somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

” আমার বন্ধু রায়হান “ - আদনান সিকদার।

২৬ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


……………………………..
সময় ১৯৯৪/৯৫ ইং।
রায়হান,আদনান,নিশু,চয়ন,হারুন,তারেক,বাপ্পি,সুমন,জনি,শাহিন,শাকিল,রমজান,আনোয়ার হোসেন,মায়া,লোপা,নাসিমা,সুবর্ণা,নাসরিন,জেসমিন সবাই আমরা কম-বেশি টিফিন প্রিয়ডে আট আনা দামের সবুজ আইসক্রিম কিনে খেয়ে ঠোট সবুজ করে গোল দায়ড়া খেলতাম।সবাই ক্লাশ ফোর-এর ছাত্র ছাত্রী। মায়া’র মা ছিলেন ইসদাইর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা, তাই মায়া’র দাপট এবং ক্ষমতা ছিলো সবচেয়ে বেশি, তাই সে সুযোগ পেলেই সব কিছুতেই কম-বেশি কান্ডামো করতো। লোপা’র মা’ও একই স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন, কিন্তু লোপা কিছুটা বোকা টাইপের হওয়াতে (সম্ভবত) তাই, ক্ষমতার কিভাবে অপব্যবহার করতে হয় তা সে জানতো না। হেলাল স্যারের ছেলে শাকিল ছিলো হাবলা কান্ত। তাই সে আমাদের দলে থেকেও না থাকার মতই ছিলো।তার কারণে আমরা কোন বিশেষ সুযোগ সুবিধা পেতাম না।যা মায়া এবং লোপা পেত। বরাবরের মতই আমরা মায়া এবং লোপা’র অগ্নি দৃষ্টির কাছে ভীত সন্ত্রস্ত হয়েই থাকতাম।


গ্রীষ্মের ভয়াল দুপুর। এক জোড়া শালিক যখন মির্যা সাহেবের দেয়ালে বসে ভাবছে জীবন এত বৈচিত্র কেন। ঠিক তখনি রেল লাইনের ঐ বস্তির পাশে জড়ো হয়ে আছে অসংখ্য শকুন মরা গরুর ঘ্রাণে।টিফিন প্রিয়ড শেষ। কিন্তু এখনো বাম পাশে সীথি করা দশ/বারো বছর বয়সী রায়হানের দেখা মিলছে না। হেলাল স্যার কিছুটা চিন্তিত। রায়হান ক্লাশের ফাস্ট বয়, কখনো ইচ্ছে করে ক্লাশ মিস দেয় না। আজকে তাহলে এখনো আসছে না কেন ! ক্লাশে উপস্থ্যিত সবাইকে একে একে তিনি রায়হানের কথা জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু সন্তসজনক উত্তর কারো কাছেই পেলেন না।
স্কুল ছুটির পর যখন তিনি বাড়ীতে ফিরলেন তখন তার বড় ছেলে শাকিল নাটাই-ঘুড়ি সমেত তার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু তিনি আজ রাগা রাগি তো দূরের কথা সামান্য চোখ বড় করেও তাকালেন না তার দিকে। বরং নরম ভাষায় বল্লেন, বাবা রায়হানের খবর পেলে আমাকে বলিস।শাকিল যত দ্রুত সম্ভব বাড়ী ত্যাগ করে খেলার মাঠে ছুটলো। রাতে যখন শাকিল বাবার সাথে ভাত খেতে বসলো, তখন বাবা জানতে চাইলো রায়হানের সাথে দেখা বা কথা হয়েছে কিনা। উত্তরে শাকিল বল্ল, আজ রায়হান খেলার মাঠে আসেনি। হেলাল স্যার আর খাবার মুখে তুলতে পারলেন না। বারং বার ভাবতে লাগলেন, আহারে মা মরা ছেলেটার কি হল আজকে টিফিনের পর আর স্কুলে আসলো না কেন ! তিনি বেড়ীয়ে পরলেন রায়হানের খোঁজে। যখন তিনি রায়হানের বাড়ীর সামনে এসে পৌছলেন, তিনি থমকে দাড়ালেন প্রচুর লোক সমাগম দেখে।ভীষণ ভয় পেলেন এবং লোক মুখে শুনলেন -
আনুমানিক দুপুর দু’টোর পর রায়হানের বড় ভাই (সম্ভবত দুবছরের বড়) বোরহান স্কুল থেকে হঠাৎ বাসায় ফিরে আসে, রায়হান তখন ভাত খাচ্ছিলো। রায়হানের বাবা জালাল সাহেব বোরহানকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এই বোরহান তুমি এ সময়ে বাসায় কি করো ? শরীর খারাপ হয়েছে নাকি ?
হাত মুখ ধুয়ে এসো আমরা একসাথে খাবার খাবো। বোরহান উত্তরে বল্ল, বাবা শরীরটা ভাল লাগছে না, গত রাতে আম্মুকে স্বপ্নে দেখেছি, একটা রূপোর থালায় তিনি ভাত সাজিয়ে বসে আছেন আমার জন্যে আর আমি গিয়ে তার পাশে বসলাম তিনি আমাকে নলা তুলে খাইয়ে দিলেন এবং বল্লেন বাবা আসতে এত দেরি করলি কেন ? তার পর আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।বাকী রাতে আর আমার ঘুম হয়নি বাবা ।এই বলে বোরহান বিছানায় শুয়ে পরলো আর বল্ল ঘুম থেকে উঠে খাবার খাবো।
কিন্তু বোরহানের এই ঘুম আর কোন দিনও ভংলো না। সে তার মায়ের কাছে যেতে আর দেরি করলো না।


রায়হানের বয়স যখন আড়াই/তিন বছর হবে হয়তো, ঠিক তখনি কোন এক গ্রীষ্মের ভয়াল দুপুরে তার মা তাকে নিয়ে পুকুরে স্নান করতে গেলেন। রায়হান যখন ঘাটলায় চুপ চাপ বসে আছে ঠিক তখনি তার মা এক জায়গায় ডুব দিয়ে অন্য জায়গায় ভেসে উঠছিলেন আর রায়হান তা দেখে হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো।তার মা তা দেখে তাকে খুশি করবার জন্যে বারংবার একই কাজ করে যাচ্ছিলেন এবং তার মা আবার ডুব দিলেন। কিন্তু এবার আর তিনি কোথাও ভেসে উঠলেন না তখন রায়হান ভাবলো এটাও বোধহয় নতুন ধরনেল কোন এক খেলা ! সন্ধার আগে আগে জালাল সাহেবের নেতৃত্বে একদল লোক সমস্ত পুকুরে মাছ ধরার জাল ফেললেন এবং মাছ ধরার মত করে রায়হানের মায়ের লাশ টেনে তুল্লেন। সেই স্মৃতি রায়হান কখনো ভুলতে পারেনি। বরং সব সময় তার মায়ের কথা তার মনে পরত এবং সে মনে মনে মৃত মায়ের সঙ্গে অনেক কথা বলতো,গল্প করতো, অভিমান করতো, কখনো বা ঝগড়াও করতো। আজ যখন তার ভাই বোরহান মারা গেলো, তখন তার হাত পা কাপতে লাগলো। সে কিছুক্ষন পর পর মূর্ছা যেতে লাগলো।


জালাল সাহেবের ভোর খুব পছন্দ ।তাই তিনি প্রতিদিন ভোরে উঠেন এবং রায়হানকে নিয়ে ফজরের নামায আদায় করেন। তার পর বাপ বেটাতে মিলে কিছুক্ষণ গল্প করেন।আজ যখন ফজরের আযান হচ্ছে, কিন্তু রায়হান এখনো ঘুম থেকে উঠছে না, তখন তিনি কিছুটা বিচলিত বোধ করলেন এবং ভাবতে লাগলেন মা-ভাই মরা ছেলেটার শরীটা আবার খারাপ করেনিতো। রায়হানের চেহারা তার মায়ের মত এবং স্বভাবও কিছুটা তার মায়ের মত কোমল। রায়হানের চোখগুলো অনেক বড় এবং সব সময় তাতে পানি টলমল করে, তার মায়ের চোখও অনেক বড় ছিলো এবং সব সময় তাতেও পানি টলমল করতো। রায়হানের দিকে তাকালে তার বুকের ভিতরটা কেমন যেন খাঁ খাঁ করে উঠে তার মৃতা স্ত্রীর কথা মনে করে। এই সেদিনের কথা, জালাল সাহেব যখন তার নতুন বউ নিয়ে এ বাড়ীতে প্রথম উঠলেন, তখন বউ লজ্জাতে তার সামনে মাথা তুলে তাকাতে পারছিলো না, কথাও বলতে পারছিলো না। তিনি ভাবলেন কিছুদিন পার হলে হয়তো লজ্জাও ভাংবে এবং মাথাও তুলে তাকাবে তখন আর সাপের ফনার মত মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ছোট খাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিবে। কিন্তু তার ধারণা ছিলো সম্পূর্ণই ভুল ।বিয়ের দিন হতে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি কোনদিন একটিবারের জন্যেও মাথা তুলে কথা বলেননি এবং ঝগড়াও করেননি তার স্বামীর সঙ্গে।সে ছিলো অত্যন্ত মৃদু স্বভাবের ও কোমল হৃদয়ের অধিকারিণী স্ত্রী।


দূর থেকে তিনি অনেক বার রায়হানকে ডাকলেন। সাড়া না পেয়ে কাছে গিয়ে শরীরে হাত দিয়ে ডাকতে চেষ্টা করলেন ।কিন্তু ডাকতে পারলেন না, কারণ রায়হানের শরীর তখন বরফ শীতল।রায়হানের শরীরে হাত রেখেই তিনি চমকে উঠলেন। তাকে আর ডাকবার সাহস সঞ্চয় করতে পারলেন না তিনি ।নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলেন সদ্য মৃত ছেলের লাশের দিকে। রায়হানও চলে গেলো না ফেরার দেশে।
--------------------------------------------------------------------------------------

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:০৫
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মত প্রকাশ মানে সহমত।

লিখেছেন অনুপম বলছি, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৭

আওয়ামী লীগ আমলে সমাজের একটা অংশের অভিযোগ ছিলো, তাদের নাকি মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই। যদিও, এই কথাটাও তারা প্রকাশ্যে বলতে পারতেন, লিখে অথবা টকশো তে।

এখন রা জা কারের আমলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্নমর্যাদা!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৩

রেহমান সোবহান একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। রেহমান সাহেব এমন একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন যা খুব নির্জন এলাকায় অবস্থিত এবং সেখানে যাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁঠালের আমসত্ত্ব

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

কাঁঠালের কি আমসত্ত্ব হয় ? হয় ভাই এ দেশে সবই হয়। কুটিল বুদ্ধি , বাগ্মিতা আর কিছু জারি জুরি জানলে আপনি সহজেই কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানাতে পারবেন।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানানের জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে ।
...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×