মাঝরাতে হঠাৎ বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ল লালবানু; গভীর রাত্রি এবং ঘুমের নিস্তব্ধতা ভেদ করে কিসের যেন গুঞ্জন! প্রথম ভেবেছিল পুলিশ হবে হয়তো, প্রায়ই ওদের পুলিশের আক্রোশের শিকার হতে হয়! কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে ঘুমজড়ানো চেখে দেখতে পেল অসংখ্য সেনাসদস্য এবং পুলিশ ও র্যাব ছড়িয়ে আছে রাস্তায়! তাদের একেকটি গাড়ি বিকট শব্দে হুইসেল বাজিয়ে আসছে-যাচ্ছে। আর কোনো মানুষজনের দেখা নেই, সে-এক ভয়ানক রাত! অজানা আতঙ্কে মোচড় দিয়ে ওঠে বুকের ভেতরটা!
অবশ্য ক’দিন ধরেই লালবানু লক্ষ করছিল প্রতিদিন একটার পর একটা মিছিল-মিটিং লেগেই আছে; লগি, বৈঠা এবং কাস্তে নিয়ে দু’পক্ষের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। মানুষের মৌলিক চাহিদা বা প্রতিদিনকার রুটিন খাওয়া-দাওয়ার মত এ-ও যেন এক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আজকে এই যে রাত, এরকম সে আর কোনোদিন দেখে নি; উদ্বিগ্ন চোখে ঘুমিয়ে থাকা ছেলেটির দিকে তাকায়, এই ছেলেটিকে ঘিরেই তার জীবন—যত আশা, যত স্বপ্ন আর ভালোবাসা, তার ভালোবাসার চিহ্ন।
ফুটপাথের দেয়াল ঘেঁষে ওরা ঘুমোচ্ছিল; এখানে থাকার মত কোনোরকম একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছে লালবানু। একসময় কল্যাণপুর বস্তিতে থাকত, ক’বছর হলো সরকার উচ্ছেদ করে দিয়েছে, তারপর থেকে এই অস্থায়ী এবং অনিশ্চিত নিবাস; আজ এখান থেকে কেউ উঠিয়ে দেয় তো কাল ওখান থেকে। ওরা যে কোথায় যাবে কেউ-ই বুঝতে চায় না; পুলিশও উঠিয়ে দেয়, অনেক কাকুতি-মিনতি করার পর কারও একটু দয়া কিংবা করুণা হলো, তো আবার পরের দিন অন্য পুলিশ এসে তাড়িয়ে দেয়।
হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে লালবানুর সারা শরীর কেঁপে উঠে; সাবধানতার সঙ্গে, ছেলেটি যাতে আবার উঠে না পড়ে, ধীরে-ধীরে কাঁথা-বালিশ দেয়ালের আরও কাছে গুটিয়ে নেয়। দেয়লে পিঠ ঠেকিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে; অনেকটা ‘দ’ এর মতো হয়ে—যতটা সম্ভব ছোট হওয়া যায়—কেউ যেন দেখতে না পায়।
না জানি কী হয়—ভীতু এবং চোরাচোখে চারদিকে তীক্ষè নজর রাখে লালবানু, চোখের দৃষ্টি যতদূর যায়। একটু দূরেই ডাস্টবিনের পাশে একটি কুকুর ঘুরঘুর করছে। অন্য আর যারা এখানে খাকে, আজ কেন জানি কেউ নেই!
লালবানুর আতঙ্কগ্রস্ত চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময়—কুকুরটার চেয়েও কী অসহায়, কী দুর্গতির ভাগিদার ওরা; বুকের গভীরতম তলদেশ থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আল্লার উপর বড় রাগ হয়—যা খুশি সে তা-ই করতেছে ওদের নিয়ে! তার তো খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা করতে হয় না, মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই পেতে পুলিশের ডাণ্ডার বাড়ি খেতে হয় না।
ওদের সামনে পুলিশের একটি গাড়ি থামে; কয়েকজন পুলিশ নামে, নেমে ওদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। লালবানু কী করবে কিছুই বুঝতে পারে না, আল্লাকে স্মরণ করে, সবকিছু ছেড়ে দেয় সে মহান আল্লাতালার ওপর। আসন্ন এ-বিপদ থেকে বাঁচতে নানাভাবে সে আল্লাকে খুশি করতে থাকে—পরিবাগ মাজারে দুই টাকা মানত করে, এবং মনে মনে আরও ঠিক করে যে, কোনোদিন আর নামাজ ফাঁকি দেবে না; ঠিকঠাক পাঁচ ওয়াক্ত পড়বে।
দুই টাকার বিষয়টা তাকে ঠিক সায় দিচ্ছে না, মনের মধ্যে কেমন একটা উসখুস ভাব—দুই টাকা আবার কম হয়ে গেল নাকি! আবার মনে হয়—না, আল্লার কাছে দুই টাকা যা, একশো টাকাও তা। আসল কথা হলো অন্তর থেকে বলা; সে কি অন্তর থেকে বলেছে? না ভয়ে? অন্তর থেকেই বলেছে—তা-ই মনে হয় লালবানুর।
ভয়ানক চটে গেল পুলিশ অফিসার, তিক্তস্বরে বলল, ‘ওদেরকে কেন ধরে নিয়ে আসছো? সবকিছু বলে দিতে হয়! এটা তো কমন সেন্সের ব্যাপার, নাকি?’
হতভম্ব হয়ে গেল ওদের ধরে নিয়ে যাওয়া পুলিশটি, কিছুই সে বুঝতে পারল না; দ্বিধাগ্রস্ত চোখেমুখে নির্বোধের মত হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকালো, মুখ থেকে কোনো কথা বেরুলো না।
দু’চোখে যতদূর সম্ভব করুণ-ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লালবানু; পুলিশ অফিসারের যদি একটু দয়া কিংবা করুণা হয়!
‘ওদেরকে গলির ভেতরে নিরাপদ একটা জায়গায় রেখে আসো,’ গায়ে না- লাগানো ভঙ্গিতে বলে, লালবানুর দিকে বিরক্তভাবে তাকালো পুলিশ অফিসার, ‘তোমাদের যেখানে রেখে আসবে ঠিক সেখানেই থাকবে, উঠবে না, হ্যাঁ? যাও!’
মাথা হেলিয়ে সায় দিল লালবানু।
লালবানুর চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ল প্রশান্তি আর ভরসার ছাপ। পুলিশটির পেছনে পেছনে, বাচ্চা ছেলেটিকে কোলে নিয়ে গাড়িতে উঠল সে। পুলিশ অফিসারের জন্য মমতায়, তার মঙ্গল কামনায় বুক ভরে ওঠে; কী মহানুভবতা! কৃতজ্ঞতায় লালবানুর চোখে পানি চলে এলো।
পুলিশটির মন কেমন আবছা হয়ে আসছে; কিছুতেই সে হিসেব মেলাতে পারছে না, তাদেরকে তো এরকমই অর্ডার দেওয়া হয়েছিল : রাত ১১টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ, কেউ বাইরে থাকতে পারবে না। তো! এছাড়া সে আর কী করতে পারতো? এটাই কি তার করণীয় ছিল না! নিয়মমাফিক সে তো কেবল অর্ডারটি পালন করেছে। অর্ডারটি মনে করতে থাকে সে... হ্যাঁ, সব ঠিকই তো আছে, তাহলে? তাহলে ভুলটা কোথায়! দ্বিধাদ্বন্দ্বের গোলোকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে থাকে তার মনোজগৎ! তাহলে কি ওরা মানুষ না! দেখতে তো অবিকল মানুষের মতই। কীভাবে ঠিক ঠিক বলা যায় যে ওরা মানুষ কিনা! মানুষ হতে হলে কী কী যোগ্যতা ও গুন থাকা উচিৎ এবং কী কী থাকতে নেই? মানুষের সংজ্ঞা কী? সে কি জানে! যেমন সে জানে, পাঠ্যবইয়ে পড়েছে প্রাণীর সংজ্ঞা—প্রাণ থাকলেই প্রাণী; সে-হিসেবে ওরা প্রাণী। কিন্তু মানুষ কিনা তা কীভাবে বলা যেতে পারে! কে জানে ওরা মানুষ কিনা! হয়তো মানুষ, হয়তো মানুষ নয়; না, নিশ্চয়ই ওরা মানুষের পর্যায়ে পড়ে না; স্যার ঠিকই জেনে থাকবে, সে যদি স্যারের মত অফিসার হতো তাহলে সে-ও হয়তো বুঝতো মানুষ আর অমানুষের পার্থক্য।
পুলিশ অফিসারের দেয়া আশ্বাসে পুরোপুরি স্থির হতে পারছে না লালবানু; আকাশ-পাতাল ভাবনাচিন্তায় উতলা হয়ে উঠছে মন—পুলিশটি তাকে ঠিক কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! পুলিশ অফিসারের প্রতিও সন্দেহের একটু আভাস উঁকি দিচ্ছে মাথায়; সে আবার হঠাৎ এত দরদ দেখাল কেন? ওরা যে কী! ওদেরকে তো হাড়ে-হাড়ে জানা আছে। এই পুলিশটির আবার কোনো মতলব নেই তো! কোনো কুমতলব? ওরা ধরেই-বা নিয়ে গেল কেন? আবার ছেড়েই-বা দিল কেন? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না! আজ রাতের এমন অবস্থাই-বা কেন? ছেলেটি হঠাৎ নড়ে উঠলে, কিছুটা ঘাবড়ে যায় লালবানু—ঘুম ভেঙে গেলে আবার কান্নাকাটি শুরু না-করলে হয়!
না, শেষমেশ যদিও তেমন কিছু হয় নি, এবং নতুন করে আবার পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পেলেও (ওরা যেখানে ছিল, সেখান থেকে ওদের কাঁথা-বালিশ আর দু-চারটা হাঁড়ি-পাতিল যা ছিল, পুলিশ সব গাড়িতে করে ওদেরকে ভেতরের দিকে একটি গলির ভেতরে রেখে গেছে।) স্থির হতে পারছে না লালবানু—কবে যে পুনর্বাসন হবে! ওদের যে পুনর্বাসনের কথা ছিল তার আর নামগন্ধ নেই! মনে পড়ে ছেলেটির বাবার কথা, নদী ভাঙ্গনে সর্বস হরানোর কথা... রাজ্যের ভাবনাচিন্তায় আর ঘুম আসছে না, কতকিছু যে ভনভন করে মাথার ভেতর!
ভাবতে ভাবতে বুকভাঙা চাপা কান্নায় ভিজে আসা দু’চোখ ঘুমে ঢুলে পড়ছে; যাপিত-জীবনের সমস্ত অন্ধকার ছাপিয়ে অসহায় সে-চোখে ভেসে ওঠে একটি ফলবতি গাছ। ফলের ভারে, গাছটি মনে হচ্ছে যে এখনই ভেঙে পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু পড়ছে পড়ছে করেও শেষমেশ পড়ছে না—অবাক হয় লালবানু! পরক্ষণে আবার মনে হয়, কেন পড়ে যাবে? এ-তো যেনতেন গাছ নয়, বেহেস্তের গাছ বলে কথা; এক উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে দু’চোখ। বুকের ভেতর একটু একটু করে জমাট বাঁধা এতদিনের চাপা কষ্টগুলো মিলিয়ে যেতে থাকে সেই আলোয়। হঠাৎ কান্নার শব্দ—প্রচণ্ড এক ঝাপটায় গাছটি পড়ে যায় ছেলেটির গায়ের উপর, কেঁদে ওঠে ছেলেটি। হাউমাউ করে উঠে বসে লালবানু। যাহ! এমন স্বপ্ন কেউ দেখে!
ছেলেটি কাঁদছে, হাত-পা ছুড়ে কাঁদছে ছেলেটি। কাঁদুক, ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে আছে লালবানু—ওকে নিজের মত করে, নতুনভাবে বাঁচতে শিখতে হবে। কেঁদেই চলে ছেলেটি। লালবানু তাকিয়ে আছে বিপরিত দিকের দেয়ালে একটি পোস্টারের দিকে। পোস্টারটির উপর দিকে এক কোনায় একটি সূর্য আঁকা আর নিচে দেখতে ঝাপসা এমন অসংখ্য মানুষ, উপরে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত তুলে সূর্যের দিকে এগিয়ে চলছে, একেবারে নিচে লেখা ‘নতুন সূর্যের সন্ধানে’। এবার লালবানু ফিরে তাকায় ছেলেটির দিকে, তাকিয়ে থাকে, দেখে, আর কোনোদিন বুঝি দেখে নি সে তার ছেলেটিকে। কখন যেন ওর তাবিজটি ছিঁড়ে পড়ে আছে, একদিন কিসে যেন ভয় পাওয়ায়, পরিবাগ মাজার থেকে একটি তাবিজ এনে ওর গলায় পরান হয়, ভেতরে আল্লার কালাম ভরা। লালবানু সেটি তাগা থেকে খুলে ছুড়ে ফেলে দেয় আর তাগাটুকু রেখে দেয় বালিশের নিচে—কত সময় কত বাঁধাছাঁদার কাজে লাগে।
[এই গল্পটি আমার ব্লগিং এর একেবারে প্রথম দিকে দেয়া হয়েছিলো। প্রথম দিকের অনেক পোষ্ট মুছে ফেলায়, এটিও মুছে ফেলা হয়। এখন যারা আমার ব্লগে আসছেন তাদের অনেকেই সে-সময় এই গল্পটি দেখেন নি, তাই আবার দিলাম।]