---------------------------------------------------------------------------------------------
প্রেমময় খোদার প্রতি প্রেম-প্রীতির পূর্ণ প্রকাশ ঘটে তাঁর রাহে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিলীন করে দেয়ার মাধ্যমে,তাঁর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে, তাঁর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমে। আমাদের খোদা প্রেমময় খোদা। আর প্রেম এমন এক বস্তুু , যা প্রেমিক প্রেমাস্পদ উভয়ের মধ্যে ক্রিয়া করে। প্রেমিকের ভেতরে প্রেমাগ্নি থাকে,সে প্রেমাগ্নিতে প্রেমাস্পদের ভিতরেও অগ্নির উত্তাপ সৃষ্টি হয়। যার মধ্যে প্রকৃত খোদা প্রেমের আগুন নেই তার বেঁচে থাকা বৃথা। কেননা প্রকৃত খোদা প্রেম ইহকাল ও পরকাল উভয়ের জন্যই কল্যাণকর। পক্ষান্তরে, যে প্রেম শুধু মানুষের প্রতি এবং তার রং-রূপের ভিত্তিতে হয়,বস্তুত তা প্রেম নামের অযোগ্য। কারণ তার পরিনাম লজ্জা ও অনুতাপ। সাধারণত রূপ-লাবন্যের কারণে প্রেমে পড়ে জান-মাল সর্বস্ব খোয়াবার পর যখন তার পরিবর্তে প্রেমে ভাটা পড়ে সুবদ্ধি ফিরে আসে,তখন লজ্জিত অনুতপ্ত হওয়া ছাড়া গতন্তও থাকে না। তাই প্রকৃত প্রেম একমাত্র খোদারই প্রাপ্য। হাদীসে কুদসীতে আছে, আল্লাহ বলেন,”যে আমার প্রতি এক বিঘত অগ্রসর হয় আমি তার প্রতি এক হাত অগ্রসর হই,সে এক হাত অগ্রসর হলে আমি এক বাও অগ্রসর হই,আমার প্রতি হেটে আসলে আমি তার প্রতি দৌড়ে যাই”। সে ব্যক্তির অবস্থা খুবই উত্তম, যে ব্যক্তি আল্লাহ প্রেমে তার ধন-দৌলত,বাড়ি-ঘর সর্বস্ব লুটিয়ে দিয়েছেন।
---------------------------------------------------------------------------------------------
প্রকৃত মোমেন তারা যারা খোদার খাঁটি প্রেমিক। খোদার প্রেমে মুগ্ধ,মাতোয়ারা ও তন্ময় হয়ে থাকা তাদের বৈশিষ্ট্য। আর এই জন্যই তারা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের মাধ্যমে প্রেমময় খোদার দরবারে সেজদা করে তাঁর সান্নিধ্য কামনা করে। প্রকৃত প্রেমিক দুনিয়ার লোভ ত্যাগ করে খোদার সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট থাকে। আর মোমিনমাত্রই হযরত মুহাম্মদ (সা.)-য়ের পথের উত্তম অনুসারী। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন প্রেমময় খোদার প্রেমের পথের পথিক। পৃথিবীর সব কিছুর মায়ার উর্ধে ছিল খোদার প্রতি তাঁর প্রেম-প্রীতি। তিনিই হলেন খোদার সবচেয়ে প্রিয় রসূল। তাঁর জন্যই সৃষ্টি করেছেন এই বিশ্ব-জগত।এ পৃথিবীতে যদি কেউ খোদাকে ভালোবাসতে চায়,সে যেন প্রিয় নবী (সা.)-এর পূর্ণ অনুসরণ করে। কেননা,তিনি এ পর্যায়ে যে মহান আদর্শ পেশ করেছেন তা অনুপম ও অতুলনীয়। প্রেমময় খোদার ভালোবাসা লাভ করার একমাত্র পন্থা হল তাঁর প্রিয় নবী (সা.) –এর পরিপূর্ণ অনুসরণ করা। তিনি ছিলেন খোদার প্রেম-ভালোবাসার জীবন্ত প্রতীক। সারা পৃথিবীর মানুষ খোদাকে যতখানি ভালোবেসেছে,হয়তো তাএকত্রিত করলেও প্রিয় নবীর ভালোবাসার সমান হবে না। যে খোদাকে ভালোবাসতে চায়,তাকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে প্রিয় নবী (সা.)-কে। এজন্যই খোদাতায়ালা প্রিয় নবী (সা.)-কে ”হাবীবুল্লাহ্” বা ”খোদার প্রিয় বন্ধু” বলে আখ্যায়িত করেছেন। নিজেকে খোদার রাহে সম্পূর্ণভাবে বিলীন করে দেওয়ার মাধ্যমেই মানুষ খোদার প্রেমে তার ভালোবাসা ধন্য হতে পারে। আর কিভাবে নিজেকে খোদার রাহে বিলীন করতে হবে তার অতি সুন্দও বাস্তব আদর্শ পেশ করেছেন প্রিয় নবী (সা.)। কেননা,আমাদের প্রিয় নবী (সা.) খোদার প্রতি প্রেম-ভালোবাসার পূর্ণ পথ প্রদর্শন করেছেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর জীবণের প্রতি মূহুর্তেই খোদাকে স্বরণ করতেন এবং তাঁর প্রতি শুকরিয়া আদায় করতেন। তিনি (সা.) বলেছেন, যে খোদাকে স্বরণ করে না,সে প্রকৃতপক্ষে জীবনী শক্তি রহিত। তিনি (সা.) আরো বলেন, যে কাজের শুরুতে খোদার নাম লয় না তার সাফল্যের আশা সুদুর পরাহত। প্রিয় নবী (সা.)-এর অন্তরে খোদার প্রতি যে গভীর প্রেম,প্রীতি ও ভালোবাসা বিদ্যমান ছিল, নামাযে তাঁর তন্ময়তা এবং কৃতজ্ঞতা উহারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। আর তাঁর সাহাবাগণও তাঁর (সা.)-এর পরিপূর্ণ অনুকরণে সচেষ্ট ছিল। তাই, হযরত আলী (রা.)-র পায়ে তীর বিদ্ধ হলে প্রিয় নবী (সা.) বলেছিলেন, আলী যখন নামাযে রত হয়, তখন তোমরা তীর খুলে নিয়ো।
---------------------------------------------------------------------------------------------
প্রেমিক প্রেমময় খোদার সান্নিধ্য লাভ করে বিভোর ও তন্ময় হয়ে থাকে, আর এ তন্ময়তা, খোদার দরবারে অত্যন্ত পছন্দনীয়। কেননা এই তন্ময়তা,প্রেমের গভীরতারই স্বাক্ষর বহন করে। আর খোদার প্রকৃত প্রেমিক সেই ব্যাক্তি যে, ইহকাল ও পরকাল এ দু’য়ের কোনটির প্রতি লালায়িত থাকেনা। বরং শুধুমাত্র এক খোদার প্রেমের জন্য লালায়িত থাকে এবং তা অর্জনে আজীবণ সাধনা করে যায় এবং অন্তরের অন্তস্থল থেকে খোদা প্রেমের তাগিদ অনুভব করার ফলে সর্বদা জীকরে এলাহীতে রত থাকে। প্রেমের ধর্ম হচ্ছে - প্রেমিক ও প্রেমাস্পদ পরস্পর পরস্পরকে আত্মস্থ করতে আকুল হবে। পরস্পরের মধ্যে আত্মবিলোপে কৃতার্থ হবে। যে প্রেমিক মনের পবিত্রতা অর্জনে সক্ষম, স্বীয় জীবন ও জীবনের সর্বস্ব খোদার রাহে বিলনি করে দিতে প্রস্তুত সে শুধু এ কারণেই খোদার রহমতের সৌভাগ্য লাভ করবে । কেননা প্রেমময় খোদা বিশ্ব - প্রতিপালক। পৃথিবীর বুকে যত কিছু আছে সবই তাঁর সৃষ্টি আর সবই তাঁর প্রেমের নিদর্শন। মানুষ দুনিয়ার বুকে তাঁর প্রেমিক মাত্র। প্রেমময় খোদা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানে মানুষকে দিয়েছেন উচ্চমর্যাদা, তাঁর প্রেম ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ মানুষ লাভ করেছে অফুরন্ত নেয়ামত। আর খোদা প্রেমিক মানুষ খোদাকে ভুলে থাকবে,ক্ষনিকের জন্যও তাঁকে স্বরণ করবেনা,তাঁর সন্তষ্টি অর্জনে সচেষ্ট হবে না,তার বিধি-নিষেধ পালনে অগ্রসর হবে না,প্রেমের জগতে এহেন সর্বনাশা নীতি কি গ্রহণযোগ্য হওয়া সম্ভব!
---------------------------------------------------------------------------------------------
আমরা তাকেই সর্বাধিক ভয় করি,যাকে আমরা সর্বাধিক ভালোবাসি।তার মন রক্ষায় আমরা সর্বদা সচেষ্ট থাকি। সে পছন্দ করে না এমন কোন কাজ আমরা করি না। অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে ”নিশ্চিত ভাবে স্মরণ রেখ,যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং যাদের হৃদয় আল্লাহর ভয়ে বিগলিত হয়ে যায় আল্লাহ তাদের সঙ্গেই থাকেন এবং তিনি তাদের দুশমনদের দুশমন হয়ে যান” । তেমনিভাবে প্রকৃত খোদা প্রেমিক খোদার ভয়ে সর্বদা কম্পমান থাকেন। পবিত্র কোরআনে আছে, ”ইহা একমাত্র শয়তানই যে তার বন্ধুকে ভয় দেখায়,যদি তোমরা মোমেন হও তবে তাহাদেরকে ভয় করো না বরং আমাকেই ভয় কর” (৩:১৭৬)।
”তারা (বিনয়ী মুসলমানগণ) এমন লোক যে যখন তাদের নিকট আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয় তখন তাদের হৃদয় ভয়ে কেঁপে উঠে” (২২:৩৬)।
” নিশ্চয় যারা সংগোপনেও তাদের প্রতিপালককে ভয় করে তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা এবং বৃহত্তর পুরস্কার” (৬৭:১৩)।
” যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সমীপে দন্ডায়মান হতে ভয় পায় তার জন্য রয়েছে দুটি জান্নাত” (৫৫:৪৭)।
---------------------------------------------------------------------------------------------
খোদার সাথে বান্দার সম্পর্ক মূলত আত্মিক। আর এ সম্পর্ক রক্ষায় এবং সমৃদ্ধকরণে খোদা মানুষকে কতিপয় ইন্দ্রিয় দান করেছেন। যা মানুষকে খোদা মুখি হতে সাহায্য করে। তাই মানুষকে পরম করুনাময় খোদা বাহ্যিক পঞ্চ ইন্দ্রিয় ছাড়া কতিপয় আধ্যাত্মিক ইন্দ্রিয় দান করেছেন। সে ইন্দ্রিয় গুলো বাহ্যিক ইন্দ্রিয় অপেক্ষা অনেক বেশি শক্তিশালী, অনেক বেশি তীক্ষ্ম, অনেক বেশি মূল্যবাণ। দেহ্যিক ইন্দ্রিয় গুলোর খোরাক হলো পচনশীল দ্রব্যাদি যা মাটি,পানি,বায়ূ,তাপ ইত্যাদি পদার্থের কল্যাণে সৃষ্ট। আর এসব পদার্থের কল্যাণে সৃষ্ট পচনশীল উদ্ভিদ থেকে তৈরি খাদ্য উপাদাণে বাহ্যিক ইন্দ্রিয় গুলো পুষ্টি লাভ করে। পক্ষান্তরে আধ্যাত্মিক ইন্দ্রিয় সমূহ মহাণ সৃষ্টিকর্তার নূর থেকে শক্তি লাভ করে। এখন উভয় শ্রেনীর ইন্দ্রিয়ের শক্তির তারতম্য করা অতি সহয, মাটির উদ্ভিদ এবং স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা উভয়ের মধ্যে শক্তির যে পার্থক্য,উভয় প্রকার ইন্দিয়ের মধ্যেও সে পার্থক্য বিদ্যমান। কারণ - যে বস্তুু যে কেন্দ্র থেকে পুষ্টি,শক্তি,বীর্য আহরণ করবে,সেই কেন্দ্রের তুলনায়ই ওই বস্তু‘র মধ্যে শক্তির সঞ্চার হবে। বাহ্যিক ইন্দ্রিয় গুলো মাটি থেকে উৎপন্ন পচনশীল দুর্বল উদ্ভিদের রস থেকে পুষ্টি আহরণ করে এবং এর শক্তি সে অনুপাতেই হয়। পক্ষান্তরে আধ্যাত্মিক ইন্দ্রিয় সমূহ মহাণ সৃষ্টিকর্তার নূর থেকে শক্তি লাভ করে এবং এর শক্তিও সে অনুপাতে হয়। ফলে প্রকৃত খোদা প্রেমিক মহাণ সৃষ্টিকর্তার নূর থেকে ভালোবাসার শক্তি লাভ করে থাকেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত রসূলে করীম (সা.) বলেছেন,”মহান আল্লাহ বলেন,যে ব্যক্তি আমার বন্ধুর সাথে শত্র“তা করে,আমি তাকে যুদ্ধে আহবান করছি। যখন আমার কোন বান্দা আমি যা নির্ধারণ করেছি তদ্বারা আমার নৈকট্য কামনা করে,আমি তাকে ভালোবাসতে আরম্ভ করি। এবং যখন আমি তাকে ভালোবাসি , আমি তার কান হয়ে যাই যদ্বারা সে শুনে,এবং আমি তার চোখ হয়ে যাই যদ্বারা সে দেখে এবং আমি তার হাত হয়ে যাই যদ্বারা সে ধরে,এবং আমি তার পা হয়ে যাই যদ্বারা সে চলে। এবং যখন সে আমার নিকট কোন কিছু চায়আমি তাকে তা দেই এবং যখন সে আমার আশ্রয় চায় আমি তাকে আশ্রয় দেই” (বুখারী)। হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) আরে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত রসূলে করীম (সা.) বলেছেন,” আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে ভালোবাসেন তখন জিবরাঈল (আ.) - কে ডেকে বলেন,আল্লাহ অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসেন, এ জন্য তুমিও তাকে ভালোবাস। তখন জিবরাঈল (আ.)-ও তাকে ভালোবাসেন। অত:পর জিবরাঈল (আ.) ঘোষনা করে দেন যে,আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন,এজন্য তোমরাও তাকে ভালোবাস। তখন আসমানবাসীরাও তাকে ভালোবাসতে থাকে। তারপর পৃথিবীর অন্তরেও তাকে বরনীয় করে রাখা হয়” (বুখারী-কিতাবুল আদব)।একথা বলার অপেক্ষা রাখে না ”পাপ বিদূরিত করবার একমাত্র উপায় আল্লাহ’তাআলার সাথে প্রেম ও ভালোবাসা সৃষ্টি। সৎকর্ম প্রেম ও ভালোবাসা হতে উৎপন্ন হয়। তা পাপের আগুনে পানি নিক্ষেপ করে। কেননা মানুষ আল্লাহ’তাআলার জন্য সৎকর্ম করে তার প্রেমের প্রমাণ দেয়। আল্লাহ’তাআলাকে এরূপভাবে মান্য কর,যেন তাঁকে প্রত্যেক বস্তুও উপর প্রাধান্য দেয়া হয়। এমনকি স্বীয় প্রাণের উপরর প্রাধান্য দেয়া হয়। এটাই প্রেমের প্রথম শোপান”।
---------------------------------------------------------------------------------------------
বরই পরিতাপ তাদের জন্য, যারা দুনিয়া খুঁজিয়া বেড়ায় প্রেমাস্পদের সন্ধানে। অথচ কতই না নিকটে রয়েছেন পরম প্রেমাস্পদ আল্লাহ তাআলা, কিন্তু তারা তা বুঝতে পারে না। কারণ তারা আধ্যাত্মিক ভাবে অন্ধ। পরম করুনাময় আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে তার ভালোবাসা অর্জনে সক্ষম করুন এবং তাঁর রাহমানিয়াতের ছায়া তলে রাখুন সদাসর্বদা। আমিন।