সিরাজ মিয়ার মনটা বেশ কিছুদিন ধরে ভাল নেই। কেন কে জানে! কম তো করলো না এ জীবনে। সাফল্যের চরম শিখরে পৌঁছানো যাকে বলে তকেও বুঝি অতিক্রম করে ফেলেছে এত অব্দি। কিন্তু তারপরেও কোথায় যেন হাহাকার। বুঝে উঠতে পারছেনা। ঘরের অশিক্ষিত গ্রাম্য সরল বৌটাকে বলে যে মনের বোঝা হালকা করবে সে উপায়ও নেই। গার্ল ফ্রেন্ডগুলো তো যা তা। চেহারা সুরত সিরাজ মিয়ার ভাল হলেও আশ পাশের মানুষগুলোকে যেন নিজের চেয়েও বেশি ভাল মনে হয়। আর তাই সারাক্ষণ একই ধান্দায় ব্যস্ত থাকে কিভাবে টেক্কা দেয়া যাবে প্রতিবেশীদের। গত বছর ব্রিজের কন্ট্রাক্ট পাওয়ার পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সিরাজকে। বস্তির ছোট্ট খুপরি থেকে বেরিয়ে ভদ্র সমাজে পদার্পণ করে নিজের সুন্দর চেহারা আর ধূর্ত বুদ্ধির জোরে নিজেকে ওই সমাজে মানিয়ে নিতে এতটুকুও অসুবিধা হয়নি তার। ইংরেজিটা যা একটু রপ্ত হল না আজ অব্দি। ওতে অসুবিধা কি। অফিসে চৌকষ ম্যানেজার রেখেছে না! সব কাজ তো স্মার্ট ম্যানেজার-ই সামলায়। ধূর্ত বুদ্ধির খেলাটুকুই যা নিজের একান্ত আপন। আর চাকচিক্য দেখাবার জন্য যে বল প্রয়োজন তা তো তার রয়েছেই। টাকা। অগাধ টাকা। এত টাকা খোদা যে কোন পূণ্য কর্মের জন্য তাকে দিয়েছেন ভেবেও স্থির করতে পারে না সিরাজ মিয়া। মনেও পড়ে না কখনো এই দিল তার কারো ভাল চেয়েছিল কিনা ।পরশ্রীকাতর না হলে কি উচ্চভিলাষী হওয়া যেত? আর এ সবটুকু গুনের সমাহারে আজ না তার কত প্রতিপত্তি। সমাজে উচ্চাসন। বেছে বেছে ঢাকা শহরের জৌলুসপূর্ণ এলাকায় বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে এক নিমেষে। চারপাশে যেখানে শুধুই মান্যগন্য লোকের বসবাস। তা সে আর কম কিসে। রাজপ্রাসাদের মতন আলীশান বাড়ি আর হাতি ঘোড়া থেকেও সুদৃশ্য লটবহর ওয়ালা গাড়ী। ঘরে পরীর মতন তিনটি ফুটফুটে কন্যা। ছেলে মেয়ের কোনই তফাত করে না আধুনিক কালের বাবা মা। তাই পুত্র সন্তান নেই বলে কোন আফসোস নেই তার। তবুও মাঝে মাঝে কোলের ছোটটাকে বুকে টেনে নিয়ে সিয়াজ মিয়া প্রায়ই বলে ফেলে ‘তুইই আমার ছাওয়াল।’ বাবার সুপ্ত আকাঙ্খা শিশুর কোমল মন ঠিকই বুঝতে পারে। বাবাকে ভীষণ ভালবাসে সে। তাই বাবার অপূর্ণ সাধ পূরণের জন্য সাথে সাথে বলে উঠে ঠিকই তো বাবা, আমিই তোমার ছেলে। ডানপিটে স্বভাবের সাথে আচরণের মিল থাকায় পাড়ার সবাই ভাবে সিরাজের ছোট মেয়েটা আসলেই তার আকাংখিত পুত্রের স্থানটি ভরে দিয়েছে। আহা রে সিরাজ! ছেলের বড় সখ। এত টাকা পয়সা বাড়ি, গাড়ি...কে খাবে। ছেলের মুখ দেখাল না তাকে বিধাতা। নাকি এমনই হয়, এই ই খোদার বিধান। সব দিয়ে একটু যেন ফাঁক রেখে দেয়া। সকল স্বপ্ন পূরণ হতে যেয়েও না হওয়া। তবুও সিরাজের উচ্চভিলাষের কমতি নেই।
গত বছরের শুরুর দিকে বানানো আলীশান প্রাসাদ আজ তার একেবারেই ভাল লাগছেনা। এত পয়সার তৌফিক খোদা তা’লা দান করেছেন যাকে তার কি ইট সিমেন্টের বাড়ি আর ভাল লাগে? এ প্রাসাদ সোনায় মুড়ালে কেমন হয়! যেই বলা সেই কাজ। বোমা মেরে পারলে তার প্রাচীন এই সুউচ্চ অট্টালিকাটি গুড়িয়ে দিতে মন চায়। কিন্তু না সেরকম করা যাবে বলে মনে হয়না। রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া বলে কথা।গড়ের মাঠ তো নয়।চারপাশে মানুষ জনের বসবাস। বোমা মেরে বাড়ি উড়ালে সিটি কাউন্সিল ঝামেলা করতে পারে।না বাবা। ওসবের মাঝে যেয়ে কাজ নেই।বরং সোনার প্রলেপের আস্তর লেপে দিলে রাজপ্রাসাদখানা নাহয় সোনার রাজপ্রাসাদে পরিণত হবে। বড় শান্তি পাবে এ মন।
পয়সার আধিক্য মানুষকে উন্মাদ করে তোলে। সিরাজের তা হয়নি। হলে তো ফার্মগেটের ওভার ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে দুহাতে উড়িয়ে দিতে পারতো কয়েক বস্তা টাকা। তা করবে কেন। উন্মাদ ও না। অন্ধও না। পয়সার মোহে সে উদ্ভ্রান্তও না। তাই তো সোনার প্রলেপ মাখানো টাইলস্ ফিট করে ফেলেছে সে আগাছে গোড়া আর চারতলা প্রাসাদে। ঘরের প্রবেশের মুখে রেখেছে স্বর্ণ নির্মিত সিংহ মূর্তি। ভিতরে বাহারি ঝর্ণা। তাতে স্নাত হয়ে আছে স্বর্ণ নির্মিত চিত্রা হরিণ। আসলে বেহেশত বেহেশত করে মানুষগুলো কি যে বোকামী করে ভেবেই বাঁকা হাসি হেসে ওঠে নিজের অজান্তে। বুদ্ধি থাকলে পূণ্য কর্ম করে বেহেশতে যেতে হয়না।বেহেশতকে নিজের ঘরে হাজির করা যায়। সিরাজ মিয়া তাই-ই করে এবার তাক লাগিয়ে দিয়েছে সবাইকে।
গৃহ আগমনীর অনুষ্ঠানে এসেছিল সেদিন শহরের সকল রাঘব বোয়াল।চোখ তো তাদের ছানা বড়া। সিরাজ মিয়ার রুচির প্রশংসা করতে করতে গলায় তাদের ঘা হবার জোগাড়।
‘আরে ভাই টাকা পয়সা তো সবারই আছে। কিন্তু রুচি আছে ক’জনার।’
স্তুতি বাক্যে সিরাজের মন যে খুব একটা ভরে গেল তা না। কিন্তু তার পাশের প্রতিবেশীদের স্তুতি শুনবার জন্য প্রানটা কেমন যেন আকুলি বিকুলি করে উঠলো। ওদের কাছে সিরাজের পাত্তা নেই বললেই চলে। প্রতিবেশীরা সমাজের তথাকথিত রাঘব বোয়াল যদিও না, কিন্তু সম্মানের দিক দিয়ে রাঘব বোয়ালরা পাশের ওই প্রতিবেশীর পায়ের ধূলারও যোগ্য যে না, সিরাজ তা ভালই জানে। তাই এ সকল রাঘব বোয়ালের কথায় কি মন ভরে? মন ভরে উঠত তাদের দিয়ে যাদের নাগাল সে কখনোই পায়না এবং পাবেও না বলে জানে। মনে মনেই তাই মন ভরানোর কাজটা সম্পাদন করে নেয় সিরাজ মিয়া। বহুবার সে কল্পনা করে পাশের বাড়ির ডাক্তার সাহেব এসেছেন তার কাছে। সিরাজ মিয়ার বড্ড ইচ্ছে তার সমানে সমান হতে পারা। নাহ্ কোথায় যেন পেরে ওঠে না। কি এমন আছে ঐ ডাক্তার সাহেবের যা ওর নেই। বিদ্যা। সে তো পয়সা ঢাললেই পাওয়া যায়।একখানা কেন দশখানা ডিগ্রির সার্টিফিকেট। জোগাড় করতে কতক্ষণ।এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাত যেন চমকে ঊঠে সে। কানের পাশে কে যেন ফিসফিস করে কথা বলে উঠলো মনে হয়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সিরাজ। কই, কেউ তো নেই। তাহলে কে কথা বলে উঠলো।সিরাজ চারিদিকে তাকায়।কোথাও কেউ নেই। কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে সে। ওর নাম ধরেই যেন কেউ একজন ডেকেছে তাকে। আবারো স্থির হয়ে মনকে শান্ত করে বুঝবার চেষ্টা করল। মনের ভুল হয়তো। ঠিক তখনই! সিরাজ পেছনে তাকায় ।বশীরুল দাঁড়িয়ে আছে ঠায়।তাকিয়ে আছে ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে। খুব তীক্ষ্ণ সে দৃষ্টি। সিরাজকে দেখছে চেয়ে। কিন্তু বশীরুল এলো কোথা থেকে? তাকে তো গত বছরের আগের বছর খুন করে নদীর ধারে পুঁতে রেখে এসেছিল সিরাজ নিজ হাতে। আজ পর্যন্ত বশীরুলের হদিস পাওয়া যায়নি বলে সিরাজ মিয়া সেদিনও ওদের বাড়ি যেয়ে কতনা দুঃখ প্রকাশ করে এসেছে। সেই বশীরুল ঠিক এখানে, এত কাছে। তার দুর্গসম প্রাচীর ঘেরা সোনার রাজপ্রাসাদের লৌহ দ্বার অতিক্রম করে একেবারে অন্দর মহলের খাস কামরায়! দাঁড়িয়ে আছে ঠাঁয় কিন্তু কিভাবে? সিরাজ উঠে দাঁড়ায়। অবাক, সন্ত্রস্ত, ভীত সিরাজ কেঁপে উঠা গলায় জিজ্ঞেস করে,
-বশীরুল না?
-হ্যা আমি বশীরুল।
-তুমি এখানে কিভাবে?
- এলাম তোকে দেখতে। মেরে পুঁতে আমাকে তো দিব্যি রেখে এলি ঐ নদীর ধারে। পোকা মাকড় আর বিচ্ছুর কামড়ে যে বেহাল অবস্থা আমার। তোর এই সোনার রাজপ্রাসাদে কেমন আছিস তা দেখতে এলাম রে। কিচ্ছু ভাল লাগে না বন্ধু। ঐ মাটির কব্বরে বহুত কষ্ট। খুব গরম। শক্ত মাটির চাপে জীবন অতিষ্ঠ। তুই এক কাজ কর । তোর কবরটা সোনা দিয়ে বাঁধাই করে রাখ আগেভাগে। কখন ডাক আসে বলা কি যায়?
-তার মানে?
-মানে আমার তো ডাক আসবার আগেই আমাকে ঐ পাড়ে পাঠিয়ে দিলি। তোকে এমন করবে কার সাধ্যি। তুই-ই তো করার মালিক। বেহেশত এনে পুরেছিস ঘরে তেমনি কবরটাকেও পুরে দে এবার।কবরটা বাঁধাই করে চারিদিকে ফোমের নরম আবরণ দিয়ে দিস। শুতে যাতে কষ্ট না হয়।ঐ বাঁধাই করা সোনার কবরে সাপ বিচ্ছু আর আসবে না? এই দুনিয়ায় শুধু আরাম করবি, পরের দুনিয়ার কথা ভাববি না?
সিরাজ কিছুটা অন্যমনস্ক হয়েই বলল,
-আমি কি মরে যাব নাকি?
বশীরুলের খুব ঠান্ডা কন্ঠস্বর সারা ঘরময় ঘুরপাখ খাচ্ছে অনবরত। খুব নরম স্বরে বলল,
-মরবি কেন বন্ধু? নিজের বাঁধাই করা কবরও তো দেখতে সুখ।সে সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবি কেন? বাড়ী করেছিস, গাড়ি করেছিস, নিজের কবর করবি না?
সিরাজ বুঝতে পারে না কিছুই। বলে ফেলে,
-কবর কি কেউ করে নাকি?
বশীরুলের সেই এককথা আবারো ঘরময় ঘুরপাক খায়। বশীরুল বলে,
-তুই না হয় কবর করেই কবরে যাবি। আমার বড় কষ্ট হয় রে অমন ভাবে থাকতে। বড্ড গরম। পারলে না হয় একটা এয়ারকণ্ডিশানও ফিট করে নিস।পাশে আরো কয়েকটা ঘর বানিয়ে নিস যেন পরে তোর পরিবারেরও কষ্ট না হয়। এ দুনিয়া ঐ দুনিয়া সব দুনিয়ার কথাই তো ভাবতে হবে।কেউ কেউ ভেবে জায়গা কিনে রাখে। তুই না হয়...
সিরাজ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে, থাক ওসব। ফাজলামো করিস না। কিন্তু বশীরুল যে আজ বলতে এসেছে। ও থামবে কেন। বন্ধুত্বের আড়ালে স্বার্থপর সিরাজের প্রতিশোধ নিতে সে পারবে না। কিন্তু আক্ষেপ , যন্ত্রণা আর কষ্ট কোথাও যে রাখবার জায়গা পায় না সে। তাই সে বলে চলে। একটি নয় দুটি নয় অনেক অনেক কথা। লোভে উন্মত্ত সিরাজের নৈতিক অধপতনের কথা। খুব ধীরে, খুব সহজে।
-ফাজলামো না বন্ধু। খুন করেছিস আমাকে তো কি হয়েছে। আজও আমি তোর প্রকৃত বন্ধু। তাই তোকে পরামর্শটা দিতে এলাম।তোকে দেখতেও মন চাইলো।আমার বদলে ব্রিজের কন্ট্রাক্ট টা তুই-ই না হয় পেয়েছিস। তুই না হলে আমি পেতাম।টাকার বন্যায় উন্মাদ হয়ে মানুষ যে অহংকারে গা ভাসায় তার উদাহরণ আজ আমি নই, তুই। টাকা মানুষকে অন্ধ করে। আমায়ও হয়তোবা করতো। কিন্তু সে তো পাবার পরে। তুই তো আগেই হয়েছিলিস। তাই নদীর ধারে বেড়াবার নাম করে আমাকে নিয়ে বধ করতে তোর একটুও হাত কাঁপেনি। তুই উন্মত্ত ছিলিস ওটা হাতে আসবার আগেই। আর এখন, টাকা আসবার পর? তুই হয়েছিস রুচিবান, অ্যারিস্টোক্র্যাট।
পিনপতন নিস্তব্ধতায় হারিয়ে যায় বশীরুলের কন্ঠস্বর। সিরাজ যেন আজ নিজেকে আর চিনতে পারছে না।