১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩
শরৎ এর আকাশটা আমার খুব বেশী প্রিয় । আর নদী-পাড়ে বসে ওপাড়ের কাশবনটা দেখতেও বেশ ভালো লাগে । তার সাথে মন খারাপ করা একটা অনুভূতির মিশ্রণ । মন খারাপ ভাবটা এমনি এমনিতে না আসলে জোর করে নিজের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া যেতে পারে । আজ আমার মন এমনিতেই খানিকটা বিষণ্ণ । কারণটা হয়তো খুব ছোট । বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘ইছামতী’ বইটা পড়ছিলাম । শেষের দিকে কিছু পৃষ্ঠা নেই বইটার । পুরনো,সেলাই-হীন,ক্ষয়ে যাওয়া বই । পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে হারিয়ে গেছে হয়তো কোথাও । হিমুকে জিজ্ঞেস করতে হবে উপন্যাসটার শেষের দিকে কি ঘটেছিল । তবে সেটা পরের কাজ । আমি এখন নাহয় সর্বোন্দ্রীয় দিয়ে অনুভব করি এই বিকেল বেলা । নদী-পাড়ের প্রকৃতি, সবুজ ঘাস, নাম না জানা পাখিগুলোর ডাক, খেয়াঘাটে লাগিয়ে রাখা নৌকার প্রাচীন মাঝিটির মুখে তামাক টানার গুড়গুড় শব্দ; লোকটাকে মনে হচ্ছে জাদুঘরে লটকে রাখা কোনো চিত্রকরের হাতে আঁকা ছবি থেকে উঠিয়ে আনা হয়েছে ।
আমি যে জায়গাটাতে আধশোয়া হয়ে আছি, এখানে খুব প্রয়োজন না পড়লে কেউ আসে না । চারদিকে ঝোপঝাড়, পুরু ঘাস । পোকামাকড়ের অভয়ারণ্যও বটে, সে কারণে পুরোপুরি শুয়ে পরতে পারছি না । আমার পেছন দিকে বাঁশের ঝাড় রয়েছে একটা । মাটি থেকে কয়েক ফুট উপরে ওগুলোর গোঁড়া । নিচের মাটি সরে গেছে, আমার জন্য সুবিধা করে দিয়েছে । হঠাৎ বৃষ্টি হলে ওখানটায়, ঐ প্রাকৃতিক গর্তের মাঝে আশ্রয় নিতে পারবো, কাদায় জামাকাপড় নোংরা হবারও উপায় নেই । আকাশ অবশ্য বেশ পরিষ্কার । শেষ বিকেলের রবি দিনের সর্বশেষ রৌদ্র-প্রতাপ দেখিয়ে নিচ্ছে । চারপাশে ঘন সবুজ প্রকৃতি । চোখে নেশা লাগিয়ে দেয় যেন । দিনের পর দিন দেখেই আসছি, তবু পুরনো হয়ে যায় নি জায়গাটা । হিমুরা শহর থেকে এসে বাড়ি বানিয়েছিল এই নদী-পাড়ে । কতো হাসিখুশি একটা পরিবার, কত আনন্দে মাতিয়ে রাখতো চারপাশ! আর প্রতিদিন নতুন করে মুগ্ধ হতো এই বিপুল সবুজ দেখে । অথচ ওরা এখন আর এখানে আসে না । জায়গাটা পুরনো হয়ে গেছে তাদের কাছে । হুট করে যে ভালোবাসা তীব্র হয়ে যায়, তা মিলিয়ে যেতেও সময় লাগে না বেশী । অথচ আমি এখনো এই নদী-পাড়, গাছপালা, ঝোপঝাড় সবকিছু আগের মত করেই ভালোবাসি । আমি জানি, আমি ভালোবাসতে জানি...
প্রৌঢ় সূর্যটার দিকে চোখ রাখি বাঁশঝাড়টার মাঝ দিয়ে । সে দিক অনুসরণ করতে গিয়ে চোখ পড়ল একটা বাড়ির ছাদের উপর । ঐ বাড়িটাও খুব পরিচিত । কত দিন গল্পের বই পড়েছি ঐ ছাদের চিলেকোঠায় শুয়ে, এমনই কোনো শরতের রাতে টেলিস্কোপে দেখেছি কালপুরুষ, সপ্তর্ষি... শুনতাম গ্রীক মিথলজিতে রূপান্তরের গল্প, যে, প্রাচীন গ্রীকরা বিশ্বাস করতো এই কালপুরুষ আসলে দেবী আর্টেমিসের ছয় সখী আর এক বন্ধু । এরকম নানা গল্প-কথা,দর্শন,বিজ্ঞান,ইতিহাস, রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা, কবিতা আবৃত্তি, কখনো কোরাসে গাইতাম গান । বাড়িটা হিমুদের । বহুদিন যাওয়া হয় না সে ছাদে । অযত্ন অবহেলায় শ্যাওলা জমে গেছে সে ছাদের রেলিং এ । এতদূর থেকেও বেশ বোঝা যাচ্ছে । মনটাই খারাপ হয়ে গেল...এবারে খুব বেশী ।
আধশোয়া থেকে উঠে দাঁড়াই । পাঞ্জাবীর হাতায় উঠে আসা গুবড়ে পোকাটায় সজোরে টোকা দিয়ে দূরে ফেলে দিই । দাঁড়ানোয় এবারে বেশ খানিকটা দূরে নদীর মাঝখানে বালু-তোলা স্টিমারটা দেখা গেল । সে স্টিমারটার কর্মচারীদের মধ্যেও নেই কোনো প্রাণ-চাঞ্চল্য । সৃষ্টির আদি-লগ্ন থেকেই যেন তারা একাজ করে আসছে । প্রত্যেককেই ক্লান্ত দেখায়, মুখের ভাবেও নেই কোনো বিকার । সবাই একসাথে থেকেও যেন কিছুই নেই । ওরা সবাই নিঃসঙ্গ, ওরা সবাই ক্লান্ত । ঠিক যেন আমারই মত ।
একেবারে পাড়ে বসে নিচে পা ঝুলিয়ে দিলাম এবার । কোনো আনন্দের গান গাইতে ইচ্ছা করছে । অথবা কবিতা...নাহয় নিতান্ত একটা ছড়াই ? কিন্তু মনে পড়ছে না কিছুই । নিজের উপর মেজাজ খারাপ হচ্ছে খুব । হাতের কাছে কিছু ঢিল কুঁড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারলাম নদীতে । বৃষ্টির ফোঁটার মত শব্দ করে ডুবে গেল সেগুলো । আমার কানে লেগে থাকল কেবল শব্দটা । ঝর,ঝর,ঝর একটা শব্দ । মাথার খুব ভেতরে গিয়ে যেন বাজে, শুনতে ভালো লাগে । তখন আমার মনে পড়ল ছোটবেলার খেলাটার কথা । যতটা সম্ভব নদীর পানির সমান্তরাল করে ঢিল ছুঁড়ে মারা । ঢিলটা তখন একবারেই ডুবে না গিয়ে পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে উপরে উঠে আসবে । এরকম কয়েকবার করার পর একসময় ডুবে যাবে । কিশোর বয়সে এ খেলাটা খেলতাম আমি,হিমু আর হিমুর বাবা ।
হিমু । আমার বন্ধু । আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ।
হিমুর বাবাকে সবসময় নিজের বাবার মতই মেনে এসেছি । আর হিমুর মা, যেন পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াবতী সে মা ।
আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন লেদকাটার মেশিনে চাপা পরে । আমি তখন খুব ছোট, বেশ মনে পড়ে দৃশ্যটা । বাবার পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে এসেছিল, আর শরীরটা যেন কয়েক দস্তা শিরিষ কাগজের মত হয়ে গিয়েছিল, উপরে রক্তিম তরলের প্রলেপ । কারখানার লোকজন মা’কে লাশটা দেখায়নি, আমি লুকিয়ে গিয়ে দেখে ফেলেছিলাম ।
আমার মা । হয়তো দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্টতম মা । মা’কে নিয়ে লেখা কত গল্প, কত গান শুনি! অথচ আমার মা’কে সবসময় আমার কাছে বিভীষিকার মত লাগতো । মা আমাকে কখনো খাইয়ে দিয়েছেন কিনা মনে পড়ে না, কখনো মাথায় হাত রেখে গায়ের জ্বর মেপেছেন কিনা মনে পড়ে না, মনে পড়ে না শেষ কবে আমার সাথে একটুও ভালো করে কথা বলেছেন । মাকে আমার একদম ভাল্লাগে না । হিমুর মা’র মত যদি আমার মা হতেন!
খেয়াঘাটের মাঝি উঠে দাঁড়িয়েছে । কেউ এসেছে নদী পেরোতে । আজকাল কেউ সহজে নৌকায় নদী পেরোতে আসে না । কাছেই খুব সুন্দর একটা ব্রীজ বানানো হয়েছে মাস-খানেক আগে ।
মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখি দুজন কমবয়সী ছেলে । শেষ বিকালে ছোটখাটো এডভেঞ্চারে এসেছে হয়তো । স্বাভাবিক, আমরাও আসতাম । আমি,হিমু,পিয়াল,তপু । হিমুকে অদ্ভুত লাগতো তখন । নানারকম দেশের ইতিহাস, নানা ভাষার সাহিত্য,মাথামুণ্ডু-হীন দর্শন নিয়ে কথা বলতো । কিন্তু তবুও বাড়ি ফেরার পর হিমুর ওসব কথাবার্তা মাথায় ঢুকে বসে থাকতো, ভাবাতো খুব ।
মা চাকরী নিয়েছিলেন কাছেই, একটা প্রাইমারী স্কুলে । স্কুল শেষে দুটো বাড়িতে পড়াতে যেতেন, ফিরতে ফিরতে সূর্য লম্বা ডুব দিত নদীতে । আর এসে ধমকাতেন আমাকে, কখনো মারতেনও । এখনো সেই রুটিন অব্যাহত আছে । মারটা অবশ্য দেন না ।
গল্প-উপন্যাসে কষ্ট করে চলা পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েরা ক্লাসে ফার্স্ট হয় সবসময়, আমি হতে পারিনি । মা’র মার খেয়ে কখনো কখনো হাতজোড় করে প্রার্থনা করতাম যাতে উপন্যাসের চরিত্র হয়ে যেতে পারি । ছোটবেলার ফ্যান্টাসি...
উঠে দাঁড়াই এবার । ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়েই পাড় ধরে হাঁটি । সদ্য শেষ হওয়া বর্ষার নরম কাদা থেকে পা বাঁচিয়ে সাবধানে হাঁটতে থাকি । দেড় মাস আগেও এ পুরো অংশটাই ছিল পানির নিচে । ভেজা মাটির খপ্পর থেকে সহজে রেহাই পাওয়া যায় না তাই ।
হিমুর সাথে ঘনিষ্ঠতার সপ্তাহ-খানেকের মধ্যেই ওদের বাড়িতে যাই । হিমুর মা,বাবা আর হিমুর চেয়ে বছর দেড়েকের ছোট বোন, ইভা । বাসার খুব কাছেই হওয়ায় ওদের বাড়িতে নিয়মিত আনাগোনা ছিল আমার । একটা সময় এমন হল যে, নিজের বাসা আর হিমুদের বাড়িটার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য করতে পারতাম না । আর হিমুর চেয়ে বেশী বন্ধু হয়ে গেলাম ওর বাবা,মা’র সাথে । মধ্যবয়স্ক হিমুর বাবার সাথে ফুটবল খেলতে গিয়ে অনায়াসে ল্যাঙ মারতাম, ও বাসায় হিমুর মা’র হাতের রান্না খেয়েছি বহুবার, ইভার চুল টেনে দৌড়ে পালিয়েছি প্রায় প্রতিদিনই । আর হিমুর সাথে নদীর ওপাড়ে নিত্যদিনের এলান কোয়ার্টারমাইন হয়ে ঘুরে বেড়ানো তো আছেই । এতো উচ্ছ্বাস,আনন্দের মাঝে অপ্রাপ্তিটা মূলত বাড়ি ফেরাতেই । সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে বাড়ি ফিরে মা’র জন্য অপেক্ষা । একসময় মা ফিরেন, আমরা একসাথে বসে খাই । মা আমার লেখাপড়ার খোঁজ নেন, ঝাড়ি দেন, স্কুল থেকে বেতন-ভাতা না পেলে সে রাগ আমাকে মেরে মেটান । তারপর মা কাঁপা কাঁপা হাতে সেলাইয়ে বসে যান, আমি বসি সুর করে পড়ায় । মা’র ঝিমুনি এলে হিমুদের বাড়ি থেকে ধার করে আনা বই, পাঠ্যবইয়ের উপরে নিয়ে ধরে অনায়াসে গিলতে থাকি । কখনো কখনো মা’র ঝিমুনিটাই গাঢ় ঘুমে পরিণত হয় । এলোমেলোভাবে শুয়ে থাকতে দেখে আমার সেই জঘন্য মা’কে প্রচণ্ড ভালোবাসতে ইচ্ছে করে...
কাদামাখা পথ পেরিয়ে এখানে শক্ত মাটি । জায়গাটা একটু উঁচুও । পলিমাটির কালো কালো গর্তগুলো বিশালাকার ফোস্কার মত দেখাচ্ছে । এজায়গাটা থেকে আরেকটু দূরেই থাকা দেবদারু গাছের সারিটা দেখা যায় । ওখানে দুপুরের প্রখর রোদের সাথে মুফতে লিলুয়া বাতাস পাওয়া যেত । হিমুর মা, মানে খালার খালি গলায় গান, ত্রয়ীর মানে আমি,হিমু আর খালুর তর্কযুদ্ধ প্রবল প্রতাপে চলতো ছুটির দিনগুলিতে । কেবল চুপচাপ থাকতো ইভা । এখনো কান পাতলে যেন সেই সব নীরবতা ভঙ্গকারী পাপী কলরবগুলো প্রাচীন প্রেতাত্মার মত ভেসে ভেসে বাজতে থাকে এখানে । আর কেউ শুনতে না পেলেও, আমি ঠিকই শুনতে পাই তা...
আমরা বড় হই । আমরা বলতে আমি,হিমু,ইভা । খালু,খালা বা আমার মা, বড় হন না । উনাদের বয়সটাই বাড়ে শুধু, প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতায় । আমাদের নিয়মতান্ত্রিক হাস্যোচ্ছ্বলতায় ভাঁটার টান পড়ে । নাক আর ঠোঁটের মাঝের শুকনো রোঁয়ার মত লোমগুলোর সঙ্গী হয় দু’গালে চাপ চাপ, সদ্য গজানো দাঁড়ি । মনোজগতে বিরাট না হলেও অনেকটাই পরিবর্তন আসে, টের পাওয়া যায় তা । সেই বয়সে এসে যেন খালার করা সমাজসেবা মূলক কাজগুলোর কিছু কিছু বুঝতে পারছিলাম । পৃথিবীর হাওয়া-জল-নির্মলতায় বড় হয়ে নির্জীব পদার্থ হয়ে থাকাটা আমাদের কাজ নয়, এই পৃথিবীর প্রতিও আমাদের কিছু দায়িত্ব রয়েছে, কিছু কর্তব্য আছে --- খালাম্মার এসব শক্ত শক্ত কথাগুলোর গূঢ় অর্থগুলো একটু একটু টের পাওয়া শুরু করেছিলাম । যার ফলে ঈদ-পূজোয় আমাকে পাওয়া গেল রেললাইনের পাশের বস্তি গুলোয় খালাম্মা আর হিমুর সাথে, জামাকাপড় বিতরণে । কি যে আনন্দ! কত ভালোলাগা!!
আমার বদরাগী মা প্রায় কোনোকাজেই এর আগে কখনোই আমাকে বাঁধা দেননি বা নিষেধ করেননি । এবার করলেন । একদিন হয়তোবা আমাকে মারার উদ্দেশ্যেই ঘরের বাইরে থেকে আটকে পাশের শিমুল গাছের কচি ডাল পাড়তে গেলেন । মার খেয়ে অভ্যস্ত আমি, তাই ব্যাপারটা আমলে না নিয়ে কারণটা জানার ব্যাপারে বেশী আগ্রহী ছিলাম, মারটা কেন খেতে যাচ্ছি ?
মা ঘরে এসে প্রথমেই এক দফা আমার পিঠে চাবুকের মত ডাল দিয়ে বানানো বেতটা দিয়ে মারা শেষে আমাকে বললেন বামহাত উপরে উঠাতে, উঠাই । উনি দেখালেন আমার শার্টের বামপাশটার বেশ ভালোরকমেই ছেঁড়া অংশটুকু । তারপর আমাকে আনতে বললেন আমার একমাত্র জুতোজোড়া । খুঁজতে হয় না, সহজেই বোঝা যায় এটা বহুবার মুচির হাতুড়ি-বাটালের হাত ঘুরে এসেছে । মা এরপর আমাকে বুঝাতে চাইলেন, যে ছেলের নিজেরই এই অবস্থা, সে করছে গরীবদের সাহায্য, এটা কি যৌক্তিক কিনা । তারপর তিনি বলতে চাইলেন, কিভাবে হিমুর বাবা,মা আমাকে এভাবে পক্ষান্তরে অপমান করছেন । আর এসব বলার সাথে সাথে মহা ক্ষিপ্ত অবস্থায় হাতের বেতটা আমার পিঠে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে একসময় কেঁদে ফেললেন । সেদিনের পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে বিস্ময়কর ছিল । মা কখনই এতো কথা আমার সাথে বলেন নাই, আমার কখনই মনে হয় নাই হিমুর বাবা-মা আমাকে অপমান করছেন, আর তারচেয়েও বড় কথা... মা’কে সেদিনের আগে কোনোদিন কাঁদতেও দেখিনি । চমকের পর চমক!
তারপর আর কিছু হয়নি । মা একসময় স্বাভাবিক হয়ে গেলেন । সব ভুলে আমিও আবার চলে যাই হিমুদের বাড়িতে । খালার পাশে পাশে ঘুরঘুর করতে থাকি । খালুর সাথে বসে দেশ পাল্টানোর আলাপ করি । হিমুদের লাইব্রেরী ঘরে গিয়ে একটার পর একটা বই পড়তে থাকি । কিন্তু পরিবর্তনটা হল অন্যভাবে । চঞ্চল হলেও চুপচাপ থাকি, এরকম একটা কথা প্রচলিত আছে আমার নামে । সেটাকে আরো ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকলাম । বয়ঃসন্ধিকালে যে এতো যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে, সেটা কে কবে ভেবেছিল!
দেবদারু গাছগুলোর কাছে পৌঁছে গেছি । সূর্য আরো নেমে এসেছে । দিগন্তের সাথে মিলিয়ে যাবে খানিকক্ষণ বাদেই । সেখান থেকে উঁচু ঢিবির মত জায়গাটায়, আর তারপরের কিছুক্ষণ পরেই আমাকে যেতে হবে হিমুদের বাড়িতে । ওটাই মোক্ষম সময়...
খালার সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে তুমুল সমর্থন দিলেও খালু নিজে কখনোই আসতেন না আমাদের সাথে । সেটা নিয়ে খালা আর খালুর মাঝে খুনসুটি লেগে যেত আমাদের সামনেই । আমি আর হিমু এসময় কখনো পক্ষ নিতাম খালার, আবার কখনো খালুর । তবে যেদিন বা যখন আমরা খালুর পক্ষ নিতাম, সেদিন খালা কপট রাগ দেখিয়ে আমাদেরকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ সম্বোধন করতেন । আমাদের তা শুনতেও বেশ ভালো লাগতো । বয়স্কদের ছোটদের মত আচরণ দেখার চেয়ে বেশী আনন্দ আর নাই । পাগলদের প্রতি হয়তো তা-ই বেশী আকৃষ্ট হয় শিশুরা... আমরা অবশ্য আর শিশু নই । বড় বড় লাগে এখন নিজেদের । খুব বড় ভাবতেও খারাপ লাগে না । কৈশোর-যৌবনের সেই দোটানাময় সময়কালে খালা-খালুর সেইসব স্মৃতিগুলো রাতে স্বপ্নের মধ্যে এসেও দেখা দিত । আর তাতেই হল সর্বনাশ । আমার মাঝে নিষিদ্ধ ঘোষিত প্রেমিক-ভাব এসে গেল । বেশিদূর যাওয়া লাগে নি । ছোটবেলা থেকে একসাথে বেড়ে ওঠায় আর মনস্পটে ভালোমতোই আঁচড় ফেলে রাখায়, আমি ভালোবাসতে শুরু করি হিমুরই ছোটবোন ইভাকে...
কিছুক্ষণ আগেই শেষ করা ইছামতী বইটার কথা মনে পড়ছে । বইটার একজন চরিত্র, অনেকটা সন্ন্যাসীর মত । লোকটা সন্ন্যাস-ব্রত নিয়েও ছিলেন, কিন্তু একসময়ে তার সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়া হল একই পরিবারের তিন বোনের সাথে, একসাথেই । উপন্যাসটার প্রেক্ষাপট এদেশে নীলচাষের সমসাময়িক ছিল । গল্পে আরো অনেক চরিত্র থাকলেও আমাকে আকৃষ্ট করেছিল ঐ সাধু লোকটাই । ইসলাম ধর্মের মারফতি,সুফিবাদ, হিন্দুধর্মের সন্ন্যাসী, বৌদ্ধভিক্ষু, বাউলদের প্রতি খালু আর হিমুর বেশ আগ্রহ । তা দেখে আমার মাঝেও তার প্রভাব পড়েছে । আহমদ শরীফ থেকে শুরু করে রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন পর্যন্ত কিছু কিছু বই আমিও পড়েছি । পড়েছিলাম মনসুর বিন হাল্লাজের কথাও । কিন্তু মূল ব্যাপারটা হল, পুরো ইছামতী বইটাতে সন্ন্যাসী লোকটার সন্ন্যাসব্রতের চেয়ে বেশী ভালো লেগেছে, পরিবারের প্রতি তার অচেতনভাবে আকর্ষণের বর্ণনা । পতির প্রতি পত্নীর প্রেম । ছেলের প্রতি বাবার ভালোবাসা । সত্যি বলতে কি, পুরোটা জুড়ে আমি কেবল ইভাকেই কল্পনায় সাজিয়েছি । ওর মনকে যদি মানানো যেত...
এসব ভাবতে ভাবতেই ঝট করে সরিয়ে নিলাম আমার পা । মাথানিচু করে হাঁটি বলে গোবরটা চোখে পড়েছিল, নাহলে প্রায় মাড়িয়েই ফেলেছিলাম! হঠাৎ করেই মনে পড়ল, আমার এই মাথানিচু করে হাঁটা নিয়েও খালা কিছু কিছু কথা বলেছিলেন ।
কোনো এক খামখেয়ালী বর্ষার বিকালে বৃষ্টিতে ভিজে হিমুদের বাড়িতে এসে শুনলাম, আজ সবাই বৃষ্টিবিলাস করবে । সবাই বলতে আসলে খালু আর হিমু । খালা বা ইভা, কারোরই বৃষ্টিতে ভেজার শখ নেই । তাই ওঁদের সাথে সাথে আমিও এখনকার শ্যাওলা পড়া, আর তখনকার সেই চমৎকার ছাদে উঠে যাই । বৃষ্টিতে ভেজা শেষে চিলেকোঠায় দাঁড়িয়ে থাকা খালা আমাকে ডাকলেন । কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি হীনম্মন্যতায় ভুগি কিনা । খানিকটা হলেও চমকে উঠি । খালা সেটা লক্ষ্য করলেন । তারপর বললেন আমি নাকি এতক্ষণ ধরে ছাদের একটা কোণে থেকে চুপচাপ হিমু আর খালুর দিকে তাকিয়ে ছিলাম । মোটেও ওদের সাথে আনন্দে ভিজতে পারিনি । আমি আরো অবাক হয়ে যাই । কারণ, আমার মনে হচ্ছিল এই সারাটাক্ষণ জুড়ে আমি এতো লাফালাফি,উচ্ছ্বাসে ফেটে পরলাম...আর আমি নাকি একদমই নড়াচড়া করিনি! খালা কি আমার সাথে কোনোরকম
মজা করছেন আমার সাথে ?
উনার মুখ দেখে অবশ্য তেমন কিছু মনে হয়নি । বেশ সিরিয়াস । তিনি আমাকে নিচে ডেকে নিয়ে তোয়ালে দিলেন । জেরা করার ভঙ্গিতে তাঁর সামনে একটা চেয়ার রেখে আমাকে বসতে বলেন । ইভাকে ভালোবাসার কথা বুঝে ফেললেন কিনা এটা ভেবে ঘামতে ঘামতে আমি বসি তাতে । তিনি জিজ্ঞেস করেন, আমি ওরকম মাথা নিচু করে হাঁটি কেন সবসময় । গত প্রায় দুই বছর ধরে আমি একেবারেই হাসতে ভুলে গেছি, সেটাও বা আমি খেয়াল করেছি কিনা । আমি এমন জীবন্ত মূর্তির মত হয়ে যাচ্ছি কেন, এসব ।
আমি বোকার মত মাথা চুলকোই । মনে মনে অবশ্য বেশ ঝড় উঠে গেছে । গত দুই বছর ধরে আমি ‘জীবন্ত মূর্তি’ হয়ে আছি ! কিন্তু কেন ? তাহলে আমি যে উচ্ছ্বাস, আনন্দ নিয়ে ঘুরি, ফিরি এসব কি কেউ দেখতে পায় না ? এ কীভাবে সম্ভব ! নাকি খালা অন্য কিছু সন্দেহ করছেন, যেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এসব কথা দিয়ে বলতে চাইছেন ? শেষেরটাই বেশী যৌক্তিক মনে হল । খালা আমার উত্তরের জন্য তাগাদা দিলে আমি একটু উশখুশ করে বয়োসন্ধিকালীন সময়ের উপরে দোষ চাপিয়ে দিলাম ।
খালা এরপর সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে আমি সেই আদি, অকৃত্রিম ভয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকলাম । কিছুক্ষণ বাদেই তিনি আমাকে বলেন এ নিয়ে পরে কথা হওয়ার কথা । আমি তা মেনে নিয়ে মাথা নামিয়ে ত্রস্তপায়ে পালাই ।
তার ঠিক পরের দিনই হিমুকে শহরের দিকে ইভাকে টিউটরের কাছ থেকে আনার জন্য পাঠিয়ে দিয়ে আমাকে নিয়ে বৈঠকে বসা হল । বৈঠকের জায়গাটা ছিল এই এখানেই, নদীর পাড়ে দেবদারু গাছগুলোর নিচে । উনারা আগে থেকে কি আলাপ করে এসেছিলেন, জানা ছিল না আমার । তাই অন্যমনস্ক হয়ে মাথা নিচু করে ছিলাম চুপচাপ । একসময় খালু নানারকম কথা বলে আমাকে হাসানোর চেষ্টা করে শেষে বললেন, “জয়, তোর এই অবস্থাটাকে বলে ডিপ্রেশন । তোর মত বয়সে আমারও এরকমই ছিল । আর আমি তখন কি করেছিলাম শোন…কোনোকিছু না ভেবেই ঝপ করে প্রেমে পড়ে গেলাম তোর খালার উপর । তারপর দেখ! উপদ্রবের মত ভালোবাসি বলে তোর খালা বিরক্ত হলেও শেষমেশ ঠিকই আমার সাথে টিকে গেছে । এমনটাই হয় জানি । বুঝাই যাচ্ছে তোর একজন দেবী দরকার, সেটাই তোর সমাধান”--- হ্যাঁ । বিজ্ঞ বিচারকের মত রায় দেয়ার ভঙ্গিতে ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলেন খালু । আমার হার্টবিট বোধহয় তখন একশ চুয়াল্লিশে । তবুও চেষ্টা করলাম, চেহারায় লাজুক ভাব আনতে । খালা ঠাট্টাচ্ছলেই জিজ্ঞেস করলেন, আছে নাকি আমার তেমন কেউ । আমিও কোনোকিছু না ভেবেই বোকার মত বলে বসলাম যে আছে একজন । খালু তখন ছোট বাচ্চাদের মত খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে বললেন আমি নাকি অর্ধেক কাজ প্রায় করেই ফেলেছি । তারপর জিজ্ঞেস করলেন আমি মেয়েটিকে এ বিষয়ে কিছু জানিয়েছি কিনা । আমার না সূচক উত্তর শুনে তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন হয়ে যাবে সব, অত ভেবে কাজ নেই । আরো বললেন, গম্ভীর হয়ে না থেকে হাসিখুশি হয়ে থাকতে । চেষ্টাচরিত্র করে তখন এক হাসির মুদ্রা ঠোঁটে ফুটিয়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টায় লিপ্ত হয়ে যাই ।
বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে এখন । গাছগুলোর নিচে বসতে ইচ্ছে করলেও উপায় নেই । এইতো আরেকটু সামনের ঐ উঁচু ঢিবিটা দেখা যাচ্ছে, ক’দিন আগেই ওখানটায় মাটি খুঁড়েছিলাম । কি একটা দিন যে ছিল! ওখানটায় গিয়ে বসা যাবে ।
আমাদের জীবনটা ঠিকঠাক নাকি পুরাটাই বোকামি নাকি ব্যর্থতার ব্যাপার, সেগুলো পত্রিকার সাময়িকীগুলোর জন্যই নাহয় বরাদ্ধ থাক, নিজের ব্যাপারে বারবার অসহায় বোধ করেছি আমি । ভুল করেছি...বার বার ।
ইভাকে ভালোবেসে ফেলাটাও কি ভুল ছিল না ?
উত্তর যখন অজানা, তখন তা নিয়ে আর তর্ক করতে আগ্রহ পাই না । হয়তোবা ভুল । তেমন এটাও হয়তোবা ভুলই ছিল যে, দিনের পর দিন আমি খালা,খালুর কাছে ইভাকে নিয়ে আমার মাঝে যা যা অনুভূতি আসে সব বলে ফেলতাম । অবশ্যই ইভার নাম গোপন রেখে । আমি ওর নাম দিয়েছিলাম ‘সিনোরিটা’। কখন ইভা একবারের জন্য হলেও হেসে আমার দিকে একটু তাকিয়েছিল, কখন আমার মনে হয়েছে পূর্ণিমার রাতে নদীর ধারে ইভার হাত ধরে চুপচাপ বসে থাকব, কখনোবা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে প্রাণভরে কাঁদতে পারবো – এসবই বলতাম তাঁদের কাছে - সংকোচে, দ্বিধায়, লজ্জায় । কেন যেন মনে হত তাঁরা আমার এইসব কথাগুলো শুনে বেশ আনন্দ পেতেন ।
“কাঁদবি ? কাঁদবি কেন ?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন খালা ।
আমি উত্তর দেইনি । দিবো কি ! উত্তর তো আমার জানা নেই... কাঁদতে ইচ্ছে হত, তাই বলতাম ।
তরুণ হিমু এখন অনেকটাই অজানা,অচেনা । আমাদের সকলের কাছেই । ছোটবেলার এডভেঞ্চারের ভূত আমার মাথা ছেড়ে অনেক আগেই বেরিয়ে গেলেও হিমু আকৃষ্ট হয়েছে তাতেই । বৈষয়িক ভাবনা নেই দেখে কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেও খালা যেন একটু প্রশ্রয়ই দিতেন হিমুর এই স্বভাবকে । আর খালু তো প্রকাশ্যে বলেই বেড়াতেন হিমু যদি মার্কো পোলো হয়ে যায় তাতে তিনি বরং গর্বিত বোধ করবেন । সহজেই অনুমেয়, হিমু তাই বাইরে বাইরেই থাকতো বেশীরভাগ সময় । লেখাপড়া আর রাতে ঘুমানো বাদে বাকি সময়টা আমার তাই কাটতো হিমুদের বাড়িতেই । খালা,খালুকে সঙ্গ দেয়ার জন্য তো অবশ্যই । আমার নিজের সঙ্গ লাভের জন্যেও বটে । আমার মা ততদিনে অনেকটাই পার্শ্বচরিত্রে; কেন কে জানে ।
ব্যাপারটা ঘটল আচমকাই । খালু একদিন বলে বসলেন আমি নাকি অনেক রোমান্টিকতা দেখিয়ে ফেলেছি, এখন সেটা সিনোরিটাকে জানানো উচিত । খালুর কথার উত্তরে কি জবাব দেবো তা ভাবতে না ভাবতেই খালা আমাকে চেপে ধরলেন “মেয়েটা কে রে ? সত্যি করে বল ”— তা বলে । স্বভাবতই পুরনো ভয়টা জেগে উঠলো, তাঁরা কি কিছু জেনে ফেললেন ?
মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা । একদিকে খালার দেয়া তাগিদ, অন্যদিকে খালুর বলা কথা...দুটোই মাথায় ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছিল । সিদ্ধান্ত নিলাম, ইভাকে আমি জানাবো...জানাবো আমার সকল অনুভূতি...আমার নির্ঘুম রাতের যন্ত্রণাক্লিষ্ট হাহাকারের বর্ণনা ।
মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে নিচ্ছিলাম, যা বলা দরকার তা মনে মনে শতবার রিহার্সাল করছিলাম । মনের ভিতরেই বাঁধ সাধলো আরেক জায়গায় । ব্যাপারটার পরিণতি নিয়ে । আমি যদি ইভাকে সবকিছু জানাই, ও হ্যাঁ বা না বলার আগেই খালা-খালুকে জানাবে । এটা ভাবতেই সেই পৌষ মাসের শীতল হাওয়া যেনো বহুগুণে আমার গায়ে এসে লাগলো । এতদিন ধরে বন্ধুর মত করে খালা-খালুর সাথে যেসব কথা বলে এসেছি, তারা যখন জানবে যে সেই মেয়েটা আর কেউ নয়,তাদেরই মেয়ে... তখন যত উদারই হোন, এটা কি মেনে নিবেন ? কোনোভাবেই না ! আমি তো কোনো কমেডি মুভিতে অভিনয় করছি না । আমি তো কোনো মহাযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নই । আমি তো...একেবারেই সাধারণ একটা মানুষ ... যার বাবা লেদকাটা মেশিনে মাংসপিণ্ড হয়ে মারা যায়, যার মা তাকে মারধর করে নিজের অভাবের রাগ মেটান, যার একমাত্র জুতোজোড়ায় মুচিদের অজস্র গালিগালাজ আর সৃজনশীলতা, পরীক্ষায় কখনই ভালো ফল না পাওয়া...
আমি তাহলে কি করবো এখন ? কি করা উচিত ??
এজন্যেই বহুবার নিজেকে জিজ্ঞেস করে গেছি, ইভাকে ভালোবাসাও কি আমার অন্যতম বড় ভুল নয় ?
অন্তত সেদিন মনে হয়নি । সেসময়ে মনে হয়নি । সেই মুহূর্তে মনে হয়নি ।
ইভা আমাকে মেনে নিতো কি নিতো না, তার পিছনে মনে মনে অজস্র ‘না’ উত্তর পেলেও আশাবাদী ছিলাম । মনের ভেতর একটা তাড়না ছিল, আমার ইভাকে পেতেই হবে, তা যে করেই হোক । একথা ভাবতে গিয়ে হুট করেই একটা চিন্তা এলো মাথায় । একটা কাজ করতে হবে । একেবারেই ছোট্ট একটা কাজ । সেটা করলেই হয়তো ইভাকে আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে পারবো । ইভা রাজি হবে । আমরা সুখী হবো । বছর-খানেক বাদে আমরা বিয়ে করবো । আমাদের বাচ্চা হবে । পাখির মত কিচিরমিচির করে বেড়াবে ওরা । হিমুর বাবা-মা’র মত করে আমরাও এই নদী-পাড়ে একটা বাড়ি বানাবো । আমরা সুখী হবো । সত্যিই খুব বেশী সুখী হবো... বললাম না, আমার তখন একেবারেই মনে হয়নি যে ইভাকে ভালোবাসা আমার কোনো ভুল ছিল না ?
আমার সিদ্ধান্তটা ছিল, হিমু-ইভার বাবা-মা’কে অর্থাৎ আমার সাথে এতোটা কাল ধরে বন্ধু সুলভ আচরণ করে আসা, বলা ভালো আমার প্রিয় বন্ধুও, সেই খালা-খালুকে আমি খুন করবো । ওরা না থাকলে ইভা কখনই আমার বিত্ত-বৈভবের অভাবের কথা ভেবে অরাজি হবে না । আর তাছাড়া...তাছাড়া, ওরা অনেক কিছু জেনে গেছেন । ওরা বেঁচে থাকলে আমাকে সারাটা জীবন নর্দমার কীটের মত ভাববেন, বিয়ে তো দূরের কথা, ইভাকে ভালোবাসার কথা জানলে ওদের বাড়িতেও আর কখনো যাওয়া সম্ভব হবে না । বাবা যখন লেদকাটা মেশিনে চাপা পড়ে মারা যান, সেই স্মৃতি আমার মনে আছে, সেই দিনের দুঃখ, ভয়াবহতার সবটুকু আমি টের পাই...যে আমার জীবনসঙ্গিনী হবে, ও ও সেটা টের পাবে, ও আমাকে বুঝবে, আমি যেমন অনুভব করি, ইভাও তা অনুভব করবে । ইভা তখন আমার অসহায়তা টের পাবে । আর হ্যাঁ, ও তখন আমাকে ভালোও বাসবে । যে আমি ওকে এতোটা ভালোবাসি, ও সেটা বুঝবে না তা কি হয় ?
সুতরাং...
আমি...তাঁদেরকে...খুন...করবো...। তাঁরাই ইভা আর আমার মাঝের বাঁধা । হ্যাঁ...হ্যাঁ... তাঁরাই...
হাঁপিয়ে উঠেছি প্রায় । উচ্চতাটা ব্যাপার না জানি । খুব সম্ভবত মনের ভয় থেকেই । এই উঁচু জায়গাটার প্রতিই আমার ভয় এসে গেছে । কেমন যেন কবরের মত দেখায় । তবুও আসি । হয়তোবা নিষিদ্ধ আকর্ষণেই ।
আমার সর্বশেষ সিদ্ধান্তটা কি সঠিক ছিল ?? জানি না । এটার উত্তরও আমি আজ পর্যন্ত জানতে পারিনি ।
সঠিক সময়টা কখন হতে পারে, সেটা নির্ধারণ করার জন্য পুরো এক সপ্তাহ খালা-খালুকে ফলো করি আমি । সঠিক জায়গাটাও সেসময়েই বের করে নিই । নদীর উঁচু পাড় থেকে নিচে নামার সময় একটা ল্যাম্পপোস্টের পাশেই তাঁদেরকে খুন করবো । খুনটা হবে ঠাণ্ডা মাথার খুন, একই সাথে প্রমাণহীন । তাই প্রচুর সময় দেয়া লাগলো আমাকে এর পিছনে । শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে ।
চার ইঞ্চি বাঁট আর পুরো দশ ইঞ্চি উচ্চতার ছুরি কিনে নিই সস্তায় শহরে ফুটপাথের উপর থেকে, বাঁটটা খাঁজ কাটা হলেও ছুরিটা ছিল একেবারেই সাধারণ । দেখতে অনেকটা বাতিল মালের মতই লাগছিল । না, সাথে কোনো রশিদ দেয়নি ।
ছুরিটায় ধার দেয়ার পর থেকেই অবশ্য দারুণ দেখাচ্ছিল । ধার দেয়ানোর জন্যে কোনো দোকানে বা কোনো ফেরিওয়ালার কাছে যাইনি । বাসার পাশে প্রচুর পাথর । ছুরিতে কিভাবে ধার দিতে হয় ভালোমতোই জানা ছিল । তাই ভালোভাবে ঘষেমেজে, ধার দেয়ার পর ছুরিটা দেখে বেশ মুগ্ধ চোখেই তাকিয়ে ছিলাম । আঙ্গুল বোলানোর সাথে সাথেই কেটে যাওয়ায় মুগ্ধতা আরো বাড়ে ।
মাগরিবের আজানের পর পরই ইভাকে এখানকারই একজন কলেজের অধ্যাপকের কাছে পড়াতে নিয়ে যান ইভার বাবা-মা । অধ্যাপক লোকটি খালুর বন্ধু মানুষ । আর উনার বাড়িটাও আমাদের বাড়ির কাছেই । দোতলা বাড়ি । নিচতলায় উনার ছোট ভাই থাকেন, আর দোতলায় উনি আর উনার পরিবার । একটা ঘরে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ান । এসব আগেই জানা ছিল । সেই কয়দিনে আরো নিখুঁতভাবে মিলিয়ে নিই । বিশেষ করে সময়টা বেশী জরুরী ।
হিসেব করে দেখা গেল, ইভাকে নিয়ে ওর বাবা-মা এই ল্যাম্পপোস্টের জায়গাটা পার হতেন, পড়া শুরু হওয়ার পনের মিনিট আগে । আর ইভার পড়া শুরু হওয়ার মিনিট দশেক পর উনারা সেখান থেকে বের হয়ে বাসায় ফেরার পথে আস্তে আস্তে হেঁটে পার হতেন এই জায়গাটা । তাও প্রায় পাঁচ মিনিটের মত সময় লাগে তাঁদের আসতে । তাই আমি ধরেই রেখেছিলাম ইভাকে পৌঁছে দেয়ার সময় থেকে আধঘণ্টা পরই হবে সর্বোত্তম সময় । অর্থাৎ যখন শুধু তাঁরা দুজন অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে আসবেন, সে সময়টাতেই ।
অবশ্য প্রথমেই এই সিদ্ধান্তে আসিনি, একবার মনে হয়েছে ইভাকে যখন তারা নিয়ে আসতে যাবেন, তখনও ছুরি মারা যেতে পারে । কিন্তু সে সময়টাতে সবসময় ইভার বাবা-মা যান না, কখনো কখনো হিমুও যায় । তাই আমি সে ঝুঁকি নিতে চাইনি ।
এরপর ছিল দিন নির্ধারণ করে সেই সন্ধ্যার অপেক্ষায় থাকা ।
হাত দিয়ে উঁচু ঢিবিটার একটা অংশে নরম মাটি সরাতেই হাতে এসে লাগে সেটা । সেই ছুরিটা । হাতে নেয়ার পরপরই যেন গায়ের ভেতরে রক্তের উন্মত্ততা বেড়ে যায় কয়েকগুণে । মাথার খুব গভীরে গিয়েও আঘাত আনে । মুহূর্তের মধ্যেই অসুস্থ বোধ করি... মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়...দ্রুত হাতে ছুরিটা আবার পুঁতে রাখি । কেমন যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, সেদিনের মত...ঠিক সেদিনের মত...
দিনটা ছিল সোমবার । ততদিনে মাঘ মাস । শীতের আচড়ে দগ্ধ সবাই । গায়ে চাদর জড়িয়ে হাতের মুঠোয় ছুরির বাঁটটা চেপে ধরে ধীরে সুস্থে হেঁটে দাঁড়াই সেই ল্যাম্পপোস্টটার কাছেই এক গাছের আড়ালে । মশার কামড় খেতে খেতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠার আগেই আসলো সিনোরিটা...সাথে ওর বাবা,মা । এতদিন ধরে যাঁদেরকে খালা-খালু সম্বোধন করে এসেছি, আর নয় । ভুলটা হয়তো আমারই ছিল তাঁদের সব জানিয়ে দেয়া... কিন্তু কিছু করার নেই, এরজন্যে ওদেরকে মরতেই হবে... মরতেই হবে...আর সেটা আজ রাতেই...
তারা জায়গাটা পার হয়ে যাবার পরপরই ল্যাম্পপোস্টটার সামনে গিয়ে হাতঘড়িটার দিকে তাকাই । ছয়টা চল্লিশ । পনের মিনিটেরও বেশী আগে...যাই হোক । এ রাস্তা দিয়েই তো ফিরবেন তাঁরা । হাত নামিয়ে রাখতে গিয়েই ভ্রু কুঁচকে উঠে আমার । ছায়া...আমার...আমার সামনেই পরছে । তারমানে স্ট্যাব করতে গেলে আমার ছায়াও ওদের সামনে পড়ার সম্ভাবনা আছে । তখন যদি ওরা সরে যায় বা আমাকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে, তখন! তখন আমও যাবে,ছালাও যাবে । না...কিছু একটা করা দরকার... এই ব্যাপারটা আমার প্ল্যানে ছিল না দেখে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল । কিন্তু সময় কম, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে । যদি এই দিকটায় অর্থাৎ ল্যাম্পপোস্টটার ডানদিকটায় না থেকে বামদিকে সরে যাই আর তারপর পেছন থেকে ছুরি মারি, আমার ছায়া তখন আমার পিছনে পরবে...কিন্তু সমস্যা হল, তখন সামান্য চিৎকারেও পাশের মানুষজন এসে যেতে পারে । ঐদিকটায় এই সমস্যা নেই... কিন্তু আলো...ছায়া ?
উপরে বাল্বের দিকে তাকাই । ওটাকে ফাটাতে হবে । তাহলেই সমস্যা মিটে যাবে । এ রাস্তায় এই সময়ে মানুষজন একেবারেই আসে না । আরো ভালো করে বললে, হিমুদের পরিবারের লোকজন বাদে আর কেউ এই রাস্তা মাড়ায় না । গত বেশ কয়েকদিনে সেটা ভালোমতো জানা হয়ে গেছে আমার । আর তাছাড়া তাঁদের দুজনের উচ্চতাটাও মনে আছে আমার । ভুল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই । তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার এই সিদ্ধান্তটা নিতে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, শীতকাল, অন্ধকারে কুয়াশায় মিশে যাওয়া সহজ হবে । খুব ঠাণ্ডা মাথায় থাকতে হবে, বারবার বোঝাচ্ছিলাম নিজেকে । কোনোভাবেই দৌড়ে পালানো যাবে না । চাদর থেকে নিজেকে উন্মুক্ত করে হাতের ছোরাটার দিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলাম । গত কয়েকটা-দিন এটা বেশ বন্ধুর মত সঙ্গ দিয়েছে আমাকে, আজই তার শেষদিন ।
ছুরিটা নিচে রেখে, ছোটখাটো একটা পাথর ছুঁড়ে বাল্বটা ফাটিয়ে দিতেই চারপাশ ঘন অন্ধকারে ডুবে যায় একদম । বাল্বটা ভেঙ্গে যাওয়ার পর আবছা আলোয় চিকচিক করতে থাকা কাঁচের টুকরোগুলো সরিয়ে ফেলে দেই পাশের ঝোপে । আজ এই জায়গাটায় কোনো ময়লা নেই, শিশিরে ভিজে থাকা পাতা নেই, নেই কোনো মরা কাঠি, ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে রেখেছি বিকালে...আমি আছি খালি পায়ে...যাতে পেছন থেকে আসার সময় একটুও শব্দ না পায় তাঁরা । এটাও আমার পরিকল্পনার অংশ । বাড়তি সতর্কতা ।
সব ঠিকঠাক । আবার হাতঘড়ির দিকে তাকাই । ব্যর্থ চেষ্টা, অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না । বেশ কিছুক্ষণ চোখ রাখার পর সেই অন্ধকারে চোখ সয়ে আসার পর সময় দেখতে পাই । সাতটা দশ । আর বেশীক্ষণ নেই । এসে পড়বেন তাঁরা যেকোনো সময় । সুবিধামত একটা ঝোপের মধ্যে বসে ছোরাটায় হাত বুলিয়ে পরম তৃপ্তিতে আর একই সাথে চরম উত্তেজনায় টগবগ করতে থাকি ।
বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি । দুটো ছায়ামূর্তির অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে কয়েক গজ দূরেই । আসছে ... ওরা আসছে । আর কিছুক্ষণ, আর কিছু সময় মাত্র...
একদম কাছে এখন । এইতো, ফুটখানেক দূরত্ব । ঠিক এই মুহূর্তে সব যেন এলোমেলো হয়ে গেল । গলায় কি যেন একটা আটকে গিয়ে ভীষণ কাশি পাচ্ছিল, মাথার মধ্যে যেন মল্লযুদ্ধ, নিউরনগুলোর পরস্পর থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাবার পাঁয়তারা ।
কিন্তু আমি শান্ত থাকলাম । নিজের স্থিরতার কথা চিন্তা করে এখন অনেক অবাক হয়ে যাই । কীভাবে পেরেছিলাম সে রাতে ?
আমি বামহাতি হওয়ায় পেছন থেকে ছুরি মারার একটা বড় সুবিধা পেয়েছিলাম, এইই যে, তাতে শরীরের বাম দিকে ছুরিটা বিঁধবে । বুকের বাম দিকটায় ছুরি মারলে সেটা হৃদপিণ্ডে গিয়ে লাগবে । ফলাফল, কয়েক সেকেন্ডেই মৃত্যু । ঠিক ছুরি মারার আগ মুহূর্তে আবার আরেক সমস্যা... হঠাৎ করেই মনে হল কেন আমি এই খুনটা করতে যাচ্ছি ? আদতেই কি এর কোনো দরকার আছে ?? ফ্ল্যাশব্যাকের মত করে খালা-খালুর সাথে কাটানো অনেক সুসময়ের স্মৃতি মস্তিষ্ক আমাকে দেখাতে লাগল । ঠিক তখনই ল্যাম্পপোস্টটার নিষ্প্রভ অবস্থা দেখে অভিযোগের কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারি হিমু-ইভার মা’র গলা...যাকে খালা ডাকতাম এতদিন । সকল দ্বিধা ভুলে প্রবল আক্রোশে এবারে তাদের গায়ে থাকা শাল ছিন্ন করে আমূল বিদ্ধ করে দেই ছোরাটা । প্রথমে একজন, তারপর আরেকজন । বহুবার কাদার তালে ছুরি ঢুকিয়ে অভ্যস্ত হাত কোনোরকম বিশ্বাসঘাতকতা করে নি আমার সাথে ।
আর তারপর পূর্ব-পরিকল্পনার কথা ভুলে দৌড়... দৌড়...দৌড় ... দৌড়ে আসা এই উঁচু ঢিবিটাতে । ছুরি দিয়েই ছোট একটা গর্ত খুঁড়ে তাতে সেটা রেখে মাটিচাপা দিয়ে দেই । অথচ আমি ভেবেছিলাম ছুরিটা নদীতে ফেলে দিবো, কিন্তু সেদিন রাতে আমি তা কেন করিনি, বুঝতে পারিনা ।
সেই থেকে আজ অবধি মনে মনে দৌড়ে যাচ্ছি আমি । এই এখনো কেন যেন মনে হচ্ছে ঢিবিটা থেকে ছুরিটা উঠে এসে আমার বুকের উপর চেপে বসবে । দৌড়ানো শুরু করি আমি । দৌড়োতে দৌড়োতেই দূর থেকে দেখি ইভাকে ।
ইভা...আমার সিনোরিটা...
থেমে দাঁড়াই, ওকে ভালোমতো দেখার জন্য । খুব বেশী রোগাটে, শ্যামবর্ণের মেয়েটা, বেশ লম্বা, প্রায় ওর বাবার মতই । ওর চোখে রাজ্যের বিষণ্ণতা । কিন্তু আমি জানি ওর চোখেমুখে একই সাথে থাকে নির্মল বিশুদ্ধতা, পবিত্রতা... কাছে গেলেই মনে হয় যেন পৃথিবীটা খুব বেশী শান্তির, খুব বেশী আনন্দের, খুব বেশী নিশ্চিন্ত থাকার ।
কাছে যেতে যেতেই আবার দৌড়ে যাই, ওকে তাড়াতাড়ি দেখার জন্য । কিন্তু কাছে গিয়ে আর পাই না ওকে । এই একটু আগেই দেখেছিলাম, আর এখন যেন হঠাৎ করেই হারিয়ে গেল । আমার কান্না পেয়ে যায়...বড় হয়েছি, কিন্তু অনুভূতির তীব্রতা কমেনি একটুও । ইভা কেন চলে যায় আমাকে দেখলেই ? ওকে কেন আজও বলতে পারি না, আমি ওকে এতো এতোটা ভালোবাসি ?? ও কি কিছুই টের পায় না ???
সন্ধ্যা হয়ে গেছে । মা হয়তো বাড়ি ফিরে গেছেন এরমধ্যেই । ক্লান্ত কিন্তু যতটা সম্ভব দ্রুত পায়ে হেঁটে যাই হিমুদের বাড়িটার দিকে । বইটা ফেরত দিতে হবে । বইটার নাম ‘ইছামতী’। একটা নদীর নাম । বেশ সুন্দর নাম ।
দরজায় নক করতেই তপু বেরিয়ে এলো । অবাক হওয়ার পালা ! ও এখানে কি করছে ! সে কথা জিজ্ঞেস করতেই তপু বলে, “তো আর কাকে আশা করছিলি ?”
“হিমু কই ?”
“হিমু ? হিমু তো এখানে থাকে না!”
“এখানে থাকে না মানে! এই যে এই বইটা তো আজ সকালেই ওর কাছ থেকে...এই বাসা থেকেই নিয়েছিলাম ।” হাতে থাকা বইটা দেখিয়ে বলি আমি ।
“বইটা তুই এখান থেকেই নিয়েছিলি ঠিক । তবে হিমুর কাছ থেকে নয়, আমার কাছ থেকে । তুই ঘরে আয়... বোস । কথা আছে ।”
প্রায় বিস্ফোরিত চোখেই তপুকে অনুসরণ করি আমি । মনে হচ্ছে যেন কেউ আমাকে কালাহারি মরুভূমিতে এনে ছেড়ে দিয়েছে, সাথে কোনো কম্পাস নেই ।
চিরপরিচিত বসার ঘরের সোফাটায় বসার পরপরই একটা ট্যাবলেট আর এক গ্লাস পানি আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে তপু বলল, “খেয়ে নে । তারপর বলছি ।”
কিছু না বুঝেই ট্যাবলেটটা গিলে নিই ।
“শোন জয়, সবার জীবনেই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা আসে । সেইসব দুর্ঘটনার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয় । বাঁচার জন্য সংগ্রাম করতে হয় । অন্তত চেষ্টা করতে হয় । বুঝতে পারছিস আমি কি বলতে চাইছি ?”
দুর্ঘটনা ? হিমুর মা-বাবাকে খুনের কথাটা বলছে নাকি ? আমি ঢোক গিলে নিই সন্তর্পণে । কিন্তু তাদের সাথে তপুর এখানে থাকার কি সম্পর্ক !
কিছু না বুঝেই উপরে-নিচে মাথা নাড়াই আমি । হাতের বইটা টেবিলে রেখে উঠে বেরিয়ে যাই ও বাসা থেকে ।
তারপর বাড়ি ফিরি । বাইরে থেকে তালা দেয়া । তারমানে, মা এখনো বাড়ি ফিরেননি ।
--------------------------------------------------------------------------------------------
(গল্পের বাকি অংশ নাম পুরুষে লেখা হয়েছে)
৬ই জানুয়ারি, ২০১১
সকালের চা’টাও খেয়ে আসতে পারেননি বলে মন মেজাজ বেশ খারাপ হয়ে আছে শফিক সাহেবের । ঢাকায় বড় অফিসারের সাথে খারাপ ব্যবহারের ফলে এতটা বাজে অবস্থায় পরতে হবে, তা কে কবে ভেবেছিল! এই মফস্বল এলাকায় চুরি-ডাকাতি ছাড়া বড় ধরণের কিছু ঘটে না একেবারেই । বসে বসে শুধু চর্বিই বাড়ছিল শরীরে । সে তুলনায় এটা বেশ ভালো কাজই বলা যায় । দু,দুটো খুন একই জায়গায় ।
চায়ের কষ্ট ভুলে বামহাতে সিগারেট ধরিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলেন এই অঞ্চলের সি আই ডি স্পেশাল এজেন্ট । গতরাতে খুন হওয়া লাশের থকথকে রক্তগুলোর স্তুপে ভালোমতো চোখ রেখেও কিছু পেলেন না । কাছাকাছি কোনো পায়ের ছাপ নেই । লাশগুলো সরানোর সময় এসবের কথা কেউ ভেবেছিল কিনা তা-ই বা কে জানে । “সবসময়ের অলস, অসতর্ক, মূর্খের দল”—ভাবলেন তিনি ।
উঠে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকালেন কিছুক্ষণ । জায়গাটা যে বেশ পরিষ্কার এবং সেটা যথেষ্ট অস্বাভাবিক, তাও চোখে পড়লো এবারে । গতকাল সন্ধ্যা থেকে শেষ রাত পর্যন্ত ভালোমতোই শিশির পরেছে, আর সেটা খুনির জন্যে বেশ সুবিধাও করে দিয়েছে । হঠাৎ করেই শফিক সাহেবের মনে হওয়া শুরু করলো, এটা কোনো পেশাদার খুনির কাজ কিনা ।
ভ্রু কুঁচকে ল্যাম্পপোস্টটার দিকে আরো খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে উপরে তাকাতেই চোখে পড়ল ভেঙ্গে থাকা বাল্বের সাথে লেগে আছে কয়েক টুকরো কাঁচ । এটা একটা ভালো সূত্র হতে পারে ।
জুতোর ছাপ পেলে ভালো হত, আশেপাশে নরম মাটি আছে বেশ, একটা না একটা ছাপ তো পাওয়া যাবেই খুনির— এসব ভেবে শফিক সাহেব আরো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন সব । বাল্বের কথা ভুললেন না, এটা কবে থেকে এরকম অকেজো হয়ে আছে, সেটা এখানকার মানুষজনকে জিজ্ঞেস করতে হবে ।
মাথা নিচু করে উঁচু পাড়ের দিকে আস্তে আস্তে যাওয়ার সময় হঠাৎই পড়লো এতক্ষণ ধরে যা খুঁজছিলেন । পায়ের ছাপ! কিন্তু সমস্যা হল, এটা সত্যি সত্যিই পায়ের ছাপ, জুতোর নয় । খালি পায়ে একটা লোক এখান দিয়ে কেন যাবে! পায়ের দিক অনুসরণ করে আরেকটু এগোতেই আর সন্দেহ রইলোনা এটা সেই খুনিরই পায়ের ছাপ । শিশিরও ধুয়ে নিতে পারেনি ছাপগুলো, বুঝাই যায় বেশ চাপ দিয়ে হাঁটা হয়েছিল । পায়ের ছাপের সামনের দিকের অংশগুলো বেশী গভীর আর পেছনের দিকের অংশগুলো অপেক্ষাকৃত কম গভীর । হুমম...হাঁটা নয় তাহলে, খুনি এই পথ দিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিল ।
হাঁকডাকের মাধ্যমে সাদা পোশাকের কয়েকজন পুলিশকে ডেকে কাজে লাগিয়ে দিলেন তিনি, এই রাস্তা ধরে এরকম পায়ের ছাপ আরো পাওয়া যায় কিনা সেটা ভালোমতো দেখতে । খুনি একেবারেই আনাড়ি, পায়ের ছাপেই অনেকদূর বোঝা যাবে । তিনি নিজে গেলেন আশেপাশের বাড়িগুলোর মানুষজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ।
কিন্তু ...
কিন্তু খুন করার মোটিভটা এখনো বোঝা গেল না । মোবাইল ফোন বের করে লাশ দুটোর ছবি যতটা সম্ভব ভালোমতো দেখার চেষ্টা করলেন তিনি । এরা এখানে একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা তো দূরের কথা, কোনো ল্যাপটপও জোগাড় করতে পারেনি । সব ঘুষ খেতেই ব্যস্ত ।
অধীনস্থ এক কর্মকর্তাকে ফোন দেন তিনি, “গতকাল রাতে খুনটা হয়েছিল । হ্যাঁ...নদীর পাড়ের কাছে...দু’জন...হুমম ইয়েস, বোথ অফ দেম আর ফিমেল । পাঠিয়ে দিন তো ওদের পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা ।...হুমম...ওকে । আচ্ছা আমি দেখছি ।”
কলটা কেটে আবার ছবিটার দিকে তাকান তিনি । এই দুজনের শত্রু কে হতে পারে ???
--------------------------------------------------------------------------------------------
১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩
দরজার কড়া নাড়া শুনে মা এসেছে ভেবে দরজা খুলে তপুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জয় ।
“তোর হাতে কি এগুলো ?”
“আগে ভেতরে আসতে দে । দেখবিই তো”
তপু জয়ের পড়ার টেবিলের উপরেই খাবার প্লেট রেখে টিফিন ক্যারিয়ার থেকে একে একে ভাত,তরকারী রেখে সাজায় । জয় বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এগুলো কি?”
“এগুলো খাবার । তোর জন্য ।”
জয় আবার কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তপু বলে উঠলো, “তোর মা, মানে আন্টি স্কুলের একটা ট্রেনিং এর কাজে সিলেট গিয়েছেন । ফিরতে কয়েকদিন লাগবে । তুই ছিলি না তখন, তাই আমাকে বলে গিয়েছেন তোকে খাবার দিতে ।”
“ওহ...আচ্ছা” এই সংক্ষিপ্ত একটা মন্তব্যের মাধ্যমে সব বুঝে ফেলার ভঙ্গি করে হাত ধুয়ে খেতে বসে যায় জয় । ওর আসলেই বেশ খিধে পেয়েছে ।
জয়কে কোনোদিকে না তাকিয়ে একমনে খেতে দেখে নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তপু । ওদের বন্ধুদের মধ্যে জয় সবসময়ই খুব বেশী সরল প্রকৃতির । স্কুল,কলেজের স্যার ম্যাডামরা সবাই ওর সম্পর্কে বলতেন, “জয়ের মেধা আছে, সাথে কিছু অস্বাভাবিকতাও আছে । একদিন ও নিশ্চয়ই ওর মেধা কাজে লাগাতে পারবে ।”
সেই সামান্য অস্বাভাবিকতার জয়কে এরকম অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে তা কে কবে ভেবেছিল!
প্রায় বছর তিনেক আগের এক রাতে তপু,জয়েরই বন্ধু হিমুর বাবা আর মা, হিমুর ছোট বোন ইভাকে এক অধ্যাপকের বাসায় পড়াতে দিয়ে গিয়েছিলেন শহরে কেনাকাটার কাজে । ভেবেছিলেন শহর থেকে ফেরার পথে ইভাকে নিয়ে ফিরবেন । কিন্তু সেদিন সেই অধ্যাপকের ছোট ছেলে হঠাৎই খুব বেশী অসুস্থ হয়ে পড়ায় সব ছাত্র-ছাত্রীদের ছুটি দিয়ে দিয়েছিলেন পড়া শুরুর মিনিট দশেকের মধ্যেই । অন্ধকারে একা একা বাড়ি ফেরার সাহস পায়নি ইভা । কাছেই জয়দের বাড়ি হওয়ায় ইভা সে বাড়িতে গিয়ে জয়ের মার কাছে আবদার জানিয়েছিল ওকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার । জয়ের মা সে আবদার রক্ষা করার জন্য বেরিয়েছিলেন ইভার সাথে । আর তার কিছুক্ষণ পরেই, হিমুদের বাড়িতে যাওয়ার রাস্তায় খুন হয় ওরা দুজন । আর খুনি যেন মিলিয়ে যায় হাওয়ায় । তার কোনো হদিস আর পাওয়া যায়নি ।
দুটো মানুষ...খুন...মৃত্যু...
অথচ তার প্রভাব কতদূর বিস্তৃত! ইভার মা সেই শোকে আজ পর্যন্ত আর কথা বলতে পারেন না । ইভার বাবাও মেয়ের মৃত্যুর জন্য বারবার সেই রাতে মেয়ের কাছে না থাকাকে নিজের দোষ হিসেবে ধরে আহাজারি করতে করতে এখন রয়েছেন জীবন্মৃতের মত অবস্থায়... তারা চলে গেছেন গ্রামে । ওদের এই বাড়িটা তপুর বাবার কাছে বিক্রি করে হিমুও হারিয়ে গেছে কোথায় যেন, ওরও আর খোঁজ পাওয়া যায়নি । হিমুদের ঐ বাড়িটার প্রায় সব আসবাবপত্র, লাইব্রেরী থেকে শুরু করে জানালার পর্দা পর্যন্ত সবই তপুদের কাছে বিক্রি করে দিলেও ইভার ঘরের সবকিছু নিয়ে গেছে ইভার বাবা-মা । এ বাড়িতে এখন শুধু তপুই থাকে । কোনোকিছুই পালটায় নি সে । এমনকি ঝুল বারান্দার মাকড়সার জালগুলোও সরায় না । বাড়িটার অবস্থাও ইভার বাবার মত, জীবন্মৃত ।
জয়ের তৃপ্তি সহকারে খাওয়ার দিকে তাকিয়ে তপুর মনে পড়ল, সিআইডির এক অফিসার সে রাতের খুনের ব্যাপারে সন্দেহ করেছিল কিনা এই জয়কে! কিন্তু নিজের মাকে কেন খুন করবে, সে ব্যাপারে কোনোরকম ব্যাখ্যা দিতে না পেরে ক্ষান্ত দিয়েছিলেন অফিসারটি । সেই রাতের মৃত্যু-রহস্যের আজও কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি, কেসটা থেকে গেছে অসমাপ্ত । আর এদিকে জয়কে জানানো ওর মায়ের মৃত্যুসংবাদ একেবারেই বিশ্বাস করছে না ও । কোনো একটা অদ্ভুত কারণে তার সব স্মৃতি,চিন্তাভাবনা একটা সময়ে এসে থেমে গেছে । মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা জয়ের এই অবস্থার জন্য স্থায়ী কোনো সমাধানের পথ দেখাতে পারেন নি । নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ দিনের পর দিন খেয়ে গেলেও কোনো উন্নতি হয়নি তার ।
জয় এখনো সন্ধ্যা হলেই পথের দিকে তাকিয়ে থাকে ওর মা’র বাড়িতে ফেরার অপেক্ষায় । অথচ, দুই বছর নয় মাস চৌদ্দ দিন পার হয়েছে, জয়ের প্রতীক্ষা আজও শেষ হয়নি ...