আমাদের জীবনে উল্লেখযোগ্য কোন ভ্রমণ নেই। অবশ্য আমরা ভ্রমণ করতেও চাইনা। পুরোটা জীবন পায়ের উপর পা তুলে নির্ঝঞ্ঝাট যাপন করাটাই যেন আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। আমাদের কাছে পৃথিবী যেন নব্বই মিনিটের ফুটবল মাঠ। প্রবেশ করলাম, পাঁচ টাকার মুড়ি কিনলাম, মুড়ি চিবুতে চিবুতে বার দুয়েক হাত তালি দিলাম, খেলা শেষে জয় পরাজয় নিয়ে চার পঙক্তি উত্তেজনা বিনিময় করতে করতে বাড়ি ফিরলাম।
একজন আপাদমস্তক তথাকথিত জীবন বিমুখ মানুষকে কাছ থেকে দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। ভ্রমণ সম্পর্কে কোন প্রকার ধারণা ধারণ না করেই পুরোটা জীবন ভ্রমণ করেই কাটিয়েছেন যিনি। প্রথম দেখাতেই তিনি আমাকে একটা উদ্ভট প্রশ্ন করেছিলেন এবং সে প্রশ্নটাই সম্ভবত আমাকেও অচিরেই একজন জীবন বিমুখ মানুষ হিসেবে রূপান্তরিত করবে অথবা করে ফেলেছে এতদিনে।
প্রশ্নটা ছিল, 'আমি যদি তোমাকে অমরত্ব দেই, বাকী জীবনটা তুমি কিভাবে পার করবে?'
আমি কোন কিছু না ভেবেই উত্তর দিলাম,
-কেন? এখন যেভাবে পার করছি!
-এখন কিভাবে পারছো?
-এইতো খেয়ে-না খেয়ে, সঙ্গমে, ঘুমে।
-কাকে খাওয়াচ্ছো? কার সাথে সঙ্গম করছো? কোথায় ঘুমাচ্ছো?
-আমাকে, স্ত্রীর সাথে, খাঁটে।
-দেহটা তুমি নও। আর আমি শুধু তোমাকেই অমরত্ব্ব দেব। আর তোমার স্ত্রী কিংবা পৃথিবীর এক বিন্দু ধূলিকণাও বাঁচিয়ে রাখবোনা। এবার বলো তুমি কিভাবে বাকীটা জীবন পার করবে?
-আমি অমরত্ব চাইনা।
আমার এই কথায় উচ্চস্বরে হেঁসে উঠলেন তিনি। বললেন,
-তুমি অমরত্ব এড়াতে পারবে না কিছুতেই। তোমার জন্মই তোমাকে অমরত্বের নিকট পৌঁছে দেবে।
-আপনি মিথ্যে বলছেন। সত্য এটা যে, প্রত্যেক প্রাণীই একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে। তাহলে আমি কিভাবে অমরত্ব এড়াতে পারবোনা?
এবার মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন তিনি,
-মৃত্যু অমরত্ব নয় তোমায় কে বললো?
২)
সে রাতে ভালো ঘুম হলোনা। উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখতে দেখতে রাত কাটলো। একবার মনে হলো আমি একটা ধূসর কাক হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছি আর শত শত মানুষ লাশ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক, দিকবিদিক। একবার মনে হলো আমি মরে গেছি। অসীম শূণ্যতা চেপে ধরেছে আমায়। আমি এখন কি করবো? এর থেকে পরিত্রাণ কোথায়? আরেকবার মনে হলো মুখ ধুবড়ে পড়ে আছি ধূলোয়। উঠে দাঁড়াবার তাড়া নেই। পড়ে থাকার ধৈর্যও নেই। বড্ড নিস্পৃহ জীবন পার করে চলেছি।
খুব ভোরেই আমি তার তাবুতে চলে গেলাম। তিনি চলে যাওয়ার আগে একটা প্রশ্নের উত্তর আমাকে পেতেই হবে। তিনি তাবু গুটিয়ে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত এমন সময় আমি উপস্থিত হলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
-তাহলে বাকী জীবনটা আমি কিভাবে পার করবো?
-যাপন পাল্টাও। পাল্টাতেই থাকো। অমরত্বে তোমার ভয় নেই। তোমার ভয় যাপনে, তোমার ভয় একঘেমেয়িতে। কিভাবে, কি করে যাপন করবে সেটা জেনে নিয়ে সেই অভ্যেস তৈরী করো যত পারো। যখন চোখের পলকে দুই আঙ্গুল এক করে এক জীবন থেকে আরেক জীবনে প্রবেশ করতে পারবে তখনই তুমি সফল, অমরত্বে আর কোন ভয় নেই।
৩)
অবশেষে আমি জেনেছি যাপন পাল্টানোটাই হলো ভ্রমণ। এই মূহুর্তে আমি একটা লেবু গাছের জীবনে ঢুকে পড়েছি। জীবনকে যাপন করছি লেবু গাছের মত করে।
স্নিগ্ধ সবুজ হাওয়ায় দুলে বেড়াচ্ছি হেলেদুলে। একঘেয়েমি চলে আসলে আরেকটা জীবনে ঢুকে যাবো চোখের পলকে। আর নিমিষেই পালটে যাবে যাপন!
ছবি: (ইন্টারনেট)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ সকাল ১১:৪০