অন্ধকারে বসে আছি।
আলোটা চলে গেলো হঠাৎ করে। চারিদিক নির্জনতায় ডুবে গেছে। নির্জনতা ভাঙতে কানের কাছে মশা এর মাঝেই গুনগুণ শুরু করে দিয়েছে। অন্ধকার এলে তাদের বড্ড আনন্দ হয়। যদিও অন্ধকারে বসে থাকতে আমারও খুব একটা খারাপ লাগছে না। চারপাশের অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছি না, এই যা।
অবশ্য আমি এমনিতেও চারপাশের সব কিছুই যে দেখতে পাই, তা নয়। প্রাণী হিসেবে আমি একটি অন্ধ প্রাণী। পুরোপুরি নয়, আংশিক। আমার চোখ ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রামের শুধুমাত্র একটা নির্দিষ্ট অংশ ব্যবহার করে দেখতে পায়। সেটার নাম আলো। আমার চোখ ইনফ্রা-রে, কিংবা আলট্রাভায়োলেট, কোনটাতেই সংবেদনশীল না। প্রাণী হিসেবে আমাকে সেই হিসেবে আংশিক অন্ধ বলাই যুক্তিযুক্ত। কানের কাছে মশার শব্দ শুনছি যদিও এখন, তারপরেও আমি বধির। আংশিক বধির। আমার থেকে একটা কুকুর কিংবা মাকড়শার শ্রাব্যতার সীমা অনেক বেশি।
মানব প্রজাতির ধারনা, তারা তাদের দুটি চোখ ব্যবহার করে সবই দেখতে পারে। দুই কান দিয়ে সবই শুনতে পারে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আশেপাশে তারা যেই জগতটা দেখে, তার মাঝে অন্য কোন অদৃশ্য কিছুই থাকতে পারে না। তারা কিন্তু পুরোটা দেখে না, তারপরেও নিজেদের যুক্তি প্রতিষ্ঠায় সর্বদা অগ্রসর। এই প্রজাতিটির সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে- তারা তাদের নিজেদের সীমাবদ্ধতাগুলো সহজে মেনে নিতে শিখেনি। কিংবা মেনে নিলেও সেগুলো সম্পর্কে ভাবতে চায়নি। তারা সবসময় নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে দেখতে চেয়েছে। অনেক ত্রুটিপূর্ণ এবং নিকৃষ্ট হয়েও তাদের তেমন একটা লজ্জা নেই।
পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, আমি কেন তাদের সীমাবদ্ধতা খুজে বেড়াচ্ছি? আমি কে? আমার পরিচয় কি?
প্রথমটির সুস্পষ্ট উত্তর আমার জানা নেই। বলতে পারেন, সত্যের অন্বেষণ। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর আমি জানি। বেশ ভালোভাবেই জানি।
প্রথমেই বলে রাখি, পরিচয় এর ক্ষেত্রে আমি "নাম" নামক শব্দটিতে বিশ্বাসী নই। আমি স্রষ্টাপ্রদত্ত কোন স্বতন্ত্র নাম নিয়ে পৃথিবীতে আসিনি। পৃথিবীতে এসে আমি নাম পেয়েছি একটা। সেটা মানবপ্রদত্ত নাম। নকল নাম। পৃথিবীতে কিছু সময় কাটানোর জন্য দেওয়া নাম। আমার আসল নাম কি, এটা কেউ জানে না। জানা সম্ভব না।
সুতরাং আমি প্রকৃত নামবিহীন একটি প্রাণী।
আকৃতিতে আমি কিছুটা গোলাকার এবং ছোট। একটা পাত্রের মধ্যে রাখতে চাইলেও রাখা যাবে হয়তো। মুল শরীরটা শক্ত কিছু নয়, বরং এক ধরনের নরম পদার্থের তৈরি। পদার্থটির নাম লিপিড। বাইরের খোলসটা অবশ্য বেশ শক্ত। খোলস বিহীন আকৃতির কথা চিন্তা করলে প্রজাতির অন্য সবার সাথে আমার বিশেষত কোন পার্থক্য নেই। তবে খোলসে পার্থক্য অনেক। পার্থক্য এতোটাই বেশি, যে কারো খোলসের সাথে কারোরটা পুরোপুরি মিলে না।
নারী এবং পুরুষ উভয়ের খোলসের গঠন কিছুটা ভিন্ন। পুরুষদের খোলস তুলনামুলকভাবে শক্ত। নারীদেরটা কোমল ও নমনীয়। খোলসের ভেতরে থাকতে থাকতে প্রজাতির সবাই নিজের আসল চেহারাটাই ভুলে গেছে। অবশ্য চেহারা ভুলে যাওয়ার পিছে আয়নার ভূমিকা মুখ্য। আয়নার সামনে দাঁড়ালে শুধু খোলসটাই দেখা যায়। আসল চেহারা বা অবয়ব খোলসের আড়ালে সবসময় ঢাকা।
আমার প্রকৃত দেহের চেয়ে প্রায় ১২ গুন লম্বা আমার খোলসটা। এইটুকুন একটা দেহ ঢাকতে এতো বড় খোলসকে হঠাৎ করে বাহুল্য মনে হলেও সেটার প্রয়োজন আছে। এটি ছাড়া আমার মুল দেহের দক্ষতাগুলির পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বহিঃপ্রকাশ করা সম্ভবপর হতো না। পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীকুল থেকে আমাদের খোলসটির গঠন প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল এবং দুর্বোধ্য।
খোলসের উপরের দিকে দুইপাশ থেকে যে দুটি উপাঙ্গ বের হয়েছে, তাকে বলা হয় হাত। উপাঙ্গ হিসেবে এটি বেশ প্রয়োজনীয়। কানের কাছে এখন যে মশা গুলি প্যান প্যান করছে, ইচ্ছে করলেই আমি চটাস করে এক থাপ্পড় দিয়ে পিষে ফেলতে পারবো আমার দুই হাত ব্যবহার করে। আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে পুষ্টি দরকার, সেটাও আমি গ্রহন করি এই হাত দিয়ে। হাত না থাকলে পুষ্টি হয়তো অন্যভাবে গ্রহন করতে হতো। সেটি কিছুটা জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। হাতের সবচেয়ে বড় কাজ যেটি, সেটি হচ্ছে আত্মরক্ষা। আক্রমণও করা যায় এই উপাঙ্গ দিয়ে, কিন্তু আক্রমনও এক ধরনের আত্মরক্ষা।
নিচের দিক থেকে হাতের মতোই আরও দুটি উপাঙ্গ বের হয়েছে। হাতের মতো এদেরও পাঁচটি করে আঙ্গুল। লম্বায় যদিও এই উপাঙ্গ দুটি হাতের চেয়ে লম্বা এবং তুলনামূলকভাবে শক্ত। এদের নাম পা। উপাঙ্গ দুটির কাছে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। এরকম অংশ না হলে আমার হয়তো চিরজীবন শুধুমাত্র একটি স্থানেই বসে পচে মরতে হতো। চেষ্টা করলে হয়তো টেনে হিঁচড়ে স্থানান্তর সম্ভব হতো, কিন্তু খোলসটা এতো সুন্দর থাকতো না। টানা হেঁচড়ার আঁচড় আর দাগে সে তার সৌন্দর্য হারাতো।
উপাঙ্গ ছাড়া খোলসের বাকি অংশটাকে মুল দেহ বলা হয়। খোলসের এই অংশটার মধ্যে আমাকে বাঁচিয়ে রাখার যাবতীয় প্রণালী লুকোনো আছে। তারা আমার বিশ্বস্ত ভৃত্যের মতোই কাজ করে চলেছে নিরলস। আমি যা বলি, তারা নিখুঁতভাবে তাই করার চেষ্টা করে।
খোলসের সবচেয়ে উপরের অংশ, যেটি খোলসের বাকি অংশগুলোর তুলনায় ছোট এবং গোলাকৃতি, সেখানে আমার বসবাস। এটি আমার খোলসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারন এখানে রয়েছে আমার দুটো অপরিহার্য ইন্দ্রিয়- চোখ এবং কান। এটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পিছে আরও একটি কারন আছে। অংশটির নিচের দিকটি খোলসটার "চেহারা " নির্ধারণ করে। সমস্ত খোলসটা যে পাতলা হলদে পর্দা দ্বারা আবৃত, তাকে আমরা চামড়া বলি। যার চামড়া যত বেশি সুন্দর, সে ততো বেশি আকাঙ্খিত।
আমার প্রথম স্ত্রীর চামড়াটা অনেক সুন্দর ছিলো। শুধু চামড়া বললে ভুল হবে, পুরো খোলসটাই সুন্দর ছিলো। এই সুন্দর খোলসটার কারনেই তার ভেতরে সৃষ্টি হয়েছিলো অদমনীয় এক অহংকার। সামান্য একটা খোলসকে নিয়ে এতো অহংকারের কি থাকতে পারে, আমি ভেবে পেলাম না।
তীব্র অহংকার একটি মানসিক ব্যাধি। এই ব্যাধি দিন দিন কমে না, বরং বেড়েই চলে। ব্যধিগ্রস্ত এই রমণীটির জন্য তাই আমার অনেক মায়া হল। আমি তাকে ব্যাধি থেকে মুক্তি দিতে চাইলাম। খোলস থেকে সৃষ্ট ব্যাধি থেকে মুক্তি দেওয়ার উপায় একটাই ছিলো, তার খোলসটা কেটে তাকে বের করে নিয়ে আসা। কিন্তু খোলস ছাড়া সে বাঁচল না। দুঃখজনক।
প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর আমি দীর্ঘকাল স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিলাম সমাজ থেকে। আমার মুখোশটা এতোটাই পবিত্র ছিলো যে কেউ ঘুনাক্ষরেও সন্দেহ করতে পারেনি আসলে কি ঘটেছিলো। আমার স্ত্রীকে মানসিক বিকারগ্রস্ত হিসেবে প্রমান করতেও আমার তেমন কোন কষ্ট করতে হয়নি। বাস্তবিকপক্ষে আমি তার চেয়েও হাজার গুন বেশি ধূর্ততা করার সামর্থ্য রাখি।
স্বেচ্ছা নির্বাসনের দীর্ঘ সময়ে প্রথম স্ত্রীর আনন্দমাখা স্মৃতিগুলি আমাকে কিছুটা হলেও বিচলিত করে ফেলেছিলো। আমি তার শাস্তিস্বরূপ হিসেবে নিজেকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করতে সচেষ্ট হলাম। উপাঙ্গসমুহকে কাঁটাতারের চৌবাচ্চায় জড়িয়ে রেখে তার মধ্যে থেকে মৃদু বিদ্যুৎ প্রবাহ ছিলো আমার সবচেয়ে প্রিয় প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে একটি। যদিও আমার উপাঙ্গসমুহ আমার আদেশ ছাড়া পুরোপুরি নির্বোধ এবং অসাড়। যন্ত্রণার অনুভূতিগুলো ভোগ করার ক্ষমতা তাদের নিজেদের নেই। সেই অনভুতিটাও আমাকে বলে দিতে হয়। আমি বলি দেখেই তারা প্রাপ্য যন্ত্রণাটুকু অনুগত ভৃত্যের মতো আমার কাছে পৌঁছে দিতো।
স্বেচ্ছা নির্বাসন কালে মোটামুটিভাবে সব অনুভুতির সাথেই সম্পৃক্ততা ছিলো, শুধু জৈবিক অনুভুতি বাদে। অনুভূতির স্বাদ পুরোপুরি গ্রহন করার জন্য জৈবিক অনুভূতির পরিপূর্ণ বিকাশের প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে আমি আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে ঋণী। তার খোলসটা অনেক সুন্দর না হলেও তিনি ছিলেন একজন যথেষ্ট কামাতুর মহিলা। প্রথম স্ত্রীর তুলনায় তিনি কিছুটা চালাকও বটে। কিন্তু চালাক প্রাণীও মাঝে মাঝে নির্বোধের মতো ভুল করে। আমার দ্বিতীয় স্ত্রীও করেছিলেন। কি করেছিলেন, সেটা বলতে চাচ্ছি না। তবে তিনি বুঝতে পারেন নি, তার উচ্ছৃঙ্খল জীবনের প্রায় পুরোটুকুই আমার জানা। বেচারা।
দ্বিতীয় স্ত্রীর "অন্তর্ধানের" পর আমার খুব একটা খারাপ লাগেনি, যতটা লেগেছিলো প্রথমবার। এবার আর নিজেকে নির্বাসনে নেইনি। বেশ শান্তিতেই কাটছে জীবন। সম্প্রতি তৃতীয় নারী হিসেবে একজন আমার জীবনে আসার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মানুষ হিসেবে চিন্তা করলে আমি অত্যন্ত সুদর্শন এবং রূপবান। আমার খোলসের এই রূপই বোধ হয় তার প্রেমে পড়ার একমাত্র কারন। আমি তাকে যতই দূরে রাখতে চাচ্ছি, সে ততোই বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। মহা যন্ত্রযন্ত্রণা।
সুদর্শন হয়ে অবশ্য এক দিক থেকে ভালোই হয়েছে। বোধ করি এ কারনেই আমার অতীব সুন্দরী এবং অহংকারী প্রথম স্ত্রী আমার সাথে থাকতে এসেছিলেন। খুব সম্ভবত একারনেই কামাতুর দ্বিতীয় স্ত্রীটি আমার সুন্দর সুঠাম শরীরটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলো। আমি রূপবান না হলে সেটি কি সম্ভব হতো? মনে হয়না।
বলতে দ্বিধা নেই, আমি আমার দুই স্ত্রীর কাছে অনেক অনেক ঋণী। তাদের মস্তিস্ক থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। কৃতজ্ঞতা তো প্রকাশ করাই উচিৎ। তাই নয় কি?
বর্তমানে আমার খোলসের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া মেয়েটির সরলতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বেশি সহজ সরল মেয়ে বোধহয়, তাই ঠাস করে প্রেমে পড়ে গেছে। আমার হাসি পাচ্ছে এটা ভেবে, মানুষ কতো সহজেই খোলসের প্রেমে পড়ে। হা হা হা। সহজ সরল মেয়েটার মস্তিষ্কটাকে শাস্তি দিতে ইচ্ছা করছে না। আমি তাকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখতে চাইছি। কাছে এলেই কোন না কোন ছুতোয় তাকেও শাস্তি দিয়ে বসবো।
সব কিছুর মুলে এই খোলসটা। খোলসটা বদলানো দরকার। নিজের প্রকৃত চেহারার সাথে মানানসই একটা কদাকার মুখোশ খুঁজছি। পেলে মন্দ হয়না। খোলস বদলানোর একটা চেষ্টা করে দেখা যেতো।
"মানুষ" শব্দটি অনেক বিভ্রান্তিকর। মস্তিস্ক আর তার মুখোশ- দুটি মিলে তৈরি হয়েছে মানুষ। যেখানে মুখোশ আছে, সেখানেই মিথ্যা আছে। আমার মিথ্যা ভালো লাগে না।
একটি মস্তিস্ক হিসেবে নিজের পরিচয় দিতেই আমি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
----------------------------------------------------------------------------------
দ্বিতীয় পর্ব- একটি খুন, অথবা নিছক আত্মহত্যার গল্প।
শেষ পর্ব- অন্ধকারে জমাট বাধা কিছু পাপ এবং অপরাধবোধ ।।