[মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১২]
অনুবাদ: আ-আল মামুন
ক্রিল ডান
শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে বিশ বছরের অধিক সময় ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে রাজনৈতিকভাবে তার সাম্প্রতিক চূড়ান্ত শীর্ষারোহনে। তবু সবসময়ই তাঁর লক্ষ্য ছিল মাতৃভূমি বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশবাদী আচরণ থেকে ‘মুক্ত’ করা। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আর যা কিছু অভিযোগ আনা গেলেও তাকে রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানী বলা যায় না। বালক বয়সে তিনি কখনও কখনও বৃটিশ রাজের পুলিশ বাহিনীর প্রতি পাথর নিক্ষেপ করেছেন বটে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে বৃটিশ রাজের বিরোধিতাকারী স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন না তিনি। বৃটিশ রাজনৈতিক ইনস্টিটিউশনগুলোকে তিনি প্রশংসা করেন। আভ্যন্তরীণ মুক্তি অর্জনের জন্যই তিন তাঁর বেশিরভাগ প্রচেষ্টা নিবেদিত করেছেন- প্রথমত ভারতের হিন্দু আধিপত্য থেকে মুসলমান স্বার্থরক্ষা করতে, এবং পরে পাকিস্তান আমলে পাঞ্জাবী ও পাঠানী আধিপত্য থেকে পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করার কাজে।
শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার স্থায়ী বাসিন্দা। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় যে অগনিত মুসলমান উদ্বাস্তু ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল শেখ মুজিব তাদের অন্তর্ভুক্ত নন। ঢাকার পশ্চিমে ফরিদপুর জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মধ্যবিত্ত ভূস্বামী পরিবারের সন্তান। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। পশ্চিম বাংলার সাথে এটাই ছিল তার একমাত্র সংযোগ। এসব ১৯৪২ সালের ঘটনা এবং এসময়ই তিনি বিবাহিত ছিলেন।
পাকিস্তান সৃষ্টির এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে মুজিব, জনগণ তাঁকে এই নামেই ডাকে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম শুরু করেন। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র মুজিব রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দূর বিরুদ্ধে এবং বাংলার পক্ষে ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করতে থাকেন। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠন পরবর্তীতে আইয়ুব খান সরকারকে উৎখাত করতে ব্যাপক ও বিধ্বংসী ভূমিকা পালন করে।
এসব কার্যক্রমের জন্য মুজিবকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং প্রথমবারের মতো পাকিস্তানী শাসকদের হাতে তিনি ৬ দিনের জন্য কারাবরণ করেন। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি পূর্ব বাংলার বঞ্চিত শ্রমিকদের স্বার্থে ধর্মঘটের আয়োজন করতে থাকেন। অপরাধমূলক কার্যক্রমের অভিযোগে, যে অপরাধের প্রকৃতি এখনো দুর্বোধ্য, তাঁকে আবার কারাগারে পাঠানো হয়। এবার তাঁর কারাবাস হয় আড়াই বছর। এ সময় বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক সৌভাগ্যের অধিকারী যুক্তবংলার শেষ মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর পাকিস্তানভিত্তিক আধিপত্যবাদী মুসলীম লীগের প্রতি মোহভঙ্গ ঘটে এবং তিনি আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। কারাগারে থাকা অবস্থাতেই শেখ মুজিব এই নতুন রাজনৈতিক দলের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন।
মন্ত্রীত্বের অভিজ্ঞতা তাঁর সীমিত। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে যোগ দেন। ৫৪’র নির্বাচনে বাঙালিরা মুসলিম লীগকে ছুঁড়ে ফেলে। এই সময়কালে তিনি বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন কিন্তু সবসময়ই তিনি ছিলেন দলের একজন দক্ষ সংগঠক। ১৯৫৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত গণজমায়েতের বৃহত্তর শক্তি যুগিয়েছিলেন তিনি। এর তিন বছর পরে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে আনুষ্ঠানিক রেজুলেশন পাশ করার পেছনেও তিনিই কাজ করেন। আর এই গণ-জমায়েত ও রেজুলেশনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য প্রায় পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের যে দাবি করা হয়েছিল, অনুরূপ দাবিই আজ পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার দ্বারপ্রান্তে উপনীত করেছে।
১৯৫৮ সালে ক্ষমতা দখলের সময় থেকেই আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে অন্যতম শত্রু হিসেবে বিবেচনা করেন, তার ভাষ্য অনুযায়ী, মুজির পাকিস্তানের ঐক্যের প্রতি হুমকীস্বরূপ। জন-নিরাপত্তা আইনের আওতায় প্রথম দিকে গ্রেপ্তারকৃতদের অন্যতম ছিলেন শেখ মুজিব। বিনা বিচারে তাঁকে দেড় বছর জেলে আটকে রাখা হয়। ১৯৬২ সালে সোহরাওয়ার্দীর মতো সাহসী দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তিনিও ‘পরবর্তী পাঁচ বছর রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানো যাবে না’ এই মর্মে আইয়ুব খানের কাছে মুচলেকা দিতে অস্বীকৃতি জানান, যদিও পাকিস্তানের অধিকাংশ নেতা তখন পরবর্তী পাঁচ বছর রাজনীতি করবেন না এই মর্মে মুচলেকা দিয়েছিলেন। ফলত, শেখ মুজিবকে আবারও ছয় মাসের জন্য জেলে যেতে হয়।
মুক্তি পেয়ে তিনি অতীতের চেয়ে আরও জোরেশোরে বাংলার মুক্তির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সুকঠিন সামরিক একনায়কতন্ত্রের দ্বারা সন্ত্রস্ত দেশে তিনি বিস্ময়কর সাহসিকতার পরিচয় দেন। পুরো পূর্ব পাকিস্তান ঘুরে ঘুরে তিনি সরকার বিরোধী বক্তৃতা দিতে থাকেন। এতে তিনি ঘন ঘন কারারুদ্ধ হন। কিন্তু বেইলে ছাড়া পেলেই তিনি সরকারবিরোধী বক্তৃতা দিতে থাকেন এবং সম্পূর্ণ বেপরোয়াভাবে বিদেশী পত্রিকার সাংবাদিকদের কাছে পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঔপনিবেশিক ব্যবহার এবং এ থেকে বাংলাকে মুক্ত করার জন্য তার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এসব সময় তাকে খুব স্বতস্ফূর্ত দেখাতো এবং তাঁর বিশ্বাস ছিল যে বৃহত্তর বাঙালি সমাজ তার পক্ষে রয়েছে।
আইয়ুব খান কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে ডিটেনশন থেকে ছাড়া পাওয়ার পরপরই সৈন্যরা তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তাঁকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে পাঁচ মাস নির্জন স্থানে বন্দী করে রাখা হয়। এ সময় সামরিক প্রশাসন ছাড়া আর কেউই জানতো না তাঁকে কোথায় রাখা হয়েছে। তারপর তাঁকেসহ আরও ৩৫ জনকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামী করে বিচারের সম্মখীন করা হয়। অভিযোগ আনা হয় যে, শেখ মুজিবের নের্তৃত্বে তারা ভারতীয় সহায়তা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে দাঙ্গা বাধানোর এবং আইয়ুব খানের সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা করেছিলেন। এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলায় মুজিবের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। এর পূর্ব পর্যন্ত, বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও শেখ মুজিবকে গুরুত্বপূর্ণ নেতা মনে করা হতো না। এই মামলাই তাঁকে বাঙালির জতীয় বীরে পরিণত করে। জঙ্গী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান দাবি হয়ে ওঠে তাঁর মুক্তি। সহিংস ধ্বংসাত্বক ছাত্র আন্দোলনের চাপে এই মামলা প্রত্যাহার করা হয়। এদিকে ১৯৫৬ সালেই শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে তাঁর ছয়-দফা কর্মসূচি প্রদান করেছেন যা ১৯৫৩ সালে ঢাকার গণজমায়েতে প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল- এসব দাবিনামা নিয়েই শেখ মুজিব বর্তমানে আইয়ুব খানের উত্তরসূরী সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানকে মোকাবিলা করছেন।
নাটকীয় অতীত জীবন সত্ত্বেও শেখ মুজিবকে বেপরোয়া বলা যায় না, যদিও বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি তাৎক্ষণিকভাবেই জনগণকে জাগ্রত করে তুলতে পারেন। উইলসন পাইপ মুখে বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় তাকে বৃটিশ লেবার পার্টির নেতাদের চেয়ে কোনো অংশেই বেশী আকর্ষণীয় মনে হয় না। লেবার পার্টির নেতাদের তিনি পছন্দ করেন। স্ট্যালিনের চেহারার সাথে মিল আছে তাঁর। তিনি লম্বা ও সুদর্শন। তিনি পাঁচ সন্তানের জনক। ঢাকার মধ্যবিত্ত এলাকায় তাঁর বাড়ি, সেখানে ধন-সম্পদের প্রাচুর্যের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংঘাতের যদি নিস্পত্তি কখনও ঘটে এবং তিনি যদি সুযোগ পান তাহলে তিনি একজন খাঁটি এবং বুদ্ধিমান রাজনৈতিক নেতা হিসেবেই নিজেকে প্রাকাশ করবেন।
দ্যা অবজারভার
২৮ মার্চ, ১৯৭১
রাশিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারে
দেব মুখাজী
মস্কো, ২৭ মার্চ: সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্রুত অবস্থান পরিবর্তন করে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। যদিও মস্কো তাড়াহুড়ো করে কোনো ভূমিকা নেয়ার প্রস্তাব করছে না, তবু তারা মনে করছে যত দ্রুত সম্ভব বৃহৎ শক্তিগুলো স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধে গণহত্যা কমানো যাবে। বাংলাদেশকে - পূর্ব পাকিস্তান যে নামে নিজেকে পরিচয় দিতে চায় - স্বীকৃতি দিলে তার মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নিতে সুবিধা হবে এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনীর হাত থেকে পূর্ব বাংলাকে রক্ষা করা যাবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বীকৃতি প্রদান কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। প্রথম এবং প্রধান যে বিষয়টি বিবেচ্য তা হলো, বিপ্লবের নেতা শেখ মুজিবের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি যেকোনো অবস্থাতেই পূর্ব বাংলা কর্তৃক পশ্চিম পাকিস্তানকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা। অন্যদিকে, ইয়াহিয়া খান যদি এতো ক্ষতি সাধনের পরও নতুন করে শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেয় তাহলে স্বীকৃতি দানের বিষয়টি বিলম্বিত হতে পারে। এখন অবশ্য ইয়াহিয়া খানের পক্ষে সে ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। অন্যান্য বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর এ-ব্যাপারে গৃহীত রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলোও মস্কো বিবেচনা করবে।
রাশিয়ানরা খুব ভালভাবেই সচেতন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথেই তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ব্যাপকভাবে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু মস্কো পূর্ব বাংলায় নিপীড়ন চালনাকারী পশ্চিম পাকিস্তানের অপরাধের অংশিদার হতে চায় না, বিশেষত বিষয়টি যদি কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থিত হয়। তারা যুক্ত পাকিস্তানের পক্ষে থাকাতেই বেশি আগ্রহী ছিল। কিন্তু অবস্থা পর্যালোচনা করে তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে প্রকৃত অর্থে যুক্ত পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটেছে। দৈব্যবশত এ যাত্রা যদি যুক্ত পাকিস্তান টিকেও যায় তবে তা থাকবে শুধু নামে মাত্র- অস্ত্রের মুখেই কেবল তা টিকে থাকবে।
দ্যা অবজারভার
২৮ মার্চ ১৯৭১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ২
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৩
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৪
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৫
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৬
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৭
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৮
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৯
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১০
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১১