[মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১৬]
অনুবাদ: আ-আল মামুন
পিটার প্রিস্টন
ইয়াহিয়া সম্পর্কে সবসময় দুটো ধারণা প্রচলিত ছিল। হয়ত নিজের সম্পর্কে যা বলছেন তিনি তাই: মেজাজী ও কুটিলতাহীন- কর্তব্য পালন করছেন, জাতীয় দায়িত্ব পালন শেষ হলে ব্যারাকে ফিরে যেতে চান; কিংবা তার বিরুদ্ধবাদীদের সন্দেহ অনুযায়ী তিনি একজন ধান্দাবাজ: জেনারেল হিসেবে ক্ষমতা হাতিয়ে নিয়েছেন, কিন্তু এখন কিছুটা গণতান্ত্রিক লেবাস ছাড়া ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারছেন না। গত ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর রাজনীতিতে পাকিস্তানী প্রভাবের নতুন রূপ অনিবার্য্য হয়ে উঠেছে; ইয়াহিয়ার সমর্থকরা সমঝোতার পক্ষে, তারা চায় মুজিব এবং ভুট্টো সমঝোতা করুক এবং ইয়াহিয়াকে সম্মানিত ও মহিমান্তিত প্রেসিডেন্ট পদে আহ্বান করুক।
আসলে, ইয়াহিয়ার দু’ধরনের চারিত্রিক বিশ্নেষণের কোনোটাই সন্তোষজনক নয়। নতুন ঘটনাবলী দু’ধরনের বিশ্লেষণকে মিশ্রিত করে তাকে একটি রক্তঝড়ানো ট্রাজিক ব্যাক্তিতে পরিণত করেছে। সম্ভবত ইয়াহিয়া ক্ষমতার মোহে আবদ্ধ; নির্বিচার বাঙালি হত্যাকাণ্ড সম্ভবত একজন ছদ্ম স্বৈরশাসকের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার চুড়ান্ত প্রচেষ্টা ছিল। বস্তুত, এসব একজন সাধারণ, কিংবা বলা যায় জড়বুদ্ধি, সৈনিকের চরিত্রকেই ফুটিয়ে তোলে। কারণ কোন্ বুদ্ধিমান স্বৈরাচার নেতৃত্বের জন্য সাধারণ নির্বাচনের অনুমোদন দেয়, নির্বাচিত নেতার সাথে তিন সপ্তাহ উন্মুক্ত আলোচনায় রত হয় এবং আকস্মাৎ পরিস্থিতির মৌলিক কোনো পরিবর্তন না হলেও নির্বাচিত নেতাকে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ দায়ে অভিযুক্ত করে এবং অস্ত্রধারীদের আহবান করে? একজন হৃদয়হীন সার্জেন্ট মেজরের পক্ষেই নির্বিচার হর্তাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব।
যে জাতির খুব কম জিনিসই স্বাভাবিকভাবে চলে, সেখানেই সামরিক অস্ত্রের প্রতি আস্থা ও প্রযুক্তি-মুগ্ধতা পরিলক্ষিত হয়; মাত্রতিরিক্ত প্রতিরক্ষা বাজেটের মাধ্যমে যোদ্ধাদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও উন্নত বেতন-ভাতাদির ব্যবস্থা করা হয়। তারা জাঁকজমকপূর্ণ জীবন যাপন করে- করাচীর বস্তীগুলো পাশ কাটিয়ে পাঁচমিনিট পথ গেলেই দেখা যাবে সেনা অফিসারদের আরাম-আয়েশের জন্য নির্মিত আক্ষরিক অর্থেই সুরম্য ‘সানসেট বুলভার্ড’ ভিলাগুলো। কিন্তু এসব অফিসারদের মেধা গণ্ডীবদ্ধ, অবিমিশ্র এবং প্রশ্নসাপেক্ষ। ধনী পাঞ্জাবী পরিবারগুলো এখনও তাদের সম্ভাবনাময় সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ও আইনের ওপর উচ্চ শিক্ষার্থে পাঠায়। উচ্চশিক্ষায় প্রত্যাক্ষ্যাত, যাদের কাঁধে স্কুলের বই কারাগারের মতো ভারী ঠেকে, তারাই সামরিক জীবনে চলে আসে। এয়ার মার্শাল উর খান এবং আসগার খানদের মতো সত্য সত্যই মেধাবী অফিসাররা এলে তারা দ্রুতই পদোন্নতি পায় এবং অল্পবয়সেই চাকুরী ত্যাগ করে রাজনীতি বা বড় ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এটা লেগে থাকার চাকরী, অতিসাধারণ সৈন্যরাই কেবল দীর্ঘদিন ধরে এই চাকরিতে ঝুলে থাকে।
রাওয়ালপিন্ডীতে এরকম স্বল্পবুদ্ধির সামরিক ভদ্রলোকেরা গিজগিজ করে। সাধারণভাবে যে পরিমাণে তাদের থাকার কথা বর্তমান সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি (ইয়াহিয়া দু’বছরেই পদোন্নতি দিয়ে তাদের সংখ্যা দ্বিগুণ করেছেন)। তারা সংকীর্ণচেতা, তাদের অধিকাংশই ধর্মভীরু মুসলমান এবং ভারতীয় শত্রুতা সম্পর্কে কট্টর মনোভাবের। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে যখন নিশ্চিত জয়ের দৃঢ়তা অতি অল্প কদিনেই শান্তির আবেদনে পরিণত হলো তখন তারা খুব ন্যাক্কারজনকভাবে মর্মাহত হয়েছিল। তারা এর চেয়েও গভীরভাবে মর্মাহত হলো যখন তারা বুঝতে পারলো যে তাদের নেতৃত্বদানকারী ‘লৌহমানব’ আইয়ুব খান ধূর্ত ভূট্টোর দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে।
ফলত, কিছু কিছু পূর্বানুমান গভীর বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে, আলাপচারিতার সময় তারা স্বাদেশপ্রীতি ও ঐস্লামিক ঐক্যকে শক্তিশালী সেনাবাহিনী প্রতিপালন করার সাথে এক করে দেখেন, যদিও বাজেটের ৬০% ক্ষয় হয়ে যায় প্রতিরক্ষা খাতে, ‘সানসেট বুলেভার্ড’ এবং আমেরিকার ট্যাংক নিয়ে কাশ্মীর ইস্যুতে তাদের বারুদ নিয়ে খেলার সারম্বর ব্যর্থ প্রয়াসে। তারপরও চিন্তাহীন, প্রশ্নহীন, সামরিক ব্যবস্থার পক্ষে তারা। তারা রাজনৈতিক নেতাদের একেবারে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দেখে। তারা মনে করে যে, এসব রাজনৈতিক নেতাদের দেশ পরিচালনায় একটা সুযোগ দেয়া দরকার বটে! কিন্তু তারা এটাও বিশ্বাস করে যে, কয়েক মাসের রাজনৈতিক শাসনের পরই রাজনৈতিক কৌশলের মারপ্যাঁচেই সামরিক বাহিনীর কাছে কৃতজ্ঞ পাকিস্তান দেশ পরিচালনার জন্য আইয়ুব প্রশাসন তোষণকারী ফিল্ড মার্শাল ও দক্ষ সিভিল সার্জেন্টদের ডেকে আনবে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে ইয়াহিয়ার সাম্প্রতিক পদক্ষেপ সঙ্গতিপূর্ণ বলেই মনে হয়। মুজিবের সাথে আলোচনায় তিনি একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত ধর্মীয় রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থের পক্ষে কাজ করেছেন। তিনি যখন জিন্নাহর ‘পবিত্র স্বদেশ’ রক্ষা এবং কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক সেনাবাহিনীর ভরণপোষণের পক্ষে কথা বলেন তখন কেই-বা তার এরূপ আপত্তিজনক কথার বিরুদ্ধে সোচ্চার না হয়ে পারবে? পাঞ্জাবীরা বাঙালিদের জাতিগতভাবে হীন চোখে দেখে। “দিনের কয়েক ঘণ্টা তারা কাজ করতে পারে, কিন্তু খাঁটি মানুষ কাজ করে সারাদিন,” ইসলামাবাদের এক আমলা একথা বলেন। সুতরাং, বিদ্রোহীরা তিন সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশেও স্বাধীনতা পেয়েছিল এবং কয়েক থাপ্পরেই বিদ্রোহীদের আবার পূর্বাবস্থানে ফিরিয়ে দেয়া হবে।
পাকিস্তানের সর্বত্রই মারাত্মক শক্তিশালী, যদিও ভ্রান্ত, এসব অনুমানের বিস্তার ঘটছে। ইয়াহিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা বস্তুত অক্ষম: পাশ্চিম পাকিস্তানের কেউই নির্বাচনে শেখ মুজিবের নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন প্রত্যাশা করেনি। ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী আত্মগরিমায় পরিপূর্ণভাবে ডুবে গেছে; বন্যার সময় ত্রাণ বিতরণে অদক্ষতার অভিযোগ ইয়াহিয়া যেভাবে অবজ্ঞাভেবে অস্বীকার করেছিলেন, সেটা হয়তো ঠিকই, কিন্তু সাথে সাথে এটাও সত্য যে কার্যকরী পাকিস্তানী ত্রাণ পৌঁছানোর পূর্বেই বৃটিশ ত্রাণ বন্যার্তদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। আর, তিন সপ্তাহ আগেই সামরিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন থাকলেও সেনাবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানে বসে বসে সম্ভাব্য ভারতীয় অগ্রাসনের বিরুদ্ধে কেবল তর্জন-গর্জন করছিল।
রাওয়ালপিন্ডী থেকে সবসময় পূর্ব পাকিস্তানের অবক্ষয় ও দূর্নীতির কথা বলা হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তি সম্পর্কে মুল্যায়নে গলদ ছিল; কারণ এখনও পাকিস্তানের উচ্চ মহলে মনে করা হয়, বাঙালি জীবনে ক্ষণস্থায়ী যে আধুনিকতার আভাস দেখা যায়, পাক-ভারত যুদ্ধের পরে পাশ্চিমী অসন্তোষ কমিয়ে আনতে, তা নিয়ে এসেছেন আইয়ুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদ তিনিই উস্কে দিয়েছিলেন- ঐক্যের প্রতি হুমকি বলে সেটাকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। এর মধ্যে সত্যতাও হয়ত ছিল। মুজিব তার সংঘাতপূর্ণ সাহসী রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েছিলেন এবং এজন্য অলঙ্কারপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করেছেন। তাই, অসহোযোগ আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্ত পর্যন্ত, নির্ভেজাল অর্থে বলতে গেলে, ঢাকা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়নি। শব্দের চাতুর্য্যে সবসময় স্বাধীনতার ঘোষণাকে আড়াল করে রাখা হয়েছে, কারণ শেখ মুজিব ঘোষণা দিতে চাননি। এখন অবশ্য যেকোনো দীর্ঘস্থায়ী সমঝোতা-চেষ্টার নিয়তি নির্ধারিত হয়ে গেছে।
হাজার মাইল ভারতীয় সীমান্তের বাধা অতিক্রম করে সেনাবাহিনী সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে দমায়ে রাখতে পারবে- কেবল নির্বোধরাই এমন ভাবতে পারে। মুজিবের মতো খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বকে কি বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়া করানো যাবে? তিনমাস আগেই পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলেন। ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্ত মূলতঃ অবমুল্যায়ন ও পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাবের ফল। তিনি একজন গুণী রাজনীতিবিদকে নিয়ে খেলতে চেষ্টা করছেন এবং তাকে স্বদেশের জন্য আত্মাৎসর্গ করিয়েছেন। তিনি সতর্কতার সাথে স্বায়ত্বশাসন দেয়ার কৌশলী পদক্ষেপ নিতে গিয়ে সেটাকে একটি বিপ্লবে রূপ দিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু ইয়াহিয়ার এসব পদক্ষেপের পিছনে যে মনোভাব কাজ করেছে তা হাওয়া থেকে পাওয়া নয়। যাবতীয় সুযোগ-সুবিধাসহ যে অভিজাত শ্রেণী বছরের পর বছর মেকী অবাস্তাব জগতে বাস করছে এটা তাদেরই সৃষ্টি। দু'টো ট্রাজেডি ঘটলো: প্রথমত, বন্যা বিধ্বস্ত গাঙ্গেয় বদ্বীপে ইয়াহিয়া যে গতিতে চিকিৎসা সরবরাহ পাঠিয়েছিলেন তার চেয়ে দ্রুতগতিতে চট্টগ্রামে বন্দুকবাজ পাঠিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, করাচীতে একজন নৌ-কমান্ডার আমাকে যা বলেছিল তা আমার মনে উদয় হলো। সে বলেছিল, “দীর্ঘদিন যাবত আমাদের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ ছিল না। এখন আমি আমার পরিপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারব।” গত কয়েকদিনের মধ্যেই হয়ত সে তার পরবর্তী চাকুরী জীবনের জন্য একজন চিহ্নিত ব্যক্তিতে পরিণত হবেন: একজন পূর্বাঞ্চলীয়।
দ্যা গর্ডিয়ান
২৯ মার্চ, ১৯৭১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ২
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৩
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৪
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৫
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৬
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৭
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৮
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৯
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১০
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১২
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১৩
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১৪
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১৫