somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি চশমার আত্মকাহিনী

২৯ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ২:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




আমি একটি চশমা। আমার ব্রান্ডের নাম পুমা। আমার গায়ের রং ঠিক লাল এর মতো না,অনেকটা মেরুন রং। আমার বর্তমান লেন্স পাওয়ার ৮.১ ।
আমি আমার মালিকের অর্থাৎ আমার ব্যবহারকারীর সাথে আছি এই প্রায় সাড়ে তিন বছরের মতো। আমি তাকে আমার মালিক বলতে একদমই পছন্দ করিনা ,করবোই বা কেন ? অনেকদিন থেকেই আছি ,তাই ভালোবাসাটা অধিকারে রূপ নিয়েছে। ওর একটা সুন্দর নাম আছে আমার কাছে , ''অপরাজিতা ''।এই নামটা এই জন্য দিয়েছি যে ওকে শত কষ্টের মাঝেও আমি ভেঙে পড়তে দেখিনি। যখনই কাউকে জিজ্ঞেস করে,''আমার চশমাটা কই?'' তখনই আমি বুঝতে পারি ও আমাকে প্রচন্ড ভাবে খুঁজছে। আমাকে ছাড়া ও একদমই চলতে পারেনা।

আমি যখন অপরাজিতার কাছে প্রথম আসি সেই সময়টা বা ঘটনাটা আমার ঠিক মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে যে ও আমাকে অনেক পছন্দ করেছিল। একটা নীল রঙের প্লাস্টিকের বাক্সে করে আমাকে দোকান থেকে নিয়ে এসেছিলো। সেই থেকেই আমি ওর সাথে আছি। অনেক হাসি-আনন্দ,দুঃখ-বেদনা বয়ে গেছে এই বছরগুলোতে। কখনো ওর হাসির আনন্দে হেসেছি, কখনোবা ওর কষ্টের অশ্রু গড়িয়েছে আমার গা বেয়ে।
.
এতদিনে ও মোট তিনবার লেন্স পাল্টিয়েছে ,কিন্তু এই ফ্রেমটাকে খুব যত্ন করে আগলে রেখেছে। একবার ওর হাত থেকে আমি পরে গিয়েছিলাম বেশ খানিকটা নিচুতে ,তখন ওর সেকি আফসোস!! আমি স্পষ্ট শুনছিলাম, ও বারবার বলতেছিলো, "আল্লাহ , চশমাটার যেন কিছু না হয়''।আমি সেদিন কিছুটা হলেও বুঝেছিলাম আমার প্রতি ওর তীব্র ভালোবাসার আর্ত অনুভূতি।

এইতো বছর খানেক আগে ও একবার মারাত্ত্বকভাবে অসুস্থ হয়ে পরে,সারারাত ধরে বমি, শেষ রাতের দিকে শরীর একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেলো। ও বারবার বলতেছিলো ,''আম্মু , আমি আর বাঁচবোনা''। তারপর সকাল হলো ,ওকে এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো । আমি সারাটা পথ ওর সাথেই ছিলাম ,আর তাকিয়ে ছিলাম নির্বাক। সেবার ও অনেক দিন হাসপাতালে ছিল ,অনেক কষ্টে কেটেছিল ওর দিনগুলো। একটা জড়ো বস্তু হয়েও আমি প্রত্যাশা করছিলাম একটা আলাদিনের চেরাগের ,যা দিয়ে আমি ওর সমস্ত কষ্ট দূর করে দিতে পারি।

তবে সেবার সুস্থ হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ি ফেরার সময় ও খুব উচ্ছ্বাসিত ছিল,চোখ বড় বড় করে চারিদিকে তাকাচ্ছিলো ,হেসে হেসে কথা বলতেছিলো সবার সাথে। সে হাসিতে ছিল নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দ।

আমাকে নেয়ার প্রায় এক বছর পর ওর আবার চোখে কিছুটা প্রব্লেম শুরু হলো ,ডাক্তার যথারীতি চশমার পাওয়ার বাড়ালেন, আমাকে বদলানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। কিন্তু এবার বেঁকে বসলো ও । কিছুতেই এই ফ্রেম পাল্টাবেনা। ওর আম্মু বললো তাহলে তুই এইরকমই দেখতে একটা নতুন চশমা নে। এবারও সিদ্ধান্তে অটল রইলো ও। অবশেষে ঠিক হলো আমার ফ্রেমেই নতুন লেন্স লাগানো হবে। এভাবেই আমি চলে যেতে যেতে আবার ওর কাছে ফিরে এলাম।

চোখে কাজল ব্যবহার করতো ও ,এমনিতেই ওর চোখ গুলো খুব সুন্দর,তার উপর কাজল ওর চোখের মায়াকে কয়েক গুন্ বাড়িয়ে দিয়েছিলো। মাঝে মাঝে আমার নিজের উপর খুব বিরক্ত লাগতো যে আমি শুধু শুধু ওর চোখের উপর সারাক্ষন লেগে থেকে ওর সুন্দর চোখের মায়াকে আড়াল করে দিচ্ছি ,আবার এটা ভেবে গর্ববোধও হতো যে ও তো আমার সাহায্যেই এই সুন্দর পৃথিবীকে দেখে।

ও সাধারণত আঁচল দিয়ে লেন্স মোছে। ওর আঁচলের প্রতিটা স্পর্শ আমার কাছে আজও জীবন্ত। আমাকে নিয়ে অবশ্য মাঝে মাঝে ওর আম্মুর কাছে কিছুটা বকা খেতে হয়--''মোটা লেন্সের এক চশমা রাত দিন পরে থাকিস,তারপরেও কিছু দেখিসনা ?'' এটা নিয়ে অবশ্য ওর কোনো আফসোস তো ছিলইনা বরং দেখতাম ও মুচ্কি মুচ্কি হাসতেছে। সে হাসি দেখার জন্যে কোনো মানুষ অনায়াসে কয়েকটাদিন বেশি বাঁচার আবদার সৃষ্টিকর্তার কাছে করতেই পারে।একবার ওকে বলতে শুনেছিলাম ও নাকি ওর সমস্ত জীবনে মোট আঠাশটা চশমা ব্যবহার করেছে ,তবে আমার মতো এতদিন কোনো চশমা নাকি সে ব্যবহার করেনি বা পছন্দও হয়নি।মাঝে একবার হাত থেকে পড়ে লেন্স ফেটে যাওয়ায় আবার লেন্স পাল্টানো হয়েছে এবং শেষবার প্রায় মাস দুয়েক আগে পাওয়ার বাড়ানোর জন্য আবার লেন্স পাল্টানো হয়েছে। আর কত?-- হয়তো এবারই শেষবার ,তারপর হয়তো আমার আর অস্তিত্ব থাকবেনা,পরিণতি হবে আগের চশমাগুলোর মতো।

শুনেছি ,মানুষ তার প্রিয় কিছু কখনো নিঃশ্বেষ হতে দেয়না ,ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখে। আমিতো এক নিষ্প্রভ জড় বস্তু,আমার আবেদন ফুরিয়ে গেলে আমাকে কি আগলে লাগবে সেইরকম ভালোবাসায় ?!! এর উত্তর আমার অজানা। সামনে যে কয়টা দিন আছি ,অনুভুতিটা আগের মতোই থাকুক,এটাই আশা। তারপর হয়তো একদিন জায়গা হয়ে যাবে আলমিরার এক কোণে, সেই প্রথম নীল বাক্সে করে ভালোবাসার জিনিসগুলোর পাশে।

তারপর কখনোবা ধুলোপড়া বাক্স নাতি নাতনিদের বের করে দেখাবে আর বলবে ,''তোরা জানিস?-- এই চশমাটা আমি সবচেয়ে বেশি সময় ধরে পরেছি,আমার খুব পছন্দের''।আমি অনেকদিন বাদে আবার পাবো সেই হাতের ছোয়া , আঁচলের স্পর্শ। দেখতে পাবো সেই মায়া ভরা চোখ দুটো। আবার হতেও পারে, আমার স্থান ডাস্টবিনে কিংবা পুরোনো জিনিসের দোকানে .

মানুষ বিচিত্র ,বিচিত্র তার অনুভূতি ,অদভূত তার ভালোবাসা। তার মনের রং পাল্টায় ঘন ঘন। না ,আমি এইসব কিছু বুঝতে চাইনা ,ভালোবাসা আর অনুভূতি আমি জানতে চাইনা। আমার কাছে আলমিরা আর ডাস্টবিন একই ,আমি মানুষের মতো করে রং বদলাতে জানিনা।

কারণ ,আমি একটি জড় বস্তু ,একটি মেরুন রংয়ের চশমা। এটাই আমার পরিচয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ২:১১
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দেশনায়ক তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত করার নেপথ্যে  

লিখেছেন এম টি উল্লাহ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৮


আগেই বলেছি ওয়ান ইলেভেনের সরকার এবং আওয়ামীলীগের যবনায় জনাব তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পৌনে একশ মামলা হলেও মূলত অভিযোগ দুইটি। প্রথমত, ওই সময়ে এই প্রজন্মের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছিল দেশনায়ক তারেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পকে নিয়ে ব্লগারদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



**** এডমিন টিমের ব্লগারেরা আমাকে বরাবরের মতোই টার্গেট করে চলেছে, এভাবেই সামু চলবে। ****

ট্রাম্পের বিজয়ে ইউরোপের লোকজন আমেরিকানদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী শংকিত; ট্রাম্প কিভাবে আচরণ করবে ইউরোপিয়ানরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পের বিজয়, বিশ্ব রাজনীতি এবং বাংলাদেশ প্রসংগ

লিখেছেন সরলপাঠ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২১

ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশে বা দেশের বাহিরে যে সব বাংলাদশীরা উল্লাস করছেন বা কমলার হেরে যাওয়াতে যারা মিম বানাচ্ছেন, তারাই বিগত দিনের বাংলাদেশের ফ্যাসিস্টের সহযোগী। তারা আশায় আছেন ট্রাম্প তাদের ফ্যাসিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠেলার নাম বাবাজী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩১

এক গ্রামীণ কৃষক জমিদার বাড়িতে খাজনা দিতে যাবে। লোকটি ছিলো ঠোটকাটা যখন তখন বেফাস কথা বা অপ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করে ক্যাচাল বাধিয়ে ফেলতে সে ছিলো মহাউস্তাদ। এ জন্য তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×