সকাল সাড়ে পাঁচটায় যখন ফুলবাড়ী ষ্টেশনে নামলাম, তখন চারিদিক ভোরের প্রথম আলোকছটার আলোকিত। দিগন্ত রেখায় লাল আভা হারিয়ে উঁকি দিচ্ছে কুসুম লাল সূর্যখানি। সেই সকাল থেকে সারাটা দিন প্রায় অলস কাটিয়ে (মাঝে একটা জমিদার বাড়ী ঢুঁ মেরেছি বিকেল বেলা শুধু, মূলত আমার এই ট্যুরের উদ্দেশ্যই ছিল তিনটা জমিদার বাড়ী ঢুঁ মারা) দিনাজপুর পৌঁছলাম রাত আটটার পর। টার্মিনাল থেকে সোজা মালদহপট্টি, অনলাইনে ভাল ভাল কথা শুনে চেকইন করলাম হোটেল ডায়মন্ডে... ইহাকেই তাহলে ভাল হোটেল বলে, যেখানে রাত একটা বাজে বোর্ডাররা নিজ বউকে, কেউবা ব্যবসায়িক পার্টিকে এতো জোরে জোরে ঝাড়ি দেয় যে একশত ফিটের করিডোরের শেষ মাথার রুম থেকে সেই শব্দ ভেসে এসে প্রথম রুমের মানুষের ঘুমের বারোটার পর তেরটা বাজিয়ে দিতে যথেষ্ট।
আচ্ছা থাক, ধান ভাংগতে শিবের গীত বন্ধ করা যাক আপাতত। তো হোটেলে চেকইন করে রাতের খাবার খেতে গেলাম পাশের রোডে হোটেলের মালিকানার রেস্টুরেন্ট “ডায়মন্ড হোটেল” (খাবার হোটেল) এ। মালদহ পট্টি এলাকাটা পুরো কলকাতা কলকাতা ভাব, মনে হয় সেখানে চলে এসেছি। যদিও এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। তবে দিনাজপুর কিন্তু বহুকাল আগে বিশাল এক মহকুমা ছিল যার বিস্তৃতি ছিল ব্যাপক। সেই গল্প পরের কোন লেখায় করা হবে না হয়। তো রাতের খাবার শেষে রেস্টুরেন্টের ক্যাশে বসা প্রবীণ ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করে রওনা হব লিচুর বাজারে, তখন তিনি বললেন ভাল কথা। রাতের বেলা তো সব বাসী লিচু মিলবে, তাই পরের দিন সকাল বেলা কেনাটাই উত্তম। কথা মনপুত হল, চলে গেলাম হোটেলে, তারপর রাত দুটো পর্যন্ত ঘুমাতে পারলাম না... কি কারনে তা আগেই বলেছি। আগের রাতে সারারাত ট্রেন জার্নি করে ক্লান্ত ছিলাম, তারপরও সকাল ছয়টার এলার্ম সেট করে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। সকালবেলা উঠে তৈরি হয়ে রওনা হলাম লিচুর বাজারের উদ্দেশ্যে। বের হয়ে দেখি সেই রেস্টুরেন্ট এই সাতসকালেও খোলা, বাকী কোন দোকানপাট তখনো খোলে নাই। যাই হোক সেখান থেকে নাস্তা সেরে পায়ে হেঁটে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম নিউ মার্কেট এলাকা বলে পরিচিত সেই জায়গায়, যেখানে বসে লিচুর বাজার।
যে কোন পাইকারী বাজারের একটা সাদৃশ্য আছে। হোক সেটা ঢাকার শাহবাগের ফুলের বাজার অথবা পুরাতন ঢাকার সোয়ারীঘাটের মাছের বাজার থেকে শুরু করে চাপাই নবাবগঞ্জের আমের বাজার অথবা এই লিচু বাজার। সারি সারি অস্থায়ী এবং স্থায়ী দোকানের সামনে একে একে ভ্যান, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা করে বাগান থেকে লিচু নিয়ে আসছে বাগান ব্যাপারীরা। পাইকাররা সেই লিচু ঘিরে জটলা করছে। অনেক পাইকার ইতোমধ্যে লিচু কেনা শেষ করে বসে আছে। একটা দোকানে তখন লিচু নামছিল, আমি ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলছি, এসময় দোকানের মালিক বের হয়ে এসে আমাকে একটা গোছা হতে একটা লিচু ছিড়ে নিয়ে বললেন, “মুখে দেন... এইটা হইল মাদ্রাজি লিচু... রোজ পাওয়া যায় না...”। মুখে দিয়ে বুঝলাম লিচুটা সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের এবং সত্যি খুবই সুস্বাদু। বেদানা লিচু বা চায়না লিচু মুখে দিলে মনে হয়ে সেকারিন দিয়ে মিষ্টি করে রাখা হয়েছে, স্বাদহীন মনে হয় আমার কাছে। এই কথার সত্যতা প্রমাণ করতে ঐ দোকানে সকল ধরনের লিচুই খেয়ে দেখেছি, বেষ্ট মনে হয়েছে এই মাদ্রাজি লিচুকে। মজার ব্যাপার দামেও এটা ছিল সবচেয়ে সস্তা। বেদানা, চায়না বা বোম্বাই লিচু যেখানে ৬০০-১২০০ টাকা শ হিসেবে বিক্রি হচ্ছিল, এটার দাম চাইল ৩৫০ টাকা। যদিও পরে দরদাম করে ২৫০ টাকা শ হিসেবে এক হাজার লিচু কিনে এস এ পরিবহণে পাঠিয়ে দিলাম তাদের হাত দিয়েই। সাথে দশ কেজি অরিজিনাল ভেজালমুক্ত হিমসাগর আমও ধরিয়ে দিলেন ঐ ভদ্রলোক, আমও স্বাদে সেইরাম ছিল...
পুরো বাজার ঘুর ঘুরে দেখছি, বড় পাইকাররা লিচু নিয়ে আসা বাগান মালিক বা বেপারিদের থেকে সকল লিচু দরদাম করে কিনে নিচ্ছে, আবার সেই পাইকারদের কাছ থেকে বিভিন্ন ফল বিক্রেতারা লিচু কিনে নিয়ে যাচ্ছে। আমার মত দু’চারজন খুচরা বিক্রেতাও আছে। এক জায়গায় জটলা দেখে দাঁড়ালাম, সদ্য এক গাড়ী লিচু এসেছে। শুরু হল নিলাম, প্রথমেই চিৎকার করে বলা হল, “ প্রতি দুই আটিতে একশ, আটিতে ত্রিশটা করে থাকলেও একশ...”। নিলামের একক হল এক হাজার, প্রারম্ভিক মূল্য ছিল আশি টাকা শত হিসেবে হাজার আটশত। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সেই মূল্য পাঁচ হাজার পর্যন্ত উঠলো। এই ফাঁকে জটলা আরও বাড়ছে। আসলে দিনাজপুরের বেদানা লিচু, চায়ান লিচু আর বোম্বাই লিচুর চাহিদা দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরে অনেক থাকায় এই লিচুর দাম আকাশ ছোঁয়া। খোদ দিনাজপুরেই এই মূল্য সর্বনিম্ন ৭০০-৮০০ টাকা শতক!!! তবে এই লিচুর স্বাদ আর সাইজ ঢাকায় ৩০০-৫০০ টাকা শতক হিসেবে বিক্রি হওয়া লিচু থেকে একেবারেই ভিন্নতর।
লিচু বাজার ঘিরে কিছু দোকান রয়েছে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি ছোট ছোট ঝুড়ি’র। কিছু লোক রয়েছে যারা লিচু নিয়ে ট্রান্সপোর্ট এ তুলে দেয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেলিভারির জন্য। চারিদিকে কেমন একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ। পুরো বাজার ঘোরা শেষ করে সেই দোকানে এসে দাম চুকিয়ে দিয়ে আমরা রওনা হলাম দিনাজপুর রাজবাড়ী’র উদ্দেশ্যে। এর মাঝে প্রায় গোটা বিশেক লিচু এই সাতসকালে খাইয়ে দিয়েছে সেই দোকানদার...
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১৬ রাত ১২:৫৬