
ঈদ মানে আনন্দ ।
আমি এ পর্যন্ত যতোজন মানুষের সাথে ঈদ বিষয়ে কথা বলেছি , প্রায় সবাই ঈদ নিয়ে ভীষণ ডিপ্রেসড । “সেই দিনকি আছে” , “আগে কত কি করতাম” , “আগে গরুর মাংস ৪০ টাকা কেজি ছিলো” ইত্যাদি ইত্যাদি । কিন্তু , ঈদের কথা বললেই সবার চোখ চকচক করে ওঠে , বাসে – ট্রেনে – লঞ্চে বাদুরঝোলা হয়ে মানুষেরা যখন ঈদে বাসায় ফেরে তখন তাদের জোখমুখ আনন্দে ঝলমল করে ।বাসায় যাইতেছি , এই আনন্দ রাখার যায়গা নাই । বাসায় ফেরামাত্র ফেসবুকে স্ট্যাটাস “ হোম, সুইট হোম “
আমি জানিনা এই কথাটা কার মাথা দিয়া আসছিলো , কিন্তু কথাটা চিরন্তন সত্য । হোম , বাড়ি , ঘর , দেশ – তাকে যেজন যেনামেই ডাকুক না কেন , তার স্থান হৃদয়ের অতি সন্নিকটে । আর বাসায় আসার জন্য , পুরনো মাঠে বসে হারানো বন্ধুদের সাথে তাসের আড্ডার জন্য , অথবা বাবার পাশে বসে থাকা , অথবা মায়ের হাতের রান্নার জন্য , ঈদের চেয়ে ভালো কোন অজুহাত নেই ।
ঈদ বললেই মনে পড়ে যায় নিজের ঈদের কথা ।
ঈদ অবশ্যই আমার কাছে ভীষণ বিশেষ কিছু ।রোযার শেষের দিকে কোন কিছুই যখন আর ভালো লাগে না , দিনগুলো ভীষণ বিরক্তিকর লাগে । তখন , আকাশের বুক খুজেঁ পাওয়া একফালি চাঁদ এমনকি নিল আর্মস্ট্রং আর চেয়ে বেশি আনন্দ দিতে পারে । আমারও ঈদ শুরু হত এই চাঁদ দেখা ও পটকা ফোটানোর মাঝ দিয়েই । আহা , স্ল্যাশের গিটারের চেয়েও শতগুণ মধুর ছিলো সেই পটকার বিকট শব্দ ।
পটকার কথায় মনে পড়ল । একবার “বুড়িমা” নামক পটকার বিপুল খ্যাতি শোনা গেল । শোনা গেল , এটা নাকি এ্যাটম বোমার মত শব্দ করতে সক্ষম । আমরা তখনও জানতাম না , আসলে এ্যাটম বোমা কিরকম শব্দ করে ঠিক , তবে পটকা ফোটাবার পর যারপরনাই হতাশ হয়েছিলাম ।
এক ঈদে লাইটওয়ালা জাম্প কেডসের উদ্ভাবন হলো । আমার শিশুমনে তা বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করলো তা বলাই বাহুল্য ।দি নিউ এ্যাডভেঞ্চার অব সিনবাদ আর পাঁচ মিনিট পর পর ধুক ধুক বুকে জাম্প কেডসের বিজ্ঞাপন । আমি দিনে রাতে , শয়নের স্বপনে শুধু জাম্প কেডস দেখতে থাকলাম , যেদিকে তাকাই শুধু জুতার নিচে লাল বাতি ।
আবদার শুনে বাবা আকাশ থেকে পড়লেন । বাবা ভীষণ অসংসারী লোক । সংসার ব্যতীত জগতের আর সকল বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান । কিন্তু তার মাথায় আমি কিছুতেই এই কেডস কেনার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে পারলাম না । সারাদিন বোঝাবার পরে তার একটাই প্রশ্ন ,“ তুমি জুতোর আলো দিয়ে কি করবে ? “
সুতরাং , শেষ ব্রক্ষাস্ক্র প্রয়োগ করতে বাধ্য হলাম …. “ ভ্যা……………” এবং দিবস সমাপ্ত হবার পূর্বে আলোকিত পদযুগল ।
ঈদের সকালে বাবা আর আমরা তিন ভাই , একটা বড় পাটি নিয়ে রওনা দিতাম ঈদগাহের দিকে । ঈদের সকালে সবচেয়ে কষ্টদায়ক কাজ ছিলো সকালে হিমশীতল পানিতে গোসল করা … কিন্তু নতুন পান্জাবী আর আতর দিয়ে যখন বাবার হাত ধরে ঈদগাহের দিকে এগিয়ে যেতাম , দারুণ লাগতো ।
তারপরে ঈদগাহে চলত “ঈদগাহ উন্নয়ন কমিটির” চাঁদাবাজি আর দুই মিনিট নামাযের পর দুই ঘন্টার আকুল মোনাজাত । মোনাজাতের মাঝে একটা জিনিসই চাইতাম , এই মোনাজাত তাড়াতাড়ি শেষ হোক ।
আমার মনে আছে , আমরা অনেক বড় ফ্যামিলি ছিলাম । মধ্যবিত্তের সংসারে বাবার সাধ্য ছিলো না আমাদের সব ভাইবোনের আবদার পূরণ করবেন তিনি । মা সেলাই খুব সুন্দর করতেন । প্রতি ঈদের আহে দেখতাম মা বাটারফ্লাই সেলাই মেশিনে ঝুঁকে জামা বানাচ্ছেন , আমার ঈদের জামা । পোশাক হিসেবে তা হয়তো কখনোই খুব যুতসই কিছু ছিলোনা , কিন্তু ঈদ , নতুন জামা – সে আমার কাছে এক বিশাল ব্যাপার ।
আর মনে আছে জর্দা রান্নার কথা । মায়ের হাতের জর্দা , তার স্বাদই অন্যরকম । ঈদের আগের দিন রাত্রে মা কিসমিস আর বাদাম পানিতে ভিজিয়ে রাখবেন , আর একটু পর পর রান্নাঘরে ঘুরে আমি চুরি করে খেয়ে ফেলবো , এর মজাই অন্যরকম । আমি কখনো বুঝিনি , আমার চুরি করাটা হিসেব করে মা পানিতে ভেজাতেন ।
ঈদে সবথেকে লজ্জাজনক কাজ ছিলো সালামী আদায় করা । আমি কেন যেন কিছুতেই পারতাম না । একবার কার যেন পাল্লায় পড়ে একটা সালামী-সংঘে ডুকে গিয়েছিলাম , দেখি এতো চমৎকার ব্যাপার । কোনমতে একটু ঝুকে পা ছুয়েঁ দিলেই চকচকে দশটাকার লাল নোট …. কি মজা । মোটামুটি যাকে কখনোই দেখিনাই , চিনিনা , তাকেও সেবার দুবার করে সালাম করেছিলাম সেইবার ।
ঈদে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে হবে …প্রশ্ন হলো কোথায় ঘোরা যায় ? অতি জটিল প্রশ্ন , কোন সন্দেহ নেই । এমনকি ছেলেবেলাতেও আমরা ঘোরার জন্য খুব বেশি জায়গার কথা মনে করতে পারিনি । বন্ধুদের বাসা , ভিডিও গেমসের দোকান , কোকাকোলার লাল বোতল আর খুব বড়জোড় অন্ধকার গলিতে ঢুকে সিগারেটে বেমক্কা টান দিয়ে দমকা কাশি – এটুকুই ।
তবে গ্রামে দেখেছি মার্বেল খেলা হত । শুধু নির্দোষ মার্বেল নয় , টাকা দিয়ে মার্বেল খেলা । সালামীর বদৌলতে সবার পকেট সরগরম , সো মানি ইজ নো প্রবলেম , প্রবলেম ইজ ইগো । কোপা সামসু ।
একটু যখন বড় হলাম তখন দেখি রাস্তায় ব্যাঙের ছাতার মত শামিয়ানা টাঙ্গিয়ে কোকের দোকান । ধুমসে হিন্দি গান বাজছে , এরই মাঝে দুই তিন কেস কোকাকোলা আর গোটাদশের প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে সদ্য গোঁফ গজানো যুবসমাজ । হাড় জিরজিরে দেহ , চকচকে পান্জাবী , সিগারেট আর কায়দা করে রিকশাবহুল তরুনীদের কটাক্ষ করে শিষ , মামলা ডিসমিস ।
মা মারা গিয়েছিলেন রমযান মাসে , ২০০১ সালে । ১১ রমযান । সেই ঈদ , আমি , আমরা কেউ কখনোই ভুলতে পারবো না …. কোন নতুন রান্না নেই , কোন কোলাহল নেই , পুরো বাসাটাকে কেউ যেন নৈশব্দ্যের একটা চাদরে মুড়ে দিয়েছিলো । আমরা সবাই নামায পড়লাম , মা’র কবর যিয়ারত করলাম । আমাদের ঈদ শেষ ।
সেই থেকে ঈদ আর আমার কাছে বিপুল আনন্দের কিছু নয় । আমার ঈদ শেষ হয়ে গিয়েছে , এখন যা আছে তা শুধুই প্রিয়জনদের পাশে পাবার আনন্দ । সে সৌভাগ্যও সবসময় জোটে না ।
তবুও ঈদ মানে অবশ্যই আমাদের কাছে বিশেষ কিছু । আমরা চুজার্স না , আমরা থার্ড ওয়ার্ল্ডের খেটে খাওয়া বেগার্সের দল , আমাদের স্বপ্ন টেলিভিশনের স্ক্রীণে শুরু হয় , কখনো পূরণ হয় না , আমাদের পয়সার জন্য নিজেদের ঘর ছেড়ে দূর কোন বস্তিনগরীতে মুখগুজেঁ থাকতে হয় , আমাদের বসের অপমান , প্রেয়সীর অভিমান সহ্য করতে হয় ….. ক্লান্ত , বিষন্ন এক একটা দিনের শেষে আমরা ছেলেবেলাকে স্বপ্নসুখ ভাবি । আর তাই ঈদে বাড়ি ফেরা আমাদের কাছে স্বপ্নের কাছাকাছি চলে যাওয়া , নিজের মাঠ , নিজের ঘর , নিজের বিছানা বালিশ , প্রিয়জন পাশে পাওয়া ।
তবুও যতদিন চলে যাচ্ছে , প্রতিটি ঈদ হয়ে পড়ছে আরও একটু অপ্রয়োজনীয় , আর একটু সাদাকালো ।পথের পাশে আমার ছেলেবেলা মুখ থুবড়ে পড়ে , ঈদের কোন জামা নেই তার কাছে । পর পর চারটি ঈদ করছি অনেক দূরে , জীবিকার প্রয়োজনে …. আমার এক ভাই আছেন , মিশু ভাই , নিজেও ভুলে গেছেন শেষ কবে ঈদ করেছিলেন পরিবারের সবার সাথে । ঈদে নতুন জামা কেনার দিন আর নেই , এখন কিনে দেবার বেলা । ছেলেবেলা আর নেই , আমরা সবাই খুব বেশি বড় , খুব বেশি একা হয়ে গেছি ।
সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা , ঈদ মোবারক ।