এ্যসাইনমেন্ট বাংলাদেশ ’৭১ নামের প্রায় সাড়ে সাতশত পৃষ্ঠার সংকলনগ্রন্থটি ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রহমান প্রকাশ করেন মমিন পাবলিকেশন্স থেকে। এটি গ্রন্থিত করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা অধ্যাপক মউদুদ এলাহী। প্রফেসর এলাহী ১৯৬৮-’৭২ সাল পর্যন্ত উচ্চশিক্ষার্থে যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। তিনি সেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন এবং ১৯৬৯-’৭২ সালের মধ্যে পশ্চিমা পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশ (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) সংক্রান্ত প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় কলাম, কার্টুন, ছবি ইত্যাদি সংগ্রহ করেন। সেগুলোই এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। যেহেতু এদেশের এবং তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানের যে দু’চারটা মিডিয়া প্রচারের সুযোগ পেত সেগুলো ভীষণ সেন্সরশীপের আওতায় ছিল, যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র সেখানে ছিল একেবারেই অনুপস্থিত। সেহেতু, বাংলাদেশের যন্ত্রণাময় অভ্যুদয়কালের এসব প্রেস-রিপোর্ট ইতিহাসচর্চায় এবং নতুন প্রজন্মের আত্মপরিচয় সন্ধানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এক ধূসর অস্পষ্টতা এখনও ভূতের মতো আমাদের ঘাড়ের ওপর বসে আছে। প্রাধান্যশীল রাজনৈতিক দলগুলোর ‘বিশেষ স্বার্থ’ রক্ষার্থে কিছু তথ্য গোপন করা, কিছু তথ্য অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে ফলাও করে প্রচার করা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তথ্যবিকৃতি এবং একইসাথে ইতিহাসবিদদের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী ও সাবজেক্টিভ মূল্যায়ন আমাদেরকে বিভ্রান্ত আর দিকভ্র্রান্ত করে তোলে। ফলে, মুক্তিযুদ্ধ এক সংকীর্ণ স্বার্থোদ্ধারের হিসেব-নিকেশ মাত্র হয়ে ওঠে। দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের কথা বলে ‘রাজনীতিজীবী’ আর বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ হাহাকার করেন, কিন্তু সেই চেতনা বস্তুটা যে কী তা আদৌ স্পষ্ট হয় না তাদের বক্তব্য আর কর্মকাণ্ড থেকে।
যাহোক, এই গ্রন্থটিতে অক্টোবর ১৯৬৯ সাল থেকে ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালের মধে প্রকাশিত প্রায় সাড়ে তিনশত রিপোর্ট, সম্পাদকীয় নিবন্ধ, কলাম ইত্যাদি কালানুক্রমে গ্রন্থিত করা হয়েছে। ফলে সে সময়ে প্রতিদিনের, প্রতি সপ্তাহের ঘটনাবলী সবরকম খুঁটিনাটিসহ চোখের সামনে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে- যা পাঠককে নিজে থেকেই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্তে আসবার সুযোগ পান। আর, যে যুদ্ধ আমরা বর্তমান প্রজন্ম দেখিনি সেই যুদ্ধের প্রাত্যহিক অস্থিরতা, আবেগ, রক্ত, মৃত্যু ও চেতনার সাথে একধরনের ছদ্ম-আংশগ্রহণও আমাদের ঘটে যায়।
সংকলনগ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পরে, এটি পাঠ করে আমি এতোটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম যে একদিন আমার শিক্ষক প্রফেসর গোলাম রহমানকে প্রস্তাব করেছিলাম এর একটা বাংলা ভাষ্য প্রকাশ করার। তিনি এবং প্রফেসর এলাহী রাজী হয়েছিলেন। এই সংকলনটি তিন ভাগে ভাগ করে একটা ভাগ অনুবাদ করে দিতে সম্মত হয়েছিলাম আমি এবং করে দিয়েছিলাম সেই ২০০১ সালের দিকে। কিন্তু তার পরে এক দশক পার হয়ে গেলেও সংকলনগ্রন্থটির বাংলা ভাষ্য আলোর মুখ দেখেনি। তাই, স্যারের সাথে আলাপ করে আমার অনূদিত অংশটুকু ব্লগে প্রাথমিকভাবে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি যার ভিতরে রয়েছে ২২ মার্চ – ২০ মে ১৯৭১ এবং ৫ সেপ্টেম্বর – ১ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত প্রকাশিত প্রতিবেদন, কলাম ও সম্পাদকীয়। এগুলো প্রতিদিন একটা করে পোস্ট দেয়ার ইচ্ছে আছে আমার, অন্তত এটা নিশ্চত করে বলতে পারি, ক্রমান্বয়ে আমার অনূদিত অংশটুকু পাঠকের সামনে তুলে ধরবো।
আজ ১৪ই ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে এগুলো প্রকাশ করতে শুরু করছি বিশেষভাবে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জন্য তাঁদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে।
গত ৯ ডিসেম্বর আমার ভাই মুক্তিযোদ্ধা আফতাব উদ্দিন হঠাৎ মাঝরাতে স্ট্রোক করে মারা গেলেন। যুদ্ধ শেষে তিনি পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। সারাজীবন আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেশের সেবা করে গেলেন তিনি। মৃত্যুর পরেই তিনি অস্ত্র সমর্পণ করলেন। মৃত ভায়ের গর্বিত মুখের দিকে যুদ্ধ-পরবর্তী আমি তাকিয়ে থাকি আর ভাবি সেই দিনগুলোর কথা: ত্রিপুরায় প্রশিক্ষণ শেষে জুলাই মাসে তিনি দেশে ফিরেছিলেন, কুষ্টিয়ার কুমারখালী অঞ্চলে সক্রিয় ছিলেন। একটা এল.এম.জি ছিল তাঁর সঙ্গী। ১৬ই ডিসেম্বরের পর তিনি বাড়ি ফেরেন। আনন্দে আমাদের ঘরের টিনের চালে একটা গুলি ছুঁড়েছিলেন। ছোটবেলায় সেই গুলিসৃষ্ট গর্ত আমাকে যুদ্ধদিনের কল্পনারাজ্যে নিয়ে যেত, যখন বারান্দায় শুয়ে শুয়ে সেদিকে তাকিয়ে ভাবতাম সেই দিনগুলোর কথা। এই অনুবাদ প্রকাশনা তাঁকেই উৎসর্গ করলাম।
...
রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া পুনরায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেছেন
পিটার হেজেলহার্স্ট
করাচি, মার্চ ২২: দীর্ঘ প্রতিক্ষিত জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন আজ আবার হঠাৎ স্থগিত করা হয়েছে। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং ঢাকায় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানকারী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জাতীয় পরিষদ সংকটের কোনো সমাধান বের করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ ঘটনা দেশটিকে বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গত বছর নির্বাচনের পর এই প্রথমবারের মতো পূর্ববাংলার নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে আলোচনার টেবিলে আনার কিছুক্ষণ পরই একজন সরকারি মুখপাত্র জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বাতিলের ঘোষণা দেন।
ঘণ্টাব্যাপী তৃপক্ষীয় আলোচনার টেবিল থেকে পাকিস্তনের দুই শাখার নেতৃদ্বয় বের হয়ে আসার কিছুক্ষণ পরই প্রেসিডেন্টের বাসভবনে একজন মুখপাত্র ঘোষণা করেন, “দুই শাখার নেতৃদ্বয়ের সাথে আলোচনার মাধ্যমে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার সীমা আরও বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে” প্রেসিডেন্ট অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেছেন। অনুমান করা হচ্ছে, এ সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসবে; এবং প্রেসিডেন্ট ও সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এমন একটা ফর্মুলা বের করতে পারবেন যার সাহায্যে গণভোটে নির্বাচিত নেতাদের নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক কোয়ালিশন সরকার গড়ে তোলা যাবে।
আজ সকালে শেখ মুজিব আরেক দফা আলোচনার জন্য যখন প্রেসিডেন্টের বাসভবনের দিকে যাচ্ছিলেন তখন হাজার হাজার বাঙালি তাদের নেতাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে উৎসাহ জোগায়। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিসত্মানী নেতা ভুট্টো যখন ব্যাপক সামরিক প্রহরায় প্রেসিডেন্টের বাসভবনে যাচ্ছিলেন তখন ঢাকায় তার রাস্তার পাশে দাঁড়ানো জনতা কালো ব্যাচ ধারণ করে ছিল এবং ভুট্টো-বিরোধী শ্লোগান দিচ্ছিল। সকালে আলোচনা থেকে ফিরে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের সাথে মিলিত হয়েছেন। তিনি প্রেসিডেন্টের অধিবেশন স্থগিতাদেশের প্রেক্ষিতে ভবিষ্যত সাংবিধানিক আলোচনার পূর্বশর্ত হিসেবে সামরিক শাসন উঠিয়ে নেয়ার দাবি করেছেন। তিনি বলেন, “আমি সুস্পষ্টভাবে বলেছি যে আমাদের চারটি দাবি না মানা পর্যন্ত আমি অধিবেশনে বসবো না।” কিছুটা আশার বানী শুনিয়ে শেখ সাহেব বলেন, ‘যদি কোনো অগ্রগতিই না হবে তাহলে আমি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি কেন? সপ্তম দফা আলোচনার জন্য তিনি আগামী কাল অথবা আগামী বুধবার আবার প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করবেন।
ব্যাপক নৈরাশ্য ও অনিশ্চয়তার পরিবেশে পাকিস্তান আগামীকাল ১৫তম প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করতে যাচ্ছে। যেকারো পক্ষেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান দূরত্ব চিহ্নিত করতে পারা সম্ভব। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিরা লাহোর রেজুল্যুশনের ৩১তম বাষির্কী পালনের পরিকল্পনা করছে। এই রেজুল্যুশনে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রগুলো নিয়ে ফেডারেল পাকিস্তান গঠনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানীরা প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করছে, যা দেশটিকে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের আওতায় নিয়ে এসেছে।
এই প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে ৭ কোটি বাঙালির উদ্দেশ্যে এক বার্তায় শেখ মুজিব সুনির্দিষ্টভাবে লাহোর রেজুল্যুশনের কথা উলেস্নখ করে তার সমর্থকদের বলেছেন, “মুক্তির সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।” আমাদের উদ্দেশ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা, সুতরাং বিজয় আমাদের পক্ষেই। তিনি বলেন, “আমাদের জনগণকে আর রাইফেল, গুলি, বেয়নেট দিয়ে দমিয়ে রাখা যাবে না। বাংলাদেশের প্রতিটি বাড়িকে এক একটা শক্তিশালী দূর্গে পরিণত করা হবে।”
একই সময়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্যে তার বার্ষিক ভাষণ সম্প্রচার করেন। তিনি বলেন, “কোনো সন্দেহ নেই যে বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে আমরা সফল হব। গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের যন্ত্রণাময় যাত্রাপথে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় উদ্ভুত হয়েছে। কিছুই হারায় না, যদি আমরা আমাদের নিয়তিতে আস্থা না হারায়।” প্রেসিডেন্ট সকল প্রদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে এখন ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এই নেতৃবৃন্দ এমন একটি ফর্মূলা বের করবে যার আওতায় দুই শাখার বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা শেখ মুজিব তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করবেন।
আওয়ামী লীগের একজন সংবিধান বিষয়ক উপদেষ্টা বিখ্যাত আইনজীবী এম. এ. ব্রোহী আজ করাচি এসে পৌঁচেছেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ঢাকাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের তিন দফা ফর্মূলা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
ঢাকা, মার্চ ২২: শেখ মুজিবের মারমুখী সমর্থকদের কাছে আগামীকাল প্রজাতন্ত্রের ১৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী প্রতিরোধ দিবস হিসেবে গণ্য হবে। ঢাকাতে তারা প্রতিটি বাড়িতে নতুন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের আহ্বান জানাচ্ছে। ভুট্টোর প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণার প্রকাশ গতরাতে দেখা গেছে। ভূট্টো তার হোটেলের একটা লিফটে আটকে গেলে ক্রুদ্ধ জনতা ছুটে আসে। তাদের প্লাকার্ডে লেখা ছিল ‘ভুট্টো রাজনৈতিক জারজ’। অটোমেটিক রাইফেল হাতে সেনাবাহিনী রাজধানীর পথে পথে হাঁটছে।
দ্য টাইমস
২৩ মার্চ, ১৯৭১