একবার এক ভীষণ আমলাতন্ত্রের খপ্পরে পড়েছিলাম। সেইবার খুকুর জন্য একটুকরো অন্ধকার খুব জরুরী হয়ে পড়েছিল। খুকু মোটেই ঘুমায় না, নিরন্তর নির্ঘুমে, আমার খুকু যেন কেমন হয়ে যেতে লাগলো। বৈদ্য দেখে বললেন, “বিরল অসুখ, তবে রাজ্যের অন্ধকার সব লুট হলে এই রোগ দেখা যায় বটে। এখন তো অন্ধকার ছাড়া আর কোন গতি দেখিনা। যেখান থেকে পার কিছু অন্ধকার নিয়ে আস... ”
অতঃপর আমি অন্ধকারের খোঁজে বের হলুম। শুরুতেই গেলাম সকালের কাছে। সকালের টেবিলখানিই না সবার আগে। ‘একটুখানি অন্ধকার চাই’- দাবী পেশ করা মাত্র সকাল এমন আজব তাচ্ছিল্য করল, রোদের তেজটাও যেন একটু বেড়ে উঠল। ‘অন্ধকার চাই তো আমার কাছে কেন? এমন আহাম্মক তো সূর্য জন্মানোর পরে আর দেখিনি। পথ ছাড় বাপু। ওসব অন্ধকার আমার বিভাগে না। সরে দাঁড়াও, সরে দাঁড়াও।’
নিতান্তই লজ্জা পেয়ে মুখ লুকিয়ে সরে আসলাম। আমাকে এক কোনে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা বক এগিয়ে আসল, ‘আমার একটুখানি অন্ধকার চাই’- শুনে বকটা কেমন বিভ্রান্ত হয়ে একটু ভাবল, তারপর বলল, ‘আমি তো অন্ধকারের খোঁজ পুরো জানিনে। আমি একটুখানি গোধুলীর দাবী নিয়ে এসেছি সন্ধ্যার কাছে। আমার ছানাটাকে গোধূলির আলোয় নিরুদ্দেশের পানে উড়ে যাওয়া শেখাতে চাই। তুমি সন্ধ্যার সাথে কথা বলে দেখতে পার। ’ সাদা ঝলক মেলে বক উড়ে যায় সন্ধ্যার পানে।
উপায়ন্তর না দেখে আমিও তাই ভাবলাম, সন্ধ্যার কাছেই যাব। পথে দুপুরের সাথে লাগলো এক ধাক্কা, তখন গলা শুকিয়ে কাঠ। বিরক্ত দুপুরের পথ থেকে সরে আসতে আসতে আমি কপালের ঘামটুকু মুছে ফেলি, আমার তো হাল ছাড়ার কোন উপায় নেই, খুকুর জন্য একটুখানি অন্ধকার যে চাইই চাই।
বিকেল পেরিয়ে যখন সন্ধ্যার কাছে আসলাম, তখন সন্ধ্যা যায় যায় ভাব। আকাশের পশ্চিম পাড়ে সিঁদুর রঙের আঁচল বিছিয়েছে সাঁঝ , রূপের বিভায় কেমন যেন ধাঁধা লেগে যায়। বার বার ঘড়ি দেখা দেখে বুঝলাম সন্ধ্যার খুব তাড়া। আমার অন্ধকারের দাবি শুনে বলল, ‘আসলে আমার তো একদম সময় নেই, আমার অফিস এখনি বন্ধ হবে। তোমার একটুখানি সন্ধিপ্রকাশ গোধুলি লাগলে বোলো।’ ‘গোধুলী নয়, আমার অন্ধকার চাই, আমার খুকু... ’ মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে অস্থির সন্ধ্যা বলল, ‘তা বেশ তো অন্ধকার লাগে তো রাত্রির কাছে যাও না কেন, তোমায় দেখে মায়া লাগলো বলেই না এত কথা খরচ করলাম।’ বলেই ঝপ করে টেবিল গুছিয়ে সন্ধ্যা পাহাড়ের ওপাশে হারিয়ে গেল।
দূরে দেখলাম একটা বক তার ছানাকে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে। খুকুর জন্য পড়ন্ত বেলায় আমার মনটা হু হু করে উঠলো। থামলে চলবে না, এগিয়ে গেলাম আবার। দেখলাম অন্ধকারচ্ছন্ন, ধূলোমাখা একখানা টেবিল। পদবী দেখে বুঝলাম এটাই তাহলে রাত্রির দপ্তর। অন্ধকার বুঝি এবার মিলবে। কিন্তু কই, কোথাও যে কাউকে দেখছিনা। একটু পরেই নোটিশখানা চোখে পড়ল, ‘যুবরাজ সুর্যের সাথে বিবাদে রাত্রির অন্ধকার অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হল।’ এবার? এবার তবে কি হবে? আর আমার সইল না, হাঁটুমুড়ে বসে পড়লাম। এতদূর থেকেও যেন আমার কানে ভেসে আসছে খুকুর নির্ঘূম কান্না। আমি অন্ধকার ছাড়া ফিরব কি করে?
আমার বুঝি আর কোথাও ফেরার নেই, আমার বুঝি কোথাও যাওয়ার নেই। আমার বুঝি আর কোথাও কেউ নেই। এইভাবে অল্পক্ষণ নাকি বেশিক্ষন কে জানে, হঠাৎ করে মনে হল কেমন কোমল এক আলোয় বুঝি ধুয়ে যাচ্ছে চরাচর, চোখ তুলে চেয়ে দেখি রূপসী চাঁদ, সুর্যের প্রাণপ্রিয় রক্ষিতা হিসেবে যার জগত জোড়া কলঙ্ক। জন্মের পর থেকেই সুর্যের সাথে অন্ধকারের বিবাদ। মহাবিশ্বের সিংহাসনের আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী কৃষ্ণবিবরের সাথে সুর্যের জন্মের শত্রুতার কথা কে না জানে। শুধুমাত্র চন্দ্রের জন্যেই সুর্যের যা কিছু অন্ধকারের ছাড়, অন্ধকারেই চাঁদের রূপটা ঠিকমত খোলে কিনা।
আমার অবস্থা দেখে চাঁদের বুঝি মায়া হল, সব বৃত্তান্ত শুনে বলল, ‘খুকুর কপালে তুমি আমাকে এঁকে নিও, তাহলে আর আলো এসে খুকুর ঘুম ভাঙ্গাবে না। সূর্য আজ ভুলে গেছে যে জেগে উঠে ঘুমানোর জন্য একটুখানি অন্ধকার সবারই চায়। ঈশ্বর তো বেচারাকে একবার ঘুমানরও ফুসরত দিলনা...।’। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাঁদ স্থির হয়ে বসল। আমি এক টুকরা কয়লা কুড়িয়ে এনে হাতের তালুতে চাঁদের ছবিটা ঠিকঠাক তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলাম, খুকুর মাদের কে জানিয়ে দিতে হবে কপালে চাঁদ আঁকবার কথা। আহা, কতদিন পরে আমার খুকু ঘুম দিয়ে উঠে আবার জেগে উঠবে...
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১:৪৮