আমার প্রিয় ঋতু শীত হলেও প্রিয়তমা কিন্তু বৃষ্টি। বৃষ্টির দিনে মনটা আজানা কোন এক মায়াময় ভাবের জগতে হারিয়ে যেতে আনাচান করে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে খোলা রাজপথে হাঁটা; দুপুরে ভুনা খিচুড়ি সাথে ইলিশ ভাঁজা, আমের আচার; খাবার শেষে এক কাপ গরম ধূমায়িত চা বা কফি হাতে দক্ষিনের বারান্দায় প্রিয় কোন লেখকের প্রিয় কোন বই হাতে বসে যাওয়া... সাথে মৃদু ভলিউমে বাজবে প্রিয় সব গান যার প্রথমেই থাকবে শ্রীকান্তের , ‘আমার সারাটা দিন... ... ... বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’।
বৃষ্টি দেখলেই আমার ভেতরের অজানা এক সত্ত্বা জেগে ওঠে, আমি আবেগে আপ্লুত হই, এমনও হয়েছে বৃষ্টির জলের সাথে আমার আঁখি হতে জল ঝরেছে। এই যেমন এখন, যখন এই লেখাটি লেখছি, আমার চোখের কোনে জলকণারা উঁকিঝুঁকি দেয়া শুরু করেছে। বেয়ারা দুষ্টর দলকে কোন মতে আটকে রেখে লিখে চলেছি। আমার সারা জীবনে আমি বৃষ্টি নিয়ে যতটা পাগলামি করেছি, আর কোন কিছু নিয়ে বোধহয় এতোটা পাগলামি করিনি। ইদানীং অবশ্য ঘোরাঘুরি নিয়ে পাগলামি শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম গিয়ে বৃষ্টির দিনে সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ মন্দিরের পাহাড়ে উঠে নেমে এসে আছাড় খেয়ে প্রচণ্ড কোমরে ব্যাথা, না পারি বসতে, না পারি শুতে। তারপরও আরও তিনদিন প্রায় পাঁচশত কিলোমিটার জার্নি করে ঘুরে বেড়িয়েছি, আর প্রতি মুহূর্তে ব্যাথায় ‘আহ উহ ইহ’ করে সঙ্গেরজনকে বিড়ম্বনায় ফেলেছি।
তো যেখানে ছিলাম, আমার বৃষ্টি বিলাস। ভ্রমণে বৃষ্টি নিয়ে আরেকদিন লিখবো। কথায় আছে না, আপনি যদি মনেপ্রাণে কাউকে ভালবাসেন, তবে সেও আপনাকে ভালবাসতে বাধ্য। তাই আমার বেশীরভাগ ভ্রমণেই বৃষ্টি মহারানী আমার সাথী হয়ে যান। যাই হোক, আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করবো আমার কিছু বৃষ্টি বিলাসের কথা তথা পাগলামি।
বৃষ্টির প্রেমে মজে ছিলাম বোধহয় সেই শৈশবেই। প্রায়ই স্কুল থেকে ফেরার সময় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাসায় ফিরতাম, আর মাঝে মাঝে ভুলে যেতাম আমার সাথে নাজুক নাজুক বইপত্র মহোদয়েরা আছেন। ফলে বাসায় এসে ভাগ্যে জুটতো মহা আদর সোহাগ। আমার বৃষ্টি প্রীতি বাসায় সবাই ভালোই বুঝে গিয়েছিল, আর তাই বৃষ্টি আরম্ভ হলেই তাগিদ দিত, ‘এই যা বৃষ্টিতে গোসল করে নে’। এমনো হয়েছে ভোরবেলা, ঘুম থেকে তখনও উঠি নাই, বৃষ্টি শুরু হতেই আমায় ডেকে তুলে দিল কেউ, সেই একই বাক্য, ‘এই যা বৃষ্টিতে গোসল করে নে’।
ক্লাস ফাইভে পড়ি, তখন বৃষ্টি হলেই ফুটবল খেলা ছিল বাধ্যতামূলক। কমবেশি তখনকার সব ছেলেপুলেদের এটা কমন বিষয় ছিল। একবার আমাদের মাঠের লাগোয়া এক বাসার নির্মাণ কাজ চলছিল। তো তাদের ইটের খোয়া তৈরির পর একগাদা গুড়ো ইটের মিহি টুকরো পড়ে ছিল। কয়েকদিন আগেই আমরা সে মিহি গুড়ো দিয়ে মহা উৎসাহে আমাদের এবড়ো-থেবড়ো মাঠকে সমান করেছিলাম। তার দিন দুয়েক পরে বৃষ্টিতে মহা উৎসাহে আমরা ফুতবল খেলছি মাঠে, হঠাৎ একজন ট্যাঁকেল করতে গিয়ে পরে গেল। পড়ল একটুকরো খোয়ার ধারালো মাথায়, হাঁটুর কাছটা কেটে গিয়ে সাতটা সেলাই হয়েছিল।

তখন ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ি। ঈদের ছুটিতে লম্বা সময়ের জন্য স্কুল বন্ধ। স্কুল ছিল বাসার পাশেই, বৃষ্টির দিনে স্কুল মাঠে কাঁদাপানিতে মাখামাখি হয়ে ফুটবল খেলছি পাড়ার ছেলেদের সাথে। বৃষ্টি থেমে গেছে, কাঁদা মাখামাখি করে দুষ্টুমি চলছে। হঠাৎ দেখি ক্লাস টিচার গোফরান স্যার স্কুলে ঢুকছে। আমি অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে সবাইকে বললাম কেউ যেন আমার নাম ধরে না ডাকে। সবচেয়ে ফাজিল ছেলে, বন্ধু মুরাদ দিল দৌড়... স্যারের কাছে গিয়ে আমাকে দেখিয়ে স্যারকে কি যেন বলে আসলো। এরপর? স্কুল খোলার প্রথম দিনই উত্তম মধ্যম, কারণ ক্লাসের প্রথম সারির ছেলেদের কাঁদায় মাখামাখি করতে নেই

এস.এস.সি. পরীক্ষার আগে আগে, বৃষ্টি শুরু হল, কিন্তু গোসল করবো কীভাবে? শিলা বৃষ্টি!!! (মুন্নি বৃষ্টি নাই কেন? জাতি জানতে চায়...)। মাথায় বুদ্ধি এলো, একটা এলুমিনিয়ামের গামলা মাথায় দিয়ে ছাদে চলে গেলাম।
কলেজে পড়া কালে, বাল্যবন্ধু মনা আর আমি বৃষ্টি হলেই পুরাতন ঢাকা হতে সাইকেল নিয়ে পলাশী হয়ে এস.এম. হলের কাছ দিয়ে ফুলার রোড হয়ে পুরো ঢাকা ইউনিভারসিটির ক্যাম্পাস জুড়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সাইকেল চালাতাম। খুব মিস করি সেই দিনগুলো। (অফটপিকঃ আজ দুপুরে মনা’র বাসায় সবজি খিচুড়ি আর ইলিশ ভাঁজা, ডিম ভাঁজা, আচার দিয়ে লাঞ্চের দাওয়াত পেলাম লেখার মাঝখানে

এইচ.এস.সি. পরীক্ষার আগে দিয়ে, কোচিং সেন্টারে ব্যায়বহুল মডেল টেস্ট (সেই সময়ে সাবজেক্ট প্রতি ৩০০ টাকা!) চলছে। একদিনের কথা, বাইরে সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ ছিল, পরীক্ষা সবেমাত্র শুরু হয়েছে, শুরু হল সেইরকম বৃষ্টি। মনতো মানে না, কি করি। ভয়ে ভয়ে স্যারের সামনে গিয়ে স্যারের হাতে খাতা জমা দিয়েই ভোঁ দৌড়, পেছন হতে স্যারের ডাকাডাকি কে শোনে? একা নয় কিন্তু, আরেকটাকে সঙ্গী করে নিয়ে এসেছি। কোচিং হতে বের হয়েই সাইকেল করে বৃষ্টি বিলাস, গোল্লায় যাক পড়ালেখা... “গোল্লায় নিয়ে যাচ্ছে আমায় হাওয়ায় জলের গাড়ী... ... ...”।
এইচ.এস.সি. পরীক্ষা, সিট পড়েছে তেজগাঁও কলেজে, প্রথমদিন ইংরেজি প্রথম পত্র পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ হওয়ার আধঘণ্টা আগে দিয়ে শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। সব স্টুডেন্ট আর গার্জিয়ান মিলে আটকে আছে, বিশাল মানব জটলা। সে জটলা ভেদ করে আমি বের হয়ে হাঁটা দিলাম। পাক্কা একঘণ্টা কুকুরবিড়াল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাসায় ফিরলাম। আমার কাণ্ড দেখে কলেজের গেটে দাঁড়ানো সবারতো চক্ষু চড়কগাছ। হায়রে, তারা যদি জানতো... আমি হলাম ওয়াটার প্রুফ ম্যান!
জাহাঙ্গীরনগর ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ফেরার সময় বাসের গেটে ঝুলে ঝুলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঢাকায় ফিরেছি। ঢাকা যখন পৌঁছলাম, শুকনো খটখটে রাজপথ, এদিকটায় বৃষ্টি হয় নাই। আর আমার শরীরের একপাশ তখন পুরো ভেজা, আরেক পাশ শুকনো। আমায় দেখতে সার্কাসের ক্লাউনের মত লাগছিলো।
কলেজে পড়া অবস্থায়, আরেক ফ্রেন্ডের সাথে টানা পাঁচ ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম, দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবধি, শহীদ মিনার এলাকায়। শহীদ মিনার হল আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের আড্ডার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। বৃষ্টি নিয়ে আমার সবচেয়ে আফসোস এর ঘটনাও এই জায়গাটায়। ২০০১-২০০২ এর ঘটনা, রাত সাড়ে দশটা কি এগারোটা বাজে। আড্ডা শেষে উঠবো বলে, তখন শুরু হল তুমল বৃষ্টি। সেদিন ছিলাম আমি আর বন্ধু মনির (বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী)। আমরা আশ্রয় নিলাম শামিয়ানা টাঙ্গানো এক ফুটপাথের চায়ের দোকানে। হঠাৎ আমার মাথার পোকা লাফানো শুরু করলো, বৃষ্টিতে ভিজবো। মনিরকে অনেক অনুরোধ করেও রাজী করাতে পারি নাই, পায়ে ধরা বাকী ছিল। তার একই কথা, তুই একা একা ভিজ গিয়ে, কে না করছে

এরকম অসংখ্য বৃষ্টি নিয়ে আমার পাগলামির গল্প রয়েছে, বলে শেষ করা যাবে না। এখনো অফিস থেকে ফেরার সময় বৃষ্টি হলে নেমে পড়ি খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টির চাদরে জড়াতে। শেষ যে গল্পটি বলে আমার এই ব্যাক্তিগত প্যাচালি শেষ করবো (দুঃখিত নিজের ব্যাক্তিগত ফাও প্যাচাল নিয়ে পোস্ট দিয়ে আপনার বৃষ্টির এই রোমান্টিক দিনটির কিছুক্ষণ নষ্ট করার জন্য। অফটপিকঃ আপ্নে পড়ছেন কেন? আমি কি রিকুয়েস্ট করছি?

২০১১-১২ সালের দিকের কথা, মোহাম্মদপুরে এক বন্ধুর বাসায় অফিস শেষ করে গিয়েছি। গল্প করতে করতে রাত সাড়ে দশটা বেজে গেল। বিদায় নিয়ে রাস্তায় পা দেয়া মাত্র বৃষ্টি শুরু হল। আমি দৌড়ে বন্ধুর বাসার উল্টোদিকের এক কনফেকশনারি দোকানে আশ্রয় নিলাম। বন্ধু আর তার আম্মা দোতলা’র গ্রিল হতে আমায় দেখে ডাকতে লাগলো, ফিরে যেতে অথবা একটা ছাতা নিয়ে যেতে। সাথে আমার ব্যাগ, ব্যাগে নোটবুক, পকেটে মোবাইল। কিন্তু মাথায় যে বৃষ্টি বিলাসের পোকা! আমি তাদের কথা শুনেও না শোনার ভান করে দোকান থেকে পটেটো চিপসের বিশাল এক পলি প্যাক নিয়ে তাতে ব্যাগ ভরে সুন্দর করে ওয়াটার প্রুফ প্যাক করলাম। ও হ্যাঁ, তার আগে ব্যাগের ভেতর ভরে নিলাম আমার মোবাইল দুটোকে, সাথে মানিব্যাগ। এবার নেমে পড়লাম কুকুরবিড়াল বৃষ্টিতে, বন্ধু আর বন্ধু মাতা চেয়ে রইলো এই পাগলটার দিকে। ওদের গলি থেকে মেইন রোডে বের হয়ে একটা রিকশা নিলাম আজিমপুর পর্যন্ত। তুমুল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চলল আমার রিকশা, এত জোরালো বৃষ্টি আমি অনেক কম দেখেছি। বৃষ্টির তোরে আমি চোখের পাতা খোলা রাখতে পারছিলাম না। নিয়ন আলোয় ফাঁকা রাস্তায় অঝোর ধারায় ঝরে পড়া বৃষ্টির মাঝে রিকশায় এই অধম আমি। সাথে ছিলনা একটা ওয়াটার প্রুফ এম্পিথ্রি (গান শোনার জন্য) আর ছিল না... ? (বুঝে নিতে হবে)
( বিঃ দ্রঃ সবগুলো ছবি নেট হতে সংগৃহীত। এতগুলো সোর্সের লিংক দিতে পারলাম না বলে নিজগুণে ক্ষমা করবেন। )
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ২:১১