জুন ২৬ '০৯
জীবনের মুহূর্তগুলো কেমন জড়াজড়ি করে থাকে। এঁদের আমাদের মতো একা থেকে অভ্যাস নেই। একজনের হাতে টান পড়লেই স্মৃতির এঁদো ডোবায় আশ-পাশ থেকে ভুসস্ করে মাথা তোলে আরো কয়েকজন। অর্থহীন নষ্ট লজিকগুলোর ভারে মানুষ হঠাৎ নস্টালজিক হয়। কাঁদে-হাসে... এলোমেলো হয়... বিমূর্ত হয়।
এখনের শুক্রবারের সকালগুলা মানেই শান্তি; একটা এলো-মেলো আরাম। নিয়ম মেনে প্রতিদিনের দৌড়াদৌড়ি নেই, মা'র ঝাড়ি নেই। বেশ একটা অলস মেটে-আলো মাখা আদুরে সকাল। ঘুম থেকে উঠে নিজেকে প্রায় টেনে টেনে পিসির কাছে নিয়ে ওর সবুজ চোখে চোখ রেখে ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে চা নিয়ে বসলাম। এম.এস.এন. টুডে-তে চোখ বুলাতে গিয়ে হাতের চা ছল্কে ফেলে দিলাম। মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যুটা অবাক লাগলো কারন কিছু মানুষের মৃত্যুচিন্তা ভাবনার সীমানায় আসে না। তারা তাদের কাজকর্মে নিজেদের এমনভাবে রোপন করেন যে তাদের অন্তর্ধানটা "হঠাৎ" মনে হয়। সত্যি বলতে কি, এম.জে. আমার ততোটা প্রিয় কেউ না যার গান আমি সকাল-সন্ধ্যা শুনি। তার কয়েকটা গান খুব বিচিত্র কারনে আমার ভয়াবহ অ্যালার্জির কারন। আর ২০০৪-এর পর থেকে আমি তার একটা গান-ও শুনি না বা কাউকে শুনতেও দেই না। এম.জে.-র সেক্সুয়াল স্ক্যান্ডাল বা অন্যান্য কোনোকিছুই ততোটা তাড়িত হই না, কিন্তু এই নামটা শুনলেই আমার ভেতর থেকে অসহ্য কিছু বুদ্বুদ ফাটার আওয়াজ শুনতে বাধ্য হই।
এম.জে.-র সবচে' বড় ভক্তকে এতোটা জীবন্ত আর এতোটাই পাগল-পাগল দেখতাম যে তখন এম.জে.-কে খুব বিশেষ কেউ একজন মনে হতো! দাদুর এম.জে.-কে দেখে একদম বাচ্চাদের মতো লাফালাফি করাটা দেখতাম, তাঁর মুগ্ধ চোখটায় ওর ঐ তিড়িং-বিড়িং নাচের প্রতিফলন দেখতাম, পাগলা গানগুলো শুনে মাথা দুলানোতে বাচ্চাদের মতোন সরলতা পেতাম। দাদু ওকে দেখতো। আর আমরা দাদুকে দেখতাম। এম.জে. নামটার অর্থ আমার কাছে সেজন্যই "আমার দাদু" আর তার সাথে কাটানো কিছু অপার্থিব-এলোমেলো মুহুর্ত।
দাদুর শেষের দিকের কিছু কথা বলেছিলাম এখানে...
একদিন দাদুকে দেখলাম তড়ি-ঘড়ি নামাজ পড়ছে; এতো আগে তো পড়ে না! আমি অবাক - "অ্যাই! কি হলো আজকে? এতো তাড়াতাড়ি নামাজ পড়ো যে?"
- শশশ্
- বলো না!
- আরে আজকে জ্যাকসনের কনসার্ট! পেপারে দাগ দিয়ে রাখ্সি দেখিশ নাই! ... দাদু মহাবিরক্ত!... "অ্যাই শুন, আবার তোর বাবাকে বলিস না; ভাববে... বুড়ির মন নামাজের চে' কনসার্টে বেশি!"
- এহ! মনে হয় জানে না তোমাকে!
- ধুর! যা না! নামাজটা পড়তে দিবি না ?
আমি আর জ্বালাই না! থাক, বেচারী পড়ুক নামাজ। পেপারে নীলকালির গোল বলগুলা চোখ এড়ালো না কিন্তু আমার। কনসার্ট, চ্যানেল আর সময়ের উপর তিনটা বল বানানো! মুচকি হেসে ফিসফিসিয়ে বাবাকে দেখাই নীল বলগুলা। বাবা বলে, "আম্মাকে ভিডিওগুলার একটা সেট বানায় দিবো ভাবতেসি। দেখি পাওয়া যায় কিনা!"
বৃহস্পতির সন্ধ্যাগুলা দাদুর জন্যই বেশ উৎসব-উৎসব হয়ে যেতো। কেউ পড়বে না, সবাই সন্ধ্যায় একসাথে হবে। আমার চাচার বাসা থেকেও ভাই-বোনরা চলে আসতো। আমাদের বাসায় ছোট-খাট হাট বসে যেত। বাবা-মা-ও দেখা যেতো যোগ দিতো। দাদু আইসক্রিম-স্ন্যাক্স এনে রাখতো; তাই খাওয়া-দাওয়া, নানা ধরনের খেলা, ম্যুভি বা গান... কিছু না কিছু একটা হচ্ছেই। গান খুব পছন্দ ছিল দাদুর। সব ধরনের গান শুনতো। আর কিছু গায়কের উপর ছিল অদ্ভুত টান। গানের খেলায় যে জ্যাকসনের গান সুন্দর করে গাইতে পারতো সে কিছু না কিছু গিফ্ট পাবেই দাদুর থেকে। আমি আর আমার বোন দাদুর প্রিয় "Heal The World", "Human Nature","Black Or White" বা "Beat It" মুখস্থ করে ফেললাম। দাদুর কি খুশি! আমাদের কোরাস গান রেকর্ড করা হলো। এরপর থেকে দাদু চোখ বন্ধ করে , মাথা দুলিয়ে শুনতো সেসব। দাদুর উৎসাহের চোটে আমরা "Heal The World" গানটা অনুবাদ করে আমাদের এস.এস.সি. র্যাগে গেয়েও ফেললাম। সবার বিশাল প্রশংসা পেয়েছিলাম সেবার!
দাদুর অসুস্থতার সময়টায় তাঁর কিচ্ছু ভাল লাগতো না। আমি অক্সিজেন মাস্ক দেয়া, প্রেশার দেখা বা নেবুলাইজ (শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বস্তির জন্য শ্বাসনালীটা প্রশস্ত করার একটা প্রক্রিয়া) করার দায়িত্বটা পালন করতাম। বাবা দেখিয়ে দেয়ার পর বেশ ভালভাবে করতে পারতাম, আর দাদু-ও আমার উপর অনেক নির্ভর করতো। সে সময়টায় দাদুর কিচ্ছু ভাল লাগতো না। আমি দেখতাম, প্রচন্ড প্রানশক্তিতে ভরা একজন মানুষকে আষ্টে-পৃষ্টে শাসন করছে একটা দানব। দাদুর শুয়ে-বসে থাকার অভ্যাস খুব কম ছিল। আমি সারাক্ষণ-ই প্রায় এখানে-ওখানে হেলান দিয়ে বসে থাকতাম তাঁর কাছাকাছি। "দাদু গান শুনবা? গাই? ভিডিও দেই জ্যাকসনের? বলো তো কি করলে তোমার ভাল লাগবে? ডাকবো সবাইকে? চলো সবাই মিলে "থ্রিলার" দেখি ?" দাদু হালকা করে বলতো... "তুই আমার সাথে থাক্ তো পিচ্চি-ডাক্তার! তাহলেই আমি ভাল হয়ে যাবো দেখবি। আমাকে ভাল করে দে তো! চেহারাটা ঠিক কর না! মুখ ভোঁতা ডাক্তার দেখলে তো রোগী আরো অসুখী হয়ে যাবে!" আমি দাদুর গায়ে নাক ডুবিয়ে বসে থাকতাম, হাসতাম, তাঁর প্রিয় জ্যাকসনের গান গেয়ে শুনাতাম। দাদু তাঁর ভেতরে সদ্য হওয়া অপারেশনের অসহ্য কষ্ট অগ্রাহ্য করে স্বর্গীয় শান্তি নিয়ে হেসে উঠতো। দাদু কিভাবে ঐ থেমে যাওয়া হৃৎপিণ্ডটা দিয়ে এতো ভালবেসেছিল জ্যাকসনকে!
২০০৪-এর পর দাদুর প্রিয় গানগুলোকে আমি নিজের হাতে নিশ্চিনহ্ন করেছি। আমাদের রেকর্ড করা গানটাও নষ্ট করেছি। কোনদিক থেকে এমন কিছু রাখি নি, যেটা আমাকে আমার প্রচন্ড প্রিয় মানুষটা বা তাঁর গায়ের তীব্র মিষ্টি গন্ধটা মনে করিয়ে দেয়। যখন-ই আমার মনে হয় মানুষটা আমার সাথে নেই, সাথে সাথে একটা ভয়াবহ এ্যাবসার্ড একটা অনুভূতি হয়! যে মানুষগুলো জীবন ছড়িয়ে দিতে পারে বাকিদের ভেতর, তাঁর মতো ক্ষমতা খুব কম মানুষের-ই আছে। এঁরা কেন হারিয়ে যাবে! তাঁর স্মৃতি এতোটাই তীব্র যে আজকেও বাসার প্রতিটা কোণে আমি তাঁর ছায়া পাই, তাঁর হাসিটা পাই... শুধু তাঁকেই কেন পাই না!
আজকে রাতে তাই জ্যাকসনের গানগুলো দেখে আমি বা আমার বাবা নিজেদের অজান্তেই ফুঁপিয়ে উঠলাম। আমি উঠে গিয়ে টিভি বন্ধ করে প্রচন্ড রাগ নিয়ে ঘরে এসে দরজা আটকে দিলাম। ঐ সুরগুলো খুব ভেতরের একটা সম্পূর্ণ খালি জায়গায় প্রতিফলিত হয়ে হয়ে ফিরে আসছিল। যে জায়গাটা ভরে দেবার মানুষটা আমাদের চমকে দিয়ে হারিয়ে গেছে। আজকে সারা পৃথিবীর কাছে বিস্ময় যে মাইকেল জ্যাকসন নেই। আর আমাদের কাছে তাঁর চলে যাওয়ার প্রায় পাঁচ বছর পরেও বিশাল বিস্ময় যে তিনি কীভাবে নেই! এতোটা উচ্ছল মানুষ হারিয়ে যায় কি করে! আজকে আমরা জানতাম আমরা কেন কাঁদছি, কার জন্য কাঁদছি। ঘরে এসে দাদুর একটা শাড়ি বের করে অনেকদিন পর ওটায় নাক ডুবাই... সেই গন্ধটা একটুও বদলায় নি এতোদিনে! চোখ বন্ধ করে মনে হলো দাদু বলছে..."আমাকে ভাল করে দে তো! চেহারাটা ঠিক কর না! মুখ ভোঁতা ডাক্তার দেখলে তো রোগী আরো অসুখী হয়ে যাবে!"
সময়ের মোমগায়ে তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে কিছু হতচ্ছাড়া মুহূর্তের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ...
||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ছবি কৃতজ্ঞতা : ফারহাদ ভাই - যার তোলা ছবিগুলো দেখলে আমার ভেতর থেকে প্রতিবার একটা উপলব্ধি ফিরে আসে যে "আমার দেশটা কত্তো সুন্দর!!!"
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১২ দুপুর ১২:২০