উনিশ'শ একান্ন-বায়ান্ন সালের দিকে প্রায়ই এক দূর্ধর্ষ চেহারার তরুণ ও এক ছিপছিপে গড়নের কিশোরীকে দ্যাখা যেতো বড়ো সড়কের অদূরে কুঠিবাড়ি'র সিঁথানে শতাব্দী প্রাচীন কোন এক বট অথবা পাকুড় গাছের নিচে। তরুণের হাতে হয়তো দেবীনগর বা নুরুল্লাহপুর মেলা থেকে কেনা লাল রঙের কাঁচের চুড়ি থাকতো অথবা থাকতো না, তবে কিশোরীর হাতে সবসময়ই রঙিন সূতোয় বোনা আগেরবারের'চে ভিন্ন চেহারার হাত-পাখা থাকতো। বট অথবা পাকুড়, যেই গাছের নিচে বসে কিশোরীটি খুঁনসুটিতে মেতে উঠতো অথবা তরুণটি হেঁড়ে গলায় গান গাইতো সেই গাছের অদূরের বড়ো সড়ক ধরে হেটে আসা প্রৌঢ়টি হয়তো তাদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতো অথবা গাছের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলা গরুর গলায় গিঁট দেয়া দড়ির অপর প্রান্তের বালকটি হয়তো মুখ টিপে হাসতো। কিশোরীটি আর তরুণটি প্রেমিক-প্রেমিকা নাকি ফুপাতো-মামাতো ভাই-বোন, এই নিয়ে হয়তো সন্ধ্যাবেলায় আলোচনাও হতো কুঠিবাড়ি'র আশেপাশের কোন এক কুপি জ্বলা বাড়িতে মহিলাদের আসরে। কেউ জানেনা কে কী ভেবেছিলো।
তবে তা না জানলেও সেই পাকুড় অথবা বট গাছের দক্ষিনের দক্ষিন বাহ্রা থেকে শুরু করে উত্তরের নামে মাত্র সুন্দরীপাড়া পর্যন্ত সবাই জানে যে সেই এলাকার একমাত্র প্রেমিক-প্রেমিকা জুটির কিশোরী বয়সের আর তরুণ কালের প্রেম শেষ পর্যন্ত বিয়েকেও ছাড়িয়ে গত তিন বছর আগপর্যন্ত টিকে ছিলো, এই জগতে।
হয়তো কোন একদিন বাড়ির পাশের চার শতাব্দী প্রাচীন মেলায় কুষ্টিয়া থেকে আসা বাউলের আলখাল্লার সাদা-হয়ে-আসা হলুদ রঙ অথবা মেলা-ময়দানের দক্ষিন-পূর্বে চঁকচকে পদ্মায় জেগে উঠা পলি-মিশ্রিত চরের ঈষৎ হলুদ বালু বৈরাগ্য হয়ে ভর করেছিলো তরুণটির উপর। সদ্য বৈরাগ্য-প্রাপ্ত-প্রেমিক কিশোরীর রঙিন হাতপাখার ঘূর্ণনে বেরিয়ে আসা খিলখিল হাসি অথবা খুঁনসুটির ফলে উৎপন্ন বাতাসে আগ্রহ হারিয়ে অথবা কুঠিবাড়ির পাশের কুপি জ্বলা বাড়ি থেকে ভেসে আসা 'মরদ' শব্দটির যথার্থতা প্রমানে বেরিয়ে পরলো বাড়ি থেকে, কাঁচের চুড়ি'র নগর দেবীনগরে। আর এদিকে আমাদের কিশোরী প্রেমিকা ব্যস্ত তার সদ্য বৈরাগ্য-প্রাপ্ত-প্রেমিকের দেয়া কাঁচের চুড়ি'র উপর পরা তরল বিরহ অথবা মায়ের কাছে বলা কথামতোন চোখে পোঁকা যাওয়ায় বের হওয়া পানিতে তার প্রেমিকের সাতরঙা প্রতিবিম্ব আবিষ্কারে।
কিশোরীটি আবারও তার প্রেমিকের এই রঙিন প্রতিবিম্ব আবিষ্কার করেছে আজ থেকে উনষাট-ষাট বছর আগের কোন এক সন্ধ্যায়, এবার আর তরল বিরহে অথবা পোঁকায়-আনা-চোখের-পানির ফোঁটায় না, প্রেমিকের বাড়িতে চারকোনা আয়নায়। বৈরাগ্যের প্রভাবে হলুদ হয়ে যাওয়া বাউলের আলখাল্লা আর পদ্মার চরের কুমড়োর প্রভাবে হলুদ হয়ে যাওয়া বালুও সেদিন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলো তরুণের চোখ থেকে, লাল শাড়ির প্রভাবে লাল হয়ে যাওয়া চাপা-রঙের কিশোরীর কাছে। পরবর্তী চব্বিশ-পঁচিশ বছর লাল ভিন্ন অন্য কোন রঙ তরুণটি দেখেছে কিনা সন্দেহ।
বিয়ের পরও তরুণের লাল রঙের ক্ষুধা আর ফুরোয় না, কিশোরীর সাত-রঙা হাত-পাখাও অ্যাখন লাল হয়ে গ্যালো। মন থেকে লাল রঙ তাদের চোখ বেয়ে পরলো গাঁইয়ের উপর, উঠোন জুরে লাল রঙের ছড়াছড়ি তো বটেই, চব্বিশ-পঁচিশ পরে দ্যাখা গ্যালো ঘর জুরেও পাঁচ-পাঁচটি লাল রক্তের মানব-মানবীর অস্তিত্ব। তরুণটি যখন মধ্যবয়স ছাড়িয়ে মধ্য-প্রৌঢ়, আর কিশোরীটি যৌবন পেরিয়ে মধ্যবয়স্কা নারী, তখন লাল রঙের মোহ ছাড়িয়ে হয়তো আবারও বৈরাগ্যে ধরলো তাকে। একদিন ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুদিন পর সে ফিরে এলো, তার পরনে কিশোরীর শাড়ি'র লাল রঙের সাথে বাউলের আলখাল্লার হলুদ রঙ, পদ্মার পানিতে পরা আকাশের রঙ, তার চরে জন্ম নেয়া কুমড়োর প্রায় কমলা রঙ, কুঠিবাড়ির অভ্যন্তরের নীল-বেগুনী রঙ, তার সিঁথানের পাকুড় গাছের পাতার সবুজ রঙ মিশে যেই রঙটি হয়, সেই রঙের পোষাক। সেই রঙের প্রভাবে একসময়ের কিশোরীর পরনের শাড়িও শাদা হয়ে গ্যালো। যার অস্তিত্ব ছিলো তিন বছর আগেও।
কিশোরীটির প্রেম গত শতাব্দীর মধ্যভাগে শুরু হয়ে টিকে ছিলো এই শতাব্দীর প্রথম দশমাংশ পর্যন্ত। সেই তরুণটি'র কথা হয়তো তার মনে ছিলো না, অথবা মনে ছিলো। কে জানে, হয়তো আমাদের দেখে দেখে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঠাট্টার ছলে যখন তার কিশোরী-বেলার কথা বলতেন তখন হয়তো ফিরে যেতেন সেই পাকুড় গাছের নিচে, হাতের পাখা দিয়ে আমাদের বাতাস করতে করতে হয়তো কল্পনায় খুঁনসুটিতে মেতে উঠতেন তরুণটির সাথে।
অতঃপর শেষ হল হল জীবনের সব লেনদেন। থাকে শুধু অন্ধকার।