বয়স হয়েগিয়েছে। মনটা এখন কারণে-অকারণে যখন-তখন বিষন্ন হয়ে যায়।বিষন্ন মন নিয়ে যখন অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরের বাড়ীতে বসে অবসর সময় ভাবছি জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে, ঠিক তখনি দু’চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো বাবা-মায়ের কথা মনে করে। এই জীবনে তাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি আমি। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। আমার বয়স যখন বারো কিংবা তেরো ছিলো, তখন একবার ভিষণ জ্বর হয়েছিলো আমার।রাত তখন দু’টো কি তিনটে বাজে। আমি ঘুমাতে পারছিলাম না। মা বল্লেন, কিরে বেটা ( মা আমাকে আদর করে ”বেটা” বলে ডাকতেন) ঘুমাচ্ছিস না কেনরে ! আমি বলেছিলাম, ক্ষুধা লেগেছে মা। মা বল্লেন, কি খাবি বল ? আমি বল্লাম পরোটা’র সাথে আলু ভাজি।মা তখন শীতের রাত উপেক্ষা করে আমার পরোটা ও আলু ভাজি করতে ছুটলেন।
একবার প্রচন্ড রোদে বাবা আর আমি পাশাপাশি হাটছিলাম (গন্তব্য মনে নেই এখন)।বাবা একটু পর পর জিজ্ঞেস করছিলেন বেটা খুব কষ্ট হচ্ছেরে ? আমি না সূচক মাথা নাড়ছিলাম। যখন বাসায় ফিড়েছিলাম বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলেন আর বলছিলেন – বাবা গরীব মানুষদের অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়, সব সময় তাদের বাসে বা রিকসায় চড়ে বাসায় ফেরার মত সামর্থ থাকে না।আমার বাবা যখন মারা যান, তখন আমার বয়স ষোল। মেট্রিক পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। দুপুর বেলায় ভাত খাবার পর আমার বাবা আয়েস করে একটি পান খেতেন (হয়তো সমগ্র জীবনে এটিই ছিলো তার একমাত্র বিলাস)।সেদিন দুপুরেও ভাত খাবার পর তিনি আয়েস করে একটি পান চিবুচ্ছিলেন ( কে জানতো এটিই তার জীবনের শেষ আয়েস বা পান) নিশ্বাস বন্ধ হয়ে তিনি মারা গেলেন।
নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনে অভাব বা কষ্ট কি, একমাত্র তারাই ভাল জানেন যাদের কম বয়সে বাবা মারা গিয়েছেন।অভাব কি, অভাব দেখতে কেমন, অভাবের কত রং হয় সব দেখতে পেয়েছিলাম ঐ কম বয়সেই বাবা মারা যাবার পর।
জীবন থেমে থাকে না। ভাল বা মন্দ যেভাবেই কাটুক একসময় তা কেটেই যায়।স্টুডেন্ট ভিসায় যখন অস্ট্রেলিয়াতে আসছিলাম । তখন এ্যায়ারপোর্টে মা বলেছিলেন “ বাবা ভালো থাকিস “। আমার এখনো চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় “ মাগো আমি ভাল নেই “। মা মারা যান ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে’র ২২ তারিখে (স্ট্রক করে) । আমি যখন বাংলাদেশে এসে মায়ের কবরের পাশে দাড়াই, তখন কবরে ঘাস জন্মেগেছে। আমি দাড়ীয়ে থাকতে পরছিলাম না। চিৎকার করে বলতে চাইছিলাম মা...মাগো....আমায় একা করে চলে গেলে !!
আন্ম উপলব্ধি : মানুষের জীবন অতি তুচ্ছ জীবন, অতি নগণ্য জীবন। এ জীবন নিয়ে গর্ব করবার মত কিছু নেই। টাকা-পয়সা,ক্ষমতা যশ-খ্যাতি সবই নশ্বর। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবাণ মানুষটি যেমন একদিন মারা যাবেন তেমনিভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে অক্ষম/দরিদ্র মানুষটিও একদিন মারা যাবেন।তাহলে পার্থক্য কোথায় !! সুতরাং সবসময় একজন সফল মানুষ হতে চেষ্টা না করে বরং একজন ভাল মনের মানুষ হতে চেষ্টা করুন। ভালো থাকবেন সবসময়।
- আদনান সিকদার।(সিডনি)