দিবসটি কিন্তু বাংলা ভাষা দিবস নয়, মাতৃভাষা দিবস। মায়ের ভাষা তথা নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকারের প্রতি সম্মান ও সমর্থন প্রদানের দিবস। সালাম বরকত রফিক জব্বার বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন বললে তাদেরকে ছোট করা হবে, বরং বাংলা হোক, ইংরেজী হোক, হিন্দী কি মারাঠী অথবা হোক তা উর্দু- তারা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের স্ব স্ব ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ে জীবন দিয়েছেন। সুতরাং বাংলার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে আমরা কেউ অন্য ভাষার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করিনা। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট্ট শিশুটি হিন্দীতে মনের ভাব প্রকাশ করুক, এটাই আমাদের কামনা। আবার পাকিস্তানের লাহোরের স্কুল বালকটি উর্দুতেই মনের ভাব প্রকাশ করুক, আজকের দিবসে আমাদের এটিই চাওয়া। নিজ জাতির কল্যাণই আমদের একমাত্র চাওয়া নয়, একই সাথে পৃথিবীর প্রতিটি মানব ও প্রতিটি জাতির কল্যাণই আমাদের প্রত্যাশা। সেজন্যই, 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'- নামকরণটি যথার্থই হয়েছে।
উপরের কথাগুলো সকলেই জানেন, আমি শুধু স্মরণ করেছি মাত্র। আমরা নিজের কল্যাণ ও মর্যাদার আলোচনা করতে করতে অনেক সময় অন্যের প্রতি অজান্তেই বিদ্বেষাক্রান্ত হয়ে পড়ি। তা থেকে সাবধান থাকতেই এ স্মরণ করা।
শুধুই কি মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার? না। মোটেই না। প্রতিটি অধিকার আদায়ে সংগ্রামী হওয়ার আহ্বান আজকের এই দিবসে। প্রতিটি অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে উৎসাহিত করার জন্যই আজকের এই দিবস।
বলাই বাহুল্য, আমার সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন আমার অধিকার। আকাশ ও পৃথিবীর মালিক মানুষের জন্য যে জীবন বিধান দিয়েছেন সে অনুযায়ী চলতে চাওয়া আমার জন্য দোষের নয়, বরং অধিকার। আমার সে অধিকারে কোন ব্যাক্তি বা গোষ্ঠি বাধা হয়ে দাঁড়ালে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা জোগায় আজকের এ দিবস। বিশাল আকাশ যিনি সৃষ্টি করেছেন, কোটি কোটি নক্ষত্র যার সৃষ্টি, তেজস্বি মার্তণ্ড যার কথায় আলোক ছড়ায়, আমাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, প্রতি মুহূর্তে পালন করছেন, বাঁচিয়ে রেখেছেন- তার বিধানের প্রতি আত্মসমর্পন করতে উদ্বুদ্ধ করে আজকের এই দিবস। কেননা তা মানুষের অধিকার ও দায়িত্ব। আর কায়েমী স্বার্থবাদীরা যারা স্রষ্টার বিধান পালনে ও প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাদেরকে বোঝানো এবং প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার প্রেরণা যোগায় সালাম বরকত রফিক আর জব্বারের রক্তফোঁটাগুলো। এই ভুখন্ডের মানুষগুলোর এই শাশ্বত অধিকার আদায়ে অগ্রগামী হতে ৫২র ভাষা সৈনিকেরা সবসময়ই প্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে।
বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে উপন্যাস, গল্প, নাটক- আরো কত কি। একই সাথে মহান প্রভুর অমোঘ বাণী আল কুরআণের অনুবাদ ও ব্যাখ্যাকে যারা ঘাম ও শ্রমের বিনিময়ে বাংলায় উপস্থাপন করেছেন, নিসন্দেহে তারাও বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছেন। আজও যারা নিরবে নিরলসভাবে বিশ্বপ্রভুর দেয়া কল্যাণময় জীবন ব্যবস্থাকে বাংলা ভাষাভাষিদের জন্য সহজ করে দিচ্ছেন একের পর এক গ্রন্থ লিখে কি অনুবাদ করে- তারা বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং করেছেন সম্মানিত, কোন সন্দেহ নেই। যেহেতু তাদের কাজের স্বীকৃতি দেয়ার লোকের সংখ্যা যথেষ্ঠ কম, তাই এই পোস্টের মাধ্যমে তাদের প্রতি বিশেষভাবে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করছি। জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় যারা অবদান রাখছেন, তাদের স্বীকৃতি তো সকলেই দিচ্ছেন, আমরাও আবার দিচ্ছি।
সত্যি কথা বলতে, বাংলাদেশের মানুষ মাতৃভাষায় মনের ভাব প্রকাশের পূর্ণ অধিকার আজো ফিরে পায়নি। আদালতে বিচার চাইতে, ব্যাংকে কাজ করতে, অথবা একটি চাকরি পেতে মাতৃভাষা এদেশের মানুষের খুব বেশি কাজে লাগেনা। বহুবিধ যোগ্যতা থাকা সত্বেও ইংরেজীতে একটু দূর্বলতায় আটকে থাকতে হয় গ্রামগঞ্জের অসংখ্য সরল সহজ মানুষকে। তারা না পায় ইংরেজীর যথার্থ শিক্ষা, না পায় বাংলার যথার্থ মূল্যায়ন। এ পরিস্থিতির সত্ত্বর অপোনোদন আমাদের সকলের কাম্য।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১১:৪৬