি হতাশ হবো।"
আমি গম্ভীর মুখে যেয়ে টেবিলে বসলাম।
"মেজাজ কি বেশি খারাপ হয়েছে?"
আমি বললাম-" তোমার এটা করা উচিৎ হয়নি। ইদ্রিস মিয়া আমার সাথে অনেকদিন ধরে আছে। সে আমার সমস্ত পছন্দ অপছন্দ জানে।"
"তো কি হয়েছে? আমিও তো জানি।"
"তুমি কিভাবে জানবে?"
"জানি, যেভাবেই হোক। কেন? তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?"
"না।"
"ঠিক আছে। তুমি জিজ্ঞাসা করো, আমি উত্তর দেবো।"
"প্রয়োজন দেখছি না।"
"প্রয়োজন না হলেও জিজ্ঞাসা করো।"
"আচ্ছা, ঠিক আছে। বলো - আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার কি?"
"শিং মাছের ডিম দিয়ে সাদা ভাত। হয়েছে?"
"আমি একটা প্রাণীকে খুব বেশি অপছন্দ করি। বলতে পারবে সেটা কি?"
"টিকটিকি। হয়েছে?"
"বছরের একটা সময় আমার এলারজি এটাক হয়। বলতে পারবে সেটা কোন সময়?"
"শীতের শুরুতে।"
আমি চুপ করে রইলাম। চন্দ্রা আমাকে এই প্রথম খুব বেশি অবাক করেছে।
"ইদ্রিসের কাছে থেকে শুনেছো, না?"
"কি আজব! ইদ্রিসের কাছ থেকে শুনবো কেন?"
"তাহলে জানলে কিভাবে?"
"জানলাম। আরও অনেক কিছুই জানি। কিছু ভবিষ্যৎ এর কথাও জানি। কিভাবে জানি সেটা বলবো না। তবে এটা জেনে রেখো, আমি কারো কাছ থেকে শুনে বলিনি।"
"ও আচ্ছা।"
"বিশ্বাস করলে না?"
"করেছি।"
চন্দ্রা কিছু বলতে যেয়েও বললো না। শুধু একটু হাসলো। সে বুঝেছে আমি বিশ্বাস করিনি। এবং বলেও লাভ নেই।
আমি এখনো ভেবে অবাক হই- একটা বাড়িতে মাত্র দুটি প্রাণী। একজন ছটফটে, একজন নির্লিপ্ত। একজন কথা বলতে ভালবাসে, একজন নির্জনতাকে আলিঙ্গন করে রাখে। মেয়েটা কেমনে বাচতো? সারাদিন একা একা থাকতে তার দমবন্ধ হয়ে যেতো না?
ওর প্রতি আমার কোন খেয়াল ছিলো না। আমি আমার নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। এটা ঠিক উপেক্ষা করা না। চন্দ্রার প্রতি খেয়াল রাখাটা আমার আসলে জন্মায়ই নি। ওর ভালো লাগতো হয়তো বিকেলে ছাদে বসে নীল আকাশ দেখতে। বৈশাখের বৃষ্টিতে ভিজতে। রাত জেগে বাগানের দোলনায় দোল খেতে। পুকুরে নৌকার শখ ছিলো খুব ওর। আমি এগুলো জেনেও যেন না জেনে গেছি। আমি জানিনা, আমি কোন পৃথিবীতে ছিলাম। আমি জেগে থেকেও ঘুমিয়ে ছিলাম অন্য কোন পৃথিবীতে। চন্দ্রা সবই দেখতো। কিছু বলতো না। গভীর রাতে আনমনে লেখার ফাকে দরজায় চোখ পড়লে দেখতাম, চন্দ্রা দাড়িয়ে আছে। নিশ্চুপে চেয়ে চেয়ে দেখছে।
শ্রাবণ মাসের এক সন্ধ্যায় মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। চন্দ্রা আমার কাছে এসে বললো-
"ছাদে যাবে?"
"ছাদে যাবো কেন?"
"খুব ইচ্ছা করছে বৃষ্টিতে ভিজতে। যাবে?"
"আমার বৃষ্টি ভালো লাগে না।"
"ওহ। আচ্ছা, ঠিক আছে। সমস্যা নেই।"
চন্দ্রা সেদিন একা একা বৃষ্টিতে ভিজলো। অনেক ভিজলো। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ঠাণ্ডা লাগালো। রাতের বেলা গা কাঁপিয়ে তার জ্বর এলো।
আমার এমনিতেই বৃষ্টি নিয়ে অ্যালার্জি আছে। তারপরে কেউ যদি ইচ্ছা করে বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধায়, তাহলে মেজাজ খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক। ভেজার ইচ্ছা হলে ভিজুক সমস্যা নাই, একটু রয়ে সয়ে ভিজলেই তো হয়। জ্বর বানানোর মতো ভেজার কি দরকার?
দুই দিনের মাঝেই জ্বর নেমে গেলো। আমি চন্দ্রাকে বললাম- "এরকম বৃষ্টিতে আর কখনো ভিজো না।"
চন্দ্রা কিছুই বললো না। শুধু মুখ ঘুরিয়ে চুপ করে রইলো।
৭ দিন পরে আবারো মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টি নামার সাথে সাথে আমি আবিষ্কার করলাম চন্দ্রা তার রুমে নেই। ছাদে বসে বৃষ্টিতে ভিজছে। আমি এবার প্রচণ্ড রাগ করলাম। ঝাড়ি মেরে চন্দ্রাকে ছাদ থেকে নামিয়ে নিয়ে আসলাম। আমি স্পষ্ট বুঝছিলাম, কোন কারনে চন্দ্রার মন অসম্ভব খারাপ। ও হয়তো ছাদে বসে কাঁদছিল।
যে মেয়েটাকে সবসময় হাসিখুশি দেখি, ছটফট করতে দেখি, কথা বলতে দেখি, তার এই নিশ্চুপ বিষণ্ণতা আমার বুকে একেবারে কাটা হয়ে বিঁধে গেলো। আমার হঠাৎ মনে হতে লাগলো, কি জানি নেই, কি জানি নেই।
এবার চন্দ্রার আবারো গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। জ্বর পরদিন একটু কমে এলো কিন্তু ছেড়ে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। দুর্বল হয়ে তিন দিনের মাঝেই চন্দ্রা বিছানায় পড়লো।
চন্দ্রা বিছানায় পড়ার পর আমি অস্বস্তি নিয়ে খেয়াল করলাম, কেউ আর আমাকে রাতে ভাত খেতে ডাকতে আসেনা। রাতে না ঘুমিয়ে দরজার পাশে কেউ দাড়িয়ে থাকে না, লেখার মাঝে কেউ বিরক্ত করে না। এই প্রথম আমার মনে হতে লাগলো, আমি খুব অল্প কদিনেই নিজের অজান্তে চন্দ্রার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম। আমি বুঝলাম, মানুষ বেঁচে থাকার জন্য সজান্তে বা অজান্তে এক ধরনের আশ্রয় খোঁজে। চন্দ্রা আমার আশ্রয় হয়ে গিয়েছিলো। আমি না বুঝলেও আমি তার উপর নির্ভরশীল। চন্দ্রারও ঠিক একই ভাবে এখন আমাকে প্রয়োজন। খুব বেশি প্রয়োজন। আমি ছাড়া তাকে দেখার মতো এখন কেউ নেই। মানুষ বড় অসহায় একটা প্রাণী।
বাসায় বসে চন্দ্রার অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে লাগলো। জ্বর বাড়লো, শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। প্রবল জ্বরে তার সে আবোলতাবোল কথা বলা শুরু করলো। অবস্থা দেখে আমি চন্দ্রাকে হাসপাতালে ভর্তি করলাম।
সামান্য বৃষ্টিভেজা দিয়ে এতো অল্প সময়ে অবস্থা এতো খারাপ হয়ে যাবে, এটা আমি চিন্তাও করিনি। চন্দ্রার নিউমোনিয়া হয়ে গেছে। প্রচণ্ড জ্বর, নামার কোন লক্ষণ নেই। শ্বাসকষ্ট আরও বেড়েছে। অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম।
সেদিন রাতের দিকে চন্দ্রার শ্বাসকষ্ট একটু কমে এলো। অক্সিজেন মাস্ক খুলে দেওয়া হয়েছে। আমাকে ডেকে বললো-
"তুমি বরং বাসায় চলে যাও।"
"কেন?"
"আমার জন্য তোমার বিরক্তি লাগতে পারে। তুমি তো তোমার স্বাভাবিক রুটিনে নেই। বাসায় যাও।"
আমি কোন উত্তর দিতে পারলাম না। চুপ করে বসে রইলাম।
"জানো নীষ" চন্দ্রা বলতে শুরু করলো-" তুমি ভালবাসতে পারবে না, এটা জানার পরেও আমি তোমার পিছে কেন লেগে থাকতাম? আমি কখনো আমার বাবা-মা কে কষ্ট দিতে চাইনি জানো? আমার খুব সুন্দর একটা ছোট্ট স্বপ্ন ছিলো আমার ভবিষ্যৎ ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে। আমি ভেবেছিলাম, বাবা মা এর ইচ্ছায় বিয়ে করবো। মানুষটাকে অনেক ভালবাসবো। বাবা-মা তোমার সাথে আমার বিয়ে দিলেন, আমি হাসিমুখে মেনে নিলাম। নিজের ছোট্ট স্বপ্নটা বাসর রাতেই মরতে বসেছিলো, মারা যাওয়ার তাকে তার পাওনাটা বুঝিয়ে দিতেই তোমার সাথে একতরফা ভালোবাসার অভিনয় করে গেলাম।"
আমি বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে চন্দ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। হাসিখুশি সেই মুখটার আড়ালে যে এতো বড় অভিনয় ছিলো, তা কে জানতো?
আমি বললাম-" আচ্ছা, এসব কথা এখন থাক। বাসায় যেয়ে তারপরে বোলো।"
"আমি আর বাসায় ফিরে যাবো না, নীষ।"
"বাসায় ফিরে যাবে না, মানে কি?"
চন্দ্রা একটু হাসলো। হাসি দিয়েই বুঝিয়ে দিলো সে কি বলতে চাইছে।
আমি চিৎকার করে বললাম-" আমার সাথে আলতু ফালতু কথা বলবে না। একটা থাপ্পড় দিবো।"
চন্দ্রার জ্বর আস্তে আস্তে আবার বাড়ছে। মুখটা লাল টকটকে, হাত পা ঠাণ্ডা, নীল হয়ে আসছে।
চন্দ্রা আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো। হাঁপাতে হাঁপাতে ফিসফিস করে বললো-
"শোনো, তোমাকে একটা গোপন কথা বলি। আমি আগে থেকেই জানতাম এটার শেষ কিভাবে হবে। আমি এটাও জানতাম, এই জীবনে আমি তোমার ভালোবাসা পাবো না। তোমার কথাই ঠিক, নীষ। জিতে গেলে তুমি।"
আমার কি মনে হলো জানিনা। আমি দু হাত দিয়ে শক্ত করে চন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না।
আমি জড়িয়ে ধরার আগেই চন্দ্রা মারা গেলো।
----------------------------------------------------------
আমি এখনো চন্দ্রার জন্য অপেক্ষা করে আছি। রাত সাড়ে এগারোটায় সে আসবে। আমরা একসাথে ডিনার করবো। একসাথে বললে ভুল হবে, আমি ডিনার করবো, চন্দ্রা আমার পাশে থাকবে। সে প্রতিদিন এই সময়েই আসে। আমার খাওয়ার সময় আমার পাশে বসে থাকতে তার আনন্দ লাগে।
খাওয়া শেষে আমরা প্রতিদিন বাগানে এসে বসি। দোলনায় বসে বসে রাতের পুকুর দেখি। কালো পুকুরের অন্ধকারের মাঝেও একটা দুটা জোনাক জ্বলে। চন্দ্রা আমাকে বলে-
"একটা নৌকা কিনবে?"
আমি নরম গলায় বলি- "কিনবো। অবশ্যই কিনবো।"
"তুমি আর আমি নৌকায় চড়ে সারারাত পুকুরে ঘুরবো। কেমন?"
"আচ্ছা।"
চন্দ্রা সরে এসে আমার গা ঘেঁষে বসে। পাশাপাশি বসে আমরা রাতের তারাভরা আকাশ দেখি। সে অবাক হয়ে আমার কাছে সপ্তর্ষিমণ্ডল, কালপুরুষ, সিগনাস এর গল্প শোনে। তাকে ছাড়া একা একা আজকাল আমার আকাশ দেখতে ইচ্ছা করে না।
চন্দ্রা মৃত্যুর আগে আমার ভালোবাসা পায়নি, দ্বিতীয় জীবনে পেয়েছে। প্রথম জীবনে না পেয়ে অবশ্য ভালোই হয়েছে। প্রথম জীবনের শেষ আছে, দ্বিতীয় জীবনের শেষ নেই। দ্বিতীয় জীবনের ভালবাসাটাও অন্যরকম। সেখানে শারীরিক ভালোবাসার কোন অস্তিত্ব নেই। দ্বিতীয় জীবনের ভালোবাসা স্বর্গীয় ভালোবাসা। অনন্তকালের জন্য ভালোবাসা। আমি তাকে এখন অনন্তকালের জন্যই ভালবাসি।
গভীর রাতে তার মায়াভরা মুখটা দেখতে আমার বড় ভালো লাগে।
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন