চা এর সঙ্গে আমার সখ্যের বয়স ২০; এবং সখ্যের সূচনাটা খুব সুখকর কিছু ছিলনা--- গ্রামে খালার বাড়িতে প্রথম চুমুক দেয়া চায়ে জিহ্বার উপর দিয়ে স্টিমগাড়ি চলেছিল, সহজ বাংলায় বললে জিহ্বা পুড়ে গিয়েছিল; সেদিন ছিল শুক্রবার, বিটিভিতে মনের মুকুরে অয়ময় নাটকটি প্রচারিত হচ্ছিল এবং ঐ পর্বটিতে ছোট মির্জার ছোট বউ তাকে মিথ্যা সন্তানসম্ভবের গল্প শুনিয়েছিল। সময় আমার বন্ধুমানুষ অনেক আগে থেকেই , তাই সবকিছুই মনে রঙিন দৃশ্যাবলী হিসেবে জমা থাকে, এবং মিথ্যা বলবোনা, মাঝে মাঝে আমি সংশয়ে ভুগি, সত্যিই কি হুবুহু এই ঘটনাগুলোই ঘটেছিল? ভেরিফাই বা যাচাইয়ের যেহেতু সুযোগ নেই, আমার অবচেতন মন উল্টোপাল্টা কিছু একটা বলতেও তো পারে। মনের উপর কিছুটা আস্থা রাখতেই হবে বন্ধু, নইলে যে মন আপনার উপর অভিমান করে ময়নাদ্বীপে মনান্তরী হবে!
২০বছর আগেকার সেই বিরূপ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শুরু, তারপরও চায়ের সঙ্গে দূরত্ব ক্রমেই কমে কমে এসেছে, স্কুল জীবনে বলতে গেলে চা আমার সঙ্গে মিশেই গিয়েছিল। একটা বিশাল ফ্লাস্ক ছিল চায়ের, তাতে অবলীলায় ৬-৭ মগ চা এর স্থান সংকুলান হত, এবং যদি কাপের হিসেব করা হয় তবে প্রতিটি মগের ভেতরেই ছিল ৪-৫ কাপ চা এর রসদ; রাত ২ টায় ঘুমানোর আগে বাধ্যতামূলকভাবে সেই ফ্লাস্কের উদর আমি শূন্য করতামই। আর, দিনের বেলায় ছিল অন্য হিসাব। বিকালে মাঠে গিয়ে বসতাম; একটা বাঁধা চা-ওয়ালা ছিল; একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধান বজায় রেখে সে আমাকে চা দিয়ে যেত স্বপ্রোণোদিত হয়েই। যতক্ষণ মাঠে থাকা হত চা এর উপরেই থাকা হত, এবং এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে আমি কখনো স্বাভাবিক কাপের পরিমাপে চা পান করিনি, আমার জন্য ভরা কাপের ব্যবস্থা থাকত। চাওয়ালাদের সঙ্গে আমার সুসম্পর্কের ভিত্তিমূলও তখনই সৃষ্টি হয়েছিল।
নটরডেম কলেজ ক্যান্টিনের চা এর স্বাদ আমি এখনো মনে রেখেছি। আমাদের ক্লাশ শুরু হত ৮টায়, ১০টায় একটা বিরতি থাকত; সেসময় সবাই যার যার মত খাওয়াদাওয়া সারলেও আমি চা-তেই নিমজ্জিত থাকতাম। সেসময় ঢাকার অধিকাংশ জায়গায় চা এর দাম ২ টাকা থাকলেও, ঐসময়ই ক্যান্টিনের চা ছিল ৪টাকা; মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে তা এখন কত তে দাঁড়িয়েছে, বলতে পারিনা। কোন একটি অবস্থান ত্যাগ করলে সেখানে আর সচরাচর যাওয়া পড়েনা আমার; তাই কলেজ থেকে এইচ.এস.সি এর সার্টিফিকেট তুলবার পর আর কোনদিনই নটরডেম কলেজে যাইনি।
(তবে, কোন বর্তমান নটরডেমিয়ান যদি এই নোটটা পড়ে, এবং আমাকে ক্যাম্পাসে চা এর নিমন্ত্রণ জানায়, অনেস্টলি বলি, অবশ্যই নিমন্ত্রণ রক্ষা করব)
বুয়েটে এসে আমার চা-খাওয়ার ধরনে বৈপ্লবিক বিবর্তন আসে। সবার মত এতদিন আমিও চা খেতাম একহাতে, কিন্তু একদিন অচানক দুই হাতে দুই কাপ নিয়ে চা খেতে শুরু করলাম, এবং ব্যাপারটা থেকে বেশ খানিকটা আনন্দ উসুল হল। পরবর্তীতে, এই স্টাইলটাই আমার ট্রেডমার্ক হয়ে উঠে। সাধারণত ঘরোয়া আড্ডায় এভাবে খাওয়া হয়, বাইরে ভদ্রতার খোলসবদ্ধ থাকি বলে সবার মত এক কা্পেই খেয়ে থাকি। ২-৩বার বাইরে খেয়েছিলামও, এবং প্রতিবারই জবাবদিহি করতে হয়েছে। যেমন, ২০০৮ এ রংপুর ট্যুরে ডিপার্টমেন্টের স্যার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ওভাবে চা কেন খাই। আমাকে একটা তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যা দিতে হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আমি একজন নিঃসঙ্গ মানুষ, কিন্তু আমি অনুভব করি আমার একটা ইনভিজিবল ফ্রেন্ড আছে; বাম হাতের চায়ের কাপটা আমার সেই ইনভিজিবল ফ্রেন্ডের জন্য, যে আসলে আমার আমিতেই রয়ে গেছে'। এবং ২০১০ এ মানিকগঞ্জে এক চাওয়ালা অবাক হয়ে বলেছিল, 'মামা, আমি ৪০ বছর ধইরা চা বেচি, কিন্তু এমনি কইরা কাউরে খাইতে দেখি নাই'

২-১ কাপ চায়ের লোভ দেখিয়ে কতজন যে কত প্রোগ্রামের স্ক্রিপ্ট লিখিয়ে নিযেছে, স্কুলজীবনে কত বন্ধু প্যারাগ্রাফ লিখিয়ে নিয়েছে, মনে পড়লে চা এর প্রতি আসক্তিটা আরও বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি আমার খুবই পছন্দের একজন মানুষ বহ্নি আপু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আমাকে ৫ ধরনের চা খাওয়াবেন একদিন। আমি সত্য্ই সেই মুহূর্তটি কল্পনা করে ক্রমাগত দৃশ্যচিত্র ফ্রেমবন্দী করে চলেছি।
এমনকী, আমার বিয়ের অনুষ্ঠানেরও কল্পিত একটা পরিকল্পনা ছিল যা সঙ্গত কারণেই তীব্র বৈষয়িক মানুষদের কাছে অনুমোদন পায়নি। আমার চিন্তাটা ছিল বিয়ে হবে কোন একটা উন্মুক্ত মাঠে অথবা শহীদ মিনারে; আগত অতিথিদের চা খেতে দেয়া হবে, সঙ্গে ঝালমুড়ি। মানুষ বিয়েতে এত অপ্রয়োজনীয় খরচ কেন করে? বিয়ের কনে কে এমন উদ্ভট সাজানোর পেছনে কোন্ ফিলোসফি কাজ করে? ওরকম কৃত্রিম চাকচিক্য করে কি মানুষকে গিলিয়ে বোঝাতে হবে যে, হ্যাঁ আজ কিন্তু আমার বিয়ে হচ্ছে্ ওস্তাদ!!!
তবে আমি এও জানি, আমাকেও মানুষের অপ্রয়োজনীয় অনর্থক বালখিল্য রীতির কাছে হার মানতে হবে। সর্বময় ক্ষমতা আমার হাতে থাকলে, আমার চাওয়াটা পূর্ণ করতামই। আড়ম্বরতার একটা সীমা থাকা উচিৎ; নিজেকে বাড়াবাড়িরকম এক্সপোজের এই বিশ্রী প্রবণতায়্ আমি বীতশ্রদ্ধ। অন্যদের সমাচার বলতে পারিনা।
বই প্রকাশিত হওয়ায় আমি যতটা উচ্ছ্বসিত, আমার মনে হয়না এর চেয়ে আনন্দদায়ক কোন অনুভূতির সাথে ভবিষ্যতে্ আমার পরিচয় হবে। হলে ভাল, না হলেও সমস্যা নেই। সুতরাং, একে উদযাপনের ক্ষেত্রে নিজের চিন্তাধারাকে প্রয়োগ করতে চাই, এক্ষেত্রে আমার কোন পিছুটান-প্রতিবন্ধকতা নেই। তাই আজ বুয়েট ক্যাফেটেরিয়ায় বলে এসেছি কাল আমার কমসে কম ৫০-৬০ কাপ চা লাগবে। শুক্রবারে এমনিতে বুয়েট ক্যাফেতে প্রাকৃতিক চা পাওয়া যায়না, যেটা পাওয়া যায় তা মেশিনের চা। কিন্তু আজ বলে এসেছি বলে কাল পাওয়া যাবে। যে যত পারুন আগামীকাল বিকাল ৫ টা থেকে চা খেয়ে নিন। প্রয়োজনে কেটলি তে ভরে বাড়িতে নিয়ে যান। চা য়ের প্লাবন বলতে যা বোঝায়, আক্ষরিক অর্থেই আগামীকাল তেমনটা করবার ইচ্ছা আছে, যদি সৃষ্টিকর্তা সবকিছু অনুকূলে রাখেন।
লেখক হিসেবে আমি খুব আহামরি কিছু নই, ১০টা গল্পের ৭টাই কোন জাতেরই নয়, এবং আমার দৃষ্টিতে আপাত জাতের মনে হওয়া ৩টি গল্পও যে বেজাত, তাও দুর্বলচিত্তে বিশ্বাস করি; কিন্তু, পৃথিবীতে যাবতীয় উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা কি শুধুমাত্র মানসম্পণ্ন মানুষেরাই করবে? ''গুণগত মান' ব্যাপারটি বিশেষণ পদ, কিন্তু ব্যক্তি স্বয়ং বিশেষ্য পদ।এমনকী পৃথিবীটাও বিশেষ্য। বিশেষ্যই মৌলিক, বিশেষণ তো একটা খোলসমাত্র; আমি খোলসকে ভয় পাই, তাই উচ্ছ্বাসের ক্ষেত্রে কোন নীতিমালা মানতে প্রস্তুত নই।
আমি খুব সামাজিক মানুষ নই। তাই গল্প-আড্ডা নিজেরা সৃষ্টি না করলে আয়োজন পানসে হবার ঝুঁকি আছে। সুতরাং ঠাট্টা-তামাশাও নিজ-দায়িত্বে। আমি ৫টা বাজার আগে থেকেই বুয়েট চত্বরে উপস্থিত থাকব। মানুষের মত দেখতে কিংবা মানুষের ২-১টা বৈশিষ্ট্য আছে, এমন যে কেউই এই আয়োজনে অংশ নিতে পারবেন। এজন্য আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় থাকার কোনই প্রয়োজন নেই। পরিচয় আগে ছিলনা বলে কোনদিনই হবেনা, এই ধরনের কোন অমানবিক চুক্তিতে কি আমি সই করেছি কোথাও? সুতরাং, চলে আসুন। যে কোন সমস্যা, সহায়তার জন্য একদম নির্দ্বিধায় আমার পোষা নির্জীব যন্ত্রটির কান মলে দিতে পারেন। সেজন্য্ এই কোডটি অনুসরণ করাই যথেষ্ট হবে : 01670255754
বি:দ্র: সৌজন্য সংখ্যা নীতিকে ঘৃণা করি। আমি আমার মা-বড় আপাকেও সৌজন্য কপি দেইনি, এমনকী স্বয়ং সোহাগ ভাইও বই কিনে নিয়েছেন। কিন্তু আগামীকাল সর্বাধিক চা পানকারীকে একটা বই সৌজন্য কপি দেয়ার ইচ্ছা আছে। দেখা যাক, চায়ের প্লাবন মহাপ্লাবনে রূপ পায় কিনা।হয়তবা, এখান থেকেই জন্ম নেবে নতুন কোন গল্প!!!