পুরাতন ঢাকার বিরিয়ানি নিয়ে লিখতে গেলে একটা বিরিয়ানিনামা লেখা উচিত। আমার মতে পুরাতন ঢাকার সত্যিকারের কিছু বিরিয়ানি না খেলে আপনি বুঝতে পারবেন না কি জিনিস সেইটা। অধুনা যে ফুড ব্লগার, ভ্লগার, রিভিউয়ার, হাইপার (হাইপ তৈরী করে হুদাই) এদের কারণে অগা, মগা, জগা বিরিয়ানি খাইতে মানুষ দেয় দৌড়। যদি জিজ্ঞাসা করেন কোন বিরিয়ানি সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশী ফেমাস হইছিলো, উত্তর হবে দিল্লী’র কারিম’স; উনাদের নিয়ে টাইমস ম্যাগাজিন কভার স্টোরি পর্যন্ত ছাপাইছিলো। কিন্তু কারিম’স এর বিরিয়ানি খেয়ে মুখ দিয়ে উচ্চারিত মনে না হলেও, মনে মনে গালি দিছিলাম ঠিকই। সে ব্যাপারে লিখেছিলাম একদা, "এখানকার বিরিয়ানি খেয়ে মনে হয়েছে, কানে ধরে এদের পুরাতন ঢাকায় এনে অগা-মগা’র বিরিয়ানি খাওয়ায় দেয়া দরকার।"
যাই হোক, পুরাতন ঢাকার বিরিয়ানি নিয়ে গল্প শুরুর আগে একটু বিরিয়ানি নিয়ে কিছু কথাবার্তা চলে আসে। প্রথমেই বিরিয়ানির প্রচলন নিয়েই কথা বলা যেতে পারে। অত্র অঞ্চল তথা ভারতীয় উপমহাদেশে বিরিয়ানি’র প্রচলন নিয়ে কয়েকটি ইতিহাস পাওয়া যায়, যার কোনটি আসলে সঠিক সে সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্যসূত্র সহ কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। প্রথমত, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সমূহে বিরিয়ানি’র সমগোত্রীয় খাবারের ইতিহাস দেখা যায়। আর সেই সূত্র ধরে একটি ইতিহাস দাবী করে, আরব দেশসমূহ থেকে ভারতবর্ষে আগত ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সর্বপ্রথম এই উপমহাদেশে বিরিয়ানির আগমন। এই দাবী মতে, ভারতবর্ষের দক্ষিণের সমুদ্র উপকূলে আরব, তুরস্ক প্রভৃতি দেশ হতে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসা বণিকদের মাধ্যমে এই উপমহাদেশ পরিচিত হয় এই মুখরোচক খাবারের সাথে।
দ্বিতীয় আরেকটি ইতিহাস দাবী করে তুর্কি মঙ্গল বিজয়ী তৈমুর বিন তারাগাই বারলাস পনের শতকের শুরুর দিকে বিরিয়ানি’র সাথে ভারতবর্ষের পরিচয় করান। বিশাল মাটির হাঁড়িতে চাল, মাংস, মশলাপাতি দিয়ে একসাথে বিশেষ প্রক্রিয়ায় রান্না করা হতো এই বিশেষ খাবার যা তৈমুরের বিখ্যাত সেনাবাহিনীর ভোজে ব্যবহৃত হতো।
তৃতীয় ইতিহাসটি প্রায় সমগোত্রীয়, তবে তার সূত্রধর মুঘল সম্রাট শাহজাহান এর স্ত্রী মমতাজ মহল, যার স্মৃতিতে তাজমহল তৈরী করেছিলেন সম্রাট। তো মমতাজ মহল একদিন সৈন্যদের ব্যারাক পরিদর্শনে গিয়ে তাদের স্বাস্থ্যগত করুণ অবস্থা দেখে বাবুর্চিদের নির্দেশ দেন চাল, মাংস দিয়ে এমন একটা খাবার তৈরী করতে যার পুষ্টিগুণ যেমন উচ্চস্তরের হবে, তেমনই তা হতে হবে মুখরোচক এবং সুস্বাদু। আর সেই নির্দেশনা থেকেই বিরিয়ানির উৎপত্তি। তবে বিরিয়ানির ইতিহাস যাই হোক, এর নাম শুনলেই কিন্তু মুখে পানি চলে আসে। কি আসে নাই এখনো? ওকে, সাথেই থাকুন চলে আসবে।
বিরিয়ানি কিন্তু বাংলাদেশ বা উপমহাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই সমাদৃত। উপমহাদেশের বাইরে পশ্চিম এশিয়া, মায়ানমার, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মরিশাস, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকায় বিরিয়ানির প্রচলণ রয়েছে। তবে ভারত, পাকিস্থান আর বাংলাদেশে বিরিয়ানির রয়েছে বিশেষ প্রাধান্য, তবে এলাকাভেদে স্বাদ এবং রন্ধন প্রক্রিয়ায় বেশ পার্থক্য দেখা যায়। এক ভারতের বিরিয়ানি’র নানান প্রকার ভেদ দেখা যায়, ভারতে প্রচলিত নানান ধরণের বিরিয়ানির কয়েকটি হলোঃ ভাতকলি/নববতী, বোহরি, চেট্টিনাদ, দিল্লি, ঢাকাইয়া, ডিন্ডিগুল, হায়দ্রাবাদি, মেমনি, কল্যাণী, কলকাতা, রাওথার, সিন্ধি, শ্রীলঙ্কি, থালাসেরি, কাশ্মীরি প্রভৃতি।
বিরিয়ানি রান্নার দুটি প্রক্রিয়ার একটি পাক্কি, যেখানে মাংস আগে রান্না করে চাল অর্ধেক রান্না হয়ে আসলে তাতে মাংস মিশিয়ে বাকীটুকু সম্পন্ন করা হয়। অন্য প্রক্রিয়া কাচ্চি, যেখানে মাংস, চাল, মশলা সব একত্রে দিয়ে পাত্র সিল করে দেয়া হয়, এখানে চাল বেশীরভাগ সময় আধা সেদ্ধ দেয়া হয়। আরেকটা প্রক্রিয়া দেখা যায়, যেখানে আলাদা পোলাও রান্না করা থাকে, মাংস আলাদা সেদ্ধ করে রান্না করে সেটা পোলাও এর সাথে মিশিয়ে বিরিয়ানি হিসেবে বিক্রি করা হয়। এই প্রক্রিয়ার ঢাকা শহরে বেশীর ভাগ বিরিয়ানি’র দোকানে বিরিয়ানি বিক্রয় করা হয়। আর তেহারী বলে বিরিয়ানি’র অন্য একটা ভার্সন আছে, যেখানে মাংস এবং মশলার পরিমাণ কম থাকে, মাংসের টুকরোগুলো ছোট ছোট হয় এবং ঘ্রাণ অনেক কম হয়, কারণ এতে ঘি এর ব্যবহার তেমন একটা হয়ই না, বদলে সরিষা তেলে বেশী করে কাঁচামরিচের ঝাল দিয়ে স্বাদে বৈচিত্র আনা হয়।
তবে বিরিয়ানি’র মূল উপাদান চাল যা অঞ্চল ভেদে নানান রকমের হয়ে থাকে। আমাদের দেশে প্রচলিত কিছু চালের মধ্যে কালিজিরা, চিনিগুড়া, বাসমতী, তুলশীমালা, গোবিন্দভোগ, কাটারিভোগ ব্যাপকভাবে পরিচিত। এর বাইরে আরও কিছু সুগন্ধী চালের জাত রয়েছেঃ বাদশাভোগ, খাসখানী, বাঁশফুল, দুর্বাশাইল, বেগুন বিচি, কাল পাখরী, পুনিয়া, কামিনী সরু, জিরাভোগ, চিনি শাইল, সাদাগুরা, মধুমাধব, দুধশাইল ইত্যাদি।
মাংস হিসেবে অঞ্চলভেদে গরু, খাসী, ভেড়া, মুরগী, উট, দুম্বা, টার্কি, চিংড়ি থেকে শুরু করে মাছের ব্যবহারও দেখা যায়।
বিরিয়ানিতে মশলা হিসেবে পেয়াজ, আদা, রসুন, কাঁচা মরিচ, সাদা গোলমরিচ, কালো গোলমরিচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, ছোট এলাচ, বড় এলাচ, কালো এলাচ, আলুবোখারা, শাহী জিরা, গরমমশলা, জায়ফল, জয়ত্রী, কাবাব চিনি, মৌরি, পোস্তদানা, তেজপাতা, জাফরান, কাজু বাদাম, পেস্তা বাদাম, কিসমিস প্রভৃতির ব্যবহার দেখা যায়। তবে সব মশলাই সকল বিরিয়ানি’তে ব্যবহৃত হয় না, এলাকা এবং প্রকারভেদে এর ব্যবহারে বৈচিত্র রয়েছে।
তেল এর মধ্যে ঘি, মাখন, সরিষা তেল, সয়াবিন তেল, ভেজিটেবল তেল, জলপাই এর তেল, বাদাম এর তেল, সূর্যমুখী তেল অঞ্চলভেদে ব্যবহৃত হয়। ভারতের দক্ষিণাঞ্চল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ইত্যাদি অঞ্চলে নারিকেল তেল, মালয়েশিয়া এবং এর আশেপাশে পামওয়েল ইত্যাদি দিয়েও বিরিয়ানি রান্না করা হয়।
এরই সাথে অনেক অঞ্চল এবং ধরণে বিরিয়ানিতে নানান সবজির ব্যবহার দেখা যায় যার মধ্যে অন্যতম হলঃ আলু, মটরশুটি, টমেটো, গাজর ইত্যাদির ব্যবহার বহুল প্রচলিত। আর ভারতসহ অনেক দেশে “ভেজ বিরিয়ানি” তৈরী করে যেখানে মাংসের পরিবর্তে নানান সবজি ব্যবহার করা হয় যার মধ্যে আগে উল্লেখিত সবজির বাইরে ক্যাপসিকাম, ফুলকপি সহ আরও অন্যান্য সবজির ব্যবহার দেখা যায়।
তো বিরিয়ানি নামা, আজ এই পর্যন্তই থাক। বিরিয়ানিনামা’র আগামী পর্বে থাকবে পুরাতন ঢাকার এমন কিছু বিরিয়ানি দোকানের বিশেষ বিরিয়ানির কথন, যা আপনার “Must Taste” লিস্টে থাকবে। সাথেই থাকুন বিরিয়ানিনামা সিরিজের।
আসন্ন সপ্তাহান্তের ছুটিতে মধ্যাহ্ন বা রাতের ভোজ হয়েই যাক না হয় "বিরিয়ানি" দিয়ে, কি বলেন?
শুভরাত্রি।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ১২:৪৫