---------------------------------------------------------------------------------------------
অজানাকে জানার আকাঙ্খা মানুষের চিরন্তন। আর এই জানার আকাঙ্খাই মানুষকে প্রস্তর যুগ থেকে বর্তমান সুসভ্য যুগে উন্নিত করেছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা সভ্যতার অগ্র যাত্রায় জ্ঞান বিদ্যার অবদান অসামান্য। আর এই জ্ঞান বিদ্যার মূল উৎস হল পবিত্র কোরআন। পবিত্র কোরআনের সর্বপ্রথম অবতীর্ণ কয়েকটি আয়াতে এ কথারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ রয়েছে। সূরা আলাকে এরশাদ হয়েছে ” পাঠ কর তোমার প্রভুর নামে যিনি স্রষ্টা ও পালনকর্তা,যিনি মানুষকে এক বিন্দু রক্ত দ্বারা সৃষ্টি করেছেন,পাঠ কর, জ্ঞান অর্জন কর;তোমার প্রভু পরম দয়ালু, যিনি মানুষকে কলমের দ্বারা জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন, এবং যা সে জানত না, তা তাকে তিনি শিখিয়েছেন ”।
এ আয়াতে সর্বপ্রথম জ্ঞান অন্বেষণের ও বিদ্যা অর্জনের তালীম রয়েছে। এরপর স্রষ্টা ও পালনকর্তা আল্লাহর পরিচিতি বর্ণিত হয়েছে যে, ” যিনি সমগ্র সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা তাঁর পক্ষে তোমাদের মূর্খতা দুরীভূত করা এবং জ্ঞানের আলোকে তোমাদের অন্তরকে আলোকিত করা আদৌ কঠিন নয় ”। অতএব,মানুষ যা কিছু জানত না তার জ্ঞানলাভ করেছে স্বয়ং আল্লাহর তরফ থেকে,আর সেই জ্ঞানের মাধ্যম হল কলম।
গ্রীক শব্দ ‘Episteme’ এবং ‘Logos’ থেকে জ্ঞান বিদ্যার ইংরেজী শব্দ ‘Epistemology’- এর উৎপত্তি। প্রচীন কাল হতে আজ পর্যন্ত জ্ঞানের উৎপত্তি, স্বরূপ, শর্ত, বৈধতা, সম্ভাবনা, সীমা প্রভৃতি নিয়ে অসংখ্য মনীষির রয়েছে অসংখ্য মতামত ও যুক্তি, যার অধিকাংশই পরস্পর বিরধী বা কখনো স্ববিরোধী। উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটি তুলে ধরা হল :
প্রচীন গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের মতে,প্রত্যক্ষণ নয় বরং বুদ্ধিই জ্ঞানের প্রধান উৎস। এবং বুদ্ধির সাহায্যেই আমরা সার্বিক ধারণা গঠণ করি এবং সার্বিক ধারণার সাহায্যে সব জ্ঞান পেয়ে থাকি ।
প্লেটোর মতে, আত্মা হলো সক্রিয় এবং বুদ্ধি তার সহজাত ক্ষমতার সাহায্যে জ্ঞান লাভ করে। সংবেদন এবং অনুভূতি যথার্থ জ্ঞান দিতে পারে না।
অধ্যাপক আর .এম .চিজম তার ” Epistemology ” গ্রন্থে বলেন, জ্ঞান বলতে বিশ্বাস বা বিশ্বাস করার যৌকক্তিকতাকে বুঝায়।
দার্শনিক হিউমের মতে, অভিজ্ঞতাই জ্ঞান।
জার্মান দার্শনিক লাইবনিজের মতে, জ্ঞান বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া যায়, তবে ইন্দ্রিয় কখনো যথার্থ জ্ঞানের সন্ধান দিতে পারে না, যথার্থ জ্ঞান একমাত্র বুদ্ধির সাহায্যেই লাভ করা যায়।
বার্কলির মতে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস।
ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় না। কারণ যথার্থ জ্ঞান মহান আল্লাহ মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন কলমের মাধ্যমে। ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি তা পরিবর্তনশীল ও অনিশ্চিত। কিন্তুু পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি তা অপরিবর্তনশীল ও সুনিশ্চিত। এক মাত্র পবিত্র কোরআন শরীফ অকাট্টভাবে প্রমাণ করে ” জ্ঞানের উৎস পবিত্র কোরআন ”। দৃষ্টান্ত স্বরূপ পবিত্র কোরআন শরীফের কয়েকটি আয়াত পেশ করা হল :
”তুমি পাঠ কর তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন”(৯৬:২)
”তুমি পাঠ কর কেননা তোমার প্রতিপালক পরম সম্মানিত,যিনি কলম দ্বারা জ্ঞান শিক্ষ দিয়েছেন,তিনি শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে তা যা সে জানত না”(৯৬:৪-৬)
”তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন,(এবং)তাকে স্পস্টভাবে কথা বলতে শিক্ষা দিয়েছেন”(৫৫:৪-৫)
”মোমেনগনের জন্য এটা সম্ভব নয় যে, তারা সকলে একযোগে বের হয়, অতএব তাদের প্রত্যেক জামাত হতে একদল কেন বের হয় না যাতে তারা ধর্ম সম্বন্ধে বুৎপত্তি লাভ করতে পারে এবং যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসে তখন তাদের সতর্ক করতে পারে যেন তারা (মন্দ পথ সম্বন্ধে) সাবধান হয়”(৯:১২২)
”নি:সন্দেহ,আসমান ও যমীনের সৃষ্টির মধ্যে এবং রাত্রি ও দিনের পর্যায়ের মধ্যে এবং যে সকল জাহাজ মানুষের উপকারের জন্য সাগরে চলাচল করে তাদের মধ্যে এবং আল্লাহ আকাশ হতে যে বারি বর্ষণ করে পৃথিবীকে মৃত্যুর পর জীবিত করেন এবং উহাতে যাবতীয় জীব বিস্তৃত করেন উহার মধ্যে এবং বায়ু সকলের প্রবাহের মধ্যে এবং আসমান-যমীনের মাঝখানে আবদ্ধ মেরঘর মধ্যে,জ্ঞানী লোকদেও জন্য এই সকলের মধ্যে (আল্লাহর অসীম ক্ষমতার) নিদর্শন রহিয়াছে”(২:১৬৫)
”আল্লাহ, কোন উপাস্য নাই তিনি ব্যতীত।তিনি চিরঞ্জীব,চিরস্থায়ী,তাঁহাকে তন্দ্রা ধরে না, ধরে না নিদ্রা। যাহা কিছু আসমানে ও যমীনে আছে সব তাঁহারই।কে আছে এমন যে, তাঁহার বিনা অনুমতিতে তাঁহার সম্মুখে সুপারিশ করিতে পারে । যাহা কিছু তাহাদের সামনে আছে এবং যাহা কিছু তাহাদের পিছনে আছে তিনি সব জানেন;এবং তাঁহার জ্ঞানের কোন অংশ তাহার আয়ত্ত করিতে পারে না তাহা ব্যতীত যাহা তিনি ইচ্ছা করেন। তাঁহার সিংহাসন সমস্ত আসমান ও যমীন ব্যাপিয়া আছে এবং উহাদের রক্ষণাবেক্ষণে তিনি কিছু মাত্র বেগ পান না। তিনি উচ্চ,মহান।(২:২৫৬)
”বল: ইয়া আল্লাহ,রাজত্বের অধিপতি,তুমি যাহাকে ইচ্ছা রাজত্ব দাও আর যাহা হইতে ইচ্ছা রাজত্ব কাড়িয়া লও, এবং তুমি যাহাকে ইচ্ছা সম্মানিত কর আর যাহাকে ইচ্ছা অপপমানিত কর;তোমারই হাতে সমস্ত কল্যাণ, নিসন্দেহ তুমি সর্বশক্তিমান।
তুমিই রাত্রিকে দিনে পরিণত কর এবং দিনকে রাত্রিতে পরিণত কর এবং মৃত হইতে জীবিত বাহির কর এবং জীবিত হইতে মৃত বাহির কর এবং তুমি যাহাকে ইচ্ছা পরিমিত জীবিকা দান কর।(৩:২৭-২৮)
”তিনি যাহাকে ইচ্ছা বিজ্ঞান(হিকমত) দান করেন এবং যাহাকে বিজ্ঞান দান করা হয় তাহাকে বহুত কল্যাণ দান করা হয় এবং শুধু জ্ঞানবানেরাই উপদেশ গ্রহণ করে”(২:২৭০)
”এক মঙ্গলময় গ্রন্থ (কোরআন) যাহা আমি তোমার নিকট অবতীর্ণ করিয়াছি এই উদ্দেশ্যে যে, লোকে উহার নিদর্শনসমূহ সম্বন্ধে চিন্তা করিবে এবং জ্ঞানবানেরা উপদেশ গ্রহণ করিবে”(৩৮:৩০)
”এবং তিনি নিজের কৃপাগুণে যাহা কিছু আসমান ও যমীনে আছে সব তোমাদের অধিন করিয়া দিয়াছেন। নি:সন্দেহ,ইহাতে চিন্তশীল লোকের জন্য নিদর্শন রহিয়াছে”(৪৪:১৪)
”এবং আমি প্রত্যেক জিনিসের যুগল সৃষ্টি করিয়াছি যেন তোমরা (উহা হইতে আল্লাহর একত্ব ও সৃষ্টি কৌশল) বুঝিতে পার”(৫১:৫০)
”তোমরা কি লক্ষ্য করোনা যে,আল্লাহ পাক নভোমন্ডল ও ভুমন্ডলে যা কিছু রয়েছে তা তোমাদেরই উপকারার্থে নিয়োজিত এবং তোমাদেরই করতলগত করে দিয়েছেন”(সূরা লোকমান)
আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেকের জন্য ফরয। ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করে অন্যদের তা শিক্ষা দানের নির্দেশ পবিত্র কোরআন ও হাদীস সমূহে বর্ণিত রয়েছে। জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব প্রকাশ পায় এমন কয়েকটি হাদীস উপস্থাপন করা হল :
”হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত রসূলে করীম (সা.) বলেছেন, জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্য ফরয” (ইবনে মাজাহ)
”হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত রসূলে করীম (সা.) বলেছেন,যে ব্যক্তি বিদ্যা শিক্ষার পথ অনুসরণ করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ কওে দিবেন” (মুসলিম)
”হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা.)বর্ণনা করেছেন যে, হযরত রসূলে করীম (সা.) বলেছেন,একজন বিশ্বাসীর জ্ঞান অন্বেষণ প্রচেষ্টা শেষ হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে জান্নাতে দাখিল হয়”(তিরমিযী)
”হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত রসূলে করীম (সা.)
বলেছেন,যে ব্যক্তি জ্ঞানান্বষণে বের হয় সে তা থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহর কার্যে ব্যাপৃত থাকে” (তিরমিযী)
”হযরত মুয়াবিয়া (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত রসূলে করীম (সা.)
বলেছেন, আল্লাহতায়ালা যার কল্যাণ কামনা করেন তাকে দীনের সুষ্ঠু জ্ঞান দান করেন। আমি নিছক বন্টনকারী আর দান করেন আল্লাহই” (বুখারী,মুসলিম)
”জ্ঞান অর্জন কর যদিও উহা চীন দেশে থাকে” -আনাস(বায়হাকী)
”মৃত্যুও পর মানুষের কর্মফল শেষ হইয়া যায়,কিন্তু তিনটি কার্য বাকী থাকে: সদকায়ে জারিয়া বা স্থায়ী কল্যাণ কার্য,উপকারী জ্ঞান এবং সৎ সন্তানের আশীর্বাদ” আবূ হুরায়রা (মুসলিম)
স্মরণ রাখতে হবে যে যেহেতু মানুষকে এই উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে যেন সে তার স্রষ্টাকে সনাক্ত করে এবং তাঁর সত্তা ও গুণাবলীর উপর ঈমান আনয়ন করার জন্য ইয়াকিনের দরজা পর্যন্ত পৌছাতে পারে।
সে জন্য আল্লাহ মানুষের মস্তিষ্কেও গঠন এরূপ করেছেন যে একদিকে তো জ্ঞানের দিক হতে তাকে এরূপ শক্তি নিশ্চয় দান করা হয়েছে যার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহতাআলার সৃষ্টির প্রতি লক্ষ্য করে এবং বিশ্বজগতের অণু পরমাণুর মধ্যে যে সকল পরিপূর্ণ জ্ঞান আল্লাহতাআলার নকশা অনুযায়ী বিদ্যমান রয়েছে এবং যে সকল নিয়মাবলী বিশ্বজগতের সুস্পষ্ট জ্ঞান পূর্ণ ব্যবস্থাপনার মধ্যে রয়েছে, তার গভীরে প্রবেশ করে পূর্ণ প্রজ্ঞার সাথে যে একথা উপলব্ধি করবে যে, পৃথিবী ও আকাশের এত বড় কারখানা কোন স্রষ্টা ব্যতীত স্বয়ংক্রীয়ভাবে মজুদ থাকতে পাওে না। বরং জরুরী যে, এর স্রষ্টা আছে। অত:পর আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক শক্তিও তাকে প্রদান করা হয়েছে যাতে ঐ সকল ত্র“টি বিচ্যুতি এবং ঘাটতি যা জ্ঞানের শক্তির মধ্যে থেকে যায় ঐগুলি আধ্যাত্মিক শক্তির দ্বারা পূর্ণ হয়ে যায়।
জ্ঞানের পথ আলোর পথ,মানব জাতির মুক্তির পথ। প্রকৃত জ্ঞানের পথ ধর্মীয় জ্ঞানের পথ যা ইহকালের জন্যও কল্যাণকর পরকালের জন্যও কল্যাণকর। কিন্তুু কারো মণে যদি জ্ঞানের অহংকার সৃষ্টি হয়,তাহলে বুঝতে হবে তা তার অজ্ঞানতারই স্বরূপ।
জ্ঞান মানুষের এমন এক সম্পদ যা চুরি বা খোয়া যাওয়ার ভয় নাই,যা অকাতরে দান করা যায় সবার মাঝে।শত সহশ্রবার দান করলেও একটুও কমে না বরং উত্তর উত্তর আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পায় । পরম করুনাময় আল্লাহর কাছে বিনীত দোয়া তিনি আমাদের সকলকে প্রকৃত জ্ঞানের অনুসন্ধানী করুণ। আমিন।