তেজগাঁও থানায় ধরে আনা হয়েছে যুবকটাকে। সে চুপ করে বসে আছে ছোট একটা চেয়ারে। তার সামনেই দুই জন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে বন্দুক হাতে । তাদের পাশেই একটি টেবিল। টেবিলের উপর এলোমেলো ভাবে অনেকগুলো খাতাপত্র পড়ে রয়েছে ।খাতাপত্র গুলো ইন্সপেক্টর গোছাচ্ছেন। সে কাজ সেরে উঠে দাড়ালেন। ঠিক তখনই গেট দিয়ে একজন আসামী ধরে আনা হল। আসামীটি কাঁদছে আর বলছে “স্যার গো ছাইড়্যা দ্যান”। এই বাক্য উচ্চারণের সাথে সাথে তার পাছায় সজোড়ে পুলিশি বেত দিয়ে কয়েক বাড়ি বসিয়ে দিয়ে কনস্টেবলটি বলল ‘‘শালা, চুরি করার সময় মনে ছিল না।” সাথে আরও কয়েক ঘা বসিয়ে দিল ,চোর ব্যাথায় ককিয়ে উঠল ।
যুবকটি এই সব দৃশ্য চুপচাপ লক্ষ্য করছে। হাসি চেপে রেখেছে। চোর পেটানোর সময় তার ভিতর থেকে কেন যেন হাসি বের হয়ে আসে। সে নিজেই বুঝতে পারে না। চোর শব্দটার সাথে সে বেশী পরিচিত না। তবুও তার মনে হয় চোর পেটালে বুদ্ধি বাড়ে। কারণ কথায় আছে চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, এই কথাটি অসঙ্গতি মনে হয় তার কাছে। চোর পালালে বুদ্ধি বেড়ে লাভ কি?
এই যে জমিদার পুত্র, শুনতে পাচ্ছো। এই যে..
যুবকটি চিন্তায় বাধা পেয়ে খানিকটা বোকা বোকা ভাব নিয়ে ইন্সপেক্টরের দিকে তাকাল। এই লোকটিকে তার একটুও পছন্দ হচ্ছে না। দাঁড়ানো কন্সটেবলরা অনেক স্মার্ট। গায়ের গন্ধটা কেমন যেন চোর চোর।
তা বাবাজি, রাস্তার মাঝ খানে পেসাব করছিলে কেন?
কি করব বলুন, অনেক চাপের ফলে। খানিকটা বোঝানোর চেষ্টা করল সে।
নাম কি তোমার? অ্যা..
জহির উদ্দিন
বাহ্ বাহ্ খুবই সুন্দর নাম। কিন্তু তোমার কাজের সাথে নামের কোন মিল নাই। মন্ত্রী মহোদয় তখন ঔ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন জানো এই কথা।
না। আমি তখন এই বইটি পড়ছিলাম তাই খেয়াল করিনি। ইন্সপেক্টরের সামনে শার্লক হোম'সের একটি বই মেলে ধরল সে। খানিকটা বিরক্ত হলেও প্রশ্ন করা চালিয়ে গেল।
তোমার বাবা কি করেন?
জ্বি, বলা নিষেধ।
ধমকের সুরে, মানে।
আমি আমার বাবার ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না। তাকে পছন্দ করি না।
কিন্তু তোমার গার্ডিয়ান না আসলে তো তোমাকে মুক্ত করা হবে না।
সে যা খুশি করুন। বাড়ি থাকার চেয়ে জেলে থাকাও অনেক ভাল।
ইন্সপেক্টর এবার সদয় হয়ে বললেন, তোমার মা কোথায় তাকে তো ডাকতে পারো।
জহির চোখ-মুখ একটু অন্যরকম ভাব নিয়ে বলল, সে নেই।
কোথায়?
আপনি কিন্তু বেশী প্রশ্ন করছেন। আমাকে জেলে দিলে দিয়ে দ্যান। এত প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না। আমার বইটি তাড়াতাড়ি পড়ে শেষ করতে হবে।
কনস্টেবল ও ইন্সপেক্টর পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা ঈশারা করল। জহির কিছু বুঝতে পারল না। ইন্সপেক্টর তখন নিজের চেয়ারে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে বলল, ঠিক আছে, তোমাকে জেলেই ঢুকিয়ে দিচ্ছি। কনস্টেবলকে চোখের ঈশারায় কিছু বোঝায়, সে তাকে হাত ধরে জেলের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়।
জহির উদ্দিন ঢুকে প্রথমে কিছু অবাক হয়। এত নীরব একটা জায়গা। সম্পূর্ণ খালি, না দুইজন আছেন, তারা শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। জেলের ভিতরই মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তির ঘুমটা হয়। জহির একটু ভেবে নিল, এই লোকগুলোর মত ঘুম দিবে কিনা। না, বইটা পড়ে শেষ করবে। যদিও তাদের ঘুম দেখে লোভ লাগছে। কিন্তু বইটাও তো শেষ করতে হবে।
শেষ পর্যন্ত ঘুমের নিকট বই পরাজিত হল। সে ফ্লোরে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় তার চোখে ঘুম আসছে না। শার্লক হোমস, তাকে টেনে তুলে বলল, তুমি আমাকে অবজ্ঞা করছ? এত বড় সাহস তোমার।
না, স্যার। আমার প্রচন্ড ঘুম পেয়েছে। তাই……
তোমার অনেক লোভ। ঘুমের লোভ, যা কখনই ভাল নয়। তোমার ভিতরে গোয়েন্দা বসবাস করে, আবার ঘুমও। এটা হতে পারে না।
স্যার, আমাকে ক্ষমা করুন। আমার চোখের ঘুমকে আমি বিসর্জন দিলাম, আপনার জন্য।
কেউ তাকে খোঁচা দিল। তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে দেখে দাঁড়ি-গোফ সমৃদ্ধ একজন বৃদ্ধ লোক। তাকে দেখে পোকে খাওয়া দাঁত বের করে হেসে উঠল। হো হো হো। হাসি থামতেই চায় না। সারা জেল-খানাই তার হাসির জন্য কেঁপে উঠছে। যার হাসিতে এত জোর তাকে কেউ জেলে বন্দী করে রাখতে পারে বলে মনে হয় না। কিন্তু …
তুমি, এখানে কি কর?
স্যার, আমি অপরাধ করেছি। তাই এখানে….
কি করেছিলে?
তেমন কিছু না, মন্ত্রীর গাড়ির সামনে প্রস্রাব করেছিলাম।
এটা কোন অপরাধ নয়। তুমি বাসায় যাও। তোমার মা, চিন্তা করছে।
না, এখানেই ভাল। আমার জন্য কেউ চিন্তা করবে না। কিন্তু আপনি এখানে?
আমি ইচ্ছে করেই এসেছি। ধ্যানের জন্য। দিব্য জ্ঞানের জন্য।
মানে।
তুমি বুঝবে না। এই কক্ষে যেই আসুক না কেন, তাকে আমি বিদায় করে দিই। তুমি যেতে চাইলে বল।
কিন্তু ঐ যে আরেকজন, উনি কে?
এই কথা শুনে, তিনি আরো জোরে হাসলেন। এবারের হাসিতে জহিরের হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগার হল।
উনি কে? জানতে চাইছো তো।
হ্যাঁ। ভয়ে ভয়ে বলল সে।
তাহলে তার সামনে গিয়ে দেখে আসো।
সে উঠে দাঁড়ায়। ধীর-পায়ে হেঁটে যায়, তার সামনে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে যায়। একবার ঘুমন্ত লোকটার মুখের দিকে তাকায়, একবার তাকায় তার সামনে বসা লোকটার দিকে। কি মিল দুইজনের! যেন জমজ ভাই।
আপনারা কি জমজ ভাই?
আবার সে হাসে। তার হাসি প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে চলতেই থাকে।
না, আমি আর সে একই ব্যক্তি। দিব্য জ্ঞানের সাহায্যে আমি অনেক কিছুই করতে পারি। যা অবিশ্বাস্য মনে হবে, তোমাদের নিকট।
হাত-পা কাঁপতে থাকে জহিরের। তার মুখবন্ধ হয়ে যায়। কিছুই বলার সাহস পায় না। তার মুখটার দিকে তাকাতে ভয় করে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ২:০৫