এই মটু এদিকে আয় আমার সাথে মার্কেটে যাবি চল । মামা তুমি আমাকে মটু বলছো কেন ? তুই মোটা তাই মটু ডাকলাম, আচ্ছা বাবা ঠিক আছে এখন থেকে তোকে চিকনা বলে ডাকবো তবু দেখি তোর শার্ট গুলো একটু লুজ হয় কিনা ঠিক আছে ? হাহাহা ।
রাশেদঃ মামা!!!
প্রায় সমবয়সী ভাগ্নে রাশেদের সাথে মাঝে মাঝে এভাবেই মজা করে লন্ডন প্রবাসী মামা লুটন । বিয়ে করবে বলে দেশে ফিরেছে ,আর কয়দিন পরেই সানাই বাজবে , নতুন বউ ঘরে আসবে সেই আনন্দে দক্ষিণের হাওয়া বইছে তার মনে ।
...
হবু স্ত্রী নীলার সাথে চর্মচক্ষুর ইশারা এই প্রথমবারই ঘটছে , আর এই প্রথম ইশারেতেই যেন তার মনে বইতে লাগলো এক কোমল শিহরণ , মনের ভেতরটা খুশিতে নাচতে লাগলো । নীলাকে এক নজর দেখার তৃষ্ণাতো মিটলোইনা বরং সারা জীবনও তাকে চেয়ে চেয়ে দেখলেও এ তৃষ্ণা মিটবেনা । নীলার সাথে ফেইসবুকে পরিচয় হয় লুটনের । প্রায় বছর খানেক আগে ”নীল স্বপ্ন” নামের একটি আইডিতে এড দেয় সে , এড দেওয়ার পর থেকেই ঐ আইডি থেকে আসা ভালো ভালো লেখা গুলোতে লাইক কমেন্ট করে লুটন । প্রতিটা কমেন্টের চমৎকার রিপ্লাই আসে ”নীল স্বপ্ন” আইডি থেকে ।
একদিন প্রবাসীদের জীবন কথা নিয়ে একটি স্টেটাস দেয় লুটন আর তাতে নীল স্বপ্নের চমৎকার কমেন্টে পুলকিত হয়ে সে ইনবক্সে মেসেজ দিয়ে ধন্যবাদ জানায় । ধন্যবাদকে স্বাগত জানায় নীল স্বপ্ন আর তখন থেকেই ফেইসবুক মেসেঞ্জারে কথার পিঠে কথার ঝুড়ি আর ভালো লাগা ভালবাসার অধ্যায় গড়ে উঠে । চিরচারিত নিয়মে মোবাইল নাম্বার বিনিময়ের ফলে মোবাইলে কানে কানে মনের কথা গুলো আদানপ্রদান ঘটে । ভালবাসার রঙ্গ আরো রঙ্গীন হতে থাকে । ভিডিও কলে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে বলতে ওরা আরো চঞ্চল হয়ে উঠে । একজন আরেকজনকে পেতে চায় কাছে আরো কাছে ।
অবশেষে সেই প্রতিক্ষার প্রহর শেষ হলো একজন আরেকজনকে চর্মচক্ষু দিয়ে গভির ভাবে পরখ করে নিল , দুই পরিবারের কথা পাকাপোক্ত , আর মাত্র সাত দিন পরেই বিয়ে।
...
লুটন সবার সাথে খুব মজা করছে , হাসছে আনন্দ করছে তার চোখে এখন কেবল একটাই স্বপ্ন যে স্বপ্নের রং গাড় নীল । এ নীল পৃথিবীটা কেবল নীলা আর লোটনের , এর আকাশের তারা গুলো নীল , বাগানের ফুল গুলো নীল । সব নীল ছাপিয়ে একটি চন্দ্র উকি মারে আকাশের পূর্ব কোণে হাসি ভরা ছোট্র সোনামণির মতো তাদের ভালবাসার ফসল রূপে ।
...
বিয়ের মার্কেট করা শেষ । মার্কেট বলতে আসলে তেমন কিছু না , কারন নীলার জন্য ১৫ ভরি স্বর্ণালংকার , একটি হীরার নেকলেস , লন্ডনের সেরা মার্কেট থেকে শাড়ি সহ প্রায় সব জিনিসই সে কিনে এনেছে । বাবা-মা আর হবু শশুর আর শাশুড়িদের জন্যও ঐ মার্কেট থেকে প্রয়োজনীয় সব কিছু কিনেছে । তবু স্পেশাল ভাবে আত্মীয় স্বজনের জন্যেতো কিছু কিনে দিতে হবে । বিয়ের দিন সবাই নীল সাজে সাজবে তাই লুটন তার ভাই এবং ভাগ্নাদের নীল রঙ্গের পাঞ্জাবী আর বোন এবং ভাগ্নিদের জন্য নীল শাড়ি কিনল । দুজনের থাকার ঘরকে আরো আকর্ষণীয় করতে সাজ সরঞ্জাম কিনা হলো । রাশেদের আবদারে শহরের সেরা হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে মার্কেট থেকে বাসায় ফিরল ওরা । অনেকদিন পর আত্মীয়-স্বজন সবাই একত্রিত হয়ছে , বাসায় চরম আনন্দের উত্তেজনা । লুটনকে নিয়ে সকলে এক সাথে রাতের খাবার পর্ব শেষ করে খুশগল্পে মেতে উঠেছে । গল্পে গল্পে অনেক রাত হয়ে গেল ,সবাই একে একে হাই তুলতে তুলতে ঘুমের জন্য যার যার কক্ষে চলে যায় ।
লুটনও একটা লম্বা হাই তোলে দরজা লক করে ঘুমিয়ে পড়ে ।
...
সকাল এগারোটা , এতো বেলা হয়েছে তবু লুটনের ঘুম ভাঙ্গছেনা । সকালে ওরা দুজন কোথায়ে যেন যাওয়ার কথা । রাশেদ দরজায় ডাকছে মামা ওঠো বেলা এগারোটা বাজে । ওর ডাকাডাকির ব্যস্ততা দেখে কেউ কেউ বললেন কিরে ওকে ডাকছিস কেন ছেলেটা অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে হয়তো অনেক ক্লান্ত ওকে একটু ঘুমাতে দে । রাশেদ মনে মনে ভাবে দূর আমি গোসলটা সেরে নেই এর ফাঁকে মামা উঠে গেলে দুপুরের খাবার খেয়েই না হয় বের হবো । সে গোসল থেকে এসে দেখে লুটন মামা এখনো ঘুমাচ্ছে , তার মনে খটকা লাগে ও মামা -মামা ওঠো বলে জোরে জোরে ডাকে কিন্তু সেই ডাকের কোন সাড়া নেই । তার ডাকের আওয়াজে সবাই জড়ো হয়ে যায় , কেউ কেউ দরজায় ধাক্কা দেয় কিন্তু ভেতর থেকে লুটন জাগেনা । দরজা ভেঙ্গে দিয়ে সবাই ভেতরে ডুকে দেখে লুটনের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে , অচেতন অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে তার দেহ ।
...
এম্বুলেন্সে করে তাৎক্ষনিক হাসপাতালে আনা হলো । ডাক্তার লুটনের হাত ধরলেন , চোখের চশমা খোলে করুণ দৃষ্টিতে একটি পলক ফেললেন । কেউ যেন এই পলকের মানেটা কিছু বুঝেও বুঝতে পারছেনা কেবল হা করে লুটনের নিথর দেহের পাশে দাড়িয়ে রয়েছে । অল্প কিছুক্ষণ পরেই একটি ডেড
সার্টিফিকেট আসলো এখন থেকে প্রায় ৫ ঘন্টা পূর্বে লুটন হার্ট ফেল করেছে তার সাজানো নীল স্বপ্নকে শুধুই স্বপ্ন রেখে চিরনিদ্রায় চলে গেছে ।
...
লোটনের চোখ যেন চেয়ে আছে নীলার দিকে , নীলা গুটি গুটি পায়ে কাছে যায় , হাটু গেড়ে বসে লোটনের লাশের পাশে । নীলার চোখে কোন অশ্রু নেই অতি শোকে যেন সব অস্রু শুকিয়ে গেছে । কেমন যেন পাথরের মূর্তির মতো বসে আসছে সে । হাসছে না কাঁদছে কিছুই বুঝা যাচ্ছেনা । হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে লোটনের লাশের পাশে পড়ে যায় নীলা। সবাই থাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যায় । জ্ঞান ফিরলে সে অসংলগ্ন আচরন শুরু করে ।
..
পাগল হয়ে গেছে নীলা । একটা নষ্ট মোবাইল তার হাতে থাকে সময় , কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে "প্লিজ ডোন্ট ডিস্ট্রাব মি , নাউ আইএম চ্যাটিং ফোর হিম ।মাঝে মাঝে মোবাইল ছুড়ে ফেলে দেয় মেঝেতে, আবার কুড়িয়ে নিয়ে পরম যত্নে বুকে আগলে রাখে।
...
আজ লোটনের মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হয়েছে , ডাক্তারের নীবিড় পর্যবেক্ষণে সুস্থ হয় নীলা । লুটনের বাবা মা নীলাকে দেখতে যান , লুটনের নীল স্বপ্নের রাণী নীলাকে বৌ-মা ডাকার স্বাদ পূর্ণ হনি তাঁদের । তবে নীলার মাঝে লুকিয়ে থাকা তাঁদের একমাত্র সন্তান লুটনকে খোজে বেড়ান । নীলাকে মেয়ে হিসেব গ্রহণ করে বুকে টেনে নেন । নীলার জন্য আনা লুটনের সব স্বর্ণ , শাড়ী আর হিরার নেকলেসটি পরিয়ে একেবারে নীল রঙ্গে সাজিয়ে তোলেন নীলাকে ।গভির আবেগে নীলা আর লোটনের মা গলাজড়াজড়ি করে কাঁদেন । তাদের এ আবেগ ঘন মূহুর্তে ভারি হয়ে উঠে পরিবেশ, স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো প্রকৃতি,আর এর চারপাশে যেন গুঙ্গাচ্ছে একটি স্থব্ধ হয়ে যাওয়া নীল স্বপ্ন।
গল্প:-
-------নীল স্বপ্ন
লেখাঃ HM Alamgir
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০১৬ দুপুর ১:০৫