রাত বাজে আড়াইটার মত । একটু আগেই
ঘড়ি দেখেছেন মুহসীন সাহেব ।
গতকয়েকদিনে
তার ইনসমনিয়ার ধাতটা প্রবল হয়েছে ।
রমজানের শেষ সপ্তাহটায়
রাতগুলো খাটে শুয়ে এপাশ ওপাশ করেই
কেটে গেছে বলতে গেলে । একটা সময়
মসজিদ থেকে
মুয়াজ্জিন ডেকে ওঠেন সাহরীর জন্য ।
ঘুমানোর প্রচেষ্টার ইতি টানতে হয় তখন
। সাহরী খেতে ওঠা আর এই
সুযোগে স্রষ্টার দরবারেও ধরণা দেয়ার
সুযোগটা কাজে লাগানোর চেষ্টা থাকে তার
।আজকে অবশ্য সাহরী খাওয়ার
ঝামেলা নেই । সন্ধ্যাতেই শাওয়ালের চাদ
দেখা গেছে । কাল ঈদ ।
আর এজন্যেই তার অনিদ্রা আরো বেশী ।
একটা এড ফার্মের প্রমোশন অফিসারের
কাজ করেন মুহসীন সাহেব । পদটার নাম
অনেক বড়সড় হলেও বেতন আহামরি কিছু
নয় । নতুন কোন গ্রাহক
ধরে দিতে পারলে
কিংবা বড় কোন কাজ
পাইয়ে দিতে পারলে একটা ভালো কমিশনের
ব্যবস্থা অবশ্য
আছে কিন্তু এই প্রতিযোগিতার যুগে এ
সুযোগ পাওয়াটা সহজ সাধ্য নয় । তার
ব্যবহার অমায়িক হলেও তেলতেলে নয় ।
তাই কাউকে অন্যায় সুবিধা পাইয়ে দিয়ে
কাজ বাগিয়ে নেয়াটা তার স্বভাববিরুদ্ধ ।
আর তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই
নির্ভর করতে হয় বেতনটার ওপরেই ।
রাজধানী ঢাকায় এই আয়ে চলাটা যে কতটা
কষ্টসাধ্য সেটা সারা মাসেই বুঝতে পারেন
তিনি ।
মুহসীন সাহেবের দুই মেয়ে এক ছেলে ।
পরিবারে তার আম্মাও আছেন । মোট
৬জনের
সংসার । সন্তানেরা যথেষ্ট মেধাবী অথচ
আলাদা টিউটর রাখার সামর্থ্য তার নেই
। স্ত্রী সুফিয়া বেগম উচ্চ
শিক্ষিতা হওয়ায় অনেকটা রক্ষা । তিনিই
পড়া
দেখিয়ে দেন তাদের । আর অফিস
থেকে এসে সুযোগ থাকলে ওদের অংক
করিয়ে দেন
নিজেই । এতে হয়তো অর্থলোভী কিছু
শিক্ষক পরীক্ষায় কিছুটা কম নম্বরও
দেয়
ওদের কিন্তু এতে তারা মোটেও চিন্তিত
নন । তারা চান সন্তানেরা মানুষ, হোক
রেসের ঘোড়া নয় । স্রস্টাও তাদের
কে হতাশ করেন নি একেবারে প্রথম
দ্বিতীয়
হতে না পারলেও একেবারে ক্লাসের একদম
প্রথম সারিতেই থাকে ওরা ।
ছেলেমেয়েদের ছোটবেলা থেকেই ভাল মন্দ
ন্যায় অন্যায়ের তফাত্ বুঝতে
শিখিয়েছেন তারা ।
ওরা প্রয়োজনীয়তা আর শখের
পার্থক্যটা বোঝে ভালো ভাবেই ।
কখনো কিছু পেতে গোঁ ধরে বসে থাকে না ।
একটু বুঝিয়ে বললেই আর কখনো মুখ ফুটে
চাইবে না । বাবার
সীমাবদ্ধতাকে তারা অবজ্ঞা নয়
বরং শ্রদ্ধা করে ।
মেয়ে দুটো এসে সপ্তাহখানেক আগে ঈদ
উপলক্ষে একই রকম দুটো লাল জামার
জন্য
আবদার করলো ।
তিনি শোনার পর
ওদেরকে কাছে টেনে আদর করলেন আর
বাসার সবাইকে ডাকলেন । সবাই
এলে গুছিয়ে শান্তভাবে যা বললেন তার
সারসংক্ষেপ হলো এবারের ঈদে বাড়িতে
বড়চাচাদের কিছু টাকা পাঠাতে হবে । তাই
ঈদের কেনাকাটার জন্য তেমন কোন নেই
। তাই এবারের ঈদে কাউকেই কিছু
কিনে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না ।
তবে যদি সুযোগ
থাকে তবে আব্বু আগামী কোরবানীর
ঈদে নতুন পোশাক কিনে দেবেন । পরীর
মতো
ফুটফুটে মেয়ে দুটোর মুখগুলো কিছুটা মলিন
হলো তত্ক্ষণাত্ কিছুই বললো না
ওরা । কিছুক্ষণ পর বড়
মেয়েটা বললো "আব্বু ,যদি টাকার
বেশী সমস্যা
থাকে তাহলে কোরবানীর ঈদে না দিলেও
কিছু হবে না । আমরা তোমাকে অনেক
ভালোবাসি, জামা না কিনে দিলেও
ভালোবাসি ।" মুহসীন সাহেবের বুকটা হু হু
করে
উঠলো ।কিছু বলতে গিয়ে বলতে পারলেন
না তিনি । শুধু মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে
ধরে বসে রইলেন ।
এতো ভালো কেনো ওরা ? যখন দেশের
শপিংমল গুলোতে জমজমাট
কেনাবেচা চলছে অনেক
দামী দামী কাপড়ের । ধনিক শ্রেণীর
মানুষেরা কয়েক ডজন
পোশাক দিয়ে ঈদের সপিং করছে আর তখন
তাদের এই অবুঝ আবদারটুকুই
তিনি রাখতে
পারছেন না ?
কষ্টে হৃদয়টা যেনো টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিলো ।
একবার ভাবলেন বড়ভাইকে নাহয়
টাকাটা পরে দেয়া যাবে । কিন্তু
ভেবে দেখলেন
এমনিতে তিনিতো টাকা দিতেই পারতেন
না । ঈদের বোনাসটা হাতে পাওয়ায় ওটাই
তুলে দিচ্ছেন ওনাদের হাতে ।
তাছাড়া তিনি অসুস্থ ।অপারেশনের
টাকা জোগাড়
করতে না পারায়
অপারেশনটা হচ্ছে হচ্ছে করেও হচ্ছে না ।
তার ওপর আবার
গ্রামের লোকজন মনে করেন
ওনারা যেহেতু ঢাকায় থাকেন
তাহলে বোধহয় ওনাদের
অনেক টাকা । তাই গ্রামের অনেকেই
প্রায়ই অনেক আবদার নিয়ে আসেন ।
বাধ্য
হয়েই কিছু দিতে হয় । বিগত
একটা সপ্তাহ তার মাথায় এই দুশ্চিন্তা
গুলো ঘুরছে । নিয়মিত বিছানায়
মাথা এলিয়ে দিয়েই ঘুমানোর অভ্যাস
গিয়ে এখন
অনিদ্রাই তার সঙ্গী ।
হয়তো সকালবেলা তার সন্তানদের নতুন
পোশাক ছাড়া ঈদ করতে দেখে দেখে তার
খারাপ লাগাটা আরো বাড়বে ।ওদের বন্ধু
বান্ধবেরা হয়তো এটা ওটা জিজ্ঞেস করে
ওদের কষ্ট বাড়াবে । সমবয়সীদের
বাহারী পোশাক ওদের না পাওয়ার
দুঃখটাকে আরও
গাঢ় করে তুলবে । তবু তিনি ভাবছেন
কোন রকমে ঈদের দিনটা চলে গিয়ে রাত
চলে
এলেই বোধহয় এ
দুঃখবোধটা অনেকটা কমে যাবে । অন্তত
আগামী ঈদ পর্যন্ত ।
তাহলে কাল রাতে হয়তো একটু
শান্তিতে ঘুমোতে পারবেন তিনি । তাই
অধীর আগ্রহে
তিনি ঈদের
আগামী প্রহরগুলো কেটে যাওয়ার
অপেক্ষায় আছেন । কখন শেষ হবে এই
ঈদ ? কখন ?
(ঈদের দিন এমন একটা গল্প
আপনাদেরকে বলার জন্য সরি । কিন্তু
গল্পটি মোটেও
অবাস্তব নয় । একটু তাকিয়ে দেখুন
আমাদের পাশেই আছে অনেক মুহসীন
সাহেবেরা ।
ঈদ যাদের কাছে আনন্দের আবাহন নয়
অক্ষমতার শেল । আর তাদের
অক্ষমতাকে চোখে
আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেই
আমরা ঈদকে করে তুলেছি শপিং সর্বস্ব
লৌকিকতায় ।
আমাদের বোধদয় হোক ।
পোশাকী আড়ম্বরতা নয় তাক্বওয়ার
রঙই গাঢ় করুক আমাদের
ঈদের
আনন্দকে.... ঈদ মোবারক)