শুনশান নগরী। ঘন্টা খানেক আগেও সরব ছিল চারপাশ। রাত বারোটা আটচল্লিশ মিনিট, নগরীর একটি ব্যস্ততম সড়কের পাশে বাইক থামিয়ে বসলো ঈশান। পকেটে থাকা বেনসন সিগারেটের প্যাকেটে রাখা দেশাল দিয়ে বানানো জয়েন্ট বের করে জ্বালায়। সোডিয়ামের আলো এখন আর নেই, আধুনিকতার ছোঁয়ায় সোডিয়াম এর বদলে ল্যাম্পপোস্টগুলো দখল নিয়েছে এলইডি।
অফিস শেষে উদাস সময়গুলো কাটানোর জন্য মধ্যরাতে নিরব এই রাস্তাটিকেই বেঁচে নিয়েছে ঈশান । প্রতিদিনই এখানে আসে সে, একটু নিরব সময় কাটায়। তামাক পাতা পোড়ার সাথে যেন ধামাচাপা দিয়ে দেয় নিজের বেদনাগুলো।
আজ ২৯ই আগস্ট, ঈশান আজ বেশ উদাসীন । একটা জয়েন্ট শেষ করেও যেন তার নেশা হচ্ছে না, ধামাচাপা দিতে পারছে না হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোকে। অ্যালকোহলের দোকানগুলোও এতক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। অফিসে কাজের চাপ বেশি থাকায় বারোটার পর অফিস থেকে ছাড়া পেয়েছে সে। পথিমধ্যে রেডবাটনে বাইক থামিয়েছিল অ্যালকোহল এর জন্য। কিন্তু ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। সাকুরা, পিকক এবং এরামও এতক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে সম্ভবত। রাত একটা ছুঁইছুঁই। মধ্যরাতে বারগুলো বন্ধ থাকাটাই স্বাভাবিক। জয়েন্ট পেপার দিয়ে আরেকটি জয়েন্ট বানায় ঈশান, ফোনে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজে অ্যাশেজের - কার কপালের টিপ কার হয়ে যায়, চলে গিয়ে ভুল করেছে ......।
ঈশান আবার তামাক পোড়ায়। একটু নেশা দরকার তার, নেশার অতলে হারিয়ে খুঁজে নিতে চায় নিজেকে। স্মৃতিচারণ করে ঈশান, মাত্র দুবছর আগে ২৯এ আগস্ট মধ্যরাতে ঈশানের জীবনে ঘটে যায় এক মহাবিপ্লব। প্রাক্তনের জন্য দীর্ঘচারবছর অপেক্ষা করতে থাকা ঈশান এক নতুন জীবনের স্পর্শ পায়। তারজীবনে যুক্ত হয় একটি নতুন নাম তুর্ণা। ঈশানের কোলে মাথা রেখে এনে দেয় এক নতুনত্বের ছোঁয়া। ঠোঁটের স্পর্শের বিনিময়ে অ্যালকোহল থেকে দূরে ঈশানকে। শর্ত একটাই, যেদিন সর্বোপরি অ্যালকোহল ত্যাগ করতে পারবে সেদিনই তুর্ণার ঠোঁটের স্পর্শ পাবে ঈশান।
বেখেয়ালি ছেলেটা বদলাতে শুরু করে, স্বপ্ন বুনে আবার নতুন করে। অতীতকে ধামাচাপা দিয়ে বাঁচতে শিখেছিল তুর্ণার হাত ধরে। আবার ভালোবাসে ঈশান, মনপ্রাণে ভালোবাসতে শুরু করে তুর্ণাকে।
ঈশান জানতো না, তাকে বদলাতে এসে যে একদিন তুর্ণা নিজেই বদলেই যাবে। ঈশানের ইচ্ছানুসারে কপালের মধ্যখানে টিপ পরতে শুরু করা তুর্ণা এখনো টিপ পরে, তবে তা এখন আর ঈশানের জন্য নয়।
তামাাক পাতার ধোঁয়া আর একবিন্দুও অবশিষ্ট নেই। কিন্তু আজ নেশা হচ্ছে না ঈশানের। অথচ অ্যালকোহল থেকেও তামাকে দ্রুত নেশা হয়। ঈশানের কানে বাজছে ভবঘুরে ব্র্যান্ড এর - চলে যাবে যদি তবে কেন এসেছিলে, বদলাতে গিয়ে এসে কেন নিজেই বদলে গেলে........ ।
ঈশান চায়নি এ জীবন, কিন্তু ভাগ্যলিপিতে যে এমন লিখা ছিল তা কে জানতো.?
তুর্ণার শেষ বাক্যটা এখনো কানে বাজে - তোমার প্রতি এখন আর আমার ফিলিংস কাজ করে না, যখন ফিলিংস ছিল তখন রিলেশনে ছিলাম কিন্তু এখন আর কাজ করে না, সুতারং আমি তোমার সাথে রিলেশন কন্টিনিউ করতে পারবো না ।
ঈশান বুঝতে পেরেছিল সেদিন, তুর্ণা যে তাকে ভালোবাসে নাই। বরঞ্চ, সাময়িক মোহে জড়িয়েছিল মাত্র। ঈশান চেয়েছিল ফিরাতে, কিন্তু তুর্ণা ফেরে নাই। তুর্ণা এখন বহুজন নিয়ে দিব্যি ভালো আছে। ঈশানের চক্ষুতলেই অন্যকারো হাতে হাত রেখে বেড়ায় দিব্যি। ঈশান ডুবে যায় অ্যালকোহল আর তামাক পাতার পোড়া ধোঁয়ার মাঝে।
- বসতে পারি..?
ঈশান উপরে তাকায়, আচমকা চমকে উঠে ঈশান মধ্যরাতে রাস্তায় শাড়ী পরা মেয়েটিকে দেখে। ঈশান ভেবে নেয়ে গণিকা হয়তো। খদ্দেরের খোঁজে রাস্তায় বেড়াচ্ছে।
ঈশান মাথা নেড়ে সায় দিল। শাড়ী পরা মেয়েটি ঈশানের পাশেই বসে।
- সিগারেট হবে একটা.?
ঈশান সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট মেয়েটিকে দেয়, এবং নিজে একটি সিগারেট জ্বালিয়ে নেয়।
- আপনি আমাকে যা ভেবেছেন আসলে আমি তেমন নয়।
- মধ্যরাতে রাস্তায় একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাহলে কেন.?
- অন্ন জোগানের তাগিদে
- আপনার সময় নষ্ট হচ্ছে সম্ভবত।
- আপনি মধ্যরাতে রাস্তায় কেনো.?
- তা আপনার না জানলেও হবে।
- আচ্ছা
- উঠতে পারেন এখন।
ঈশান চলে যেতে বলায়, মেয়েটি উঠে দাড়ায় । এবং দুকদম সামনে যেতেই ঈশান আবার বলে উঠে।
- এই যে শুনুন।
মেয়েটি ঘুরে দাড়ায়। ঈশান বলে - এদিকে আসুন
মেয়েটি কাছে আসে, ঈশান পকেটে থাকা সবগুলো টাকা হাতে দিয়ে বলে
- বাসায় ফিরে যান আজ
- আপনি আমাকে টাকা দিচ্ছেন কেন.?
- খদ্দের থেকে যা পেতেন, তা না হয় আমিই দিয়ে দিলাম। আজ বাসায় ফিরে যান
- আমি কারো দয়া গ্রহন করি না, আপনি টাকাগুলো ফিরিয়ে নিন।
- দয়া বা অনুগ্রহ ভাববেন না দয়া করে, কিছু সময় পর টাকাগুলো মূল্যহীন আমার কাছে। তারচেয়ে আপনার কাজে লাগুক টাকাগুলো।
- একটা শর্তে নিতে পারি
- কি শর্ত.?
- দেহের বিনিময়ে টাকাগুলো নিতে পারি।
ঈশান ফিরে যায় বছরখানেক সময় আগে, তুর্ণাদের বাসায় গিয়েছে ঈশান। তুর্ণার আম্মু ঈশান এবং তুর্ণাকে বাসায় রেখে বাইরে যায় কাজে। ঈশান তুর্ণার কোলে মাথা রাখে, তুর্ণা বলে - ঈশান আম্মু বিশ্বাস করে আমাদের। ঈশান সেদিন আর তুর্ণার মায়ের বিশ্বাস নষ্ট করেনি। তুর্ণার গাঁয়ের গন্ধ কাছ থেকে পেয়েও সেদিন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখে ঈশান। আর আজ এখানে টাকার বিনিময়ে সে কারো দেহে নিজেকে বিলিয়ে দিবে.?
ভালোবাসায় যে প্রকৃত সুখ নিহিত, তা শত নারীর স্পর্শে গেলেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভালোবাসা হলো পরমাত্মার সম্পর্ক। ভালোবাসার মাঝে দৈহিক সম্পর্ক কেবলই চাহিদা মাত্র। সম্পর্কের গভীরতা থাকে দুটো মানুষের আত্মিক মিলনের মাঝে। ভালোবাসাহীন দৈহিক মিলনে তৃপ্ততা নেই , সেখানে একে অপরের ব্যাবহার হবে কেবল ভোগ্য পণ্য হিসেবে। সেখানে নেই কোন টান, মায়া এবং পরমআত্মার সম্পর্ক।
ঈশান মেয়েটিকে বললো - বিনিময়ের কথা বলছেন কেন.?
- আমি যে কারো অনুগ্রহের পাত্রী নয়। প্রথমদিনেই হারিয়ে গেছে আমার আবেগ, মায়া, টান, ভালোলাগা এবং খারাপ লাগা। চিলেকোঠার সেই দেয়ালের কোনায় ভয়ে চুপসে নিজেকে মিলিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। এই রাস্তায় নতুন জেনে তার হিংস্রাত্মক ভাব সেদিন ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল আমার জীবন। ভার্জিনিটি নষ্ট করাই যেন ছিল সেদিন তার লক্ষ্য । সে থেকে আমি আর আমার জীবনের মাঝে নেই। নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি মানুষজনের ভোগ্যপণ্য হিসেবে। আমি চাই না কারো অনুগ্রহ হিসেবে কিছু গ্রহন করতে। আপনি টাকাগুলো ফেরত নিন।
মেয়েটি ঈশানকে টাকাগুলো ফেরত দিতে ওর দিকে তাকিয়ে দেখে, ঈশান মাটিতে পড়ে রয়েছে। ভয় পেয়ে যায় মেয়েটি। ঈশানকে নাড়িয়ে দেখে- ঈশানের মুখ দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে।
ঈশান বলে উঠে - ওই যে তুর্ণা বসে আছে একটি ছেলের সাথে। একসময় আমরা বসতাম। তুর্ণা আজ মেতে আছে অন্যকারো ভুবনে। আমি চললুম।
ঈশান নিথর হয়ে যায়। শাড়ীপরা মেয়েটি ঈশানের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মসজিদ থেকে ভেসে আসছে - আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম। রাতের অন্ধকার শেষ হয়ে পূবাকাশে আলো ছড়িয়ে উঁকি দিয়েছে আরেকটি নতুন সূর্য।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:৫৭