somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প ★কাগজের ঢিল★

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



লেখাঃ-এইচ.এম আলমগীর
"""""""'''''''''''''''''''''''''
মাথার চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে । সেব করা দাড়ির গুড়া দিয়ে গজে উঠে খুঁচাখুঁচা কাঁচাপাঁকা দাড়ি। বয়স তাঁর পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই । সংসারে ঘানি টানতে টানতে কখন যে চুল দাড়ি পাকা শুরু করেছে সেদিকে কবু খেয়াল হয়নি তাঁর । বড় অফিসের ছোট পদের কর্মচারী তিনি। পিয়নের চাকরিতো তাই এটা করো ওটা করো, এখানে যাও সেখানে যাও সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ। সাহেবেরা আসার আগে অফিসে আসতে হয় আর যেতে হয় সবার শেষে । বলছি সুদর্শন বাবুর কথা । চেহারাটা তাঁর কালো হলেও মা-বাবা আদর করে নাম দিয়ছিলেন সুদর্শন । আসলে সুদর্শন বাবুর চেহারায় একটা মায়া মায়া ভাব আছে। একেবারে সহজসরল । জীবনে স্বাদ আহ্লাদ বলতে কিছু ছিল কি না সেটা তিনি নিজেও জানেননা । অফিসের সবাইকে খুব মান্য করে চলতে হয় তাই কারো সাথে তেমন কোন কথা হয়ে উঠেনা। এতে তাঁর কোন কষ্ট নাই । শুধু কেউ তাচ্ছিল্য করে কথা বললে তাঁর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। এ সময় নিজেকে হারিয়ে ফেলেন শৈশবের সেই দিনগুলিতে । কতইনা গুরুত্ব ছিল তাঁর। দিনগুলো ছিল কতো সুখের। শীত হোক আর গরম হোক স্কুল থেকে ফিরলেই মা গরম পানি দিয়ে স্নান করিয়ে দিতেন । যে টিল্লা পাড়া আজ কর্মচঞ্চল ব্যস্ত শহরের একটি অংশ সেই টিল্লা পাড়ায় একসময় ছিল মাত্র কয়েকঘর হিন্দু পরিবারের বাস । সুদর্শন বাবু ছোট প্যান্ট পরে উদাম গায়ে টিল্লাপাড়ার সবুজ টিলাগুলোতো ঘুরে বেড়াতেন । পাড়ার ছেলেময়েরা মিলে সেকি হৈচৈ । সকালে বড় একটা মগে করে গরুর দুধ ঢুকঢুক করে গিলতেন । সারা পাড়ার কোন গাছের কি ফলের কেমন স্বাদ তা ছিল তাঁর নখদর্পনে। ভালো ছাত্র, খেলাধুলায় ভালো সব মিলিয় পাড়ার ছেলেদের কাছে তাঁর কদর ছিল খুব । স্কুলে যাওয়ার সময় খাতা কিংবা কলম ভুলে গেলেও বাবার কাছ থেকে দুই টাকা নিতে কভু ভুল হতোনা । দেড় টাকার একটা সিংগাড়া খেলে সেই ছোট পেটে আর অবশিষ্ট যায়গা থাকতোনা। বাশের খুঁটি কেটে বানানো ব্যাংকে টাকা জমা করতেন । সংসারে অভাব থাকলেও সেই অভাব তখন তাঁকে এতটুকুও স্পর্শ করেনি । দিনগুলো ছিল বড়ই রোমাঞ্চকর। শৈশবের সেই স্মৃতি গুলোর ফাঁকে আরো একটা স্মৃতি এতোদিন বড় বেশি অবহেলায় মনের এক কোনে সকল স্মৃতির আড়ালেই লুকিয়েছিল। আজকাল সেই একটুকরো কোমল স্মৃতি সুদর্শন বাবুর মনকে বড্ড বেশী নাড়া দিয়ে যায়। অবশ্য সেই সুখের মূহুর্তটি এসে হাজির হয়েছিল পরম দুঃখের সাথে তাল মিলিয়ে। তাই হয়তো দুঃখ-সুখের মাঝে একটা তালগোল পেকেগিয়েছিল ।
....
তখন বাবা নেই, মা অসুস্থ, ঘরে অবুঝ দুটি ভাই । বাবার চিতার আগুনে তাঁর সেই স্বপ্ন রঙ্গিন দিন গুলোও পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে । আজ অবদি পুড়ছে। সেই পুড়া মনে কখন যে একটুকরো প্রেম পুড়ে পুড়ে খাটি হয়েছিল তা তিনি নিজেও কোনদিন বুঝে উঠতে পারেননি, আর যখন বুঝতে পেরেছেন তখন দেরি হয়ে গেছে খুব ।
....
নবম শ্রেনীতে থাকাকালিন সময়ের কথা। প্রায় প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার মধ্যপথের বাড়ির ছাদের উপর থেকে একটুকরো কাগজের ঢিল তার গায়ে এসে পড়তো । লাজুক সুদর্শন বাবুর কালো চেহারা তখন লাজে আরো কালো হয়ে যেতো, পাছে লোকে কিছু বলে এই ভয়ে সেই কাগজের ঢিল রূপী চিরকুট কবু পড়া হয়নি তাঁর ।
....
মধ্য পথের কাগজের ঢিল এড়িয়ে গেলেও সেই ঢিলের সারমর্ম তাঁকে একদিন পড়তে হয়েছিল ঠিকই । কেননা স্বর্নাদেবী যে নাছোড়বান্দা । সুদর্শন বাবুর জন্য তার মন বড়ই উথলা হয়ে উঠছিল, প্রেমের তৃষ্ণায় কাতর ছিলেন তিনি । তাই একদিন সেই মধ্য পথে ঢিল না ছুড়ে স্ব-শরীরে নিজেই সুদর্শন বাবুর পথ আগলে দাড়ালেন আর জিজ্ঞেস করলেন ওহে জনাব নাম কি আপনার কোন পাড়াতে থাকেন । সুদর্শন বাবু একবার এদিক একবার ওদিক থাকিয়ে মাথা নিচু করে বলেন টিল্লাপাড়ায় থাকি নাম আমার সুদর্শন । এই বলেই পাশ কেটে হনহনিয়ে চলে যান ।
....
সেই ঘটনার দিন পাঁচেক পরের কথা । প্রশান্ত বিকেল , সূর্যেরর তাপ কমতে শুরু করেছে , সুদর্শন বাবু মায়ের গোসলের জন্য পানি গরম করতে একখানা আধা ছেড়া গামছা পরে উদাম গায়ে ঘরের বাইরে খড়কুটার উনুনের পাশে বসে আছেন। এমন সময় কেউ একজন মায়ের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। সুদর্শন বাবুর সেদিকে খেয়াল নেই। একটু পরেই মায়ের ডাক পড়লো কইরে সুদর্শন এদিকে আয় দেখতো তোর খোঁজে কে যেন এসেছে । সুদর্শন বাবু ভাবছেন হয়তো পাড়ার কেউ এসেছে কোন কাজে । কিন্তু ঘরে ডুকেই তিনি ভ্যাবচেকা খেয়ে যান । সেই পথ আগলা মেয়ে এভাবে একেবারে বাড়িতে চলে আসবে এরকমটা স্বপ্নেও ভাবা হয়নি তাঁর । তাড়াহুড়ো করে গায়ে গেঞ্জি পরে নিলেন । কি করবেন কি বলবেন কিছুই বু্ঝে উঠতে পারছিলেননা, সুদর্শন বাুবুর এমন কান্ড দেখে স্বর্নাদেবী মুচকি মুচকি হাসেন । ঘরে নাস্তাপাতি কিছু নেই তবু মগ ভরে এক মগ চা তো দেওয়া যায় । কিছুক্ষণ পর সুদর্শন বাবু চা নিয়ে এসে দেখেন অতিথি উধাও , স্বর্নাদেবী চলে গেছেন । যাওয়ার সময় মায়ের শয্যা পাশে একখানা চিটি রেখে গেছেন । মায়ের কাছ থেকে খানিক দূরে গিয়ে মনে মনে সেই চিটি খানি পড়তে লাগলেন । প্রিয় সুদর্শন সেই কবে থেকে এ হৃদয় তোমার জন্য উৎসর্গ করেছি তা জনা নেই , যখন তুমি আমার কাগজের ঢিলগুলো অবহেলায় এড়িয়ে যাও আমার হৃদয়ে তখন কষ্টের বজ্রধ্বনী বাজে । আমার সব ভালবাসার কথা সেই কাগজে লিখে অনেকবার দিয়েও যখন ব্যর্থ হয়েছি তখন ভেবেছিলাম তোমাকে আমার মনের কথা সরাসরি-ই বলবো তাই সেদিন পথ আগলে দাড়িয়েছিলাম। কিন্তু সে সুযোগটাও তুমি দাওনি । তাই এ পথ বেছে নিয়েছি । তোমার প্রতি শত অনুরোধ তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিওনা ।
ইতি তোমার
স্বর্নাদেবী
....
দিনে দিনে সুদর্শনের মায়ের অসুখটা বাড়তে লাগলো, একদিকে মায়ের সেবা অন্যদিকে ছোট ভাই দুটিকে দেখাশোনা আর ঔষধের টাকা যোগাড় করতে বড় বেশী ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেন তিনি । স্কুলে আর যাওয়া হয়নি তাঁর দেওয়া হয়নি মেট্রিক পরিক্ষা আর দেওয়া হয়নি স্বর্নাদেবীর সেই ভালবাসার আবেগ মেশানো নরম হাতে লেখা চিটির প্রত্যুত্তর ।
.....
স্বর্নাদেবীর বাবা সরকারী চাকরিজীবী। কিছুদিন পর ঢাকায় বদলী হয়ে গেলে স্বর্নাদেবীরা স্বপরিবারে ঢাকায় চলে যান । অবশ্য যাওয়ার পূর্বে একদিন স্বর্নাদেবী সুদর্শন বাবুর কাছে এসেছিলেন। সেদিন সুদর্শন বাবুর হাত ধরে প্রচুর কেঁদেছিলেন, ডুকরে ডুকরে কেঁদে সেদিন চোখের জলে বুক ভাসিয়েছিলেন । কিন্তু পারিবারিক দায়বদ্ধতার শেকলে সেদিন সুদর্শন বাবুর হাত-পা ছিল বাঁধা ।
....
কয়েকদিন পর সুদর্শন বাবুর মা মারা গেলেন। এর পর পার হয়ে গেছে বহুবছর। নিজে বিয়ে করলেন ভাইদের বিভিন্ন কাজে লাগালেন বিয়ে-শাদী দিয়ে দিলেন। এখন যার যার সংসার নিয়ে যে যার মতো ব্যস্ত । দশ বছর হলো পিয়নের চাকরি ধরেছেন। এক ছেলে দুই মেয়ে আর বউ মিলে পাঁচজনের সংসার তাঁর। স্বর্নাদেবীকে কখনো খোঁজেছেন বলে মনে হয়না । স্বার্থপরেরর মতো স্বর্নাদেবীর ভালবাসাকে অবহেলায় দূরে ঠেলেছিলেন । কিন্তু যে ভালবাসা তার মনে এতদিন কেবল আড়ালেই ছিল সেই ভালবাসার স্মৃতি তাঁর মনকে আজকাল বড় বেশী নাড়া দিয়ে যায় মনে পড়ে সেই না পড়া কাগুজে ঢিলের কথা । শত তাচ্ছিল্য কষ্ট আর অবহেলার মাঝে একটু খানি সুখ খুজে বেড়ান সেই ভালবাসায় । মনে মনে ভাবেন কেমন আছে স্বর্নাদেবী ? আমাকে কি কবু আর মনে পড়ে তার ? মনে কি পড়ে সেই দিনগুলোর কথা। নিশ্চই কোন সাহেবকে বিয়ে করে পেতেছে সোনার সংসার ! নিশ্চই সুখে আছে খুব ! সুখে থাকুক ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:০৫
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সংস্কারের জন্য টাকার অভাব হবে না, ড. ইউনূসকে ইইউ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এবং সফররত এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক পাওলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

তোমার বিহনে কাটে না দিন

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:০৩



অবস্থানের সাথে মন আমার ব্যাস্তানুপাতিক,
বলে যাই যত দূরে ততো কাছের অপ্রতিষ্ঠিত সমীকরণ।
তোমাকে ছেড়ে থাকা এতটাই কঠিন,
যতটা সহজ তোমার প্রতিটি চুল গুনে গুনে
মোট সংখ্যা নির্ণয় করা।
তোমাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবি কখনো কখনো কিছু ইঙ্গিত দেয়!

লিখেছেন ডার্ক ম্যান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৭



গতকাল ভারতীয় সেনাপ্রধানের সাথে বাংলাদেশ সেনাপ্রধান এর ভার্চুয়ালি কথা হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের অফিসায়াল এক্স পোস্টে এই ছবি পোস্ট করে জানিয়েছে।

ভারতীয় সেনাপ্রধানের পিছনে একটা ছবি ছিল ১৯৭১ সালের... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রথম আলু

লিখেছেন স্নিগ্দ্ধ মুগ্দ্ধতা, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



লতিফপুরের মতি পাগল
সকালবেলা উঠে
পৌঁছে গেল বাঁশবাগানে
বদনা নিয়ে ছুটে



ঘাঁড় গুঁজে সে আড় চোখেতে
নিচ্ছিল কাজ সেরে
পাশের বাড়ির লালু বলদ
হঠাৎ এলো তেড়ে




লাল বদনা দেখে লালুর
মেজাজ গেল চড়ে।
আসলো ছুটে যেমন পুলিশ
জঙ্গী দমন করে!





মতির... ...বাকিটুকু পড়ুন

×