বেঁচে থাকুন, গরমের চরম ক্ষতি হতে (Don't Underestimate HEAT)
৩১ শে মার্চ, ২০১৪
আজ চৈত্রের ১৭তম দিবস। গত সপ্তাহখানেক জুড়ে প্রচণ্ড তাপদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ। গড়ে ৩৭-৩৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায়স্বা
ভাবিক জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে পরেছে। এই গরমে অসুস্থ হয়ে পরছে অনেক শিশু, বৃদ্ধ থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ। কিন্তু কেন? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আপনাকে কিছু জিনিস জানতে হবে এবং এই জিনিসগুলো এই গরমে সবার জন্য খুবই জরুরী। ব্লগে, অনলাইন ভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা কত সময়ই না অপচয় করি। আসুন না কিছুসময় ধৈর্য ধরে কিছু জিনিস জেনে নেই।
আমাদের মানব শরীর তার স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করে। মানুষের জন্য ২০-২৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা হচ্ছে আদর্শ এবং আরামদায়ক তাপমাত্রা। এই তাপমাত্রার ভেতরে অবস্থান করতে আমরা সাচ্ছন্দবোধ করি। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে আমাদের শরীর তার নিজস্ব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করে যায়, যার মধ্যে অন্যতম হল শরীর হতে নিঃসৃত ঘাম। ঘাম দ্বারা আমাদের শরীরের আভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা কিছুটা কমিয়ে নিয়ে আসে শরীর। কিন্তু গরম যখন খুব বেশী হয়, সাথে থাকে উচ্চ আদ্রতা; তখন আমাদের শরীরের এই নিজস্ব প্রক্রিয়াই যথেষ্ট নয়। আর তার ফলে আমরা প্রচণ্ড গরমে আক্রান্ত হই বিভিন্ন ধরনের অসুখে, মেডিকেল সাইন্সের ভাষায় যাকে বলা হয় Heat-related illnesses। আজকে আমার চেষ্টা এই গরমে বিভিন্ন ধরনের Heat-related illnesses নিয়ে আলোচনা করা।
আমাদের শরীর সারাক্ষন শর্করা পুড়িয়ে আমাদের শক্তির যোগান দিয়ে যাচ্ছে, সাথে অনবরত তৈরি করছে তাপ। এই উৎপন্ন তাপের পরিমান কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে থাকে, যার মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলঃ আমরা যে পরিবেশে অবস্থান করছি তার তাপমাত্রা এবং আদ্রতা, শারীরিক পরিশ্রমের মাত্রা, কাজের ধরন, যে কোন পরিবেশে মোট সময় অতিবাহিত করার ব্যাপ্তি, বিশ্রাম নেয়ার সময়কাল প্রভৃতি। আমাদের শরীরের আভ্যন্তরীণ সিস্টেম আমাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করে সর্বদা ৯৮.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট এ স্থির রাখতে অবিরত চেষ্টা করে যায়। শরীর কয়েকটি প্রক্রিয়ায় এই তাপমাত্রা কন্ট্রোল করে থাকে। যার মধ্যে রয়েছে Radiation বা বিকিরন, যে পদ্ধতিতে শরীরের সাথে সরাসরি সংস্পর্শে না থাকা বস্তুর সাথে শরীরের তাপের বিনিময় ঘটে। Convection বা পরিচলন প্রক্রিয়ায় আমাদের শরীর স্পর্শ করে বয়ে যাওয়া বাতাসের মাধ্যমে তাপের আদান প্রদান ঘটে থাকে। Conduction বা প্রবাহ হল ঐ প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ায় শরীরের সংস্পর্শে আসা বস্তু হতে শরীরে তাপের বিনিময় ঘটে। আরেকটা প্রক্রিয়া হল Evaporation বা বাষ্পীভবন প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ায় শরীরের সংস্পর্শে আসা বাতাস শরীরের ময়শ্চার শোষণ করে নেয়। এরূপ বিবিধ প্রক্রিয়ায় আমাদের শরীর তার কাঙ্ক্ষিত আদর্শ তাপমাত্রা বজায় রাখতে বিরামহীনভাবে কাজ করে যায়। তাই আমাদের শরীরের তাপ বৃদ্ধি বা হ্রাস সম্পূর্ণরুপে নির্ভর করে বাতাস এবং আমাদের চারিপার্স্বস্থ বস্তুসমূহের তাপমাত্রা, বাতাসের প্রবাহ এবং বাতাসের আদ্রতা (বাতাস কি পরিমান জলীয়বাস্প বহন করে) তার উপর।
এখন দেখি এই অতিরিক্ত গরম আমাদের কি কি শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে।
SUNBURN: প্রথমেই শুরু করা যাক Sunburn দিয়ে। আমরা যখন বাইরে সরাসরি রোদের মাঝে থাকি তখন সূর্যের প্রখর তাপে আমাদের শরীরের অনাবৃত অংশ সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মিতে পুড়ে যায়, যা আমরা সাধারন অনুভূতিতে তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারি না। Sunburn বুঝার উপায় হল চামড়া লাল হয়ে জ্বালা-পোড়া করবে, ফোসকা পড়বে গায়ে এবং অনেক সময় চরম অবস্থায় শরীর হতে রক্তপাত হয় এবং শরীরের বিভিন্ন টিস্যু ক্ষতিগ্রস্থ হয়। Sunburn হতে বাঁচার জন্য আমাদের দরকার খুব প্রয়োজন না পরলে আর বাধ্য না হলে প্রখর রোদে না অবস্থান করা, যতটা সম্ভব ছায়াতে থাকা, রোদে বের হলে শরীরের বেশীরভাগ অংশ ঢেকে রাখা, সম্ভব হলে স্কিন লোশান ব্যাবহার করা।
HEAT RASH: Heat rash বলতে বুঝায় আমরা বাংলায় যাকে বলি ‘ঘামাচি’। গরমে আমাদের শরীরের চামড়াজুড়ে দেখা দেয় বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লাল গোটা যা ঘামাচি নামে অত্যাধিক পরিচিত। এছাড়াও শরীরের চামড়া লাল হয়ে দগদগে হয়ে যাওয়ার মত ব্যাপারও ঘটতে পারে এই Heat rash এ। সাথে শরীরে চুলকানি দেখা যেতে পারে। আদ্র আবহাওয়া, ঘর্মনালী বন্ধ হয়ে যাওয়া, ঘাম না শুকিয়ে যাওয়া, বেশীরভাগ সময় শরীর আদ্র থাকা ইত্যাদি হতে আমাদের এই Heat rash হয়ে থাকে। Heat rash থেকে সুরক্ষার জন্য প্রতিদিন গোসল করা, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, শরীর শুকনো রাখা, ঘামাচি বা র্যাaশ হলে পরে লোশন, বিভিন্ন প্রিক্লিহিট পাউডার, ওয়েনমেণ্ট ব্যাবহার করা।
HEAT CRAMPS: cramp হল মাংসপেশির সংকোচন। অন্যান্য আরও কারনের সাথে একটি কারন হল অতিরিক্ত তাপমাত্রা যা এই cramp এর জন্য দায়ি হতে পারে। গরমের কারনে যে ক্রাম্প হয় তা Heat cramp নামে পরিচিত। হাতের বাহু, পা, এমনকি পাকস্থলী সংলগ্ন পেশী পর্যন্ত এই ক্রাম্পের শিকার হতে পারে। ক্রাম্প একটি সতর্ক সংকেত আমাদের শরীরের সমূহক্ষতির। ক্রাম্প অন্যান্য তাপজনিত ক্ষতির সাথে দেখা যেতে পারে, কখনো কখনো আপনি অতিরিক্ত গরমে শুধু যে কোন ধরনের ক্রাম্পে আক্রান্ত হতে পারেন। প্রচণ্ড ঘাম, দেহে পানির সাথে পর্যাপ্ত পরিমান খনিজের অভাব ইত্যাদি কারনে আপনি Heat cramp এ আক্রান্ত হতে পারেন। ক্রাম্প হতে বাঁচতে আপনি ঢিলে ঢালা জামাকাপড় ব্যাবহার করতে পারেন। ছায়ায় থাকার চেষ্টা করেন, বেশী বেশী লবন-পানি শরবত, বা স্যালাইন পান করুন, প্রয়োজনে ডাক্তারের শরনাপন্ন হন। কোনমতেই একে অবহেলা করা উচিত নয়।
HEAT EXHAUSTION: যখন আমাদের শরীরের তাপনিয়ন্ত্রন কৌশল অতিরিক্ত সক্রিয় থাকে কিন্তু ভেঙ্গে পরে নাই পুরোপুরি রুপে এমন অবস্থায় থাকে, অর্থাৎ ভেঙ্গে পরার আগ অবস্থাটা, তখন আমরা Heat exhaustion এ আক্রান্ত হই। Heat exhaustion এ আক্রান্ত ব্যাক্তি যে কোন সময় হিট স্ট্রোক করতে পারে। শিশু এবং বৃদ্ধদের জন্য এটা খুবই রিস্কি। প্রচুর ঘাম, ডায়রিয়া, ঠাণ্ডা ভেজা চামড়া, দুর্বল এবং দ্রুত পালস, শারীরিক দুর্বলতা প্রভৃতি এই সমস্যার সিম্পটম হিসেবে দেখা দেয়। এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে রোগীকে দ্রুত ছায়াযুক্ত স্থানে নিয়ে যেতে হবে, শরীর হতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাপড় খুলে ফেলতে হবে, প্রচুর বাতাস করতে হবে রোগীকে, প্রয়োজনে পানি ছিটিয়ে দিন সারা শরীরে অথবা শরীর ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিন বারবার। লবন-পানি পান করান সাথে সাথে। ডাক্তারের সহায়তা পাওয়ার আগ পর্যন্ত রোগীর সাথে অবস্থান করুন, কোন অবস্থাতেই রোগীকে একা রেখে কোথাও যাবেন না। এইক্ষেত্রে রোগীকে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে এবং প্রচুর পানি (খনিজ লবন যুক্ত) পান করতে হবে।
HEAT STROKE: Heat stroke হল অতিরিক্ত গরমে সৃষ্ট রোগসমূহের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ের বিষয়। এই সমস্যাটি সবচেয়ে উদ্দেগজনক এবং এতে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশী। এটা মূলত শুরু হয় heat cramps অথবা heat exhaustion অথবা দুইটিরই সাথে। যখন আমাদের শরীরের পানি এবং লবনের সরবরাহ প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত হয়, ঘাম বন্ধ হয়ে যায় এবং এর ফলে শরীরের তাপ বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ায় বিনিময় রুদ্ধ হয়ে যায়। এর ফলে রোগীর শরীরের তাপমাত্রা বিপদজনক সীমার শিখরে পৌঁছে যায়।
প্রাথমিকভাবে Heat stroke এর লক্ষণ হিসেবে দেখা দেবে শরীরের অতিরিক্ত তাপমাত্রা (১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের উপরে), ঘাম ঝরবে না, লালচে উত্তপ্ত শুকনো ত্বক, রোগীর পালস অতি দ্রুত চলবে, শ্বাসকষ্ট দেখা দেবে, উচ্চরক্তচাপ, মাথাব্যাথা, স্মৃতিভ্রম, শারীরিক দুর্বলতা, বমিভাব প্রভৃতি। এই রোগে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রোগীর শরীরের তাপমাত্রা ১০৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত পৌঁছতে পারে, রোগীর পালস নির্ধারণ সম্ভব হবে না, রোগী কমায় চলে যেতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত রোগীর মৃত্যু ঘটতে পারে।
তাই প্রাথমিক লক্ষন দেখা দেয়ার সাথে সাথে রোগীর শরীরের তাপমাত্রা কমানোর ব্যাবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে রোগীর শরীর পানিতে ডুবিয়ে রাখার ব্যাবস্থা করতে হবে। সারা শরীর বরফ দিয়ে ম্যাসাজ করা যেতে পারে। অচেতন রোগীকে কোন প্রকার তরল পান করানোর চেষ্টা না করাই ভালো। দ্রুত এম্বুলেন্স ডেকে রোগীকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যাবস্থা করতে হবে।
তো এই গরমে সবাই সুস্থ থাকুন এই কামনা করি। যথাসম্ভব ছায়ায় থাকুন, রোদে বের হতে হলে সারা শরীর আবৃত করে উজ্জ্বল রঙের হালকা ফেব্রিক্সের জামা পরিধান করুন। নিয়মিত গোসল করুন, পরিস্কার পরিচ্ছন থাকুন। প্রচুর পানি পান করুন, সম্ভব হলে লবন-পানি বা স্যালাইন পান করুন। গরমে যে সকল ফল পাওয়া যায় সেগুলোও শরীরের জন্য খুবই উপকারী। আর সর্বোপরি সমস্যা মনে করলে যে কোন চিকিৎসকের শরনাপন্ন হন। এক্ষেত্রে কোন অবহেলা করবেন না। মনে রাখবেন আপনার একটু অবহেলা অনেক বড় হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে শরীরের জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৭ রাত ১১:৪৩