প্রিয় আরিয়ান ওরফে হাতুড়ে লেখক,
তুমি কবে থেকে ফেসবুকে আরিয়ান রিয়াদ হলে? ব্লগের হাতুড়ে লেখক নামটাই ভালো ছিলো। আরিয়ান রিয়াদ নামের মধ্যে স্যাভেজ ভাবটা নাই। কিন্তু তুমি তো স্যাভেজ! আমি নিজেও অবশ্য স্যাভেজ। এই কারণে একদিন সকালবেলা যখন তোমাকে ফোন করে নাম বলার পরেও চিনতে পারো নাই তখন কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ব্লগেও কমেন্ট করি নাই। যদিও তুমি তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলে, তারপরেও অজুহাত শোনার অপবাদ নিতে চাইছিলাম না। এর মাঝেই দেখলাম তোমার বই ‘অপার্থিব’ আসছে বইমেলায়। সেটা দেখে ভাবলাম, নাহ এই বই সম্পর্কে দু কথা বলার জন্যে হলেও কোনো এক শুভক্ষণ দেখে মিলমিশ করে নেয়া উচিত।
অপার্থিব যদিও ছোট্ট একটি গল্পগ্রন্থ (মাত্র ৮০ পৃষ্ঠা) কিন্তু এতে গল্পের সংখ্যা ৪৯টি! কোনো গল্পই দুই পৃষ্ঠার বেশি না। এগুলোকে কি অণুগল্প বলবো, না ছোটগল্প, নাকি ফ্ল্যাশ ফিকশন? আমার আবার এসব খুব গুলিয়ে যায়। পড়ার আনন্দটাই মুখ্য হওয়া উচিত, যা পড়ছি তা সাহিত্যের কোন ধারায় পড়ে এসব নিয়ে গবেষণা পরে করলেও চলবে, কী বলো?
৪৯টি গল্প নিয়ে আলোচনা করা কঠিন। তবে উপস্থাপনার ভঙ্গি এবং থিম ভেদে গল্পগুলিকে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়।
১) বিদেশী গল্পের অনুবাদের মত করে লেখা কাহিনী-
তোমার বইয়ের প্রথমদিকের কিছু গল্প আছে এরকম। এসব গল্পের নামগুলো থাকে বিদেশী। যেমন আর্থার হোপে, মিকাশো, ইত্যাদি। তারা একে অপরকে সিনর বলে সম্বোধন করে। এগুলোর ভাষা বেশ গুরুগম্ভীর। পরিস্থিতি গুমোট। প্লট সাইকোলজিকাল হরর বা ক্লাসিক ডার্ক। সংলাপেও যথেষ্ট নাটকীয়তা আছে। এমন গল্পের সংখ্যা অবশ্য কম। ব্লগে যখন প্রথমদিকে তোমার লেখা পড়তাম, তখন এমন লেখা পাই নি। বই বের করার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে থেকে এমন ধরনের কিছু লেখা লিখেছো। কেন বলো তো? খুব বেশি অনুবাদ গল্প/উপন্যাস পড়ছিলে না কি সেসময়? এই গল্পগুলো আমার কাছে খুব একটু আকর্ষণীয় লাগে নি। এগুলোতে নিজস্বতা নেই। থাকলেও তা ধার করা। কিছু কিছু গল্পে আবার কলকাতার ভাষারীতি এবং নাম ব্যবহার করেছো। ব্যাপারটা বেশ বিরক্তিকর।
২) দেশী পটভূমিকার ডার্ক-হিউমারাস গল্প-
তোমার লেখার আসল সৌন্দর্য এখানেই পাই। এটাই তোমার মূল ধারা। আমি ব্লগে তোমার এরকম গল্পগুলি পড়েই অনুসরণে নিয়েছিলাম। এই গল্পগুলিতে মূল চরিত্রের নামগুলো থাকে বেশ অদ্ভুত এবং হাস্যরসাত্মক। যেমন চিক্কুর আলি, টগর মিয়া, রিলি বানু, হারু মিয়া, কসরত মিয়া ইত্যাদি। প্রতিটি গল্পই শুরু হয় হিউমার দিয়ে আর শেষ হয় ভয়, নিষ্ঠুরতা, ট্রাজেডি ইত্যাদির মাধ্যমে। মোটামুটি একইরকম ফরম্যাট। এই গল্পগুলি টানা পড়ে গেলে অনেকটাই প্রেডিকটেবল মনে হতে পারে সমাপ্তি। গল্পগুলির মূল শক্তি হলো এর অদ্ভুত রকম আনকোরা হিউমার। যা অন্য কারো সাথে মিলবে না।
একটা গল্পের উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। গল্পটার নাম হলো ‘বউ’। মতি মিয়া বাজার থেকে লাউ কিনে এনে বউকে দেয় সেটা রোদে শুকানোর জন্যে। জিজ্ঞেস করে সে লাউয়ের বৈজ্ঞানিক নাম জানে কি না। বউ উত্তর দিতে পারে নি যথারীতি। তখন তাকে কিছু বয়ান শুনিয়ে দিলো সে। এতে বউ বিরক্ত হয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবার হুমকি দেয়। মতি মিয়া তখন তাকে বলে যে সে বাপের বাড়ি গেলে তার কোনো আপত্তি নেই, তবে লাউটা যেন দিয়ে যায়। পরের অনুচ্ছেদে দেখতে পাই লোকটি একতারা বাজিয়ে গান গাচ্ছে “আমার একটা বউ ছিলো জানলো না তো কেউ”। এ ঘটনা দেখে আবার পুলিশের সন্দেহ হয়। তখন তারা তাকে গ্রেপ্তার করতে চায় স্ত্রী হত্যার অপরাধে। জবাবে লোকটি আত্মপক্ষ সমর্থন করে এই বলে যে সে বউয়ের চামড়া কেটে একতারা বানানোর ফলে বউ মারা গেছে, এতে তার কী দোষ! এক মাস পরে সে আবার মুক্তি পেয়ে যায়। কারণ...
এই গল্পটায় যে এ্যাবসার্ডিটি, ডার্ক কমেডি এবং পাজল আছে, তার সমাধান করা বেশ দুরূহ ব্যাপার বটে! মতি মিয়ার কাছে বউ বেশি গুরুত্বপূর্ণ, না কি লাউ, না কি দুটোই সমার্থক? মতি মিয়ার বউয়ের চলে যাওয়া, এবং সেটাকে সমাজ এবং আইন কর্তৃক গ্রহণযোগ্যতা দেয়া অথবা না দেয়া, অথবা আসল ঘটনার থৈ না পাওয়া, এগুলো কি আমাদের পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগহীনতার নির্দেশক না? এত ভারী ভারী কথা থাক। আমার কাছে গল্পটি ভালো লাগার একটি কারণ জানতে চাইলে আমি বলবো লাউ এবং বউ বিষয়ক বিতন্ডার পর “আমার একটি বউ ছিলো জানলো না কেউ” গান গাওয়া এবং পুলিশের জিজ্ঞাসার মুখে নিজের আত্মপক্ষ সমর্থন করে অদ্ভুত ধরণের অজুহাত দেয়া। ব্ল্যাক কমেডি সাহিত্যের খুবই সম্ভাবনাময় একটা ধারা। বাংলা সাহিত্যে অনেকটা অচ্ছ্যুত বলা যায় এখনও, তবে এর রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। তোমার সামনে একদম খোলা মাঠ, ড্রিবলিং করে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে! তবে গোল দিতে হলে কিন্তু আরো কলাকৌশল রপ্ত করতে হবে!
এক্ষেত্রে তোমার যে সমস্যাটি আমার প্রকট মনে হয়েছে, তা হলো বৈচিত্রের অভাব। প্রায় প্রতিটি গল্পেই একটি হারু মিয়া বা নারু মিয়া নামক চরিত্র থাকবে, যার একটি বউ/বাপ/ছেলে থাকবে, কারো সাথে তার ঝগড়া হবে, এরপর কোনো একটা ভায়োলেন্স। খুন বা আত্মহত্যা, বা অতিপ্রাকৃত কোন ঘটনা। নিজের স্বত্বার সাথে বিরোধ, নিজের সাথে কথা বলা, আয়নায় নিজেকে দেখা অথবা অন্য কোন রূপে নিজেকে দেখা, এরকম আত্মদ্বন্দ্ব প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। মাঝে মাঝে বেশ একঘেয়ে এবং ক্লান্তিকর লাগে।
৩) প্যারাবল-
এই ধারার গল্পের সংখ্যা সবচেয়ে কম তোমার বইয়ে। প্যারাবল লেখা খুবই রিস্কি একটা কাজ। কাফকা এবং জিবরান প্যারাবলকে এমন একটা মাত্রায় নিয়ে গেছেন যে এই শাখায় কাজ করে নতুন বেঞ্চমার্ক তৈরি করা খুবই কঠিন। প্যারাবল ব্যাপারটা অনেকের কাছেই বেশ সেকেল এবং অনাকর্ষণীয় লাগতে পারে। কিন্তু এর ক্লাসিক আবেদনটা থেকেই যাবে বলে আমি মনে করি। প্যারাবল লিখতে গেলে আবার ঈশপের গল্প হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তাই ভাল মানের প্যারাবল লেখা খুবই চ্যালেঞ্জিং। মজার ব্যাপার কি, জানো? তোমার প্যারাবলগুলোই সবচেয়ে ভালো আর নিখুঁত লেগেছে আমার কাছে। সেই যে ছোট্ট ছেলেটি যে বরফের টুকরো ধরতে গিয়ে ঈশ্বর এবং দেবতাদের কোপানলে পড়লো, অথবা তোতাপাখিটি কবির কাছে প্রেম নিবেদন করার পর প্রত্যাখ্যাত হবার পর মূর্ছিত হল, কিংবা স্বর্গ বিক্রেতার মতলববাজী, প্রতিটাতেই শক্তিশালী মেসেজ আছে, পড়ার পর ভাবতে হয় কিছুক্ষণ।
তোমার গল্পের চরিত্রে অনেকবারই এসেছে ঈশ্বর, অনেকবারই এসেছে পশু-পাখি, পোকা-মাকড়। তাদের সাথে কথোপকথন বেশ মজার! প্রাণীর সাথে কথোপকথনে বেশ কড়া হুমায়ূন আহমেদীয় লিকার পাওয়া যায়! হুমায়ূন আহমেদকে ট্রিবিউট করে লেখা গল্পটাই প্রমাণ করে যে তুমি তার প্রভাবকে অস্বীকার করতে চাও না। আমিও তাই বলি। হুমায়ূন আহমেদের ধাঁচ থাকতেই পারে, তুমি তো আর তাদের দলে নও যাদের নিজস্ব ফিলোসফি নেই, নিজস্ব গল্প নেই, বক্তব্য নেই। তোমার গল্পগুলিতে কাহিনীর চেয়ে বক্তব্য বেশি। তবে কিছু কিছু গল্প আছে, যেগুলিতে ফ্যান্টাসি আর মেটাফরের ভেতরের ফাইন লাইনটা খুঁজে পেতে বেশ বেগ পোহাতে হয়।
যেমন, ‘অবিকৃত’ গল্পটা। এখানে গুঁইসাপ হয়ে যাবার ব্যাপারটা তো শুধুমাত্র একটা কাহিনী পরম্পরা, এতে কোনো লুকোনো বক্তব্য নেই, তাই না? হ্যাঁ, এরকম ধন্ধে পড়তে হয়েছে আমাকে বেশ কবারই! পাঠককে এভাবে পাজলড করার ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করো নিশ্চয়ই? ভালো। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে তোমার ফ্যান্টাসি নির্ভর গল্পগুলোর চেয়ে মেটাফরিক মেসেজযুক্ত গল্পগুলোই অধিকতর সমৃদ্ধ।
কিছু কিছু গল্পে আবার একদম নির্জলা আবেগ-অনুভূতিও আছে। যেমন পুত্রের মাংস খেতে চাওয়ার গল্পটা, প্রেমিকের পাথর হবার গল্পটা।
প্রিয় হাতুড়ে আরিয়ান,
তোমার অস্ত্রভান্ডার খুবই সমৃদ্ধ। তুমি পাঠককে আঘাত করতে চাও তীব্রভাবে। এ কাজে বেশ সিদ্ধহস্ত বলা যায় তোমাকে। আমিও চাও বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হতে। কিন্তু বারবার প্রয়োগে অস্ত্রগুলো ভোঁতা হয়ে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। ধনুকটা তো তোমার আছেই, তূণও আছে। এখন দরকার শুধু বিভিন্নরকম তীর সংগ্রহ করা। এজন্যে তোমাকে যেতে হবে আরো গভীর বনে, সংকটময় উপত্যকায়। তবে আমি নিশ্চিত যে তুমি এই অভিযানে যাবার ঝক্কিটা সামলাতে প্রস্তুত দৈনন্দিন জীবনকে আলগোছে একপাশে ফেলে। মাঝেমাঝে আমিও যাবো শিকার সহচর হয়ে, ঠিক আছে?
ইতি
হাসান ভাই
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৪:১৬