মানুষ সঞ্চয় করে ভবিষ্যতের জন্য। মুলত ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, ভবিষ্যতের সন্তাব্য খরচ এইসব মাথায় রেখেই মানুষ তার আয়ের কিছু অংশ ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাখে যাতে ভবিষ্যতে টাকার প্রয়োজন পরলে সঞ্চয় ভেঙ্গে প্রয়োজন মিটানো যায়। সাধারণত যে দেশে অনিশ্চয়তা বেশী, সেই দেশে সঞ্চয়ের হারও বেশী। এই জন্য উন্নত দেশের তুলনায় অনুন্নত দেশ গুলতে সঞ্চয়ের পরিমান বেশী। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কিভাবে কষ্টার্জিত উপার্জন সঞ্চয়ের মাধ্যমে অপটিমাম রিটার্ন পাওয়া যায় সেই বিষয়ে এই লেখার অবতারনা
সঞ্চয় এবং বিনিয়োগ দুইটা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিষ। আমার এই লেখা মুলত সঞ্চয় নিয়ে, বিনিয়োগ নিয়ে নয়। আমাদের দেশে সঞ্চয়ের এভিনিউ অনেক কম। এইটা আরও সত্য যারা এক থেকে দশ লাখ টাকা সঞ্চয় করতে চান। কারন টাকার পরিমান বেশী হলে সঞ্চয়ের ক্ষেত্রের পরিধি কিছুটা বাড়ে। যেমন অনেক কোম্পানি মোটামুটি তুলনামূলক ভাবে ভাল সুদের হারে বাজরে বন্ড ছাড়ে। ঐ সব বন্ডের গ্রাহক মুলত ইন্সটিটিউশন অথবা উচ্চবিত্ত। এক থেকে দশ লাখ টাকা দিয়ে ঐ সব বন্ড কিনার সুযোগ খুবই সীমিত, যদিনা আপনার খুবই ভাল কানেকশন থাকে। সুতরাং যদি আপনার কাছে দশ লাখ টাকা থাকে এবং আপনি বিনিয়োগ না করে সঞ্চয় করতে আগ্রহী হন তবে কিভাবে করা যেতে পারে সেইটা নিয়েই আমার লেখার মুল উদ্দেশ্য।
মধ্যবিত্তের জন্য সঞ্চয়ের অপশনের মধ্যে রয়েছে সঞ্চয়পত্র, ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট, ডিপিএস (প্রতি মাসে নিদ্দৃস্ট একটা এমাউন্ট জমা রাখা)। এখন ব্যাঙ্কের সুদের হার অনেক কম। ডিপিএস বা ফিক্সড ডিপোজিটে গ্রস সুদের হার ৫-৭%। যদি আপনার টি,এই এন সার্টিফিকেট থাকে তবে প্রাপ্ত সুদ থেকে ১০% কেটে রাখবে, টি,এই এন সার্টিফিকেট না থাকলে ১৫% কাটবে। সুতরাং আপনি ব্যাঙ্কে এফ ডি অথবা ডিপিএস করলে ট্যাক্স কাটার পর (ধরে নিলাম টি এই এন আছে) আপনি নেট পাবেন ৪.৫% থেকে ৬.৩%। মুদ্রাস্ফীতির (৫-৬%) কথা মাথায় রাখলে বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে আপনার টাকার ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছেনা, অনেক ক্ষেত্রে কমে যাচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে কি করবেন?
আশার কথা হচ্ছে, এখনও পর্যন্ত সরকারী সঞ্চয় পত্রে সুদের হার বেশী, এবং এইটা নিয়া অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। সরকারের উপর চাপ আছে সঞ্চয় পত্রের সুদের হার কমানোর জন্য। অর্থমন্ত্রী নিজেও কয়েকবার বলেছেন সঞ্চয়পত্রে উপর সুদের হার কমাবেন। যদি সত্যি সত্যি কমিয়ে দেয়, তবে এর উপর নির্ভরশীল (মুলত বৃদ্ধ, নারী, পেনশজীবী) অনেকই বিপদে পড়বেন। সরকারের সঞ্চয়পত্রের মধ্যে রয়েছে পরিবার সঞ্চয়পত্র, বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিনমাস অন্তঃর মুনাফা ভিত্তিক সঞ্চয়পত্র। এর মধ্যে পরিবার সঞ্চয়পত্র সবচেয়ে লাভজনক, তবে এটা শুধু মহিলা এবং বয়স্করা কিনতে পারে। বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রে ফিচার দেখার জন্য ভিজিট করুন জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর। পরিবার সঞ্চয়পত্রে সরকারী ৫% ট্যাক্স কাটার পর আপনি প্রতি লাখে মাসে ৯১২ টাকা নেট পাবেন, যা অন্য যে কোন সঞ্চয়পত্রের চেয়ে বেশী। কিন্তু শুধুমাত্র সঞ্চয়পত্র কিনলে আপনি বছরে এভারেজে ৯.১২% পাবেন (সঞ্চয়পত্রের সুদের হার সরল সুদ, যা ৯.১২% চক্রবৃদ্ধি সুদের হার ইক্যুইভেলেন্ট)। এইটা একটা ভাল অপশন। কিন্তু যদি এই অপশনের সাথে ব্যাঙ্কের ডিপিএস এর অপশন কে একসাথে করে সঞ্চয় করি, তবে এর চেয়ে ভাল রিটার্ন আনা সম্ভব। কিভাবে? যেহেতু সঞ্চয় পত্রের সুদের ধরন হচ্ছে সরল সুদ এবং প্রতি মাসে কুপন (সঞ্চয় পত্র বা বন্ডের প্রদত্ত সুদ কে কুপন বলে) পেমেন্ট করে, এই কুপন কে প্রতি মাসে ডিপিএস হিসাবে জমা করলে আপনার রিটার্নের হার বাড়বে। একটা উদাহরণ দেই।
ধরি আপনার কাছে দশ লাখ অলস টাকা আছে (আপনি এক লাখের উপরে যে কোন এমাউন্ট নিতে পারেন, এখানে অঙ্ক বুঝানোর জন্য দশলাখ ধরা হয়েছে) যা আপনি সঞ্চয় করতে চান, এবং এই টাকা এবং এর থেকে প্রাপ্ত আয়ে আপনি আগামী পাচ বছরে কোন খরচ করতে হবে না । আপনি বিনিয়োগের ঝুকি নিতে চাচ্ছেন না। আপনার টিন সার্টিফিকেট আছে। আপনি মহিলা হলে ভাল, আর পুরুষ হলে পরিবারের মহিলা সদস্যের নামে এইটা করতে পারবেন।
প্রথমে খোজ নিন কোন বেসরকারি ব্যঙ্কে ডিপিএসের রেট বেশী। ডিপিএসের রেট বেশ কয়েকটা বেসরকারি ব্যাঙ্কে এখনো ৭% আছে। ঐ ব্যাঙ্কে আপনার একটা একাউন্ট খুলুন (যে নামে সঞ্চয় পত্র কিনবেন সেই নামে, আপনি পুরুষ হলে আপনার পরিবারের মহিলা সদস্যের নামে, আর মহিলা হলে নিজের নামে)
এইবার খোজ নেন যে ব্যাঙ্কে একাউন্ট খুলেছেন, সেই ব্যঙ্ক পরিবার সঞ্চয় পত্র বিক্রি করে কিনা। সব ব্যঙ্কের সব সব শাখায় সঞ্চয় পত্র বিক্রি করে না। যদি আপনার ব্যাঙ্কের শাখা পরিবার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে তবে ভাল, না করলেও কোন সমস্যা নেই।
বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের ওয়েব সাইট থেকে পরিবার সঞ্চয় পত্র কিনার ফর্ম ডাউনলোড করে নিন। view this link সেই সাথে EFT Mandate Form ডাউনলোড করে নিন। দুইটা ফর্ম যথাযথ ভাবে পূরন করে বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের কাছ থেকে সঞ্চয় পত্র কিনুন।
EFT Mandate Form ফর্ম হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার, অর্থাৎ, আপনার সঞ্চয় পত্রের প্রাপ্ত মাসিক সুদের টাকা আপনার ব্যাঙ্কের কোন একাউন্টে ঢুকবে সেইটার তথ্য দিতে হবে। আপনি প্রথমে ব্যাঙ্কে যে নতুন একটা একাউন্ট খুলেছেন সেটার তথ্য দিবেন।
এইবার আপনি একমাস অপেক্ষা করুন প্রথম সুদের কিস্তি পাওয়ার জন্য। প্রথম সুদের কিস্তি আপনার ব্যাঙ্ক একাউন্টে ঢুকার সাথে সাথে আপনি ব্যাঙ্কে গিয়ে ঐ ব্যাঙ্কে একটা পাচ বছর মেয়াদী একটা ডিপিএস খুলুন এবং প্রতিমাসে ডিপিএসের জন্য আপনার ব্যাঙ্ক একাউন্ট থেকে অটমেটিক টাকা কেটে নেবার ইন্সট্রাকশন দিন। যদি আপনি দশ লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয় পত্র কিনে থাকেন, তবে প্রতি মাসে আপনার একাউন্টে ৯১২০ টাকা জমা হবে। এই ক্ষেত্রে আপনি প্রতি মাসে ৯ হাজার টাকা ডিপিএস করবেন। আপনার কাজ শেষ। এর পর পাচ বছর সব কিছুই অটোমেটিক। আপনি প্রতিমাসে বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক থেকে এস এম এস এর মাধ্যমে জানতে পারবেন সঞ্চয়পত্রের সুদের টাকা আপনার ব্যাঙ্ক একাউন্টে জমা হয়েছে, এবং ব্যঙ্ক থেকে এস এম এসের মাধ্যমে জানতে পারবেন ঐ টকা ডিপিএস বাবদ কেটে নেওয়া হয়েছে। এর চেয়ে অটোমেটেড সিস্টেম আর পাবেন না। অপারেশন প্রসিডুর স্মুথ করার জন্য ঐ ব্যঙ্ক একাউন্টে প্রাথমিক ভাবে ৩-৪ হাজার টাকা রেখে দিবেন।
এইবার আসি লাভ লোকসানের হিসাবে।
১। শুধু দশ লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয় পত্র কিনলে পাচ বছরে আপনি পাবেন সুদ বাবদ পাবেন ৫৪৭,২০০, যা ৯.১২% চক্রবৃদ্ধি সুদের হার।
২। পরিবার সঞ্চয় পত্র না কিনে দশ লাখ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করলে পাচ বছর পরে সুদ বাবদ লাভ হবে ৩৫৭,২৭০ (ফিক্সড ডিপজিটের হায়েস্ট রেট ৭% ধরে), যা বার্ষিক ৬.৩% চক্রবৃদ্ধি সুদের হার।
৩। এই দুইটার কম্বিনেশন করলে (যেটার বর্ণনা উপরে দিলাম) সেটা করলে পাচ বছর পরে সুদ বাবদ আপনি পাবেন ৬৩৯,৯৯৫ টাকা যা ১০.৪% বার্ষিক চক্রবৃদ্ধি সুদের হারের সমান।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে যে কোন একক সঞ্চয়ের বিপরীতে ১০.৪% রেট বাংলাদেশে নাই। একটু চেষ্টা করলেই এই উপরোক্ত পদ্বতি ব্যাবহার করে এই রেট পাওয়া যায়।
এই পদ্ধতির আরেকটা বড় সুবিধা হচ্ছে সঞ্চয় পত্র থেকে সুদ বাবদ প্রাপ্ত আয় সম্পূর্ণ আয়কর মুক্ত এবং প্রতিবছর ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত ডিপিএস এ আপনি টাক্স্য রিবেট পাবেন। এর ইমপ্লিকেশন বুজতে পারবেন যখন আপনি বছর শেষে আপনি ট্যাক্স ফাইল করবেন তখন। এই সব হিসাব করলে, আপনার প্রকৃত রিটার্ন আরও বেশি হবে।
পরিশিষ্টঃ
এই পদ্ধতির মুল থিম হচ্ছে পাচ বছর মেয়াদী প্রতি মাসে প্রাপ্ত একটা নিশ্চিত ক্যাশফ্ল কে (পরিবার সঞ্চয়পত্র থেকে প্রাপ্ত ৯.১২% রেটে) পাচ বছর ধরে প্রতি মাসে ৬.৩% ( গ্রস ৭%, আফটার ট্যাক্স ৬.৩%) রেটে রি-ইনভেস্ট করা।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১৭ বিকাল ৪:৫২