১
- স্যার মূর্তিটা কেনা উচিত হবে না।
- কেন??
- শুনেছি মূর্তি টা অভিশপ্ত। উড়া কথা যদিও।
- উড়া কথায় বিশ্বাস করতে নেই। আমি অন্তত করি না।
- স্যার যা রটে তা কিছুটা হলে ও বটে কিন্তু, বাংলা প্রবাদ আছে।
- দেখ মাহফুজ, ফালতু কথা শুনিয়ে আমার সময় নষ্ট করবে না । তোমাকে যে ভাবে করতে বলা হয়েছে সেভাবে কাজ কর।
- স্যার আর একবার যদি চিন্তা করে দেখতেন।
- মূর্তিটা যে করেই হোক কিনে ফেল । না হলে অন্য পার্টি হাত করে ফেলবে। গোপন কথা বাতাসের আগে পৌছায় মানুষের কানে
- জ্বী আচ্ছা।
চিন্তার ভাজ পড়ে মাহফুজের কপালে । মাহফুজ হেমেন্দ্র মূখার্জির বিশ্বাস ভাজন । একই সাথে তার পি এস ও সে ।
হেমেন্দ্র মূখার্জি চোরাচালানের বিশাল নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রন করে । প্রত্ন তাত্ত্বিক সব জিনিস কেনা বেচা করে আন্ত:র্জাতিক বাজারে। প্রচুর অর্থ কড়ির মালিক বনে গেছে এই বয়সেই। আজকে এক পার্টি চন্দ্র গুপ্ত মৌর্য্যের আমলের একটা মূর্তি নিয়ে এসেছিল । চন্দ্র গুপ্ত এক সময় ভারতবর্ষ শাসন করত । ইতিহাসের বিখ্যাত মৌর্য্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা সে। খ্রিষ্ট পূর্ব ৩২৪ অব্দের দিকে। প্রায় তেইশত বছর আগে । তার মানে মূর্তিটা তেইশত বছরের পুরোন । চন্দ্র গুপ্তের মূর্তিটার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল । তার শোবার ঘরের বিছানার পাশে একটা ছোট্ট টেবিলে শোভা পেত মূর্তিটি । মূর্তিটি বিশেষ পাথরের তৈরি । সম্পূর্ণ সাদা । এই পাথরটার আসল নাম কেউ বলতে পারে না। শ্বেত পাথরের সাথে মিল আছে ,কিন্তু গুনে মানে অনেক উন্নত । প্রাচীন পৃথিবীর এক রহস্যময় পাথর। এই পাথর এখন আর পাওয়া যায় না । যদিও প্রাচীন কিছু বিশেষ বিশেষ মূর্তিতে এখনও পাওয়া যায় । এখন যেই মূর্তিটা পাওয়া গেছে সেটা একটা নারী মূর্তি । এক ফিটের মত লম্বা । অপূর্ব সুন্দর দেখতে । নাম স্বর্গের অপ্সরী । লোক মুখে প্রচলিত আছে এখন ও কোন এক বিশেষ রাতে এটা পূর্ণ নারীর রূপে ফিরে আসে পৃ্থিবীতে । ক্ষতি করে মানুষের । তার রূপের মোহে অন্ধ হয়ে যায় সবাই । অনেকে একে নাম দিয়েছে ভয়ংকর সুন্দরী । হেমেন্দ্রর কথার নড় চড় হবে না । কিনবেই সে এই ভয়ংকর সুন্দরীকে । এই মূর্তিটা হেমেন্দ্র মূখার্জির কেনা উচিত হবে না এই টুকু বোঝে মাহফুজ । মূর্তিটা যে ধাতুতে তৈ্রি সেটা এক কথায় শুধু দুর্লভই না , এখন বিলুপ্তই বলা চলে । লোক মুখের অভিশাপের কাহিণী শুনে পিছিয়ে আসবে না হেমেন্দ্র মূখার্জি । তাছাড়া মূর্তিটা পানির দরেই পাচ্ছে সে । এর থেকে যে লাভ পাওয়া যাবে তা অনেক গুন বেশি । যারা বিক্রি করছে তারা মূর্তিটার মূল্য এখন ও বুঝে উঠে নাই অথবা প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে তাদের কোন ধারনাই নাই । থাকলে এমন পানির দরে বিক্রি করতো না । মূর্তিটা অনেক দিন লোক চক্ষুর অন্তরালে ছিল । এক হিন্দু জমিদার তার বাড়ির মন্দিরের নিচে মাটি খুড়ে পুতে রেখেছিল কোন এক অজানা কারনে । সেই পুরনো বাড়ি ভেংগে নতুন দালান তুলতে গিয়েই বেড়িয়ে আসে এটা । তার পরই বিভিন্ন হাত হয়ে চলে আসে ব্লাকারদের হাতে। এর আগে ও যাদের কাছে মূর্তিটি ছিল তারাও অজানা কোন কারনে এটা পরিত্যাগ করে । মাহফুজের ভয় করছে । লোক মুখে মূর্তিটি নিয়ে প্রচলিত ভয়ংকর কাহিনী তার ভয়ের কারন । যদিও মনে মনে সে কুসংস্কারে বিশ্বাসী না । কিন্তু মন কে সে বুঝাতে পারছে না । কে জানে হয়তো আবার কোন অঘটন ঘটানোর জন্য স্বর্গের অপ্সরী উঠে এসেছে মাটির নিচ থেকে , তার ঘুম ভেংগে গেছে অন্যের ঘুম ভাংগানোর জন্য...।
২
মূর্তিটা কেনার পর তার বিশেষ একটা জিনিস ধরা পড়ল । এর চোখ দুটো কেমন জীবন্ত । যেন সত্যি কোন মানুষের চোখ বসিয়ে দেয়া হয়েছে পাথরের মূর্তিটার ভিতরে । নীলাভ বড় বড় পাপড়ি । বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকা যায় না । মাথায় ঝিম ধরে । চেতনা হারিয়ে যাওয়ার যোগার হয় কোন সম্মোহনী শক্তির বলে । মাহফুজ শুনেছে বিশেষ বিশেষ রাতে কিছু আচার পালন করে মূর্তির চোখে একটানা অনেক্ষন তাকিয়ে থাকলে হারিয়ে যাওয়া যায় প্রাচীন পৃথিবীতে । মাহফুজের ইচ্ছা আছে পরীক্ষা করে দেখার । সত্য না মিথ্যা যাচাই করবে । কিন্তু তার মালিক কিছুদিন ধরেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন । শারীরিকের চাইতে মানসিক অসুস্থতাই বেশি । এই নিয়ে ডাক্তার কবিরাজের কাছে অনেক দৌড়া দৌড়ি করেছে মাহফুজ । কোন ডাক্তারই আসল কারন ধরতে পারছে না রোগের । মাহফুজের মনে হয় এটা মূর্তি্র অভিশাপ । একটু একটু করে অভিশাপ পড়ছে তার মালিকের উপরে । প্রতি রাতে হেমেন্দ্রর ঘুম ভেংগে যায় । উঠে পায় চারি করে । মূর্তিটার কাছে গিয়ে বসে থাকে । গভীর রাতে কি সব কথা বলে তার সাথে । পূর্ব জন্মে সে নাকি চন্দ্র গুপ্তের মন্ত্রী ছিলেন এই বিশ্বাস পেয়ে বসেছে তাকে । আজকাল সে দামী জরিদার পাঞ্জাবী পাজামা পরা শুরু করেছে । আগেকার দিনের রাজা বাদশারা যে সব পোষাক পড়তেন । বিদেশে নিয়ে মানসিক ডাক্তার দ্বারা চিকিৎসা করা শুরু করা হয়েছে । কোন ওষুধেই কাজ হচ্ছে না । দিন দিন তার অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে যাচ্ছে । মাহফুজ বুঝে উঠছে না তার কি করা উচিত । এক দিন রাতে হেমেন্দ্রকে পেয়ে যায় করিডোরে ।
- স্যার মূর্তিটা বিক্রি করে দেই ?
- না । এটা পুরো দুনিয়ার বিনিময়েও আমি বিক্রি করবো না ।
- স্যার আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই মূর্তির অভিশাপ লেগেছে আপনার উপর । রাজা চন্দ্র গুপ্তের আত্মা ক্ষেপে গেছে আপনার উপরে ।
- কে ক্ষেপেছে না ক্ষেপেছে আমার জানা দরকার নাই । আমি এই মূর্তি হাত ছাড়া করব না ।
মাহফুজ আর কিছু বলে না তাকে । চলে আসে সেখান থেকে । মাঝে একদিন সে মূর্তিটা ধরে দেখেছিল হেমেন্দ্র কুমারের অগোচরে । মারাত্মক ঠান্ডা । চোখ দুটো যেন আরো জীবন্ত হয়ে উঠেছে । আগের দুধে সাদা রঙ নেই , কেমন লালচে ভাব চলে এসেছে । দুধে এক দুই ফোটা আলতা ঢাললে যে রঙ সেই রঙ । মূর্তিটার মুখে এক ধরনের অভিব্যক্তি দেখতে পেয়েছে । হয়তো দেখার ভুল হয়তো না । এক ধরনের রাগ । হিংস্রতার মিশেল । তখন একে এর নামের সাথে কেমন বেনান লাগছিল । মাহফুজ তারাতারি রুম থেকে বেরিয়ে আসে । এই মূর্তিটার কারনে যে অচিরেই কোন দুর্ঘটনা ঘটবে সেটা বোঝা যাচ্ছে । এটা সাধারন কোন মূর্তি না । এর আগে যার কাছেই মূর্তিটা গিয়েছে সবাই দূর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে । কোন বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে যাচ্ছেন হেমেন্দ্র কুমার ।
৩
হেমেন্দ্র কুমারের দিন দিন অবস্থার আরো অবনতি হচ্ছে । তার এখন পুরোপুরি বিশ্বাস যে তিনি চন্দ্র গুপ্তের সভাসদ ছিলেন পূর্ব জন্মে । তাকে কোন ভাবেই সেই বিশ্বাস থেকে সরানো যাচ্ছে না । এক দিন মাহফুজ তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছিল । কোন কিছুতেই কিছু হয়নি । তেইশত বছর আগের আত্মা আবার ফিরে এসেছে । তখন তার নাম ছিল রমন। সে ছিল চন্দ্র গুপ্তের সব চাইতে প্রিয় ভাজন মন্ত্রী আর সমর নেতা । হেমেন্দ্র বিশ্বাস করে মূর্তিটি প্রতি রাতে পূর্ণ নারী রূপে ফিরে আসে । তার সাথে প্রতি রাতে কথা বলে ,গল্প করে । সেই নারী তাকে গল্প শুনায় ,কিভাবে সে মূর্তি হয়ে গেল , এক কালো যাদুকরের রোষানলে পরে । চন্দ্র গুপ্তের প্রিয় পাত্রি এটাই তার অপরাধ । ওই যাদুকর তাকে ভালোবাসতো । তাই তার এই অবস্থা করেছে সে । পূর্ণ পূর্ণিমার রাতে তার চোখের দিকে যে একটানা চেয়ে থাকবে সে অতিক্রম করতে পারবে সময় । যে কোন যুগে চলে যেতে পারবে ইচ্ছা করলে । এক দিন হেমেন্দ্র কুমারের রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছে মাহফুজ । ফিস্ ফিস্ নারী কন্ঠের আওয়াজ পেয়ে থমকে দাড়ায় । তার চোখে ফাকি দিয়ে হেমেন্দ্র কুমারের রুমে কোন নারীর ঢোকা সম্ভব না ।তো কার গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ?! সারা রাত সে ঘাপটি মেরে বসে ছিল। এই রহস্য সমাধান করার জন্য । কে বের হয় রুম থেকে দেখার জন্য । নাহ কেউ বের হয়নি । সকালে কাজের বাহানায় হেমেন্দ্রর রুমে ঢুকে দেখেন কেউ নেই রুমে। তন্ন তন্ন করে দেখেছে রুম। একটা কনা ও বাদ দেয়নি খোজা ।মূর্তিটা রাখা হেমেন্দ্র মূখার্জীর বিছানার পাশে একটা টেবিলে । পুরো রুমে অদ্ভুত একটা সৌরভ । সুগন্ধের উৎস্য কি হতে পারে । এমন সৌ্রভ সে কোন দিনই পায়নি।পৃ্তহিবীর কোন সুগন্ধই এমন হতে পারে না।ইদানিং হেমেন্দ্র কুমারের শরীরে আরো খারাপ হয়ে গেছে ।খাওয়া দাওয়া এক দম ছেড়ে দিয়েছে সে।আগে জুস টুস খেত এখন কিছুই খায় না।না খেতে না খেতে সে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ ।সে দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। মৃত্যুর পন করেছে সে।যেন অদৃশ্য কোন শক্তি তাকে নিয়ন্ত্রন করছে। লোকে বলা বলি করে মূর্তির অভিশাপ লেগেছে তার উপরে।মাহফুজ ও তাদের কথায় বিশ্বাস করে। আবার তার আধুনিক মন সন্দেহের দোলায় দুলে উঠে ।সব কিছু কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেয়।এক দিন সকালে কোন সারা শব্দ পায়না হেমেন্দ্র কুমারের। রুমে ঢুকে দেখেহেমেন্দ্রর নিথর দেহ পড়ে আছে খাটের উপরে।তার পাশে চোখজ যায় ।মুরতিতার পাশে একটা বালিশের উপরে শোয়ানো।আগের সেই সাদা রঙ নেই।পুরো পুরি রক্তিম রঙ তার। চক চক করছে।আলো পড়লে হিরের মত আলো রিফ্লেক্ট করে । মুরতিটা তুলে নেয় সে। প্রাসাদোপম বাড়ির মাটির নিচের একটা কুঠুরিতে ফেলে দেয়। এর পর ভারী একটা তালা মেরে দেয়। অভিশপ্ত জিনিস ধরাছোয়ার বাহিরে থাকাই ভালো...। মনে মনে আওড়ায় সে..................শোয়েব হাসান
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১৬ রাত ৯:৩৮