একজন ধর্ষিতার গল্প শোনাব। তার নিজ বয়ানে। কতটুকু সত্যতা আছে, তা পাঠকরাই বিবেচনা করবেন।
নীরবের সাথে প্রথম ফেইসবুকেই পরিচয়। প্রায় প্রত্যেকদিন লম্বা সময় নিয়ে চ্যাটিং হয়। এরপর মাঝে মাঝে ভিডিও চ্যাটিং। ফোন নাম্বার আদান-প্রদান করে দিন রাত মিলিয়ে অনেক কথা হয়। আমার বয়স তখন ২৩। ফোনে কথা বলতে বলতে নীরবের সাথে একদিন ডেট ফাইনাল করি। অনেকদিন তো কথা বললাম। এবার সামনাসামনি আলাপ করা যাক।
একটা নীরব রেস্তুরায় গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা হোল। কফির ওর্ডার দিয়ে আমার পাশে বসে চোখের দিকে তাকিয়ে বলে ফেলল, তোমাকে অনেক ভালবাসি।
আমিও তোমাকে ভালবাসি। বললাম।
ও আমার হাত ধরে রাখল। সেই প্রথম দিনকার স্মৃতি এখনও ভুলতে পারি নি। ওর চোখে কেমন যেন একটা মায়া ছিল। যা ভোলার মতন না। সেদিন কফি পান করে, বাসায় ফিরে আসার পর ফোনে আবার কথা শুরু হোল। কথা থামতেই চায় না। ওর সাথে সারাদিন কথা বলেও যেন স্বাদ মিটে না এমন।
নীরব একটা ইউনিভার্সিটি'তে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত। আমি পড়তাম ইংরেজিতে।
ধীরে ধীরে আমাদের সম্পর্ক আরো গাঢ় হোল। ওর সঙ্গে যতই সময় কাটাই ততই যেন মায়া বাড়ে। কখনও খারাপ লাগা কাজ করে নি। সব সময় ওর পাশে নিজেকে সেইভ মনে হয়।
ওর ইউনিভার্সিটি'র পড়া শেষ করে স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকা চলে গেল। তখন আমাদের দূরত্ব বাড়তে লাগল। ওর নাকি সময় হয় না। মাঝে মাঝে ফোন দেয়, কিন্তু কথা বেশি একটা বলে না। ফেইসবুকেও চ্যাটিং করা কমিয়ে দিয়েছে। এদিকে আমারও পড়ার চাপ।
হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। সারা শরীর ঘেমে একাকার। কেন যেন মনে হোল, না এটা তো ভালবাসা না। শুধুই দেহের সম্পর্ক। নীরব কি তাহলে আমাকে ব্যবহার করেছে শুধু।
যখন আমরা রুমডেটে যেতাম, ও আমার নরম শরীরে হাত দিয়ে বলত, কত সুন্দর তোমার শরীর। কই বলে নিতো তুমি কত সুন্দর। কিন্তু আমি ভাবতাম, আসলে ও আমাকেই ভালবাসে। যতবারই ওর সঙ্গে আমার সঙ্গম হয়েছে, ততবারই ওর দৃষ্টি বদলে যেত। মাঝে মাঝে আমার চোখ দিয়ে পানি বের হোত। কখনও চোখের পানি মুছে দিত না। ওর কাজ চালিয়ে যেত। ও বারবার বলত, তোমাকে ছাড়া আমার জীবন সার্থক হোত না। কেমন সার্থকতা তখন বুঝি নি। ভেবেছি হয়ত দেহের সম্পর্ক হলেই ভালবাসা মুজবুত হবে। আমি ওর সঙ্গে সঙ্গম করেছি, যাতে ও কখনও বিশ্বাসঘাতকতা না করে। আমি ওর সঙ্গে সঙ্গম করেছি ওকে খুশি রাখার জন্য। মাঝে মাঝে নীরবের চোখ দুটো লাল থাকত। বুঝতাম ওর দুঃখ। একটু আনন্দ দেই। কিন্তু এখন কি হচ্ছে, আমার সঙ্গে যোগাযোগই প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে।
আমি একবার নই, বারবার নীরবের নিকট ধর্ষিত হয়েছি। ও বলত, প্রেমের শেষ স্টেজ সেক্স। আমিও তাই ভাবতাম। ও বলত, এটা কোন ভাবেই ধর্ষণ নয়। দুজনের মতেই তো হচ্ছে। কিন্তু আমার শরীরে অদৃশ্য কোন দাগ লেগে গিয়েছে ততদিনে।
অনেক দিন ধরেই এখন আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই, আগেই বলেছি। কিন্তু নীরব নামটা আমার মাথার ভিতর জোকের মত বাসা বেধে আছে।
সারা শরীরকে নিজের নিকটই ঘৃণা হয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকাতে লজ্জা লাগে। এতদিন ধরে একজন আমাকে ধর্ষণ করে গেল, ঘুনাক্ষরেও টের পেলাম না বলে এখন দুঃখ হয়। কিন্তু হায়, নীরবের ভিতর কোন মায়া-মমতা, ভালবাসা কিছুই ছিল না। ও শুধু দেহ ভোগ করত। সপ্তাহে কয়েকবার করেও আমার সঙ্গে বিছানায় গ্যাছে। সব সময় আমি প্রস্তুত থাকতাম না। কিন্তু ওর জন্য যেতে হয়েছে। আমি যে ওকে ভালবাসি।
গল্পটা আসলে ক্ষমতার। ক্ষমতা ছিল বলেই ও আমার সঙ্গে যা খুশি করতে পেরেছে। বোকা ছিলাম আমি। কিছুই বুঝতে পারি নি। যখন বুঝলাম, তখন নিজের কাছে নিজেকে ঘৃণার পাত্র ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছি না।
চারপাশে এত এত ধর্ষণের খবর দেখে দুঃখ হয়। হায়! ওরা তো মাত্র একবার ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর আমি। আমি হয়েছি বারবার। একই ব্যক্তির নিকট। তাও আবার স্বইচ্ছায়।
সময় বড়ই খারাপ। সবকিছুকে ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু শরীরের ক্ষত যে থেকেই যায়। এই ক্ষত কেউ ভুলিয়ে দিতে পারলে ভাল হোত। আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি কয়েকবার। কিন্তু পারি নি। ।ঐ যে সময় জিনিসটা বড় খারাপ বললাম। সময়ের জন্যই একদম ঘা ঝাড়া দিয়ে উঠেছি। সেই ক্ষত নিয়েই চেষ্টা করেছি, জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করবার। যুদ্ধে আমি হয়ত জিতেছি। তা না হলে এখন বেঁচে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
আমি পেরেছি। এবং জীবিত অবস্থায় বহালতবিয়াতেই আছি। আমার মত এমন হাজার হাজার ধর্ষিতা নারী বছরের পর বছর কষ্ট স্বীকার করে বেঁচে আছে। তাদের এতটুকু আশা জাগানোর কেউ নেই। আমারও কেউ ছিল না। কিন্তু নিজেকেই বলেছি, বাঁচতে হবে নীলা, বাঁচতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১৭ রাত ১০:৪৩