(২৩)
‘সকালে যখন তুমি খাবার তৈরী কর,ভাবি বছর তিরিশ,চল্লিশ,কি পঞ্চাশ পরে আমরা একজন হয়তো একা শুয়ে থাকবো বিছানায়,আরেকজন থাকবে না পাশে।পুরোনো সুখের স্মৃতির রোমন্থনে,কান্নায় ভঁরে থাকবে মন,হতাশা আর একাকীত্ব ছাড়া আর কোন বন্ধুও থাকবে না হয়তো।ছেলেমেয়েরা চলে গেছে তাদের নিজেদের পৃথিবীতে-চারপাশের পৃথিবী চলবে তার নিজের আনন্দে,আমাদের মধ্যে যে থাকবে,সে তখন অসুস্থ,বেঁচে আছে-শুধু নিয়মের অনিয়মে’।
বেশি কিছু না বলে আমার স্বামী হাত ধরে এগিয়ে গেল,হঠাৎ সামনে নতুন বছরের অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেখে,কেন জানি ক্ষেপে গিয়ে লাথি মারা আরম্ভ করলো।
‘জানি না তুমি কি ভাবলে,একগাদা কি সব আবোল তাবোল বললাম।ভাবলাম এখানে আসলে তোমার ভাল লাগবে,তা তোমার কথা যেন মনেই ছিল না-মদ খেয়ে তোমাকে শুধু শুধু অতিষ্ঠ করে গেলাম’।
আমার মুখে কোন কথা ছিল না,কিইবা বলা যায়?
সামনে কজন বিয়ার হাতে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছিল,আমার স্বামী সাধারণতঃ যা করে না,তাই করলো,তাদেরকে মদ খাওয়ার আমন্ত্রন জানালো।তবে ভঁয় পেয়ে তাড়াহুড়া করে চলে গেল তারা,হয়তো কলেজের ছেলেমেয়ে হবে।আমার স্বামীকে টেনে নিয়ে গেলাম,এমনিতেই দুজনেই কিছুটা মাতাল,আর কিছু মদ যোগ দিলে কি হবে কে জানে।
কতদিন এ ভাবে মন খুলে মাতাল হইনি,আমরা?ও তো সবসময় ছিল বীরপুরুষ,যে কোন সমস্যার সমাধান,ওর সাহায্য ছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না।আর আমিই এখন ওকে পড়ে যাওয়া থেকে তুলে নিয়ে দাঁড় করাচ্ছি।আমার স্বামী তখন একটা গান করছিল,গানটা কোনদিন শুনিনি-মনে হলো একটা আঞ্চলিক গান হবে হয়তো।গির্জার কাছে পৌঁছাতেই ঘন্টা বেজে উঠলো-যেন একটা শুভচিহ্ন।
‘গির্জার ঘন্টা শুনলেই কেন জানি মনে হয় ওটা ঈশ্বরের ডাক,কিন্ত ঈশ্বর কি শোনে,আমাদের কথা?আমরা এখন চল্লিশের কাছে,জীবনের আনন্দ আমাদের অজান্তেই কখন যে কোথায় ছুটে গেল।ছেলেমেয়েরা না থাকলে,বেঁচে থাকার কোন উৎসাহই থাকতো না হয়তো আমাদের।
হয়তো নিজেদের মনে হতো সংসারের জঞ্জাল’।
হয়তো কিছু একটা বলা দরকার ছিল,কিন্ত কোন ভাষা ছিল না আমার কথায়।জেনেভার দামী উচুতলার ইটালিয়ান রেস্তোরায়-মোমবাতির আলোতে ভালবাসা সাজিয়ে,রাতের খাবার সারলাম,আমরা।রাতের সাথে আঁতাত করে ঘুমোতে গেলাম,ঘুম ভাঙ্গলো যখন সকালের সূর্য বেশ কিছুদূরে ছুটে গেছে,কোন স্বপ্ন ছিল না রাতের চোখে,বার বার ঘুমও ভাঙ্গেনি,ঘড়ির কাটা তখন দশটায়।
স্বামীর ঘুম ভাঙ্গেনি,হাত মুখ ধুয়ে সকালের খাবার অর্ডার দিলাম।রুম সার্ভিসে খাবারের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে-জানালার বাইরের আকাশ আমাকে টেনে নিয়ে গেল কল্পনার ফানুসে।গ্লাইডাররা পাখীর মত ভেসে বেড়াচ্ছিল আকাশের এপাশ থেকে ওপাশে!ওড়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর অনেকে হোটেলের সামনের পার্কটায় নেমে যাচ্ছিল,কারও কারও সাথে ছিল ট্রেইনার।কি অদ্ভুত এক পাগলামি আকাশে ছুটে বেড়ানোর,মানুষ নীরস জীবন থেকে ছুটে বেরোনোর জন্যে কত অদ্ভুত কান্ডই না করে?
এক দুজন করে গ্লাইডাররা নামছিল,সামনের পার্কে।জানতে ইচ্ছা হচ্ছিল,ঐ দূর আকাশ থেকে পৃথিবীকে কেমন দেখায়?যদিও ঈর্ষা হচ্ছিল,তবে সাহস হবে না আমার ও ভাবে ছুটে যেতে আকাশের এপাশ থেকে ওপাশে।দরজার ঘন্টা বেজে উঠলো,খাবারের ট্রলি ওয়েটারটা নিয়ে
ঢুকলো,একটা গোলাপ,কফি,চা,টোষ্ট,নানা রকমের জ্যাম,ডিম,কমলালেবুর রস,খবরের কাগজ-আমাদের সকালের সুখ সাজানো ছিল ট্রলিতে।
চুমু দিয়ে আমার স্বামীর ঘুম ভাঙ্গানোর চেষ্টা করছিলাম,মনেই পড়ে না,চুমুতে আদর করে স্বামীর ঘুম ভাঙ্গানোর কথা।অবাক হয়ে মুচকি হাসছিল,সে।বসে সকালের খাবারের টেবিলে রাতের মাতাল পর্বের আলোচনা আরম্ভ হলো।
‘মনে হয়,নেশা করা দরকার ছিল আমাদের,অনেক কিছু আবোলতাবোল বললাম,তাই না,ওগুলো নিয়ে বেশী মাথা ঘামাবে না।জানই তো বেলুন হঠাৎ ফেটে গেলে,চারপাশে ভঁয় পেয়ে চমকে যায় সবাই।তবুও ওটা কিছু না,শুধুই একটা বেলুন যার ক্ষতি করার কোন শক্তি নাই’।
বলার ইচ্ছা ছিল,আনন্দটা আমার খুব একটা কম হয়নি,তার দূর্বলতার কথাগুলো শুনে।তবে কিছু না বলে,শুধু টোষ্টটা মুখে দিয়ে ছোট্ট একটা হাসি দিলাম।
গ্লাইডারদের ছুটে আসা যাওয়া তার চোখে পড়লো।চলে যাওয়ার আগে কাপড় চোপড় পরে আমরা বের হলাম শহরের সকালটা খুঁজতে।হোটেলের ডেক্স এ বিল পরিশোধ করে,রুম থেকে লাগেজ নিয়ে যাওয়ার প্রস্ততি আরম্ভ করলাম।
আরেক দিন এখানে থেকে গেলে,কেমন হয়?
‘কি হবে থেকে,গতকাল এটুকু বুঝলাম,পুরোনো সেটা পুরোনোই,ফিরে যাওয়া যায় না সেখানে নেই,স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করে,শুধু যন্ত্রনাই টেনে আনা যায়’।হোটেলের লবীর কাজকরা কাঁচের দরজা দিয়ে বের হয়ে দেখি,এক সময়ের পুরোনো রাস্তাটা বন্ধ করে পাশাপাশি বিশাল দুটো আবাসিক হোটেল।বোঝা যাচ্ছে পর্যটনের ব্যাবসাটা বেশ রমরমা,যদিও এখন শীতের স্কি করার সময় না।।বাইরে না গিয়ে আমার স্বামী গেল,গ্লাইডিং সমন্ধে জানার জন্যে যাচ্ছিল, ‘গ্লাইডিং করবে?চল যাই দেখিই না কেমন লাগে’?
আমরা?আমার গ্লাইডিং করার কোন ইচ্ছা নাই।কাউন্টারে বসা লোকটা কটা কাগজ দিয়ে বললো, ‘যা যা জানার,সব কিছু পাবেন এই লিফলেট গুলোতে’।
‘কিন্ত গ্লাইডিং,এর জন্যে পাহাড়ের উপরে যাব কেমন করে’?
লোকটা বুঝিয়ে বললো,উপরে যাওয়ার দরকার নাই,তা ছাড়া রাস্তাটাও বেশ দূর্গম হেঁটে যাওয়া অনেকটা অসম্ভব,গ্লাইডিং এর সময় ঠিক করলে হোটেল থেকে এসে লোকজন নিয়ে যাবে আমাদেরকে।গ্লাইডিং এ বেশ ঝুঁকি আছে,তাই না?দুটা পাহাড়ের মাঝে ঝাপ দেয়া,আগে আমাদের আগের কোন অভিজ্ঞতা নেই,আমাদের পক্ষে কি গ্লাইডিং করা সম্ভব?সরকারের পক্ষ থেকে কোন নিয়ন্ত্রন করা হয়?
‘এখানে প্রায় দশ বছর কাজ করছি,তা ছাড়া দিনে কমপক্ষে হলেও বার দুয়েক গ্লাইডিং করি,এ পর্যন্ত কোন দূর্ঘটনার কথা শুনিনি।আর সরকারী তত্বাবধান তো আছেই,আমাদের নিজেদেরও দায়িত্ববোধ সমন্ধে আপনার কোন সন্দেহ থাকার কোন কারন নাই’।
লোকটা হাসতে হাসতে কথাগুলো বলছিল,হিসেব করলে দেখা যাবে,গত দশ বছরে হয়তো এ ভাবেই অন্ততঃ হাজার দশেকবার একই কথা বলে গেছে সে।
‘চল,যাবে নাকি’?
কি?তুমি যেতে চাও যাও,তোমাকে একাই যেতে হবে,আমার খুব একটা উৎসাহ নাই।
‘একা তো যেতেই পারি।ঠিক আছে তোমার যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলে,ক্যামেরা নিয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা কর।কেন জানি মনে হচ্ছে,এই অভিজ্ঞতাটা আমার দরকার।ওড়া নিয়ে সবসময় আমার বড্ড একটা ভঁয় ছিল,বের হয়ে আসতে চাই ঐ ভঁয়ের রাজ্য থেকে।মনে পড়ে গতকাল আলোচনা করছিলাম,কেমন জানি আমরা আঁটকে আছি একটা গেড়াকলে।রাতে একেবারেই ঘুম হয়নি,অসহনীয় ছিল রাত্রিটা,নিঃস্তব্ধ যন্ত্রণায় কেটে গেছে,এপাশ ওপাশ করিনি তোমার ঘুম ভেঙ্গে যাবে বলে’।
আমি জানি।
আমার স্বামী লোকটার কাছে গ্লাইডিং এর সময় জানতে চাইলো,‘চাইলে আজ সকালেই আপনাদের যাওয়া সম্ভব,সকালের সূর্যের আলোতে বরফ ঢাকা পাহাড়ের চেহারাটা অবাক হওয়ার মত।স্বর্গ সমন্ধে তো জানা নেই কারও,বলা যায় যুসের প্রাসাদের আরেক চেহারা’।
এখনই কি যাওয়া সম্ভব,আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘দুজনই যাবেন,না একজন’?
এখন যদি সম্ভব হয় তাহলে দুজনেই যাব,কেন না বেশী চিন্তা ভাবনা করার সূযোগ হবে না আমার।বাক্স খুলে ভেতরের দানবটাকে বের হতে না দিলেই,ভয় থাকবে না জীবন মৃত্যু,অনুভুতি নিয়ে।
‘তিনটা সময়ের ভাগ আছে,কুড়ি মিনিট,আধ ঘন্টা,এক ঘন্টা,কোনটাতে যাবেন আপনারা’?
মিনিট দশেকের কোন গ্লাইডিং নাই।
না।
‘কত উঁচু থেকে ঝাঁপ দিতে চান আপনারা,১৩৫০ না ১৮০০ মিটার’?
আমি তখন টানাপোড়েনে ছোটাছুটি করছি,যাব কি,যাব না।জানি কিছু হবে না,তবে যদি কিছু ঘটে,বিপদ তো বিপদই,ওটা তো আর জানান দিয়ে আসবে না।২১ মিটার থেকে পড়ে যাওয়া আর সাততলা থেকে বিল্ডিং থেকে পড়ে যাওয়া তো একই কথা,একটা বিরাট কিছু ঘটবে।
হেসে উঠলো লোকটা,আমিও হাসছিলাম,তবে ভঁয় লুকানোর জন্যে,নিজেকে বোকাই মনে হচ্ছিল,ঐ ৫০০ মিটারের পার্থক্যে কিইবা যায় আসে?
লোকটা ফোনে কথা বলে উত্তর দিল, ‘১৩৫০ মিটারে এখন একজনের যাওয়া সম্ভব’।
আমার ভঁয় বেশ কমে গেছে,ভালই হলো!
মিনিট দশেক পরেই গাড়ী আসবে হোটেলের গেটে,স্বামীর সাথে বাইরে পাঁচ ছয়জন লোকের সাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম,আমরা।উঠার সময় ভাবছিলাম ছেলেমেয়েদের কথা,বাবা মা ছাড়া কি হবে তাদের?...মনে পড়লো আমরা তো একসাথে যাচ্ছি না।
গরম পোষাক গায়ে,মাথায় হেলমেট চাপালাম আমরা,আর কিছু না হোক পড়ে গিয়ে পাথরে মাথা ঠুকলেও অন্ততঃ খুলিটা ঠিক থাকবে।
হেলমেট সবাইকে পরতেই হয়,জেনেভার রাস্তায় সাইকেল চালানোর হেলমেটের মত অনেকটা।
এটার কোন মানেই হয়না,তবে বির্তক করে কি লাভ?দূরের বরফ ঢাকা পাহাড়টা তার ধবধবে সাদা চেহাড়ায় যেন ডাক দিচ্ছিল আমাকে,উপরে উঠে আর ফিরে নাও আসতে পারি।প্লেনে তো প্রায়ই যাওয়া আসা করি,কোন সময় আমার ভঁয় করে নি।তবে প্লেনে উঠাটাও তো আর কিছু না গ্লাইডিং।একটাই তফাঁৎ,চারপাশে ঢাকা এলুমিনিয়ামের ঢাকনা মনে বেশ একটা সাহস জোগায়।
ওটুকুই।
Physics এর নিয়ম কানুন যে আমার একেবারেই অজানা তা না,তবে মনে যে দ্বন্দ একেবারেই নেই তা নয়।যুক্তিটা আরও ভাল শোনাবে যদি মনে করি,প্লেন ওড়ে ইঞ্জিন,তেল,ব্যাগ,সুটকেস মানুষজন কতকিছু নিয়ে,আর গ্লাইডার মেনে চলে শুধু প্রকৃতির আইন,ভেসে যায় গাছের পাতার মত।
বিশ্লেষণটা খুব একটা খারাপ না।
‘আপনি,কি প্রথমে যাবেন’?
সেটাই ভাল।আর যাই হোক আমার কিছু হলে এটুকু জানা থাকলো,তোমার ছেলেমেয়েদের রক্ষনাবেক্ষন করতে কোন অসুবিধা হবে না।আর তা ছাড়া সারাটা জীবন যেন তুমি কষ্ট পাও ভেবে,আমি ছিলাম তোমার পাশে সুখে দুঃখে,অভিযানে,যন্ত্রনায়।
‘আমরা তৈরী,তা হলে যাওয়া যাক,এবার’।
আপনিই ট্রেনার!বয়স তো বেশ কম আপনার,আমি বরং অভিজ্ঞ কারও সাথে যাই,এটা আমার প্রথম বার,আর প্রচন্ড ভঁয়ও আছে মনে।
‘ষোল বছর বয়স থেকে গ্লাইডিং করছি,আর এখন তো প্রায় বছর দশেক হয়ে গেল।তা ছাড়া,শুধু এখানে না পৃথিবীর অনেক দেশে গ্লাইডিং এর সুবাদে যাওয়া আমার।ভঁয় পাওয়ার কোন কারণ নেই না,সর্ম্পূন আস্থা রাখতে পারেন আমার উপরে।আর দক্ষতা তো বয়সে না,অভিজ্ঞতায়’।
লোকটা,বরং ছেলেটা বললেই মানায় ভাল,ওর মাস্তানী কথায় একটু বিরক্তই হলাম।বয়স্ক লোকদের মনের ভয়কে কিছু সম্মান করা উচিত,আর ও যা বললো ওটা তো ওর নামতার কথা,কিছুটা আশ্বাস দিয়ে দু একটা বাড়িয়ে বললে আর কিইবা ক্ষতি হতো।
‘আপনাকে যা যা বললাম সব মনে আছে জানি,তবুও আরেকবার বলছি,আমরা যখন দৌড়ানো আরম্ভ করবো,থামবেন না কিন্ত কোন সময়,বাকীটুকু আমার হাতে ছেড়ে দিবেন’।
বলা,নির্দেশ দেয়া খুবই সহজ,যদি ভব্যিষত আমাদের আগেই জানা থাকতো,তা ছাড়া ইচ্ছা থাকলেও মাঝ রাস্তায় মন বদলালে কি হবে?মাটিতে পৌঁছানোর পর কতক্ষন হেঁটে যাব?
আমার স্বপ্নঃউড়ে গিয়ে মাটিতে পা দিয়ে ছুটে যাওয়া।স্বামীকে বললাম সবচেয়ে শেষ যেতে,
সে যেন দেখার আমার প্রতিক্রিয়াটা দেখতে পায়।
‘ক্যামেরা নিতে চান?ক্যামেরা গ্লাইডারের সাথে লাগানো একটা দড়িতে বেঁধে নেয়া যায়’?গ্লাইডিং ট্রেনার জিজ্ঞাসা করলো।
,না,ক্যামেরা নেয়ার ইচ্ছা নাই আমার।আর তাছাড়া এটা আমার বীরত্ব জাহির করার জন্যে করছি না,আমি।ভয় কেটে গেলেও,সাহস হবে না আমার প্রকৃতির সৌন্দর্য ক্যামেরায় ধরে রাখতে।এটা আমার বাবার কথা,আমরা যখন মেটাহর্ন পাহাড়ে উঠছিলাম,আমাকে ছবি তোলায় ব্যাস্ত দেখে,বাবা বিরক্ত হয়ে বললো, ‘তোমার কি মনে হয় চারপাশের এই সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারবে ক্যামেরার ঐ ছোট্ট ফ্রেমে?উপলদ্ধি কর,ধরে রাখতে চাও যদি,ধরে রাখ তোমার মনের খাতায়।লোক দেখানোর চেয়ে আনন্দ হলো উপলদ্ধিতে,নিজের মনের খাতায় ধরে রাখায়,হয়তো কোন একসময় তোমার স্মৃতির ফ্রেমে ভেসে আসবে ছবিগুলো’।
আমার ট্রেনার,ওড়ার সঙ্গী,তার ওড়ার জীবনের অভিজ্ঞতায় ক্লিপ দিয়ে দড়ি বেঁধে দিচ্ছিল সারা শরীরে।একটা চেয়ার আঁটকে ছিল গ্লাইডারের সাথে,আমি সামনে থাকবো আর ও থাকবে পেছনে।অবশ্য এখনও না যেতে পারি,তবে সেটাতো আমি না,অনুভুতি ছাড়া নতুন এক মানুষ আমি।
প্রস্ততি পর্বে আমাকে বাতাসের দিক,গতি নিয়ে কিছু বুঝিয়ে বলে,নিজেকেও চেয়ারে বেঁধে নিল আমার ট্রেনার।তার নিঃশ্বাস ছুটে আসছিল,আমার ঘাড়ে মাথায়।পেছনে ঘুরে দেখলাম সারি বেঁধে আসছে গ্লাইডাররা একের পর এক,সাদা বরফের সাজানো নানান রং এর কাপড়ে,
একেবারে শেষে আমার স্বামী,মাথায় সাইকেলের হেলমেট।
‘কি হলো থেমে আছেন কেন,দৌড়ানো আরম্ভ করেন’,তবু দাঁড়িয়ে ছিলাম,আমি।
‘কি হলো দাঁড়িয়ে আছেন,কেন’?
তাকে বুঝিয়ে বললাম,আমার পাখীর মত আকাশে ছোটার কোন ইচ্ছা ছিল না,বড় জোর মিনিট পাঁচেক উপরে,ওটাই যথেষ্ট।
‘ঠিক আছে,আপনি বলবেন যখন নামতে চান।এখন লাইন আঁটকে না রেখে দৌড়ানো আরম্ভ করেন,পেছনে লোকজন সব অপেক্ষা করে আছে’।
আমার স্বাধীনতা হারিয়ে গেছে,এখন শুধু নির্দেশ মেনে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নাই।
‘একটু জোরে দৌড়ান’।
ছুটে যাচ্ছিলাম,জুতার ধাক্কায় ছুটে যাচ্ছিল বরফ এপাশে ওপাশে,আমি ছুটছিলাম একটা যন্ত্রের মত।চীৎকার করছিলাম,তবে আনন্দে না,ভঁয়ে হয়তো?কিউবান ওঝার ভাষায় আমি আর পাহাড়ের গুহার জংলী মেয়ে না,আমি নতুন কেউ একজন।আমরা মাকড়শাকে,সাপকে ভঁয় পেয়ে চীৎকার করি-আর চীৎকার করি এ ধরণের পরিস্থিতেও।
একসময় আমার পা মাটি ছেড়ে গেল,আকড়ে ধরলাম চেয়ারটা,চীৎকার থেমে গেছে তখন,নির্বাক এক মুর্তির মত।ট্রেনার আরও ক পা দৌড়ানোর পর,আমরা ভেসে যাচ্ছিলাম বাতাসে,বাতাসের খেলায় ছুটে যাচ্ছিলাম এপাশে ওপাশে।
প্রথম কটা মিনিট ভঁয়ে চোখও খুলিনি-যদিও জানার ইচ্ছা হচ্ছিল পাহাড়ের কত উঁচুতে ছিলাম আমরা,কি হবে কিছু হলে?মনটা ছুটে গেল বাড়ীর রান্নাঘরে,বসে বসে ছেলেমেয়েদের সাথে গল্প করছি,শোনাচ্ছি বেড়ানোর অভিজ্ঞতার গল্প।কখনও শহরের গল্প কথা,কখনও হোটেলের রুমের ঘটনার কথা,ওদেরকে তো আর রাতের মাতাল পর্বের কথাটা বলা যাবে না,বলতে পারবো না গ্লাইডিংর গল্পটাও।মনে হলো,বোকার মত কেন চোখ বন্ধ করে আছি?কেউ তো জোর করেনি আমাকে, ‘গত দশ বছর আছি কোন দূর্ঘটনা দেখিনি’,
হোটেলের লোকটা তো বেশ জোর গলায় বললো।চোখ খুলে অবাক,এই উপলদ্ধির কথা
কোন ভাবে ভাষায় বর্ননা করা কি সম্ভব,হয়তো না,?মনে হচ্ছিল ভালবাসার নীচের দুটো লেক পাহাড়ের মাঝে ছুটে গেছে মিলনের আশায়।উড়ে যাচ্ছি আমরা,চারপাশের পাহাড় দেখে খুব একটা ভয়ও লাগছিল না,মাথায় বরফের সাদা মুকুট পরে হাসছিল আমাকে দেখে,সূর্যও খেলা করছিল দোলায় দোলায়।
কিছুটা আত্মবিশ্বাস ছিল আমার মনে,আকড়ে ধরা দড়িটা ছেড়ে দিলাম,পেছনের লোকটা নিশ্চয় জানে,আমি বদলে গেছি,আমি অন্য কেউ আরেকজন।নীচে না নেমে উষ্ণ বাতাসে আরও কিছু দূরে ছুটে গেল,গ্লাইড ট্রেনার।কোথায় নিয়ে যাবে বাতাস আমাদের?বাতাসও কি অবাক হয়ে দেখছে চারপাশের সৌন্দর্য?
পাশে উড়ে যাওয়া বাজপাখীটাকে দেখে মনে হচ্ছিল,ওর সাথে একটা মানসিক যোগাযোগ আছে আমার।সাথের ট্রেনার যেন ওর কথামতই ছুটে যাচ্ছিল।‘চল বাজপাখী উড়ে যাও,ছুটে চলো উঁচু আরও উচুতে।এটা যেন নিয়ন শহরের দৌড়ানোর অনুভুতি-ছুটে যাওয়া,ছুটে যাওয়া,ক্লান্তি যদি না আঁটকে ধরে’।
বাজপাখীটা বলছিল, ‘ভঁয় পাচ্ছ কেন?তুমিই তো পৃথিবী,তুমিই স্বর্গ,বাতাস তুমি,ঐ ঢেকে রাখা বরফ’।
আমি যেন ফিরে গেছি মায়ের জরায়ুতে,কোন ভঁয় নাই,কোন বিপদ হবে না,অনেক কিছু দেখা হয়নি,যে কোন মূহুর্তে জন্ম হবে,তবে মা তো আছেই আমার সহায়।মানুষ হবো,হেঁটে যাব দু পায়ে।এই মুহুর্তে জরায়ুতে আমার শুধু মেনে নিতে হবে সাজানো নিয়ম কানুন,আমি যে এখন অন্যের হাতে।
ভুল,না,আমি স্বাধীন।
হ্যা,আমি স্বাধীন।বাজপাখীর কথাটা ঠিক,আমিই পাহাড়,আমিই লেক।আমার কোন অতীত নেই,নেই বর্তমান,নেই ভব্যিষৎ,আমি সেই,যে ছি্ল,আছে,থাকবে।
একটা প্রশ্ন ছিল আমার মনেঃযারা গ্লাইডিং এর জন্যে পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেয়,সবাই কি আমার মতই কল্পনায় ভেসে যায়।অবশ্য,কিই বা যায় আসে তাতে?তা ছাড়া,অন্যদের কথা ভেবে আমার কি লাভ?প্রকৃতি আমার সাথে এমন ভাবে কথা বলছে,যেন আমি তার একমাত্র সন্তান।পাহাড় বলছিল, ‘আমার শক্তি আছে তোমার কাছে,তুমি আকাশ ছুতে পার ইচ্ছা করলেই’।শান্ত লেকটা বলছিল, ‘আমার শান্তি,স্বস্তি লুকানো আছে তোমার মধ্যে,কোন ঝড়ো বাতাসের ক্ষমতা নেই তোমাকে এলেমেলো করার’।সূর্য বলছিল, ‘চারপাশটা আলোকিত করে রাখ,ছড়িয়ে দাও তোমার চারপাশে’।
০০০০০০
১. ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২২ দুপুর ১:৩৯ ০