বাংলাদেশের অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোর তুলনায় ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা নির্বাচন প্রক্রিয়াটি একটু ভিন্ন। এর কর্মী গঠন প্রক্রিয়ায়ও রয়েছে লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এখানে সে আলোচনা কেন? কারণ সচেতন নাগরিক মাত্রই দেশের ছাত্র কি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর কর্মপ্রক্রিয়া সম্পর্কে জানার অধিকার তার আছে। এবং অধিকার ও দায়িত্ব রয়েছে সংগঠনগুলোর কার্যক্রমকে সহযোগীতা করার, পরামর্শ দেয়ার, ও কর্মপ্রক্রিয়া নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করার। আসছে ১৮ই জানুয়ারী ইসলামী ছাত্রশিবিরের বার্ষিক কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলন। সুতরাং পরামর্শ দেবার ও গঠনমূলক সমালোচনা করার সম্ভবত এটিই উপযুক্ত সময়।
নেতা নির্বাচনঃ
নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে ছাত্রশিবিরের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে কোন প্রার্থী থাকেনা। কেউ পদ প্রার্থনা করলে তাকে ঐ পদের জন্য সবচেয়ে অনুপযুক্ত বিবেচনা করা হয়। সকলেই ভোটার সকলেই প্রার্থী। কারো পক্ষে প্রচারণা চালানোর অনুমতি নেই, কারো পক্ষে গ্রুপিং করারও অনুমতি নেই। তবে ভোট দেবার ক্ষেত্রে চাইলে কেউ অন্যের পরামর্শ নিতে পারে। বাংলাদেশে এমন সিস্টেম কিছুটা অদ্ভুত মনে হলেও এর দারূণ কিছু সুফল রয়েছে। সচেতন নাগরিক মাত্রই জানেন, নেতৃত্ব নিয়ে এই সংগঠনে দেশের কোন প্রান্তে কোন কোন্দল নেই। রহস্যটা এখানেই। নেতৃত্বকে কোন উপভোগের বিষয় মনে করা হয়না, মনে করা হয় নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব, জবাবদিহীতা। কেন্দ্রীয় সভাপতি থেকে শুরু করে সংগঠনের যেখানেই নির্বাচন সেখানেই পদ্ধতি এই একই। অন্যদিকে ভোটকে একটি আমানত মনে করা হয়, ভোটারকে এই অনুভূতি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয় যে তার ভোটটি একটি আমানত এবং তা প্রয়োগ করতে হবে যথা জায়গায়। ভোট দানের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখার পরামর্শ দেয়া হয়। এমন ব্যাক্তিকে ভোট দেয়ার জন্য বলা হয় যার মধ্যে রয়েছে আল্লাহ ও রাসূল সা. এর প্রতি আনুগত্য, তাক্বওয়া, আদর্শের সঠিক জ্ঞানের পরিসর, সাংগঠনিক প্রজ্ঞা, শৃঙ্খলাবিধানের যোগ্যতা, মানসিক ভারসাম্য, উদ্ভাবনী ও বিশ্লেষণী শক্তি, কর্মের দৃঢ়তা, অনঢ় মনোবল, আমানতদারী, এবং পদের প্রতি লোভহীনতা। একজনের মধ্যে এ সবগু্লো গুণের সমাহার খুব বিরল ঘটনা, সুতরাং পর্যায়ানুক্রমিক এ গুণগুলোর সর্বোচ্চ সমাবেশ যার মধ্যে রয়েছে, তাকেই ভোট দেয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। ছাত্রশিবির চায় দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিটগুলোর ছাত্রদের মধ্যে এভাবে জীবনের শুরুতেই একদিকে নিজেদের নেতৃত্ব বাছাই করার অভ্যাস গড়ে উঠুক, অন্যদিকে নিজেদের মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিটিকে নেতা বানানোর মানসিকতা গড়ে উঠুক। ছাত্রশিবির আশা করে এই ছাত্ররা ভবিষ্যতে সমাজের বিভিন্ন স্তরে নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাকে যখন কাজে লাগাতে সক্ষম হবে, তখনই সমাজ গঠনে তাদের অংশগ্রহণ স্বীকৃতি পাবে। বাংলাদেশে আজ নেতৃত্বের চরম সংকট, এ দেশে যেমন রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ, তেমনি রয়েছে মানব সম্পদ। অভাব শুধু নেতৃত্বের। সে অভাব পূরণে ছাত্রশিবির ভুমিকা রাখতে চায়। অন্যান্য ছাত্রসংগঠনগুলো নিয়মিত কাউন্সিল অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হওয়ায় ও নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দলের কারণে না রুট লেভেল থেকে নেতৃত্ব তুলে আনতে পারছে আর না নিজেদের নেতৃত্বে যোগ্য ব্যক্তিকে বসাতে পারছে। ফলে রাজনীতি নেতৃত্বশুন্য হয়ে পড়ছে। এ সংকট মোকাবেলায় ছাত্রশিবির প্রতিবছর নিজেদের নেতৃত্ব পরিবর্তনের মাধ্যমে তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব তুলে আনছে এবং সুন্দর সিস্টেম গড়ে তুলে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিটিকে নেতৃত্বে আসার সুযোগ করে দিচ্ছে। সচেতন নাগরিকদের নিকট থেকে পরামর্শ গঠনমূলক সমালো্চনা আসতে পারে, ছাত্রশিবির তার নেতৃত্ব নির্ধারণে আর কি পন্থা গ্রহণ করতে পারে এবং বর্তমান পন্থায় কি সংশোধন করা প্রয়োজন।
কর্মী গঠন ও মানোন্নয়নঃ
একজন ছাত্র নিয়মিত ব্যক্তিগত রিপোর্ট সংরক্ষণ, দাওয়াতী কাজ করা, বৈঠকাদিতে উপস্থিত থাকা এবং সংগঠনে নিয়মিত অর্থ দান করার শর্তে ছাত্রশিবিরের কর্মী হিসেবে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। আর কর্মী হলে তাকে আরো চারটি কাজ করতে হয়- কুরআন ও হাদিস নিয়মিত বুঝে অধ্যয়ন করা, নিয়মিত ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন, ইসলামের প্রাথমিক দায়িত্বসমূহ পালন ও সংগঠন কতৃক তার উপর অর্পিত দায়িত্বসমূহ পালন করা। একজন সাধারণ ছাত্র যে হয়তো কোন একটি দিকে ভাল, অন্যদিকে শুন্য, ছাত্রশিবির তাকে কর্মী ছকে বন্দী করে একটি ন্যূনতম ভারসম্যপূর্ণ জীবন গঠনে উৎসাহিত করে।
এভাবে কিছুদিন চলার পর সে যদি সানন্দে অভ্যস্ত হয়, তাকে সাথী মানে উন্নীত করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। সাথী করার পূর্বে তার কয়েকটি জিনিস পর্যবেক্ষণ করা হয়। তার জ্ঞানগত দিক, আমলগত দিক, এবং সাংগঠনিক দিক। জ্ঞানগত দিক উন্নয়নে দিক নির্দেশনা হিসেবে তাকে একটি সিলেবাস প্রদান করা হয়। সিলেবাসটিই সব নয় বরং এটি হচ্ছে ন্যুনতম মান, এর বাহিরে সে ইচ্ছেমত পড়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারে, এবং সে জন্য উৎসাহও দেয়া হয়। আমলগত দিক যাচাই করতে তার নিকটতম কর্মী ভাইদের নিকট খোঁজ নেয়া হয়। এ বিষয়গুলো সন্তোষজনক বিবেচিত হলে তাকে সাথী হিসেবে শপথ গ্রহণ করতে হয়। বলাই বাহুল্য যে আনুষ্ঠানিক শপথের একটি অন্যরকম প্রভাব রয়েছে মানুষের উপর। এজন্যই সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত এর চল রয়েছে সর্বত্র। আফ্রিকার জঙ্গলের উপজাতীয় অনুষ্ঠানাদি থেকে শুরু করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিয়োগ- সর্বত্রই আজো শপথ অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। তবে ছাত্রশিবিরের মডেল হচ্ছে রসূল সা. এর শপথ অনুষ্ঠান। একজন সাধারণ কর্মীর তুলনায় একজন শপথের কর্মীর আন্তরিকতা যেমন বেশি থাকে তেমনি তার উপর নির্ভর করা যায় সহজেই। এক্ষেত্রে শপথের কর্মীর সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে সদস্য শপথ। সদস্যরা হচ্ছেন ছাত্রশিবিরের স্তম্ভস্বরূপ। তাদের ক্ষেত্রে কয়েকটি মৌলিক বিষয় লক্ষ্য রাখা হয়, তার কুরআন তিলাওয়াত সহীহ কিনা, নামাজ কাজ্বা হয় কিনা- এ ক্ষেত্রে মানদণ্ড ধরা হয় ছয় মাসে নামাজ ক্বাজা না থাকা। এছাড়াও কুরআনের একটি বড় অংশের তাফসির অধ্যয়ন, একটি ন্যুনতম পরিমাণ আয়াত মুখস্ত, জীবন ও জগতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার যোগ্যতা- ইত্যাদি যাচাই করে তার জ্ঞানগত মান সম্পর্কে ধারণা নেয়া হয়। আমলগত দিকে বিবেচনা করে তার লেনদেনের পরিচ্ছন্নতা, মানুষের সাথে তার আচরণ, ইত্যাদি সম্পর্কে খোঁজ নেয়া হয়। তাকে একাধারে কয়েকমাস ব্যাক্তিগত ডায়েরী সংরক্ষণ করতে হয় যার মাধ্যমে সে ২৪ ঘন্টা পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে অভ্যস্ত হতে পারে, সময় নষ্ট কমিয়ে আনতে পারে। এভাবে হলে তাকে সদস্য হিসেবে শপথ দেয়া হয়। সদস্য শপথে সে ঘোষণা করে সে সমস্ত ব্যাপারে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাধারা এবং কার্যক্রমকে কুরআন ও সুন্নাহর সাঁচে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করবে, জ্ঞান অর্জন করতে এবং শারিরীক ও মানসিক যোগ্যতার বিকাশ সাধনে চেষ্টা চালিয়ে যাবে, ইত্যাদি।
ছাত্রশিবির দেশের ছাত্রসমাজের একটি অংশকে এভাবে নিয়মতাণ্ত্রিকভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে। শ্লোগান দিয়ে হয়তো অনেক ছাত্রকে জড় করা যায় সহজেই, কিন্তু গঠনমূলক কাজ করতে হলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে দীর্ঘমেয়াদে ছাত্রদেরকে প্রশিক্ষিত করার কোন বিকল্প নেই। সে কাজটিই করার চেষ্টা করছে ছাত্রশিবির। তবে গণনার পরিমাণে মোটা অংকের একটি ছাত্রসমাজ ছাত্রশিবিরের সাথে থাকলেও বাংলাদেশের মোট ছাত্র সমাজের তুলনায় খুব কম সংখ্যক ছাত্রই ছাত্রশিবিরের এ কর্মীগঠন ও মানোন্নয়ন প্রক্রিয়ার আওতাভুক্ত। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি ছাত্রসংগঠনই যদি ছাত্রদেরকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে, তবেই ছাত্রসমাজ সহসাই এদেশের জন্য সম্পদে পরিণত হবে , আর বিশ্বের জন্য হবে আশীর্বাদ স্বরূপ। ছাত্রশিবির তার নিজস্ব পরিসরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সচেতন নাগরিকবৃন্দ তাদের সুচিন্তিত পরামর্শ, উপদেশ ও গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে নেতৃত্ব তৈরী ও মানোন্নয়নে ছাত্রশিবিরকে সহযোগীতা করতে পারেন, যা প্রকারান্তরে দেশ গঠনে সহযোগীতারই একটি অংশ। আসছে ১৮ই জানুয়ারী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলনে ছাত্রসামজের কল্যাণে আরো কার্যকরী কি ঘোষণা আসে, জনগণের প্রত্যাশা পূরণে আরো সুনির্দিষ্ট কি কর্মসূচি আসে, তাই এখন দেখার বিষয়।