রাত প্রায় বারটা। আমি বাস থেকে নামলাম আজিজ মার্কেটের ঠিক সামনে। রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়ার সংখ্যা কমে গেছে। শুধু বড় বড় মালবাহী ট্রাকগুলো চলে যাচ্ছে শা-শা শব্দ করে। আর মিটমিট করে জ্বলছে রাস্তার দু’ধারের বাতিগুলো। কিছু বাতি জ্বলছে আর নিভছে। আলো-ছায়ার খেলা যেন। আমি শর্টকার্ট রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করেছি। হাতের ডান দিকের ছোট গলিটা দিয়ে। এই গলিতে যে আমার জন্য ওৎ পেতে আছে মাকড়শার জাল তা আমি ঘুনাক্ষরেও টের পাই নি।
কিছু দূর এগোনোর পর হঠাৎ করেই আমাকে ঘিরে ধরল পাঁচ জন যুবক। তাদের প্রত্যেকের হাতে চাপাতি ও মোটা মোটা বেতের লাঠি। আচমকা তাদের দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। চারপাশের বিল্ডিং গুলোতে আলো নিভে গেছে। কয়েকটা ফ্লাটে দেখা যাচ্ছে মৃদু আলো। রাস্তাটা অন্ধকারই তবে আবছাভাবে সবই দেখা যাচ্ছে।
যুবকদের দলনেতা বলে উঠল, আপনার হাতের ল্যাপটপটি আমাদের চাই, ঝটপট দিয়ে বাসায় চলে যান, আমরা কিছুই বলব না।
‘দেখো আমার ছেলে এইচ.এস.সি তে অনেক ভালো রেজাল্ট করেছে, তাকে কথা দিয়েছিলাম ভালো করলে ল্যাপটপ উপহার দিব, তোমরা যদি নিয়ে যাও তাহলে……
বাধা দিল দলনেতাটি- অতসত জানি না, প্রাণে বাঁচতে চাইলে দিয়া দ্যান।
আমার মানিব্যাগের প্রায় দশ হাজার টাকা দিয়ে দিতে প্রস্তুত। অনেক মিনতিও করি। কিন্তু তারা তাদের কথায় অটুট।
যুবকটা এবার ক্ষেপে গিয়ে বলল,ঔ শালাকে ধর তো। সঙ্গে সঙ্গে তিন জন এসে এমনভাবে ধরল যেন কোরবানির গরুকে ধরেছে। কেউ একজন পিছন দিক থেকে আঘাত করতে লাগল। মেরুদন্ডে ও মাথার পিছনে বেশ কয়েকবার স্পষ্ট টের পেলাম আঘাতের। আঘাত সহ্য করতে পারলাম না। অল্প সময়ের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
যখন চোখ খুললাম দেখলাম যুবকগুলো আমাকে খাটিয়ার মত কিছু একটায় উঠিয়ে কাঁধে করে হেটে চলছে ধু ধু করা বালু প্রান্তরে। অবাক না হয়ে পারলাম না। যুবকেরা হাঁটছে তো হাঁটছে। তাদের যেন ক্লান্তি নেই ,তৃষ্ণা নেই। একটানা রোবটের মত হেঁটে চলছে। এদিকে আমার শরীর যেন অসাড় হয়ে পড়েছে ,না পারছি কথা বলতে না পারছি নড়াচাড়া করতে। চারপাশে তাকিয়ে বালি আর মাঝে মাঝে কয়েকটা পাতাবিহীন গাছ দেখতে পাচ্ছি। খাটিয়া থেকে এর চেয়ে বেশী কিছু দেখা যাচ্ছে না।
হঠাৎ করে যুবকেরা থেমে গেল। স্তব্ধ হয়ে আছি। কি হচ্ছে? দেখি আমার খাটিয়াটা নিচে নামিয়ে রাখল । দেখতে পেলাম সামনে একটা কূপ। যুবকরা এবার আমাকে এমনভাবে ধরে ধরে নিচে নামালো যেন আমি আসামী একটু পর ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। তারপর দাঁড় করালো অজানা সেই ভয়ংকর অতল কূপের সামনে। পিছন থেকে কে যেন ধাক্কা দিল পিঠে। সঙ্গে সঙ্গে পাতালের দিকে নেমে যাচ্ছি। আর কিছু ভাবতে পারলাম না চোখ বন্ধ করে রাখলাম। মিটমিট চোখে দেখলাম যুবকরা অট্টহাসিতে ফেটে পরেছে । কান্না আটকে রাখতে পারছি না । আর ওরা পৈশাচিক হাসি হাসছে।
কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখলাম মেঘের রাজ্যে ভাসছি। কোন এক অদৃশ্য শক্তিবলে ধীরে ধীরে নিচের দিকে ধাবমান যাকে বলে। যেন প্যারাস্যুট বাধা আছে শরীরে। চারপাশে সাদা সাদা আব ভেসে বেড়াচ্ছে। পাখিরা হাসি হাসি মুখ নিয়ে উড়ে চলছে দিগন্তের পথে। হালকা বাতাসে শরীরটা দুলছে। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বিশাল এক অপরুপ দৃশ্য। ঢাকা শহরকে যেন চেনাই যাচ্ছে না। ঢাকার দালান-কোঠা আজ যেন অন্য রকম হয়ে গেছে। যেন রুপকথার শহর। যে শহরের অস্তিত্ব কোনকালেই ছিল না। এমন একটা শহর।
প্রায় কতক্ষণ পর নিচে নামলাম বলতে পারবো না। দেখলাম একটি দু’তলা বিল্ডিং এর সামনে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিল্ডিংটি যেন রুপকথার রাজ্য থেকে এখানে বসিয়ে দেওয়া। সামনের অংশ সুন্দর কারুকার্যে বেষ্টিত। বাড়ির সামনে সুন্দর গোছানো বাগান। বাগানের মাঝখান বরাবর চলে গেছে সাপের মত পাচানো পাকা রাস্তা, যা একদম গেটের সামনে গিয়ে থমকে গেছে।
আকাশের চাঁদ এখন পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে; তার হালকা আলোয় রুপকথা থেকে উঠে আসা এই বাড়িটি দেখতে পাচ্ছি। চারদিকে মিষ্টি বাতাস বইতে শুরু করল। এত সুন্দর পরিবেশ আগে কখনও উপভোগ করি নি। বাড়িটি থেকে বের হলাম। দেখলাম ডান পাশে এক অরণ্য আর বাম পাশে ঢাকা শহর। কিন্তু এই শহরকে ছোট বেলা থেকে যেমন দেখেছি এটা তেমন নয়। তাই ভাবতে কষ্ট হল এটা আমার প্রিয় সেই ঢাকা। যেখানে আমার স্ত্রী আমাকে আশ্বিক বলে ডাকত। আমার আসল নাম আসলে আসিফ। স্ত্রীর নাম প্রিয়া বলে সে আমাকে ঐ নামে ডাকে। এমন পরিবেশে নিজের স্ত্রীকে অনুভব করলাম। সে থাকলে কতই না ভাল হত। দুই জন মিলে অরণ্যের পথে হাঁটা শুরু করতাম মাতাল হওয়ার জন্য। রাস্তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দু’জনে হাত ধরাধরি করে হাঁটতেই থাকতাম। ক্লান্তিকে বিদায় জানাতাম। এই অপরুপ সুন্দর রাস্তার শেষ কোথায় দেখে ছাড়তাম নিশ্চিত।
স্বপ্ন হঠাৎ করে ভেঙ্গে গেল এক অচেনা মানুষের তীব্র চিৎকারে। আমি যে বাড়িটির সামনে দাঁড়ানো তার ভিতর থেকে চিৎকারটি এলো। দেখার জন্য সাপের মত পথে পা বাড়ালাম। গেটের সামনে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়তেই, এক জন বৃদ্ধা এসে ঘর খুলে দিল। সে আমাকে প্রশ্ন করল না কেন তার বাসায় এলাম। মনে হল এখানেই আসার কথা আমার। সে মনে হয় আমাকে চিনে। তার অভিব্যক্তি দেখে তাই মনে হবে। মৃদু হেসে ঘরে ঢুকতে বলল। যে বাড়িটাকে এতক্ষন নীরব ভেবেছিলাম। ভিতরে ঢুকে ঠিক তার উল্টা ধারণা হল। অনেক মানুষ, বিশাল এক হল রুমে বসে আছে। সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। মনে হল কোন পার্টি চলছে। তেমনই আয়োজন। এবার বৃদ্ধাটির দিকে সোজা তাকালাম। দেখে মনে হল সে অন্ধ। তবে অনেক দিনের অভিজ্ঞতার জন্য বোধ হয় এই বাড়ির আনাচে-কানাচে তার বহুদিনের চেনা । তাই তার চলতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু তাকে দেখে মনে হল সে আমাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।
''এই বাড়িতে কি কোন অনুষ্ঠান?''
বৃদ্ধা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকানোর ভান করে বলল, সে কি তুমি জানো না? তার চোখে বিস্ময়। তার বিস্ময় দেখে খানিকটা চিন্তায় মধ্যে ডুবে গেলাম। মনে মনে বললাম, এ আবার কি বলে? আর প্রকাশ্যে বললাম, ''না, মানে একটা চিৎকার শুনে মনে হল কেউ বিপদে পড়েছে। তাই দেখতে এসেছিলাম।''
বৃদ্ধা কিছু না বলে আমাকে এক কোণে বসিয়ে উধাও হয়ে গেল। ধীরে ধীরে চারপাশটা ভাল মত লক্ষ্য করছি। দূরে এক জনের সাথে চোখা-চোখি হওয়াতে বুঝতে পারলাম এই লোকটিও অন্ধ। দৃষ্টিশক্তিহীন একজন লোক এমন পার্টিতে এসে কিভাবে উপভোগ করে; বিষয়টি বেশ ভাবিয়ে তুলল। কিন্তু অন্ধ বলেই কি তার সব ধরণের আচার-অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকতে হবে। তারও উচিত সব জায়গায় যোগ দেওয়া। তাই তাকে দেখে খারাপ কিছু মনে হল না। সে যে এখানে এসেছে; সে জন্যে মনে মনে তাকে ধন্যবাদ দিলাম।
ছোট একটা স্টেজে একটা মেয়ে হঠাৎ করে উঠে গান গাওয়া শুরু করেছে। মেয়েটির চেহারায় যেমন মাধুর্য তেমনি তার গলার স্বরও মিষ্টি। তবে এই মেয়েটিও অন্ধ। মনে মনে কষ্ট পেলাম। এত সুন্দর যৌবনময় একটি মেয়ে চোখে দেখতে পারে না। কয়েকজন গানের তালে তালে নাঁচতে লাগল। যাদের নাঁচতে দেখলাম তারাও চোখে দেখে না। এবার একটু অপ্রস্তুত হলাম। এত সুন্দর সুন্দর মানুষ তারা কি কেউ চোখে দেখে না। না তাদের সব কিছু দেখা বারণ। মনে হল অন্ধদের বাড়িতে চলে এসেছি।
কিছুক্ষন পর বৃদ্ধাটি কোথায় থেকে এসে বলল, চলুন, আপনাকে আমাদের মালিক ডাকছে।
কেন?
সেটা গেলেই বুঝতে পারবেন।
উঠে তার পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করি। হলরুমটা পার হয়ে ছোট করিডর হয়ে খোলা দরজার সামনে দাঁড়ালাম। বৃদ্ধা দরজা পর্যন্ত এসেই থমকে দাঁড়ালো আর বলল, ভিতরে যান।ভিতরে ঢুকতেই দেখি এক বৃদ্ধ একটি সিংহাসনের মত চেয়ারে বসে আছে। রুমটা যতটা ছোট ভেবেছিলাম ততটা নয়। মোটামুটি বড়ই বলা চলে। বৃদ্ধটির চারপাশে আগের দিনের রাজাদের ভাড়াটে মন্ত্রী সেনাপতির মত অনেকেই বসে আছে। ঢুকে একটা সালাম দিলাম।
তুমি নাকি চোখে দেখতে পাও?
সরাসরি প্রশ্ন করলেন তিনি। এমন প্রশ্নের উত্তরে কি বলব ভেবে পেলাম না।
কথা বলছ না কেন?
জ্বি, জনাব। কিন্তু এমন প্রশ্নের মানে কি? আপনিও তো চোখে দেখেন। তাই নয় কি?
যুবক টাইপের এক লোক রেগে গিয়ে বলল, কি রাজার মুখের উপর কথা!
আরেকজন, আমাদের এই শহরে কোন লোকেরই চোখে অধিকার নাই।
কি বলতে চান?
হ্যা ও ঠিকই বলেছে। আমি আর আমার রাজসভার লোকজন ছাড়া আর কেউ চোখে দেখার অধিকার রাখে না। এর জন্যই এই শহরের নাম অন্ধদের শহর।
মনে মনে বললাম এ কোথায় এলাম রে। যুবকরা কি ফাঁদে ফেলার জন্যই এমন এক আজব শহরে ফেলে গেছে?
কিন্তু আপনি কত বড় খারাপ কাজ করছেন সেটা কি ভেবে দেখেছেন।
আমার কাজ আমি ভাল ভাবেই বুঝি। তোমাকে বোঝাতে হবে না।
সবাইকে আপনি অন্ধ বানিয়ে একা একা সৌন্দর্য উপভোগ করবেন এটা তো ঠিক না। একটু আগে মনে হয় কারো সর্বনাশ করেছেন?
রাজা হো হো করে হেসে উঠল। তারপর সবাই। ধীরে ধীরে সারা ঘরময় অট্টহাসির প্রকপ বেড়ে গেল। সে হাসিতে শয়তানও পালিয়ে যাবে। কতক্ষণ সে হাসি চলল ঘড়ি থাকলে স্টপ ওয়াচ চালিয়ে দেখা যেত। এদের হাসি দেখে মনে হল তাদের ভিতর কোন পাপ বোধ কাজ করে না। অন্যদের অন্ধ বানিয়েই এরা মজা পায়, আনন্দ পায়, সুখ পায়।
হাসি থামিয়েই রাজা আমাকে আটক করার জন্য নির্দেশ দিল। দৌড়ে পালানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলাম । এক বন্ধীখানায় নিয়ে গেল। সেখানে আরো কয়েকজন ছিল।
সারা রাত ঘুম হল না। সকালে আবার সৈন্যবাহিনীর সদস্যরা অন্য ঘরে নিয়ে এল। হাত-পা বেধে ফেলা হল। চিৎকার করছি। কিন্তু কেউ স্বর শুনল না বা শোনার চেষ্টা করল না। ঠিক যেভাবে ঢাকায় কেউ বিপদে পড়লে অন্ধ হয়ে যায় বা কালা হয়ে যায়। এখানকার লোকদের দোষ দেই না। কারণ তারাও তো সবাই অন্ধ। তারা শুনতে পেলেও দেখতে পায় না। হয়ত দেখতে পেলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত।
এক জল্লাদ এসে সামনে দাঁড়ালো। ভয়ে দম বন্ধ হয়ে গেছে। তার হাতের দিকে তাকিয়ে আরো ভয় পেয়ে গেলাম। দুই হাতে চকচক করছে দুইটি ছুরি। কিছুক্ষণ পর রাজা আসল। বলল, তুমি এখন থেকে অন্ধদের শহরের বাসিন্দা হয়ে যাবে সারা জীবনের জন্য। জল্লাদ যতই ধীরে ধীরে আমার দিকে আসছে। ততই হৃদপিন্ড দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। সে এখন ঠিক চোখ দু’টোর সামনে। কিছুই করার ছিল না। চোখ বন্ধ করে রইলাম। এক সময় চোখের ভিতর তার ছুরিগুলো ঢুকিয়ে দিল। ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম।
কতক্ষণ পর জ্ঞান ফিরল বলতে পারব না। জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে অনেক লোকের শব্দ শুনতে পেলাম। কেউ একজন বলে উঠল। দেখ দেখ জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তারকে খবর দাও। ডাক্তার এসে চোখ থেকে ব্যান্ডেজ খোলা শেষে বলল ধীরে ধীরে তাকানোর চেষ্টা করুন। চেষ্টা করলাম। তবে সামনে কালো রং ছাড়া অন্য কোন রঙ দেখতে পেলাম না। আমাআমবআাাববকবককককআমার
আমার ছেলে প্রশ্ন করল বাবা আমাকে দেখতে পাচ্ছো তো। চুপ করে আছি। আর মনে মনে বললাম অন্ধদের শহরের রাজাই ঠিক বলেছে এখন থেকে তাদের শহরের বাসিন্দা আমি।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১৫