১)
মানব জন্ম নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ ছিলনা। সঞ্জিবের ছিল। সঞ্জিব রায় আমার শৈশবের একমাত্র বন্ধু যাকে পেয়েছিলাম কোন এক দুপুর বেলা আমাদের বাড়ির বড় আম গাছটাতে। চিৎকার করে মাকে ডাকতে যাবো এমন সময় তার চোখে আমার চোখ আটকে গেল। সেই চোখে কি ছিল বলতে পারিনা তবে আমি থেমে গেলাম আর সে দ্রæত নেমে এলো গাছ থেকে। গাছ থেকে নেমেই সে দৌড়াতে শুরু করলো। কোন কিছু না ভেবে আমিও তার পিছু নিলাম। কিছুদুর দৌড়ানোর পর আমরা নিজেদের আবিষ্কার করলাম কালীগঙ্গার তীরে, হাপাচ্ছি।
-কি ভাবছিস?
সে এই বলে শুরু করেছিল সেদিন।
-তোদের আম গাছ নেই?
আমি জিজ্ঞেস করি।
-আছে। পৃথিবীর সমস্ত আম গাছ, লিচু গাছই আমার। ওই দেখ!
সে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে নদীর ওপারের একটা আম বাগানের দিকে নির্দেশ করলো।
-ওইটাও আমার!
-তাহলে লুকিয়ে লুকিয়ে নিচ্ছিল কেন?
-আমার এভাবেই ভাল লাগে। কেমন এক রোমাঞ্চ লাগে! চল ওপারের ওই বাগান টা থেকে ঢু মেরে আসি। যাবি?
-না। মা বকবে।
-আরে মায়েদের কাজই হচ্ছে বকবে, আবার আদর করবে।
এই বলে সে নদীতে ঝাঁপিয়ে পরে। আমিও মোহাচ্ছন্নের মত তার পিছু নেই।
এভাবেই সঞ্জিব রায় আমার বন্ধু হয়ে গেল। আমরা সুযোগ পেলেই নদীর পাড়টাতে গিয়ে বসতাম দুইজন। জলের ঢেউ দেখতাম। পানিকৌড়, বেলে হাঁসের ডুবোডুবি দেখতাম। কাঁশবন দেখতাম। ঝিনুকের পেট খুলে মুক্তো খুঁজে দেখতাম। বেলে মাটির ভেজা গন্ধ আমাদের নাকে লাগত। জেলেরা জাল শুকাতে দিতে সেখানে। জালের ফুটোয় চোখ রেখে আকাশকে গোল করে দেখতাম। আরো কতকিছুই দেখতাম অথবা কতকিছুই দেখিনি আমরা সেদিন!
আমরা মেয়েদেরও দেখতাম। ওরা ঘন্টার পর ঘন্টা কি অদ্ভুত ধৈর্য নিয়ে গায়ে সাবান মাখতো! ভেজা কাপড়ে তারা যখন হেঁটে ফিরত কলসী কাঁখে আমাদের চোখ ঢুকে যেত তাদের পেছনে, বুকে। একটা শিরশিরে ভাব অনুভূত হতো শরীরে। আমি জানতাম না ওতে পাপ হয় কিনা।
-এই আমাদের পাপ হবে না?
সঞ্জিবকে জিজ্ঞেস করি।
-কেন?
-এই যে লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েদের দেখছি, খারাপ চিন্তা করছি।
-পাপ বলে কিছু হয়না। আমি পাপ-পূণ্যে বিশ্বাস করিনা।
সঞ্জিবের কন্ঠ হঠাৎ গাম্ভীর্যপূর্ণ হয়ে যায়। সে বলতে থাকে।
-বলতে পারিস? কোন পাপে আমার বাবা নেই! আমার দিদি বেশ্যা? আমার মা অন্ধ? আর কোন পূণ্যে আমাকে এই বয়সে দুমুঠো ভাতের জন্য সারাদিন কাঠমিস্ত্রির কাজ করতে হয়?
কোন পূণ্যে আমি জন্ম নিয়েছি বল? আমাকে জিজ্ঞেস করে জন্ম দেয়া হয়েছে? কেউ কি জানতে চেয়েছে আমি এইসব পাপ পূণ্যের ধকল সইতে পারব কিনা? আমার এসব ভাল লাগে কিনা?
আমার এগুলো ভাল লাগে না রিদু। আমার খেলতে ভাল লাগে, আমার উড়তে ভালো লাগে। আমার গাছ দেখতে ভাল লাগে। আমার পুকুর দেখতে ভাল লাগে। আমার পালাতে ভাল লাগে। তাই তো পালাই। দেখিস একদিন এমন কোথাও পালিয়ে যাবো কেউ আর আমাকে খুঁজে পাবেনা কোনদিন।
২)
সেদিনের পর থেকে সঞ্জিব কেমন যেন গাছেদের মত চুপচাপ হয়ে যায়। আগের মত আমাদের আর দেখা হয়না। একসময় আমাদের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল। ওদের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারি, কাউকে না বলে কোথায় যেন চলে গ্যাছে। সেই প্রথম বার আমার ভেতরে একটা দুঃখ আর অভিমানের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। তুই আমাকেও বলে গেলি না?
এভাবে আমার শৈশব পেরিয়ে গেল। সঞ্জিবের সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হয়নি। আমি শহরে পড়তে এলাম। পড়াশোনা শেষে ভাল একটা চাকরি পেলাম। একটা বিয়েও করলাম। দুটো বাচ্চা হলো। চাকুরী, বউ, বাচ্চা, পরিবার নিয়ে লুডো খেলতে খেলতে বয়স বার্ধক্যে এসে ঠেকল। একসময় মরেও গেলাম।
মানব জন্ম নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ ছিলনা। সঞ্জিবের ছিল। তাইতো সে ভর দুপুরে পেরেছিল ঘর ছেড়ে পালাতে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০৫