আমি এখানে বসে আছি, একা। এই ঘরে। আমি এবং শূন্যতা। বদ্ধ রুম। খোলা জানালা। আমি ও বিষণ্ণতা। ফ্লাওয়ার ভেস এর ফুল গুলো বিবর্ণ, মরচে পড়া। আমি বসে আছি, একা। খোলা এবং বদ্ধ জানালা।
জগত পরিবর্তিত। আমি বসে আছি এখানে, একা। শক্ত পাথুরে জায়গা। সূর্য নেই, হয়তো সন্ধ্যা। অথবা অতিপ্রাকৃত আলোর খেলা। দূরে সমুদ্রের গর্জন। ঝড়ো হাওয়া। একই সাথে শুষ্ক এবং আর্দ্র। আমি বসে আছি, একা। শক্ত পাথর, ছেড়া খড়কুটো, জলে ভাসা। দিন নেই, রাত্রি নেই। নির্জন প্রান্তরে থেমে যাওয়া শুধু সন্ধ্যা।
কেউ একজন আসে। অনভিপ্রেত এবং অনাকাঙ্খিত। আমার বিরক্ত লাগে। আমি এখানে একা থাকতে চেয়েছিলাম।
-কে তুমি?
সে একটু হাসল। তুমি নিজে জানো না, আমি কে?
-আমি তবুও তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।
সে আবারো হাসল। নিকষ, কালো হাসি। তার অক্ষিবিহীন দৃষ্টি আমাকে ভেদ করে চলে অযুত, লক্ষ বার। মনে হল অনন্ত কাল ধরেই আমরা মুখোমুখি হয়ে আছি।
ধীরে ধীরে আমার ভেতরটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠে। প্রবল আক্রোশে সবকিছু ছিন্নভিন্ন করে দিতে ইচ্ছা হয়। লাল টকটকে লাভা বুক বেয়ে নামে, গড়িয়ে গড়িয়ে। পুড়ে যাওয়া মাংসের তীব্র গন্ধ আমাকে মনে করিয়ে দেয়, আমি এখনো বেঁচে আছি।
আমি তার দিকে মনোনিবেশ করি। সে আর কতকাল অভিনয় করে কাটাবে?
-কেন তুমি আলাদা সত্ত্বা হচ্ছো না? কেন তুমি নিজের আসল রূপে পরিবর্তিত হতে চাও না? তুমি আলাদা হও। তোমার নিজের মতো করে আমাকে উত্তর দিতে শিখো। কোথায় তোমার স্বকীয়তা?
সে এবার আর হাসেনা। তাকেও ভর করে বিষণ্ণতা। কি আশ্চর্য!! দীর্ঘশ্বাস এর শব্দ হিসহিস করে সাপের মতো ফনা তুলে দূর থেকে বহুদুরে মিলায়।
বিষণ্ণ কণ্ঠ আমাকে শুধু জিজ্ঞাসা করে- তুমি কেন এখানে এসেছ?
-আমি তোমাকে চিনতে চাই। আমি জানতে চাই তুমি কে?
-আমি যদি এখানে তোমাকে আসতে না দিতাম?
-তোমার সেই ক্ষমতা নেই। তুমি কিভাবে আমাকে আটকাবে? আমি চাইলেই উপস্থিত হতে পারি এখানে। আমি চাইলে তুমি আসতে বাধ্য। বল তুমি!!! তুমি বাধ্য না?
ঠা ঠা করে হেসে উঠে সে। তার তীব্র ক্রুর অট্টহাসি প্রতিধ্বনিত হয় পাথরে পাথরে, সৃষ্টি করে এক বিচিত্র কম্পন। সেই কম্পন ছড়িয়ে পড়ে রক্তের প্রতিটা কনা থেকে কনায়,শিরা থেকে ধমনীতে।
-চুপ করো!!! তোমার এতো আস্পর্ধা হয় কি করে? তুমি তো আমারই সত্ত্বা।
-তুমি এখনো তোমার ছোট্ট গণ্ডিটার বাইরে বের হতে পারো নি -শ্লেষ মাখানো কণ্ঠস্বর যেন আমার বুকে তীক্ষ্ণ ফলার মতো বিঁধে।
-ওটা সমুদ্রের শব্দ নাকি? এতো ফুসে উঠেছে কেন ওটা? ঠিক যেন জীবন্ত কিছু!!
-এমনি। তুমি নামতে চাও সমুদ্রে? দেখতে চাও সমুদ্রের তল?
-না।
-তুমি চাইলে আমি সমুদ্রকে শান্ত করে দিতে পারি, ঝড়ো হাওয়া কমিয়ে নিয়ে আসতে পারি মৃদুমন্দ ঝিরি ঝিরি বাতাস। আনবো?
-না, তার প্রয়োজন নেই। এটাও সুন্দর। আমি এই সৌন্দর্যটাকে বুঝতে চাই।
-সৌন্দর্য কি?
-সৌন্দর্য হল আলো আর ছায়ার খেলা। রঙের সাথে রঙের মিল।
-এখানে কোনটা আলো? কোনটা ছায়া?
-আমি জানি না।
-কেন জানো না? অবজ্ঞাভরা কণ্ঠে সে আমাকে জিজ্ঞাসা করে। এসব কিছুই না তোমার কল্পনা? তোমার সৃষ্টি?
আমি মাথা আঁকড়ে বসে থাকি। সমুদ্রের গর্জন আর বিক্ষুব্ধ বাতাস আমাকে ছিঁড়ে ফেলতে চায়। আমার উপস্থিতি তাদের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে।
ও চলে যাচ্ছে। ধীর পায়ে। খুড়িয়ে, খুড়িয়ে।
আমি উঠে বসি। এখন অনেক রাত। জানালার পর্দার ফাক থেকে অল্প একটু নিয়নের আলো এসে পড়েছে দেয়ালের উপর। ছায়া বেয়ে হেটে চলে-ছোট একটা ইঁদুর। হ্যা, ওটা ইঁদুরই তো।
সারা ঘর জুড়ে অন্ধকার। বাতাসের ঘরঘর শব্দ ভালো লাগে। পুরো বাসাটা হেটে বেড়াতে ইচ্ছা করছে। নিঃশব্দে হেটে বেড়াই এঘর থেকে ওঘরে। ঠিক যেন ইঁদুর। হয়তো কেউ আমাকে তেমনি ভাবেই দেখছে যেভাবে আমি ইদুরকে দেখছি। হা হা হা। কেউ ভয় পাবে না তো আবার?
ও চলে গেছে।
আমি আমার রুমে ফিরে আসলাম। রুমের ঠিক মধ্যিখানে দাড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে। এখন রাত কটা বাজে? আড়াইটা? অথবা তিনটা? আমি অপেক্ষা করে আছি। ও চলে গেলো আমাকে ছেড়ে। আমার বুকটা ভেঙে আসে। আমি তাকে খুজে পাচ্ছি না।
-তুমি কি ভয় পাচ্ছো?
-না তো!!! আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি।
তার ধাতব হাসি রাত্রির সব নিরবতা যেন ফালি ফালি করে কেটে ফেলে।
তুমি তো আমাকে আর আনতে পারবে না। সে প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। মৃত্যুর সাথে সাথে তুমি আর তোমার কল্পনার অবলুপ্তি ঘটবে।
আমি বিভ্রান্ত হলাম। মৃত্যুর পর আমি আর চিন্তা করতে পারবো না?
-না।
-এটাই কি শূন্যতা?
-হয়তো। আমি জানি না তোমরা এটাকে কি বল।
-সেটা কেমন? তুমি দেখেছো? তুমি অনুভব করতে পারো?
-পারি।
-সেখানে আমার অস্তিত্ব নেই?
-না, তুমি শুধু ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন তুচ্ছ কিছু নিউরনের সমষ্টি। তুমি পার্থিব। তোমার শেষ আছে। তুমি কিভাবে পরিপূর্ণ ভাবে অপার্থিব জগতে থাকবে?
তার বিদ্রূপাত্মক কণ্ঠ দেয়ালে বাধা পেয়ে ফিরে ফিরে আসে।
-আমি না থাকলে তোমার অস্তিত্ব থাকে কি করে?
-আমি জানি না।
-তুমি বছরের পর বছর এভাবে থাকতে পারো? চিন্তা না করে?
-পারি।
-আমি চিন্তা করতে ভালোবাসি।
-তোমার ভালোবাসার অপমৃত্যু ঘটবে। আমি কথা দিচ্ছি।
সে দুলে দুলে হাসে।
-কি নিষ্ঠুর তুমি!!! তুমি কে?
-আমিই তুমি। তুমি আমার ছোট্ট ক্ষুদ্র একটা অংশ।
-তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি পরাধীন। তুমি শুধু আমার কল্পনার তৈরি। তোমার কোন অস্তিত্ব নেই। আমি চাইলেই তোমাকে শেষ করে দিতে পারি।
-আমি থাকবো। আমি নিরাকার হয়েই থাকবো।
সে থামল। দেয়াল ঘড়িটা টিক টিক আওয়াজ করেই চলেছে। ওটাকে খুলে ছুড়ে ফেলে দিলে কেমন হয়? আওয়াজ ধীরে ধীরে বাড়ছে। ছোট থেকে বড়। বড় থেকে ছোট। আবার বড়। তীব্র এবং ভোঁতা। উফ, অসহ্য।
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম- তুমি আমাকে মুক্ত করতে পারো?
-তুমি আমার উপর পরাশ্রয়ী। আমার উপর আশ্রিত থেকে তুমি চিন্তা করো। একটা সময় তুমি ই আমাকে ছেড়ে যাবে। আমি এখানেই থাকবো, যুগ যুগ ধরে। মহাকালের বিস্তীর্ণ সময় ধরে আমার অস্তিত্ব ছিল, আছে,থাকবে। আমার সৃষ্টি নেই, আমার ধংস নেই।
আমি বসে আছি, একা। এক টুকরো আকাশ। খোলা জানালা। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি আর আমার চিন্তার অবলুপ্তি ঘটবে। মৃত্যু প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। ও চলে গেছে। এখানে প্রচুর বাতাস। বাতাস শুস্ক এবং আর্দ্র।