###
এসো হাত ধরো হাতে,
চলো অন্তহীন পথে,
এসো তুমি, আর আমি,
দু’চোখে স্বপ্ন হয়ে নামি…
“ঐ থাম, হইসে। শাহবাগ মোড়ে এইভাবে চিৎকার করিস, ভালো ভিক্ষা পাবি। আমার কানের কাছে না।“
অপ্রস্তুত হয়ে থেমে গেলাম আমি। এই মেয়েটার মুখে কিছুই আটকায় না। সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। কিন্তু আজও অভ্যস্ত হতে পারিনি। আমি অবশ্য কথা না বাড়িয়ে মুখ কুঁচকে পাশে সরে গেলাম । আজ পেত্নীটার মন খারাপ। ওর জানের জান আরেফিনের আজ জন্মদিন।ক্লাস টেনে পড়ার সময়ই “প্রেম-প্রীতি” নামক বিদ্যায় বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছিলো আমার এই “পেত্নী”। আরেফিন নামের এক গিটারিস্ট এর প্রেমে পড়ে যায়। বলতে গেলে, কোনোরকম সতর্কীকরণ বার্তা ছাড়াই।তারপর আর কি !ওর মায়ের মোবাইলে লুকিয়ে লুকিয়ে ওর সাথে কথা বলতো। আর কি নির্লজ্জ মেয়ে রে বাবা! প্রতিদিন আমার কাছে এসে আরেফিনের সাথে কি কথা হতো, সব বলতো! আরেফিন কি খেতে পছন্দ করে, কি রঙ ওর বেশি পছন্দ, ও কতো ভালো গিটার বাজাতে পারে, এসব শুনতে শুনতে আমার মুখস্ত হয়ে গেলো।
প্রতিদিনইবলতাম, “তোর এই আরেফিনের প্যাঁচাল বন্ধ করতো।”
তখন ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলতো,“আমার আরেফিন এর কথা, আমি বলবো, না তো কি বাইরের মানুষ বলবে? আর তোকে বলি কারণ তুই একটা গাধা, একটা গার্লফ্রেন্ড জুটাইতে পারলি না, ছাগল… আয়নার দিকে তাকায়া দেখছিস কোনো্দিন, তোর কান গুলা পুরা খরগোস এর মতো………আর হাসলে তো………”
“আল্লাহর দোহাই লাগে, তুই থাম, যেভাবে বলছিস, মিরপুর চিড়িয়াখানার লোকজন কেউ শুনতে পেলে নির্ঘাত আমাকে ধরে নিয়ে চিড়িয়াখানায় ভরে রাখবে…তার থেকে বরং “তোর আরেফিন” এর প্যাঁচাল শুরু কর, শুনছি।”
কথাগুলো বলেই প্রমাদ গুনলাম, না জানি এখন কত কিলোমিটার লম্বা ঝাড়ি শুনতে হয়।
কিন্তু আমাকে অনেকটা অবাক করে দিয়েই হেসে উঠলো পেত্নী। আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এতো সুন্দর করেও মানুষ হাসতে পারে!!!
কি কথা বলতে গিয়ে কোথায় চলে এসেছি, হায়রে কপাল। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। আমি আর পেত্নী বসে আছি টি, এস, সি তে। আমার হাতে এক প্যাকেট টিসু পেপার । পেত্নী ফোঁপাচ্ছে, আর আমার দায়িত্ব হচ্ছে একটু পরপর ওর হাতে টিসু ধরিয়ে দেওয়া, আর, ওর নাক ঝাড়ার দৃশ্য দেখা। শুধুমাত্র এই কাজের জন্য সকাল আটটায় আমার অতিপ্রিয় ঘুম ভাঙ্গিয়ে এনেছেন পেত্নী বিবি। এই ‘আরেফিন’ নামটা আমি একেবারেই সহ্য করতে পারিনা, এটা জেনেই বোধহয় আমাকে দিয়েই এসব কাজ করায়। ওর মন ভালো করার জন্যই গান গাইতে গিয়ে ঝাড়ি খেলাম। ওর বোধহয় আমার কাচুমাচু মুখ দেখে একটু মায়া হলো। ফোঁপাতে ফোঁপাতেই জিজ্ঞেস করলো, “রাতে খেয়েছিলি?”
“হু।” (মিথ্যে কথা, সত্যটা বলে আবার ঝাড়ি খাওয়ার কোনো মানে হয় না)
“ঘুমাইছিস কয়টায়? ”
“১১ টা।”(সত্য কথা)
“১১ টা বাজে ঘুমালে এত হাই মারিস কেন? অসভ্যের মতো?”
“হাই মারাতে অসভ্যতার কোনো এলিমেন্ট আছে বলে, আমার জানা নেই।” আবার হাই তুললাম। এবার নকল হাই।
“দাঁত মাজছিস সকালে?”
নকল হাই এর মাঝপথে এসে থেমে গেলাম।কারণ, দাঁত মাজি নি। দাঁত মাজার মতো ফালতু(?) কাজে আমার মতো ব্যস্ত(!!!) মানুষের আবার টাইম কই ? আমাকে চুপ থাকতে দেখেই যা বুঝার বুঝে নিলেন, পেত্নী মহাশয়া… “ইয়াক থু” করে বললো,“ এ জন্যই ভাবছিলাম, এতো দুর্গন্ধ আসছে কোত্থেকে… ইয়াক থু…” করে সত্যি সত্যি একদলা থুথু আমার পায়ের কাছে ফেললো।। মনে মনে ভেবে পেলাম না, আমি স্বীকার করার পর পরই গন্ধ ছড়ালো ???
“ব্রেকফাস্ট তো করিস নাই। চল, কোনো এক রেস্টুরেন্টে ।”
কিছু না বলে, সায় দিলাম মাথা নেড়ে। পেত্নীটাও, যেনো কিছুই হয়নি এমন ভাব করে উঠে দাঁড়ালো। এতক্ষন যে ফোঁপাচ্ছিলো, দেখে বোঝার উপায়ই নেই। এখনো বুঝতে পারিনা মেয়েটাকে।
আচ্ছা ও কাঁদছিলো কেনো আর আরেফিনই বা কোথায়, সে কথা কি বলেছি? মনে হয় না। কারন, সেটা “ইট ওয়াজ এ লং স্টোরি” টাইপ ঘটনা।
সংক্ষেপে জানিয়ে রাখি, আরেফিন, আমার পেত্নীর সাথে কথা বলে, সময় কাটাতো, আর কিছুই নয়। আমরা যেটাকে বলে থাকি “টাইম পাস”। আর এ কথা যেদিন জানতে পারে ও, সেদিন আমার কাছে এসে সমগ্র পুরুষ জাতিকে তুলে শাপশাপান্ত করতে লাগলো। এরপর থেকে আর আমাকে ‘আরেফিনের প্যাঁচাল’ শুনতে হয় নি। তবু ছয় বছর ধরে মাঝে মাঝে পুরানো কথা মনে পরে, পেত্নী মহাশয়ার।। আর তা শুনতে হয়, আমাকেই। আমি হাই তুলতে তুলতে টিসু তুলে ধরি। বিনিময়ে ফ্রি ব্রেকফাস্ট পাই, খারাপ কি? (আমার পেত্নী, আমার পেত্নী করছি কেন? শোধ নিচ্ছি বলতে পারেন, ও আগে ‘আমার আরেফিন’ বলতো। সেটার শোধ। হে হে হে)
আরেফিন চ্যাপ্টার ক্লোজ… অসহ্য। আমার ভাষায়, “হালায় পেইন একটা”।
পেত্নীর নাম এখনো বলি নি… দরকারই বা কি বলুন! ধরে নিন আমার পেত্নীর নামই পেত্নী!!!
এতক্ষনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, আমি এই ‘মুখে কোনো কথা আটকায় না’ টাইপ মেয়েটিকে অনেক ভালবাসি …! আজকাল নয়। যখন আমাদের বয়স ৮, তখন থেকেই আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, বড় হয়ে এই পেত্নীটাকেই বিয়ে করবো। সাধারনত ছোটবেলার ভাবনা- চিন্তাগুলা ছোটবেলাতেই শেষ হয়ে যায়, আমার ক্ষেত্রে হয়নি। কেন যে হয়নি সেটা ভেবেই আমি অবাক হয়ে যাই। একটা দিনও ঠিকমত কথা বলতো না, কি একটা ‘ভাব’ যে মারে আমার সাথে! ছোটবেলা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যতবার ই ‘প্রিয় বন্ধু’ নিয়ে কিছু লিখতে গিয়েছি,প্রিয় বন্ধু হিসেবে আমি লিখেছি ওর নাম, আর ও লিখেছে আমার নাম, কিন্তু আমাদের মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকতো। তারপরও আমি ওর পিছে লেগে ছিলাম … ।
কেন?
জানি না।
হয়তো ভালোবাসি, তাই ।
ভালোবাসার সংজ্ঞা একেক মানুষের কাছে একেক রকম। আমার কাছে মনে হয়, যাকে ভালোবাসা হয় তাকে সেটা মুখে না বললেও হয়। ভালোবাসাটা অনুভব করার ব্যাপার। চিৎকার করে বলার মতো কিছু নয়। আমরা সবাই বাবা-মা কে ভালবাসি, কিন্তু আমরা কি তাদের কাছে গিয়ে কখনো বলি,“মা/বাবা, আই লাভ ইউ”? মুখে হয়তো বলি না। কিন্তু মনে মনে ঠিকই স্বীকার করি। তাহলে, আমরা কেনো প্রপোজ করি? বলছি। জন্মসূত্রে আমরা মা-বাবা’র সাথে সম্পর্কযুক্ত। নতুন করে কোনো সম্পর্কে জড়াতে হয় না। কিন্তু যাকে ভালবাসি, তার সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাই বলেই , আমরা এই কাজটা করে থাকি।
পশ্চিমাদের মতো গার্লফ্রেন্ড,বয়ফ্রেন্ড নামক শব্দে আমি বিশ্বাসী নই। কারন, এক্স গার্লফ্রেন্ড, এক্স বয়ফ্রেন্ড এসব কথা আমরা শুনে থাকি। কিন্তু ভালোবাসার মানুষের সাথে এক্স শব্দটি শোনা যায়না। কেননা, আমার মতে, ভালোবাসার মানুষ একজনই হয়। আমারও আছে, আর সেটা এই ‘পেত্নী’।
তাই, আরেফিন এর সাথে ওর ‘ব্রেক আপ’ এর পর ভাবলাম, এটাই সুযোগ।
একদিন পেত্নীটার কাছাকাছি চক্কর দিচ্ছি, কিভাবে কি বলবো, ভাবতে ভাবতে। যথারীতি পেত্নীর ‘পিঞ্চ মার্কা’ ডাক, “বান্দরের মতো লাফাইতেছিস কেন?” মনে মনে আল্লাহরে বললাম… এইটারেই জুটাইলা!!!
“লাফাইলাম কই? হাঁটছি কেবল।”
“তো আমারে কেন্দ্র করে ঘুরছিস কেন? আমি পৃথিবী আর তুই চাঁদ নাকি? তা চাঁন মানিক… কি বলবি , বলে ফেল।”
৫০০ মেগাবাইটের মুভি ডাউনলোড দেওয়ার পর ৯০% ডাউনলোডের পর যদি দেখা যায়, যে ইন্টারনেট প্যাকেজ শেষ, তখন যেমন অনুভুতি হয়, তেমন লাগছিলো আমার। সারা রাত কতো রোমান্টিক লাইন মুখস্ত করেছিলাম, কিচ্ছু মনে পরছে না, এখন। পেত্নীটা সামনে না থাকলে নিজের মাথায়ই দু,চারটা গাট্টা মারতাম। আমার অবস্থা বুঝেই কি না কে জানে, পেত্নীটা তার নতুন কেনা চশমার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলো,
“ঐ গাধা, কি হয়েছে বলত। আমাকে ভালোবাসিস , এটাই তো বলবি নাকি?”
নিজের কানকেও বিশ্বাস হচ্ছিল না যেনো আমার। কোনোমতে বললাম,
“হ… হু… না… না মানে… এই তো… মানে হ্যাঁ আর কি।”
“আমিও তো তোকে ভালবাসি। তো? এতে বলার কি আছে?”
খুশিতে আমার চোখ দিয়ে যেনো পাঁচশ’ ওয়াটের বাল্ব জ্বলে উঠলো, মনে হলো যেনো গ্যাস বেলুনের মত শূন্যে ভাসছি।
“তোকে আমি এত্তো ভালোবাসি যে, তোর সাথে ঝগড়া করতে না পারলে সত্যিই আমার পেটের খাবার হজম হয়না। বিয়ের পর আমার জামাইকে বলে ডেইলি তোর কাছে এসে ঝগড়া করে যাবো,তুই তোর জন্য একটা ভালো দুলাভাই খোঁজ নারে…প্লীজ।”
আমার চোখে সদ্য জন্ম নেওয়া বাল্বগুলো ফট করে ফিউজ হয়ে গেলো।শূন্য থেকে ধপ করে মাটিতে এসে পরলাম।কুইনাইন চাবানোর মতো মুখ-চোখ করে মনে মনে ভাবলাম, এই মেয়ের সাথে কথা বলার চেয়ে, সাত তালার উপর থেকে লাফিয়ে মরে যাওয়া ভালো। কিন্তু আমি হাল ছাড়লাম না। সিরিয়াস মুড নিয়ে পেত্নীর দিকে তাকালাম,
“আমি সেটা মিন করি নাই।”
“তাহলে কোনটা মিন করছিস?”
কি বলবো বুঝতে পারলাম না… মনে মনে আবার নিজেকে গালি দিলাম ৪,৫ টা। মুখে বললাম,
“দেখ, তুই তো সব বুঝিসই………”
“কই? না তো। আমি কিছুই বুঝি না…”
“প্লিজ, বোঝার চেষ্টা কর…” অসহায়ের মতো বলতে গেলাম আমি।
“হবে না… বাদ দে…।”
“হবে না মানে?”
“তুই আমাকে ভালোবাসিস … না?”
“হু।”
‘তো, আমি কি করবো? জানাতে চেয়েছিস, জানলাম, ব্যাস। আমি গেলাম।”
“আরে, দাঁড়া । তুই রাজি না?”
সরাসরি আমার দিকে তাকালো এবার পেত্নী…
“কি করতে পারবি আমার জন্য?”
“তুই কি চাস?” থতমত হয়ে বললাম।
“চাকু দিয়ে হাত কেটে আমার নাম লেখতে পারবি?”
“মানে………” আৎকে উঠলাম আমি।
“রোজ রাতে আমার বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবি?”
ভূত এর ভয়ে বাঁচি না, আর আমি ওদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবো? পাগল নাকি? ভাবতে লাগলাম।
“আমার প্র্যাকটিকাল্ এর লেখাগুলো লিখে দিতে পারবি?”
নিজের গুলোই করতে পারিনা…আর তোর টা… আমার কিসের ঠেকা।ভাবলাম মনে মনে।
“যখন তখন আমার মোবাইলে টাকা দিতে পারবি?”
টাকা পয়সার ব্যাপারে আমি খুব সেন্সিটিভ , চুপ করে থাকাই উত্তম।
“রাত জেগে আমার সাথে ফোনে কথা বলতে পারবি?”
আমি মারাত্মক ঘুমকাতুরে মানুষ।আমার জন্য সারা দুনিয়া একপাশে আর ঘুম অন্যপাশে । তাই শুধু ঢোক গিলতে লাগলাম।
“দেখলি তো? কিছুই করতে পারবি না তুই আমার জন্য। যেদিন পারবি, সেদিন বলবি, তার আগে না।”
পাঁচ বছর পার হয়েছে সে দিনটির পর… আমি আমার কথা রেখেছি।ওকে আর বলিনি যে আমি তোকে ভালোবাসি । এখন আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে পড়ছি। আর পেত্নীটা ফিজিক্সে।অনেকগুলো দিন পার হয়েছে এর মাঝে। একবারের জন্যও মনে হয়নি যে, পেত্নীকে ভালোবাসার কথাটা পাগলামি ছিলো। তবে আমি ওকে বুঝতেও দেইনি যে, ওর প্রতি আমার ভালোবাসা এখনো আগের মতোই আছে (তবে বাড়তেও পারে)। আমি কিন্তু সেদিনটির কথা ভুলি নি। আমার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
লুকিয়ে লুকিয়ে টাকা জমাচ্ছি পেত্নীর মোবাইলে দেয়ার জন্য।
বার ঘন্টা ঘুমের বদলে মাত্র দশ ঘন্টা (!) ঘুমাই এখন।
ভূতের ভয় কাটানোর জন্য হরর মুভি দেখা ছেড়ে দিয়েছি একদম।যত ধরনের দোয়া দরুদ পারছি, মুখস্ত করে ফেলছি।
প্র্যাকটিকাল করে দিতে পারবো এখন, ‘হিংসা’ কমেছে।
সব পারলেও হাত কেটে নাম লেখার ব্যাপারটা নিয়ে টেনসনে আছি। নাম লেখার দরকার হলে চাইনিজ ইঙ্ক ব্যবহার করলেই তো পারি…নাকি চাকু দিয়ে হাত কেঁটে নাম লেখার ব্যাপারটা বেশি রোমান্টিক? কে জানে… হতেও পারে…। আগে তো আর কোনোদিন প্রেম করিনি যে এসব জানবো। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, কেন যেন আগে কেন প্রেম করি নাই, সেটা নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে ।
১৯শে সেপ্টেম্বর, রাত ১১ টা। হাই মারছি একটু পর পর।
আমার ঘুমানোর সময় হয়ে গেছে। কিন্তু ঘুমাতে পারছি না। কালকে আমার আর পেত্নীর দু’জনেরই জন্মদিন। পেত্নীর কড়া আদেশ, সবার আগে যাতে আমি উইশ করি। না হলে সারাজীবনেও আর আমার সাথে কথা বলবে না। “সারাজীবন কথা বলার অধিকার” হারানোর ভয়ে… ঝিমাতে ঝিমাতে ফেসবুকে কি স্ট্যাটাস দেয়া যায় ভাবছি।
কালকে শুধুমাত্র আমার জন্মদিনই না। কালকে সিরিয়াস একটা কাজ করার ইচ্ছা আছে। কালকে পেত্নীকে প্রপোজ করবো। ওদের ডিপার্টমেন্টের বড় এক ভাই এর মতিগতি ভাল্লাগছেনা… যা করার দ্রুত করতে হবে। কালকের দিনটাই মোক্ষম।
রাত ১১ টা ৪৫ মিনিট।
দু’চোখ আর খোলা রাখতে পারছি না। মোবাইল টা নিয়ে গৎবাধা ইংরেজিতে দ্রুত লেখলাম, “Happy b’day , petni. Many many happy returns of the day.” প্রায় সাথে সাথেই রিপ্লাই, “………(কিছু গালি বসিয়ে নিন) এতো আগেভাগে কেন? কার সাথে এত ব্যস্ত তুই………(আরও কিছু গালি)… HBD to you , too.”
রিপ্লাই দিলাম,“ আমার ঘড়ি ১৫ মিনিট স্লো তো,তাই আগেভাগেই উইশ করলাম। আর তোদের ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট ইয়ারের নতুন যে মেয়েটাকে আজ দেখালি , তার সাথে চ্যাট করছি। মেয়েটা তো খুব সুন্দরী।” আজ বিকেলেই মেয়েটার কথা আমাকে জানিয়েছে পেত্নীটাই … দেখি খেপানো যায় নাকি।
রিপ্লাই আসলো,“তোর ঘড়ি কতো মিনিট স্লো এটাও জানিস, ফাইজলামি করিস আমার সাথে!!! তোর আমি…………(ভয়ানক কিছু গালি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ‘গালিমাতা’ হয়ে যেতে পারে) ঐ মেয়েরে তুই পাইলি কিভাবে? আর কালকে শহীদ মিনারের সামনে আসবি ১০ টার মধ্যে … ঐ মেয়ের সাথে কতটুকু প্রেম করলি, পুরো বর্ণনা দিবি।”
ল্যাপটপটা নিয়ে ফেসবুক ওপেন করলাম, ঘুমে আমার চোখ এর পাতা ভারি হয়ে আসছে…
তাপপরও স্ট্যাটাস দিলামঃ
২২ টা গ্রীষ্ম গেলো, পহেলা বৈশাখে লাল-পাড় সাদা শাড়ি পরা কোনো সংগী পেলাম না,
২২ টা বর্ষা গেলো, কারো হাতে হাত রেখে বৃষ্টিতে ভেজা হলো না,
২২ টা শরৎ গেলো, কারো কোলে মাথা রেখে নীল আকাশ দেখা হলো না,
২২ টা হেমন্ত গেলো, কারো চোখে চোখ রেখে গোধূলির সোনালী রঙ এ চোখ রাঙ্গাতে পারলাম না,
২২ টা শীত গেলো, ধোঁয়া ওঠা গরম কফির মগে চুমুক দিতে দিতে কেউ আমার এলোমেলো চুল না আঁচড়ানোর জন্য রাগারাগি করলো না,
২২ টা বসন্ত গেলো, মনের মাঝে কোনো কোকিল ডেকে উঠলো না।
L L L L L
এ জীবনে কি তাহাকে পাওয়া হইবে না ???
মোবাইলটা আবার হাতে নিয়ে পেত্নীকে টেক্সট দিলাম, সাদা সালোয়ার কামিজ পরবি, কালকে… প্লিজ…
১ মিনিটেরও কম সময়ে রিপ্লাই…
আমার তো খাইয়া দাইয়া কাজ নাই, যে বিয়ের আগেই বিধবার ড্রেস পড়বো।
আমি যথারীতি আমার ‘বিখ্যাত দীর্ঘশ্বাস’ ফেলে নিরীহ মানুষের মতো ঘুমাতে চলে গেলাম…
একঘুমে রাত পার করে দিয়ে সকাল নয়টায় ঘুম ভেঙ্গে ল্যাপটপ নিয়ে ফেসবুক চেক করতে বসলাম।
ও খোদা…! ২০ টা লাইকস, ৬০+ কমেন্টস! এ যে অভাবনীয়…! ভালোমতো দেখে হতাশ হতে হলো।
আমার ভার্সিটির ৩ বন্ধু আমার স্ট্যাটাসের কমেন্টের মধ্যেই ঝগড়া করেছে। আর তাই এতো কমেন্টের উদ্ভব ।
আর বাকি যারা কমেন্ট করেছে, সেগুলোও “সেইরাম পেইন” মার্কা। একটা অংশ দিলাম…
রাফিঃ ওরে ***(কিঞ্চিত অশ্লীল একটি শব্দ) তোরও বাল-ও-বাসা জেগে উঠছে দেখছি।
রাহাতঃ মামা, পহেলা বৈশাখের সঙ্গী পাস না? তৌফিক রে শাড়ি পরাইয়া পাঠায়া দিবনে নেক্সট টাইম, মনে করায়া দিস… (তৌফিক আমাদের মধ্যে একটু ইয়ে টাইপের। মানে বুঝেনই তো,হাফ স্যাম্পল আর কি। আমরা ফ্রেন্ডদের পিঞ্চ মারার জন্য তৌফিকের নাম শ্রদ্ধাভরে (!) স্মরণ করি।)
তৃষাঃ ভাইয়া, মাত্র বাইশ??? আপনাকে দেখে তো এতো কম বলে মনে হয় না। কতো বছর লুকালেন? (জুনিয়র ব্যাচের একটা মেয়ের থেকে যদি এমন কথা শুনতে হয়, কেমন লাগে, ভেবে দেখেন!!!)
ইরফানঃ চাঁন্দু, তোমারে দেখলে তো এতো নিমকি শয়তান বলে মনে হয় না। তলে তলে এতো রস
শাম্মীঃ তোর ঘিলুতে তো এরকম কথা তো থাকে নারে, কোন পেজ থেকে কপি মারলি এটা ?
…………এরকম করে চলছেই… দুঃখ ভরা চোখে তাকিয়েই থাকলাম। কিছু লেখলাম না।এক ‘হালা’ও উইশ করে নাই, কিন্তু খোঁচা মারতেও ছাড়ে নাই।
মোবাইলটা দেখা দরকার। ২৮ টা মিসকল, ১৩ টা মেসেজ…! সবগুলো পেত্নীর ! মেসেজ সবগুলোই কল কেন ধরছি না আর কেনো ফট করে ঘুমিয়ে গেলাম, সেগুলো লিখে লিখে শেষে গালি দেওয়া । কপালে আজ দুঃখ আছে। রেডি হতে লাগলাম। লেমন কালারের একটা শার্ট পড়লাম, এটা পেত্নী একদমই দেখতে পারে না, কিন্তু ওকে খেপালে যে মজাটা পাই, তা অতুলনীয় । একটা গিফট কর্ণার থেকে রঙ্গাচঙ্গা একটা পুতুল আর একটা ডায়রি কিনলাম, প্রতিবছরই দেই। প্রতিবারই বিরক্ত হয়। আর এটা দেখেই মজা পাই আমি।যারা অল্পতেই খেপে যায়, তাদের খেপানোর মজাই আলাদা। শাহবাগ থেকে ফুল কিনলাম, নিবে, নাকি ভাব মারবে, কে জানে!!! তবে আজকে ওকে আবার ‘ভালোবাসি’ বলবই। যা হবার হবে।
শহীদ মিনারের মোড়ের কাছে এসে রিকশা থেকে নামলাম, আর সাথে সাথেই কল।
“কুত্তা, কই তুই? কতক্ষন ধরে ওয়েট করবো আর?’
“সারাজীবন।” হাই তুলতে তুলতে জবাব দিলাম আমি।
“তোর……”
লাইন কেটে দিলাম আমি, সেধে গালি হজম করার কোনো মানে হয় না।
রাস্তা পার হওয়ার আগেই পেত্নীকে খুঁজতে লাগলাম। সাদা সালোয়ার-কামিজের একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে । পেত্নী তো সাদা ড্রেস পরবে না বলেছিল। তাহলে??? এদিকেই আসছে মেয়েটা। ভালোমতো দেখার জন্য, মেয়েটার দিকে তাকিয়েই রাস্তা পার হতে লাগলাম। মা`ঝামাঝি আসার পরই আবিষ্কার করলাম, এটা তো আমার পেত্নীটাই!!! ঠিক এই সময়ই হঠাৎ করে যেন, মাটি ফুঁড়ে একটা মাইক্রোবাস তেড়ে আসলো আমার দিকে… শেষ মুহূর্তে চোখ পরলো আমার সে দিকে। তবে ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। প্রচন্ড ধাক্কা খেলাম আমি, হাতের গিফট,ফুল ছিটকে পড়লো। রাস্তাটা এতোটা লাল হয়ে আছে কেনো? রক্ত? রক্তের রঙ এতো লাল হয় নাকি? পেত্নীটা কি আমাকে দেখেছে? না জানি, কতো গালাগাল করছে।কষ্ট হচ্ছে খুব। পেত্নীটাকে বলা হলো না, এখনো আগের মতোই ভালোবাসি আমি তোকে…খুব…খুউউউব।
কালো শার্ট, প্যান্ট পরা কে যেন আসছে আমার দিকে। ইনিই কি আজরাইল? সালাম দিবো নাকি? বয়সে তো অনেক বড়ই হবেন, সালাম দেওয়া যায়।সর্বশ্রেষ্ঠ জীব, মানুষ, হয়ে ফেরেশতাকে সালাম দিলে সমস্যা হবে নাকি আবার? এসব ভাবতে ভাবতেই জ্ঞান হারালাম আমি।