বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায় , কখনো
কখনো রাত সাড়ে এগারটা বা
বারটাও বাজে । সেদিন বাড়ি
ফিরছিলাম রাত প্রায় সাড়ে এগারটা
নাগাদ , বাড়ির পথ ধরতেই পেছন থেকে
একটা অদ্ভুত হাসি কানে আসলো ,
আচমকা এমন হাসিতে ভয় পাবারই কথা ,
তবু সাহস নিয়ে পেছনে তাকালাম ।
মোবাইলের টর্চের আলোটা একটু উচু
করে ধরলাম । দেখি অর্ধ নগ্ন একটা লোক
পিঠে ঝুলানো একটি কালো পুটলি
নিয়ে দাড়িয়ে আছে , উস্কো খুসকো
চুল, দাঁত খিঁচকিয়ে হাসছে । বুঝতে
বাকি রইলনা এ যে একটা বদ্ধ পাগল ।
ধমক দিতেই উল্টা ঘুরে দিল দৌড় ।
...
সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে
বাজারের দিকে যেতেই চোখে পড়ল
রাতের সেই পাগলটাকে । একটি বন্ধ
দোকানের পাশে বসে কাঁদছে ,
কান্না দেখে কাছে গেলাম যা
দেখলাম তা খুবই অমানবিক কে বা
কারা পাগলটাকে খুব মেরেছে ,
গালের চামড়ায় দাগ এখনো স্পষ্ট ,
পিটে কয়েকটা বেতের দাগ , বুঝতে
বাকি রইলনা যে নিশ্চই কাউকে ভয়
দেখিয়েছিল তাই এভাবে নির্মম
নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়েছে ।
পাগলটার প্রতি মায়া লেগে গেল
একটি খাবার হোটেলে নিয়ে কিছু
ডালভাত খাওয়ালাম আর ধমক দিয়ে
বললাম আর কাউকে ভয় দেখাবিনা ।
পাগলকি আর অতসব বুঝে তারপরেও
কাউকে কাউকে ভয় দেখাতে শুনেছি
।
...
বাজারের সবাই তাকে এখন চেনে
হাসি পাগলা নামে , ওর হাসি সবার
বেশ পরিচিত হয়ে গেছে , এখন হঠাৎ ওর
হাসি শোনে কেউ আর তেমন ভয়
পায়না । খাবারের দোকানগুলোতে
ঘুরে ঘুরে খাবার চায় , হোটেলের
কাস্টমারদের সাথে তাল মিলিয়ে
টিভি দেখে , গানের তালে কখনো
কখনো নাচে , কেউ মারলে একটু কাঁদে
, আবার হাসে , ধমক দিলেও হাসে
অর্থাৎ হাসে একটু বেশী । পাগল হলেও
সে অন্য পাগলদের মত নোংরা নয় ,
খালি গায়ে থাকে সব সময় , পরনে
একটা প্যান্ট , তেলের অভাবে রুক্ষ চুল ,
পিঠে সবসময় ঝুলানো তাকে একটা
কালো পুটলি ।
...
বাজারের পুকুরে নিয়মিত একটি অর্ধ
ছেড়া গামছা দিয়ে গোসল করে ,
রোদে শুকিয়ে তা আবার পুটলিতে
ভরে রাখে , আমি খালি গা ঢাকতে
একটা নতুন শার্ট কিনে দেই , কিন্তু সে
এটি না পরে পুটলিতে রেখে দেয় ,
কিছুতেই শার্টটি পরানো যায়নি ।
আমাকে দেখলেই দৌড়ে কাছে ছুটে
আসে , দুই টাকা চায় , বলে ভাত খাব ,
জানি দুই টাকা দিয়ে ভাত পাওয়া
যায়না তাই আমার কাছে আসলেই
হোটেলে নিয়ে যাই , যা চায় তাই
খাওয়াই । অন্য কারো কাছে কিছু
চায়না , শুধু আমার কাছে চায় এ জন্য
পাগলটার প্রতি আরো বেশী মায়া
বসে যায় ।
...
আস্তে আস্তে শীত পড়তে শুরু করেছে ,
মাঝ রাতে ঠান্ডা বেড়ে যায় আবার
ঘুমটাও বেশ ভালো হয় , তাই প্রচন্ড ঘুমে
আচ্ছন্ন , হঠাৎ মাইকের আওয়াজে ঘুম
ভাংলো , ঘড়ির কাটা তখন রাত
তিনটা , মাইকে কি ঘোষণা হচ্ছে কান
পেতে শুনার চেষ্টা করি , কেউ একজন
মাইকে ঘোষণা দিচ্ছেন , অত্র
এলাকায় রেড এলার্ট যারি করা
হয়েছে , চতুর্দিকে র্যাবের
নিরাপত্তা বেষ্টনিতে ঘিরে রাখা
হয়েছে এরই মাঝে ঠাশ ঠাশ গুলির
শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে গেল
। মনে হচ্ছে র্যাবের সাথে কোন
অস্রধারী সন্ত্রাসী চক্রের বন্দুক যুদ্ধ
চলছে , বেশ ভাবনায় পড়ে গেলাম ,
আমাদের এই অজপাড়াগায়ে বন্দুকযুদ্ধ
করার মত এত বড় শক্তিশালী সন্ত্রাসীই
বা কে আছে ! প্রায় আধঘন্টা পরে শব্দ
একটু একটু করে কমতে লাগল , সকাল হতে
এখনো অনেক সময় বাকি এরই মধ্যে
আবারও মাইকে ঘোষণা আসল ৭০ লক্ষ
টাকা মূল্যের কষ্টি পাতরের মূর্তিটি
উদ্ধার করা হয়েছে , গ্যাং লিডার
কেরামত সহ পুরো পাচারকারি ও
সন্ত্রাসী চক্রই ধরা পড়েছে , এলাকা
এখন সম্পূর্ন নিরাপদ । আমাদের পাশের
বাড়ির কেরামত চাচা শুনেছি কয়লার
ব্যাবসা করেন , চলনবলন খুবই সহজ সরল ,
ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছিনা ,
মনে হলো ঘুমের ঘোরে বোধ হয়
উলটাপাল্টা স্বপ্ন দেখছি ।
...
সকালে টিভিতে ব্রেকিং নিউজ
দেখে চোখ একেবারে ছানাবড়া হয়ে
গেল , গোয়েন্দা অফিসার আব্দুল আলী
হাসির নেতৃত্বে চুরি হওয়া মূর্তি সহ
র্যাবের হাতে গ্যাং লিডার
কেরামত ও পুরো গ্যাং চক্র আটক ।
খবরের বিস্তারিত যা শুনলাম তা
হতবাক হওয়ার মতই ঘটনা, বিদেশে
পাচারের উদ্যেশ্য গত একমাস আগে
কেরামতের নেতৃত্বে এটি চুরি করে
এনে তার বাড়িতে রাখা হয়েছিল ,
প্রায় সময়ই সাধারন লোকের বেশে বড়
বড় সন্ত্রাসীদের আনাগোনা নাকি
ছিল আমাদের এলাকায় , শুধু মুর্তি
পাচার নয় আরো অনেক নাশকতা মূলক
কর্মকান্ডের পরিকল্পনা করা হতো
কেরামতের বাড়িতে , আর তা যেনে
যায় গোয়েন্দা বাহিনী , কেরামত সহ
পুরো চক্রকেই রাখা হয় গোয়েন্দা
নজরদারিতে , মূর্তি রাখার প্রকৃত স্থান
উদ্ধারের দায়িত্ব ও কেরামতকে
নজরদারির দায়িত্ব পালন করেন
গোয়েন্দা আব্দুল আলী হাসি ।
কেরামত যখন জানতে পারলো সে
গোয়েন্দা নজরদারিতে পড়েছে তখনই
সেটি সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করল ,
তবে তার সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের
পূর্বেই গ্রেফতার হতে হল র্যাবের
হাতে।
...
একটু পরেই টিভির পর্দায় দেখা গেল
সেই স্বর্ণ উদ্ধারের নায়ক গোয়েন্দা
আব্দু আলী হাসিকে , দেখেতো
রিতিমত মাথা ঘুরপাক খেতে লাগলো
আরে এতো দেখি আমাদের সেই হাসি
পাগলা , হয়তো টিভিতে দেখে
চিনতামনা কিন্তু ওর গায়ে আমার
দেওয়া শার্ট আর অতি পরিচিত হাসির
রেখা দেখে চিনতে একটুও ভুল হলনা ,
আমার মত টিভি সেটের সামনে বসা
সকলেই হতবাক । সবার মুখে দুইটা নাম
লেগেই আছে , হাসি পাগলা আর
কেরামত ।
...
কি বিচিত্র এ জগত সব কিছু এক
অগোছালো স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে ।
এতো বড় একজন সম্মানী লোক এতোদিন
অনাদরে অবহেলায় রাস্তায় রাস্তায়
ঘুমিয়েছেন , শুধু মাত্র দেশের মানুষের
জন্য , দেশ সম্পদ রক্ষা করতে নির্দিধায়
এত কষ্ট সহ্য করেছেন ! আজ নিজেকে
অনেক ধন্য মনে হচ্ছে , আমার চর্মচক্ষু না
চিনলেও অন্তরচক্ষু হয়তো চিনতে
পেরেছিল তাই আমি পেয়েছিলাম এই
মহান মানুষটির সান্যিধ্য ।
...
.
তিন দিন পর..
.
একটি গাড়িবহর এসে থামল আমার
বাড়ির সামনে , চোখে কাল
সানগ্লাস পরিহিত আমার দেওয়া সেই
শার্টটি পরে আমারই বাড়িতে হাজির
হয়েছেন সদ্য ঘোষিত শ্রেষ্ট গোয়েন্দা
আব্দুল আলী হাসি অর্থাৎ আমার এবং
আমাদের সেই হাসি পাগলা । কাছে
এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন , বন্ধু বলে
ডাকতেই আর অস্রু সংবরণ করতে
পারলামনা আমার চোখ বেয়ে
আবেগের ঝর্ণাধারা বইতে লাগল ।
হাসি পাগলা আসার খবর শোনে
এলাকার সবাই ছুটে আসছে আমার
বাড়ির দিকে তাদের অতি পরিচিত
হাসি পাগলার আসল রূপটা চিনে
নিতে আর এক নজর দেখতে , হয়ত কোন
হোটেলে পাগলা নাচ , কিংবা
রাতে হঠাৎ করে ভয় দেখানোর মত
কান্ড আর ঘটবেনা , যেখানে
সেখানে ঘুমাতে দেখা যাবেনা
হাসি পাগলাকে , কিন্তু হাসি
পাগলা প্রিয় গোয়েন্দা হাসি হয়ে
রয়ে যাবে সব মানুষের অন্তরে ।