টনি সিকোরিয়া ৪২ বছর বয়স্ক অর্থোপেডিক সার্জন, দেখতে বেশ শক্তসমর্থ, একসময় ভালো ফুটবল খেলতেন, থাকেন নিউইয়র্কের একটি উপশহরে। শরতের এক বিকেলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে হ্রদের ধারে একটা ভবনে ঘুরতে গিয়েছিলেন। শান্ত পরিবেশ, মৃদু বাতাস বইছিল- সব মিলিয়ে দিনটা ভালোই ছিল। কিন্তু সিকোরিয়া লক্ষ্য করলেন আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে, বাতাসও আগের চেয়ে ঠাণ্ডা অনুভূত হচ্ছে। হয়তো দূরে কোথাও বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, কে জানে!
তিনি ভবনটির বাইরে বের হলেন, মাকে ফোন করবেন, রাস্তার ধারেই ফোনবুথ। সময়টা ১৯৯৪ সাল, মোবাইল ফোনের যুগ তখনও শুরু হয়নি। সিকোরিয়ার সেদিনটার কথা স্পষ্ট মনে আছে, 'আমি মায়ের সাথে কথা বলছিলাম। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল, দূরে বজ্রের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। মা ফোনটা রাখার পরপরই ঘটনাটা ঘটল। ফোনটা আমার কাছ থেকে এক ফুট দূরে ছিল। হঠাৎ ফোন থেকে আলোর ঝলকানি বের হল, আমার সামনের পৃথিবীটা যেন জ্বলে উঠল। তারপর আমার মনে হল আমি যেন পেছনে উড়ে যাচ্ছি।'
এরপর সিকোরিয়া কিছুটা ইতস্তত করতে লাগলেন, যেন বলতে ভরসা পাচ্ছেন না, 'আমি যেন উড়ছিলাম, আমি চারপাশে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি মাটিতে আমার শরীর পড়ে থাকতে দেখলাম। আমি নিজেকে বললাম, হায়! আমি তো মারা গিয়েছি! আমি দেখলাম, আমার নিথর শরীরের চারপাশে বৃত্তাকারে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। এক মহিলা ফোন বুথের বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন, আমার কথা শেষে তিনি ফোন করবেন। সেই মহিলাকে দেখলাম আমার দেহের পাশে হাঁটু গেড়ে বসছেন আমাকে সিপিআর দেয়ার জন্য। আমার ছেলেমেয়েদের দেখলাম, বুঝলাম ওরা সুস্থ আছে। আমার চেতনায় একটা পরিবর্তন আসতে লাগলো, নীলাভ সাদা উজ্জ্বল একটা আলো আমায় ঘিরে রাখলো। শান্তির একটা অদ্ভুত অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। পুরো জীবনটা যেন সামনে চলে এলো, কোন কষ্ট নেই, বিশুদ্ধ চিন্তা, বিশুদ্ধ আনন্দ। আমি আরও উপরে উঠছিলাম, অপার্থিব এক আনন্দ আমাকে আগলে রেখেছিল, আমি চিৎকার করে নিজেকে বলছিলাম- এরচেয়ে সুন্দর অনুভূতি আর হয় না! এর পরপরই আমি ফিরে এলাম'।
সিকোরিয়া যে ফিরেছিলেন- সেটা তিনি বুঝতে পারলেন 'ব্যাথা'র উপস্থিতির কারনে। জজ্রপাতের বিদ্যুৎপ্রবাহ মুখ দিয়ে ঢুকে পা দিয়ে নেমে যাবার ফলে মুখ ও পায়ে পোড়া দাগ সৃষ্টি হয়েছিল। সেই পোড়া জায়গার ব্যাথা ডাঃ সিকোরিয়াকে স্মরণ করিয়ে দিলো- কেবল জীবিতেরই ব্যাথার অনুভূতি আছে, সুতরাং তিনি মরে যাননি। তার ইচ্ছে করছিল সেই অদ্ভুত আলোকিত জগতে ফিরে যেতে, সিপিআর দেয়ায় ব্যস্ত মহিলাটিকে নিষেধ করতে- তাকে ফেরানোর দরকার নেই, জীবিতদের ভুবনের চেয়ে ঐ ভুবনটা ছিল অনেক প্রশান্তির। কিন্তু ততক্ষণে তিনি চলে এসেছিলেন নশ্বর পৃথিবীতে, জ্ঞান ফেরার পর তিনি বলে উঠলেন, 'আমি এখন ঠিক আছি, আমি একজন ডাক্তার।'
যে মহিলা সিপিআর দিচ্ছিলেন, তিনি মূলত একজন আইসিইউ-নার্স ছিলেন। তিনি হেসে উত্তর দিলেন, 'একটু আগে আপনি ডাক্তার ছিলেন না।'
এরপর যথারীতি পুলিশ এলো, এম্বুলেন্স এলো। তারা ডাঃ সিকোরিয়াকে হাসপাতালে নিতে চাইলে তিনি অস্বীকৃতি জানিয়ে বাড়ি ফেরেন। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বন্ধু, যিনি একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, সিকোরিয়াকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, 'এ যাত্রায় তো বেঁচে গেলে, মনে হয় না আর তেমন কোন সমস্যা হবে'। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি টের পেলেন, পরিচিত অনেকের নাম তার মনে থাকছে না, অনেক ওষুধপত্রের কিংবা যন্ত্রপাতির নাম ভুলে যাচ্ছেন তিনি। স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানো হল, ইইজি এবং এমআরআই করা হল। ধীরে ধীরে মনে রাখার সমস্যাও দূর হয়ে গেল।
কয়েক সপ্তাহ পরের কথা। ডাঃ সিকোরিয়া আবিষ্কার করলেন, হঠাৎ তার পিয়ানোর সুর শুনতে ইচ্ছে করছে। টানা কয়েকদিন তার মন পড়ে রইল পিয়ানোর প্রতি। তিনি যে আগে পিয়ানো বাজানোতে দক্ষ ছিলেন, কিংবা পিয়ানো খুব পছন্দ করতেন- সেরকম কিছু নয়। তিনি ভ্লাদিমির এশকেনাজির পিয়ানো এলবামগুলো আনালেন, 'মিলিটারী', 'উইন্টার উইন্ড', 'ব্ল্যাক কী' এলবামগুলোর ভক্ত হয়ে পড়লেন সিকোরিয়া। নানা পিয়ানো এলবামের স্বরলিপি যোগাড় করলেন। শৈশবে খেলাচ্ছলে টুকটাক পিয়ানো বাজানো ছাড়া পিয়ানো সম্পর্কে তার তেমন কোন ধারনাই ছিল না, অথচ এই পিয়ানোর প্রতি অসময়ে এমন ভালোবাসা জেগে উঠলো যে তিনি পিয়ানো শিখতে চাইলেন। তার সন্তানকে যে মহিলা দেখাশোনা করতেন, দৈবক্রমে তিনি তার পিয়ানোটি কিছুদিনের জন্য রাখার জায়গা খুঁজছিলেন। ডাঃ সিকোরিয়া সানন্দে পিয়ানোটি বরণ করে নিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া সাগ্রহে নিজেই নিজেকে পিয়ানো শেখানো শুরু করলেন ।
তারপর অভাবনীয় একটা ঘটনা শুরু হল। পিয়ানোর সুর তার মাথায় বাজতে লাগলো। প্রথমে ব্যাপারটা ঘটল স্বপ্নে, ডাঃ সিকোরিয়ার মুখ থেকেই শোনা যাক, 'আমি ঘুমের ভেতর দেখলাম আমি পিয়ানোতে সুরটা তুলেছি, এমন সময় ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। জাগার পরও সুরটা মাথায় বেজেই চলল, আমি একলাফে বিছানা ছেড়ে কাগজ কলম নিয়ে সুরের নোট করতে লাগলাম, যতটা আমার মনে আছে- কিন্তু আফসোস, আমি সুর কিভাবে লিখতে হয় তাও ঠিকমতো জানতাম না!'
সুরটা ঠিকমতো লিখতে পারলেন না বটে, কিন্তু যখনই ডাঃ সিকোরিয়া পিয়ানো বাজাতে বসতেন, সেই অজানা সুর তার মাথায় বাজতো, তিনি অনুভব করতেন সুরটার উপস্থিতি চাইলেও উপেক্ষা করা সম্ভব না, অনুভূতিটা এতোটাই তীব্র।
আমি নিশ্চিত ছিলাম না এভাবে সুরের মোহে আচ্ছন্ন হবার কারনটা কি। সিকোরিয়া কি 'শ্রবণজনিত হ্যালুসিনেশন'-এর ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন? না, ডাঃ সিকোরিয়া বললেন, ওটা হ্যালুসিনেশন ছিল না, বলা যেতে পারে 'প্রেরণা'- এটাই হবে উপযুক্ত শব্দ। তার অন্তরের ভেতরে কোথাও যেন সুরটা লুকিয়ে ছিল, অনেকটা রেডিও চ্যানেলের মতো, টিউন করা রেডিও চালু করলে যেমন গান ভেসে আসে-ঠিক সেরকম। যখন তিনি নিজেকে মেলে দিতেন, ঠিক তখনই সুরের আলো তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত। এ যেন মোৎজার্টের ভাসায় 'স্বর্গ থেকে নেমে আসা সুরের স্রোত'।
এই সুরের ঢেউকে উপেক্ষা করার কোন সুযোগ ছিল না, ডাঃ সিকোরিয়া এই সুর পিয়ানোতে বাজাতে চেষ্টা করতেন, সুরের লিপি লিখতে চেষ্টা করতেন। 'সঙ্গীতে প্রায় অশিক্ষিত' একুজন মানুষের পক্ষে কাজটা মোটেও সহজ নয়। এজন্য ডাঃ সিকোরিয়াকে ভোর চারটেয় উঠতে হত, সকালে হাসপাতালে যাবার আগ পর্যন্ত তিনি সুরের সাধনায় মগ্ন থাকতেন। হাসপাতাল থেকে ফিরে আবার রাত অবধি সুরসাধনা চলতো। এতে যে তার স্ত্রী খুব একটা খুশি ছইলেন, তা নয়। কিন্তু ডাঃ সিকোরিয়ার এসব ভাবার অবসর ছিল না। তিনি ধ্যানমগ্ন হয়ে পিয়ানো নিয়ে বসে থাকতেন।
তিনমাস আগেও যে মানুষটার সঙ্গীতের প্রতি তেমন কোন আগ্রহ ছিল না, ব্জ্রপাতে আক্রান্ত হবার পর থেকে এমন পরিবর্তনে তিনি নিজেও অবাক হন। পারিবারিকসূত্রে খ্রিষ্টান হওয়া সত্ত্বেও কখনো ধর্ম নিয়ে বিশেষ একটা ভাবেননি সিকোরিয়া। অথচ এখন তিনি ভাবেন, বজ্রপাতের ঘটনার পর তিনি ফিরেছেন একটা 'বিশেষ উপহার' নিয়ে, এ যেন নতুন রূপে তার পুনর্জন্মমাত্র। তার কথা শুনলে সপ্তদশ শতাব্দীর অ্যাংলো-স্যাক্সন কবি সেইডমনের সাথে মিল পাওয়া যায়, যিনি পড়াশোনা জানতেন না, মেষ চড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। একদিন স্বপ্নে কিছু একটা দেখে পুরোপুরি কবি বনে যান, বাকি জীবন ঈশ্বর ও প্রেমের কাব্য গড়েছেন পরম আনন্দে। সিকোরিয়ার ব্যাপারটিও কি সেরকম কিছু?
আমি ডাঃ সিকোরিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বজ্রপাতের কারনে 'মৃত্যুর কাছাকাছি' পৌছার পর তার চিন্তাভাবনা কিংবা জীবনদর্শনে কোন পরিবর্তন এসেছে কিনা। তিনি জানালেন, তার পাঠ্যাভ্যাস আগের চেয়ে বেড়েছে, তিনি মৃত্যুর কাছাকাছি যাবার অভিজ্ঞতা কেমন- এটা জানার জন্য জীবনীমূলক থেকে শুরু করে টেসলার উচ্চ বৈদ্যুতিক বিভব সম্পর্কিত বইপত্র- যা পেয়েছেন তাই পড়েছেন। পেশায় একজন সার্জন হওয়া সত্ত্বেও দিনের অধিকাংশ সময় তিনি কাটাতেন পিয়ানো নিয়ে সঙ্গীতসাধনা নিয়ে। পিয়ানো শেখার জন্য তিনি প্রিয় শিল্পীদের পারফর্মেন্স দেখতে দূর শহরে চলে যেতেন, অথচ নিজের শহরের শিল্পীদের সাথে তার তেমন যোগাযোগ ছিল না। সুরের মোহ ছাড়া আরেকটি বিষয় তিনি উল্লেখ করেন, সেটা হচ্ছে মাঝেমধ্যে তিনি চারপাশের মানুষজনের আশেপাশে অদ্ভুত এক ধরনের আলোর রশ্মি দেখতে পেতেন, যা সঙ্গীতের মতোই স্বর্গীয় বলে তার কাছে মনে হত। এরকম বিচিত্র অনুভূতিতে পূর্ণ নিজের ভুবনে আত্মসমাহিত হওয়া - এই ছিল তার বজ্রে আক্রান্ত হবার পরের জীবন। ২০০৪ সালে তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, এর কিছুদিন পর তিনি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। তার প্রিয় হার্লে-ডেভিডসন মোটরবাইকটি দুর্ঘটনায় দুমড়ে-মুচড়ে যায়, কয়েকটা হাড় ভাঙ্গার পাশাপাশি বুকে ও মাথায় চোট পান তিনি। দু'মাস পর সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন স্বাভাবিক জীবনে। এই দুর্ঘটনা, মাথার আঘাত কিংবা বিবাহবিচ্ছেদ- কোনকিছুই তাকে সুরের সাধনা থেকে দূরে রাখতে পারে নি।
এই ছিল হঠাৎ সুরপিপাসা জেগে ওঠা একজন বজ্রাহত মানুষের গল্প।
(অলিভার স্যাক্সের 'মিউজিকোফিলিয়া' গ্রন্থের ধারাবাহিক ভাবানুবাদের প্রথম কিস্তি)